নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছাইয়ের নেই আগুনের ভয়

জুলিয়ান সিদ্দিকী

জগতের সব কাজই আমি পারি না। অনেক কাজে অলস হলেও লিখতে কখনও ক্লান্তি বোধ করি না। এতে করে আমার সময়গুলো ভালো কাটে।

জুলিয়ান সিদ্দিকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

সম্পর্কের ভিতর বাহির

০৮ ই মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২১

প্রায় মধ্যরাতে যখন শরাফত এবড়ো থেবড়ো রাস্তা দিয়ে পুরোনো সাইকেলের ঝরঝর শব্দ তুলে তার গ্রামের বাড়ির দিকে যায় তখনই যেন আমজাদ মাস্টারের কাছে রাতকে রাত বলে মনে হয়। তার আগে শরীরটা বিছানায় থাকলেও যেন কেমন একটি ছাড়া ছাড়া ভাব বজায় থাকে। যেন নিজের অজান্তেই উৎকর্ণ হয়ে থাকেন কখন শুনতে পাবেন শরাফতের সাইকেলের ঝাঁকি খাওয়ার ঝরঝর শব্দ। কখনো বা সঙ্গে যোগ হয় মৃদু ঘণ্টি বাজার শব্দও। যা ইচ্ছে করে বাজায় না শরাফত। খুব বেশি ঝাঁকি খাওয়ার ফলে নড়বড়ে ঘণ্টি হয়তো আপনা আপনিই মৃদু শব্দে জানান দেয় তার দৈন্য দশার কথা। যার প্রতি মালিকের বিন্দুমাত্র মনোযোগ আছে কিনা তাই হয়তো পরখ করে দেখা।



কিন্তু শরাফত কেন এতটা রাত করে ঘরে ফিরে যায়? এমন একটি দিন এর ব্যত্যয় হলে কী হয়, যেদিন সে ফিরে আসবে বেলা ডুবে যাওয়ার আগেই? তার কি কখনও তেমন কোনো জরুরি প্রয়োজন পড়তে পারে না? অথচ দিনের পর দিন ফজরের আজান হওয়ার খানিক পরপরই প্রথমে অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে তার সাইকেলের শব্দ। তারপর আমজাদ মাস্টারের ঘরের সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফের স্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতায় মিলিয়ে যেতে থাকে সে শব্দ। আর এভাবেই শরাফতের আসা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের অজান্তেই যেন জড়িয়ে গেছে আমজাদ মাস্টারের ঘুম। অন্যদিকে শরাফতও কর্মস্থল থেকে ফিরে আসার সময় আমজাদ মাস্টারকে ঘুমের কোলে ঠেলে দিয়ে যাচ্ছে আবার পরদিন কর্মস্থলে যেতে যেতে জাগিয়েও দিয়ে যাচ্ছে, যে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত নয় সে নিজেও। এ যেন তাদের মাঝে পরস্পরের অজ্ঞাতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে একটি নীরব খেলা। যার ফলাফল বা সমাপ্তির দিনক্ষণ জানা নেই এ দুজনের কারো।



শরাফতের সাইকেলের শব্দ মিলিয়ে যেতেই আমজাদ মাস্টার বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে ভাবেন যে, কতদিন বা কত মাস কিংবা বছর শরাফতের মুখটি তিনি দেখেন না। ইচ্ছে করলেও দেখতে পান না। মাঝখান দিয়ে বেশ কিছুদিন ছটফট করেছিলেন একটিবার তার মুখটি দেখার জন্য। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অনেক ধরনের সক্ষমতাই কমে আসতে থাকে। দিনদিন আমজাদ মাস্টারের শারীরিক শক্তি ক্ষয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর আর দৃষ্টিশক্তিও বাধ্য হয়েছে দুর্বলতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে। যে কারণে খুব কাছ থেকে না হলে তিনি মানুষের মুখ দেখতে পান না। কথা বলার সময় শব্দগুলো ফিসফাস ধ্বনি পর্যায় থেকে উন্নীত হতে পারে না। অথচ এক সময় ক্লাসে কাউকে আস্তে করে ধমক দিলেও অন্যান্য ক্লাসের ছাত্র শিক্ষকদের কাছেও পৌঁছে যেত সে মন্দ্র-স্বর। আর তার সেই জোরালো কণ্ঠস্বরই তার জীবনের যাবতীয় সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছিল বলে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। যার কারণে তার সংসার টিকলো না। স্ত্রী টিকলো না। টিকলো না আরো অনেক কাছের সম্পর্কও।



আমজাদ মাস্টার তখনও শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েননি। জড়িয়ে পড়েননি জীবনের যাবতীয় জটিলতায়। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর গুরু প্রশিক্ষণ শেষ করে তখনও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। আর সম বয়সী নিজামুদ্দিনকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন পাড়াময়। কারো অসুখ-বিসুখে, কোনো শরিকের দ্বন্দ্বে, কারো বিয়ের অনুষ্ঠানে, চেহলাম কিংবা খৎনা সবখানেই আমজাদ আর নিজামুদ্দিন অত্যাবশ্যকীয়। তাদের কাউকে বাদ দিয়ে যেন সুষ্ঠুভাবে শেষ হতে চায় না কোনো কিছুই। তেমনই একটি সময়ে বাবা নেয়ামত উল্লা পাশের গ্রামের নাজির সরকারের সঙ্গে সামাজিক অবস্থান নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে পাঁচ গ্রামের মুরুব্বিরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দুজনের দ্বন্দ্বের অবসানকল্পে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরির পুরোনো আর সহজ পন্থাটিকে বেছে নিয়েছিলেন। যে কারণে শালিস ডাকিয়ে দুজনকে বাধ্য করেছিলেন পরস্পরের পুত্রকন্যার বিয়ে দিতে। নাজির সরকার চাপে পড়ে নেয়ামত উল্লাহর পুত্রের সঙ্গে কন্যার বিয়ে দিতে বাধ্য হলেও মন থেকে মেনে নিতে পারেননি সম্পর্কটি। যে কারণে খুব সামান্য ত্রুটিকেই বড় করে দেখিয়ে কন্যা শরিফাকে আমজাদ মাস্টারের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রায় জোর করেই। কিন্তু ততদিনে শরিফা আর আমজাদ পরস্পর পরস্পরকে বেশ কিছুটা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে দাম্পত্য প্রেমের গাঢ়তায় আবদ্ধ হয়ে যেতে পেরেছিলেন খুব কম সময়েই। যদিও নাজির সরকারের অজুহাত ছিল কন্যার সঙ্গে জামাতার দুর্ব্যবহার, বাঁজখাই কণ্ঠে অভদ্র রকমের উঁচু কণ্ঠে তুই-তোকারি করে দিনভর ব্যতিব্যস্ত রাখা। তিনি বেশ কয়েকটি জায়গায় চেষ্টা করেছিলেন শরিফাকে বিয়ে দিতে। কিন্তু একগুঁয়ে আর জেদি পিতার কন্যাও বাপের কিছুটা স্বভাব পেয়েছিলেন বলে দ্বিতীয়বার বিয়েতে সম্মত হননি। পরন্তু তিনি নিজেকে সন্তান সম্ভবা বলে এরই মাঝে কাছের নারী আত্মীয়-স্বজনদের জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই মিথ্যাটুকুকেই সত্যে পরিণত করতে কোনো এক জেদের বশেই কিংবা স্বামীর মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতেই কিনা মধ্যরাতে দু গ্রামের মধ্যবর্তী খাল সাঁতরে পেরিয়ে চলে আসতেন আমজাদের ঘরে।



নিশুতি রাতে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই ঘটে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে বা তাদের গাঢ় নিদ্রার কোনো রকম ব্যাঘাত না ঘটিয়েই। কিন্তু শরিফার এমন দুঃসাহসী কর্মের সাক্ষীও ছিলেন বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ। যে কারণে হাঁটার সময় মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা কখনো ভেঙে পড়েনি তার ভেজা কাপড়ের ছপ ছপ শব্দেও। কারো নিদ্রাভঙ্গ হয়নি আমজাদের দরজা খোলার শব্দেও। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর এ অভিসার খুব বেশিদিন চলতে পারেনি। নাজির সরকার কিছু একটা আঁচ করতে পেরেই হয়তো কন্যার থাকার ঘরের আর চলাচলের জন্য দরজার অবস্থান বদল করে দিয়েছিলেন সুকৌশলে। যে কারণে বাবা মায়ের ঘর দিয়ে আসা যাওয়া করার সময় তার গতিবিধি লক্ষ্য করা সহজ হয়ে উঠেছিল। এমনকি মধ্যরাতে দরজা খোলার শব্দ পেলেই সঙ্গী হতেন শরিফার মা। কিন্তু ততদিনে নিজের মূল উদ্দেশ্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। যা একদিন নিজেই প্রত্যক্ষ করলেন নাজির সরকার। কত প্রলোভন, কত ভয়-ভীতি দেখালেন কন্যাকে, কিন্তু কন্যা কিছুতেই সম্মত হলেন না গর্ভস্থ সন্তানের কোনো রকম ক্ষতি করতে।

ততদিনে আমজাদ কুটিলা নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ছাত্র পড়াতে আরম্ভ করেছেন। কিন্তু যথা সময়ে শরিফা সন্তান প্রসব করলেও সে সংবাদ অজ্ঞাত থেকে যায় আমজাদ মাস্টারের কিংবা শরিফার সন্তান প্রসবের সংবাদ যাতে কোনো ভাবেই আমজাদ মাস্টারের কানে না পৌঁছোয় সে ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিলেন নাজির সরকার। মাঝখান দিয়ে আমজাদ মাস্টারও ভাই-বোন আর নিকটজনের চাপে পড়ে নতুন করে বিয়ে করে ফের চেষ্টা করেছিলেন সংসার শুরু করতে। কিন্তু কোনো স্ত্রীকেই যেন আর ভালবাসতে পারলেন না তিনি। যে কারণে একজন তাকে ঘুমে রেখেই পালিয়ে গেল বাপের বাড়ি। আরেকজন মারা গেল বিষ খেয়ে। এরপর অনেকেই তাকে আবার চাপাচাপি করেছিলেন বিয়ে করে সংসারী হওয়ার চেষ্টা করতে। কিন্তু তিনি আর আগ্রহী হননি বা বিয়ের ওপর ভরসা করতে পারেননি।



একটি ব্যাপার বেশ স্পষ্ট যে, পুরুষ হোক আর নারীই হোক সবার জীবনেই শরীর কখনো কখনো বেশ যন্ত্রণাময়। বিপরীত দেহের কাতরতা অনেক সময় মানুষকে বিবেক বর্জিত করে তোলে। নীতি-নৈতিকতার হালকা-পলকা বাঁধন তাকে নিবৃত্ত করতে পারে না। যেমন করে শিশির রোধ করতে পারে না টিনের আচ্ছাদন। তার সংস্পর্শে টিনের গায়ে জমে নানা আকৃতির শীতল ঘাম। তেমনি নানা নীতি-নৈতিকতার ফাঁক-ফোকর গলিয়ে মানুষ আবিষ্কার করে নেয় তার দেহের ক্ষুধা নিবারণের বিবিধ উপায়। আমজাদ মাস্টারও তেমন কোনো উপায় অবলম্বন করেছিলেন কিনা তেমন ধরনের কোনো কথা কেউ শুনতে না পেলেও একবার শোনা গিয়েছিল যে, মতি দফাদারের স্বামী পরিত্যক্তা আর সন্তান জন্মদানে অক্ষম কন্যা সোনাতনের সঙ্গে গোপনে বিয়ে হয়েছে আমজাদ মাস্টারের। কিন্তু সে গুজবটি কৌতূহলী মানুষের ততটা মনোযোগ আকর্ষণ করতে না পারলেও গ্রামের ছিদ্রান্বেষী দুষ্টু নারী-পুরুষদের কেউ কখনোই সোনাতনকে দেখতে পায়নি রাত-বিরেতে আমজাদ মাস্টারের ঘর থেকে সন্তর্পণে বের হয়ে আসতে। এমনকি আমজাদ মাস্টারকেও দেখা যায়নি মতি দফাদারের ঘরের আশপাশে দিনে রাতে ঘুরঘুর করতে। তবে তাদের আচরণে খানিকটা সন্দেহের আঁশ বজায় ছিল কারো কারো মনে যে, সোনাতন অসুস্থ হলে আমজাদ মাস্টার কী করে খবর পেয়ে নরেশ ডাক্তারকে সংবাদ পাঠাতেন? আবার আমজাদ মাস্টারের ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসটার সংবাদ কী করেই বা পেয়ে যেত সোনাতন?

গ্রামাঞ্চলের অলস বা ব্যস্ত লোকজনের কেউই একটি বিষয়ে আগ্রহী থাকতে পারে না বেশিদিন। আর তাই হয়তো আমজাদ মাস্টার আর সোনাতনের কাহিনীও চাপা পড়ে গিয়েছিল এক সময়। ততদিনে আমজাদ মাস্টারের ধমক খেয়ে ছেলেরা কাপড় ভিজিয়ে ফেলে সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। আর তা শুনে সন্তানের বাবা-মায়েরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, আমজাদ মাস্টারের কাছে সন্তানদের পড়তে পাঠালে বেত্রাঘাতের নিষ্ঠুর চিহ্ন অন্তত থাকবে না তাদের গায়ে। আর সে ভরসাতেই সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতেন বাবা মায়েরা। দিনদিন আমজাদ মাস্টারের পরিচিতি বেড়ে যাওয়ার ফলে কুটিলা নিম্ন-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম হারিয়ে গিয়ে পরিচিত হয়ে উঠেছে আমজাদ মাস্টারের স্কুল নামে।



সে স্কুলেই একদিন পাশের গ্রাম থেকে পড়তে আসে শরাফত। যার বাবার নাম ছিল তামজিদ হোসেন। গ্রামের নাম বংশ-পরিচয় পরিচিত থাকলেও বাবার নামের কারণে আলাদা করে কৌতূহলেরে সৃষ্টি হয়নি আমজাদ মাস্টারের। যদিও শরাফতের বাবার নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একবার বলে উঠেছিলেন, আরে, ছোটকালে আমার নামও আছিল তামজিদ। আকিকার সময় মসিদের ইমাম সাব আমারে আমজাদ বানায় দিছেন।

সে কথা শুনে নতুন ছাত্রটি বলে উঠেছিল, আমার বাবা নাই।

তারপর সেই গল্প আর সামনে এগোতে পারেনি। হয়তো আমজাদ মাস্টার নিজেই আগ্রহী হননি সেই বিষয়ের প্রতি। তবে খুব স্নেহ করতেন পিতৃহীন সেই নতুন ছাত্রটিকে। তাকে দেখলে নিজের অজ্ঞাতেই যেন মনেমনে আর্দ্র হয়ে উঠতেন তিনি। আর তাই হয়তো তার কণ্ঠস্বর কখনো উঁচু পর্দায় আরোহণ করেনি তার সামনে। নিম্ন-প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে শরাফত যেদিন গুণপুর নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হতে গিয়েছিল, সেদিন গুণপুর নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিরুদ্দিন ভূঁইয়া স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে আমজাদ মাস্টারের নামটিই লিখেছিলেন অনুমতির তোয়াক্কা না করে। আমজাদ মাস্টারও কোনোদিন সেই অযাচিত দায়িত্ব অবহেলা করেছেন সে কথাও কেউ বলতে পারবে না হয়তো।



দিনে দিনে নিম্ন-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক আর উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করে বেশ কিছুদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর হঠাৎ একদিন বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে শরাফত ফিরে এসে ক্লাসের দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিতেই চমকে উঠেছিলেন আমজাদ মাস্টার। এবং তখনই কখন নিজের অজ্ঞাতেই বলে উঠেছিলেন, কীরে বাবা, তরে এমন দেখায় ক্যান?



অকস্মাৎ চোখ মুছে শরাফত বলে উঠেছিল, মায়ে কইছে আপনেরে লগে নিয়া যাইতে।



-কী হইছে তর মায়ের?



-অবস্থা ভাল না। অনেক বড় অসুখ!



আমজাদ মাস্টার স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে তখনই যাত্রা করেছিলেন শরাফতের সঙ্গে। যদিও পরিচিত গ্রাম এবং নাজির মাস্টারের বাড়ি চিনতে পেরেছিলেন তিনি, কিন্তু ঘরের অবস্থা আর অবস্থান দেখে তিনি ভাবতে পারেননি ভুলেও যে, শরিফার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন বা শরাফতই শরিফার একমাত্র সন্তান। ঘর থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে শরিফা নিচু স্বরে জানিয়েছিলেন, শরাফত আপনেরই। তার নানা তারে শিখাইছেন যে, তার বাপ মইরা গেছে। অনেক বুঝাইয়াও আমি পারি নাই তার বিশ্বাস বদলাইতে। একটা কাজই করতে পারছি যে, তার বাপের নাম বদলাইতে হয় নাই। আপনের আকিকার আগের নামটাই তার মনে জাগা পাইছে।



যিনি স্ত্রী-সন্তানের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাননি উপযুক্ত সময়ে, তাই হয়তো অসময়ে শরাফতের পিতৃত্ব দাবি করার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতেও আগ্রহী ছিলেন না তিনি। যেখানে তার গর্ভধারিণী বিষয়টিকে জনসমক্ষে আনতে চাননি, তিনিও তা প্রকাশ করে শরাফতকে বিব্রত করতে উৎসাহ পাননি। তা ছাড়া শ্বশুর নাজির সরকারের মৃত্যুর পর স্ত্রী শরিফাও কখনো তাকে আহ্বান করেননি স্বামী-সুলভ অবশিষ্ট কর্তব্য সম্পাদনে। সে কারণেও হয়তো তিনি স্ত্রীর দিকে এগিয়ে যাননি নিজ থেকে। তবে যেদিন জানতে পেরেছিলেন যে, শরাফত তারই সন্তান, সেদিন থেকেই যেন পুরোপুরি পিতৃত্বের টান অনুভব করতে আরম্ভ করেছিলেন শরাফতের প্রতি।



শরাফতের সাইকেল তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার পর মাঝে মধ্যে কোনো কারণে আমজাদ মাস্টারের ঘুম ভেঙে গেলে তাকে একবার বাইরে বের হতে হয়। সে সময় দেখা যেত সোনাতনও পিছু পিছু বাইরে বের হয়ে এসেছে। বয়স হয়েছিল দুজনেরই। কিন্তু তারও অনেক আগে একবার কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিলেন আমজাদ মাস্টার। তখন তাকে দেখাশোনার জন্য বাড়ির অন্যান্যদের অনুরোধে রাতের বেলা থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিল সোনাতন। সেবার আমাজাদ মাস্টার বেঁচে উঠবেন বা আবার বাচ্চাদের পড়াতে স্কুলে যেতে পারবেন, তেমন আশা কেউ না করলেও সোনাতন অনড় ছিল মাস্টারের শিয়রের পাশে। এর পর থেকে যেন সবারই জানা হয়ে গিয়েছিল আমজাদ মাস্টারের একান্ত আপন কেউ থাকলে এই সোনাতনই। আর তখন থেকেই যেন সোনাতনের জন্য বৈধ হয়ে গিয়েছিল আমজাদ মাস্টারের ঘর। তাদের দুজনের এক ঘরে বা একই চালের নিচে থাকাটাও যেন সবার নীরব অনুমোদন পেয়ে গিয়েছিল তখন থেকেই। যে কারণে সে ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে বা আড়ালে কাউকে কিছু বলতে শোনা যায়নি কখনো।



শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার বছর পাঁচেক আগেই কুটিলা নিম্ন-প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গ প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পেলেও স্কুলের নামের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া আমজাদ মাস্টারের নামটিও উঠে যায় সরকারি খাতায়। অবসর নেওয়ার পর প্রতি তিনমাস পরপর পেনশনের টাকা তুলতে তাকে যেতে হত জেলা শিক্ষা অধিদপ্তরে। সঙ্গে অবধারিত অবলম্বন হিসেবে থাকতো সোনাতন। কিন্তু সেবার খুব একটা সুস্থ ছিল না সোনাতনও। তবু সে সঙ্গী হয়েছিল আমজাদ মাস্টারের। জেলা সদর থেকে ফিরে আসার পর যে শয্যা নিয়েছিল সোনাতন, তারপর আর ওঠেনি সেও। একই শয্যাতেই কখন নিভে গেছে তার প্রাণ-প্রদীপ তাও যেন কেউ টের পায়নি। সেদিন থেকেই আমজাদ মাস্টারের দিন-রাতগুলোও কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। বলতে গেলে খুব দ্রুতই চলে গিয়েছিলেন স্থবিরতার পর্যায়ে। রাত্রি শেষে বা মধ্যরাতের দিকে শরাফতের সাইকেলের শব্দ ভেসে এলেই কেবল খানিকটা চাঞ্চল্য বোধ করতেন। এ ছাড়া বাকি সময়টাতে তার যাবতীয় অনুভব যেন নিমজ্জিত হয়ে থাকত অপার স্থিরতায়।



পরপর দুটো দিন ভীষণ অস্থিরতায় কাটে আমজাদ মাস্টারের। তার কাছে মনে হচ্ছিল, ভোরে এবং রাতেও যেন তিনি শুনতে পাননি শরাফতের সাইকেলের ঝরঝর শব্দ। তারপরই তার অসুস্থতা ক্রমাগত বেড়েই চলছিল। এভাবে অবস্থা যখন প্রায় চরমে, দৃষ্টিতে নিদারুণ হতাশা নিয়ে তিনি আশপাশে তাকান কেবল আর কাউকে চিনতে না পেরে বলে ওঠেন, শরাফত কই?



কিন্তু কোন শরাফত? তাদের নিজের গ্রামেই আছে তিনজন শরাফত। এখন কোন শরাফতের অন্বেষণে তিনি এতটা উতলা হয়েছেন কিংবা শরাফতের সঙ্গে তারই বা কী এমন গাঢ় সম্পর্ক ছিল তা-ই যেন বুঝে উঠতে পারছিল না বাড়ির লোকজন। শেষটায় গ্রামের আরো বিজ্ঞ কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করে বাড়ির মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় যে, গ্রামে তিন শরাফত ছাড়াও আশপাশে যে কজন এ নামের মানুষ আছে সবার কাছেই সংবাদ পাঠানো হবে। সেই সঙ্গে বিশেষ অনুরোধ জানানো হবে, তারা যেন সময় সুযোগে পরদিন একটিবার হলেও আমজাদ মাস্টারের শয্যা পাশে এসে দাঁড়ায়। পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি দেখা যায় যে, একে একে এগার জন শরাফত এসে দেখা করে গেছে আমজাদ মাস্টারের সঙ্গে। কেবল তখন পর্যন্ত দু বেলা এ গ্রামের রাস্তা দিয়ে সাইকেলে চড়ে আসা-যাওয়াকারি শরাফতকেই দেখা যায়নি। তার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে রাতের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায় বলে অনেকেই যার যার ঘরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু নাওয়া-খাওয়া ভুলে পাশে পাশে বসে থাকা মাস্টারের ছোট বোন কমলার ছেলে সদ্য পাশ করা এমবিবিএস ডাক্তার হুমায়ুনের চোখে বর্ষীয়ান মামার অবস্থার কোনো পরিবর্তন ধরা পড়ে না। রাত আরো খানিকটা গাঢ়তার দিকে হেলে পড়লে অকস্মাৎ শুনতে পাওয়া যায় দূর থেকে এগিয়ে আসতে থাকা একটি সাইকেলে মৃদু ঝরঝর শব্দ। সে শব্দ আমজাদ মাস্টার শুনতে পাচ্ছিলেন কি পাচ্ছিলেন না তা বোঝা না গেলেও সকাল থেকে প্রায় স্থির পড়ে থাকা তার দেহে খুব সামান্য হলেও চঞ্চলতা ফুটে উঠতে দেখা যায়। কানে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষার যন্ত্র হাতে ডাক্তার হুমায়ুনও যেন আরো বেশি চাঞ্চল্য বোধ করে। পাশে উদ্বিগ্ন অন্যান্য মামা-মামি এবং তার মা-খালাদের উদ্দেশ্যে উজ্জ্বল মুখে বলে ওঠে, মামার রক্ত চাপ বাড়তাছে!



এ সামান্য কয়েকটি শব্দই যেন উপস্থিত উদ্বিগ্ন মুখগুলোতে খানিকটার প্রত্যাশার রঙ বুলিয়ে দিয়ে যায়। সে সঙ্গে সাইকেলের ঝরঝর শব্দটিও ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে তাদের বাড়িটিকে অতিক্রম করার বদলে সরাসরি উঠোনের দিকেই চলে আসে যেন। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের বেড়ার গায়ে সাইকেলটিকে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেই একজন মধ্য বয়সের লোক ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে জানায়, আমি শরাফত। নাজির সরকারের নাতি। স্যারের লগে দেখা করতে আইলাম!



কথাগুলো বলতে বলতে সে বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে এক পাশে বসে একটি হাত দিয়ে আমজাদ মাস্টারের মাথা স্পর্শ করে বলে ওঠে, আমারে চিনতে পারছেন স্যার? আমি শরাফত! আর সেই স্পর্শেই যেন আমজাদ মাস্টারের মুখটি হাসি হাসি হয়ে উঠতে দেখা যায় এবং একই রকম হাসি হাসি মুখ করে তিনি তাকিয়ে থাকেন শরাফতের দিকে।

ডাক্তার হুমায়ুন সেই অবস্থাতেই আমজাদ মাস্টারের বাহু থেকে রক্তচাপ মাপক যন্ত্রের বাঁধন খুলতে খুলতে বিষণ্ণ মুখে জানায়, আমার বিদ্যায় যা বুঝতাছি, মামায় আর নাই।



তারপর সে তার কান থেকে স্টেথোস্কোপ খুলে ফেলে রক্তচাপ মাপক যন্ত্রের সঙ্গে গুটিয়ে ব্যাগের ভেতর রেখে দেয়।



উপস্থিত সবাই উঁচু-নিচু স্বরে কেঁদে উঠলেও শরাফতের মনে যেন কোনো ভাবান্তর হয় না। তবু সে আমজাদ মাস্টারের খোলা চোখ দুটো হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙুলির চাপে বুজিয়ে দিতে দিতে টের পায় যে, সদ্য মৃত মানুষটি যেন এতদিন তার স্পর্শের অপেক্ষাতেই বেঁচে ছিলেন। যেই স্পর্শটুকু তাকে জানিয়ে দেয় যে, তাদের মাঝে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে ছাপিয়েও যেন আরো কোনো গভীর সম্পর্ক ছিল। আর সে কারণেই হয়তো দেহের প্রতিটি কোষে সে অনুভব করতে পারছিল একটি অভুতপূর্ব কম্পন। সেই সঙ্গে দু চোখ বাষ্পাকুল হয়ে উঠছে বুঝতে পারলেও যেন তার কিছুই করার থাকে না। এমনকি দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু রোধের কথাও তার ভাবনায় আসে না।



মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে মে, ২০১৩ দুপুর ১:১৬

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:

ছোটগল্প ভাল লাগল।

১৬ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৯

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: কান্ডারী অথর্ব ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.