নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছাইয়ের নেই আগুনের ভয়

জুলিয়ান সিদ্দিকী

জগতের সব কাজই আমি পারি না। অনেক কাজে অলস হলেও লিখতে কখনও ক্লান্তি বোধ করি না। এতে করে আমার সময়গুলো ভালো কাটে।

জুলিয়ান সিদ্দিকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প: মাটি

০৯ ই জুন, ২০১৩ ভোর ৫:৩২

পুরোনো আমলের চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথা দিগ-পাশে আর উচ্চতায় বেশ কিছুটা কম আকৃতির লাল ইটের তৈরি মন্দিরের বিলুপ্ত কাঠামোটির মেঝের অংশে এখনও লতা-পাতা আর ঘাসের আড়ালে শ্যাওলা মাখা কালচে প্রকৃতির কয়েকটি ইটের সাক্ষাত পাওয়া যায়। আশপাশে নাম না জানা বুনো লতা-পাতা শুকিয়ে আছে কোথাও কোথাও। এ ছাড়া তেমন কিছু নেই আর বাঁশের ফালি দিয়ে বেড়া দেয়া জায়গাটিতে। বাকি অংশটুকু এভাবেই পড়ে আছে পতিত বা বিরান হয়ে। এক পাশে সামান্য কিছু অংশে বিনা অনুমতিতে মাচা বানিয়ে কেউ লাউ ফলানোর চেষ্টা করেছিল হয়তো। কিন্তু প্রয়োজনীয় যত্নের অভাবে ফুল বা ফল আসবার আগেই শুকিয়ে যাবে গাছগুলো।



বিভূতি সাহা মন্থর পায়ে বেড়া দেয়া জায়গাটির দিকে এগিয়ে গিয়ে দু হাতে দুটো বাঁশের ফালি মুঠো করে ধরেন। তারপর আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে একটি হাতে ললাট ছুঁয়ে ফের নামিয়ে আনেন বাঁশের যে ফালিটিকে মুঠো করে ধরেছিলেন। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া মন্দিরের কালচে ইটের দিকে তাকিয়ে তিনি মনে করতে চেষ্টা করেন যে, মন্দিরের ঠিক পশ্চিম দিকেই ছিল ধনা কাকার ঘরটা।ঘর থেকে সরাসরি মন্দিরে আসবার সময় বর্ষায় বা বৃষ্টি-বাদলের দিনে উঠোনের কাদামাটি যাতে মাড়িয়ে আসতে না হয় সে জন্যে ঘরের দরজা থেকেই বিঘৎ খানেক উঁচু করে ইট দিয়ে বাঁধিয়ে একটি সরু আলের মতো বানিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে ইটের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলেন না বিভূতি সাহা। মনে মনে নিজেই যেন নিজেকে প্রবোধ দিতে ভাবেন, এতকাল পর কি আর আছে কিছু আগের মতো? হয়তো এ গ্রামেরই লোকজন একটি দুটি করে নিতে নিতে মন্দিরের আর ঘর-মন্দিরের যোগাযোগের পথটির সব ইট তুলে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে গোয়াল ঘরে ইট বিছানো থাকলে বা ঘরের দরজার সামনে দু একটি আস্ত বা আধলা ইট পড়ে থাকলেও গেরস্থের মান বাড়ে। অবশ্য এখানে আসতে আসতে দেখতে পেয়েছেন গ্রামটির অনেকেই ইটের বাড়ি বানিয়েছে ওপরে ছাদ বা টিন দিয়ে। কেউ বা কেবল মেঝেটাই পাকা করে নিয়েছে সামর্থ্য অনুযায়ী।



মন্দিরের মেঝে পাকা করার সঙ্গে সঙ্গে দরজার সামনে সিঁড়ি বানানোর ঘোর বিরোধী ছিলেন ছোট পিসি। কিন্তু বয়সে ছোট বলে তার কথা কানে তোলেন নি কেউ। কিন্তু সেবার বর্ষা কালেরই একটি বৃষ্টি ভেজা দিনে প্রসাদের থালা হাতে নামতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে গিয়েছিলেন মনা কাকার বড় মেয়ে সুলেখাদি। ইটের কানায় লেগে সামনের একটি দাঁত ভেঙে গিয়েছিল। সেই ভাঙা দাঁতের কারণে তার বিয়ে আটকে ছিল দীর্ঘকাল। অবশ্য এ ঘটনার কথা তিনি শুনতে পেয়েছিলেন বড়দের আড্ডায় কান পেতে। সুলেখাদি যখন বাপের বাড়ি বেড়াতে আসতেন তখন প্রতিদিন দুপুরের দিকে বাড়ির মেয়েরা ঘর-সংসারের টুকিটাকি কাজ নিয়ে সবাই জড়ো হতেন উঠোনের কোণে। তখন তারা নানা রকম অদ্ভুত কথায় মেতে উঠতেন আর অকারণেই চাপা স্বরে হেসে উঠতেন ঘনঘন। কোনো কোনোদিন বালক বিভূতিকে কাকি জেঠিদের কেউ বা সুলেখাদি বা ছোট পিসি ধমকের স্বরে বলতেন, এখানে তোর কি কাজ? যা ভাগ! আর স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে তার মনে পড়ল অনেক বছর দেখা নেই সুলেখাদির সঙ্গে। ভালুকার ভারাডুবা গ্রামেই বিয়ে হয়েছিল। যাই যাই করে আর যাওয়া হয় নি। যদিও প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশে আসেন পৈত্রিক ভিটাটিকে একবার দেখতে, জন্মভূমির মাটিকে একবার ছুঁয়ে যেতে কিন্তু ভালুকার দিকে আর যাওয়া হয়ে ওঠে না সময় করে। দিদি বেঁচে থাকলে বয়স নিশ্চয় পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে এখন।



বছর দুয়েক আগে যখন এসেছিলেন তখন উত্তর পাড়ার হামিদ বকশি প্রস্তাব করেছিলেন জায়গাটা বিক্রি করে দিতে। ভাল পার্টি আছে, যে দামও ভাল দিতে প্রস্তুত রেজিস্ট্রির আগেই। কিন্তু মন থেকে কোনো সাড়া পাননি বিভূতি সাহা। যদিও ছেলে মেয়েরা প্রায়ই বলে যে, জন্মভূমির সঙ্গে সম্পর্ক বলতে তো কেবল একটুকরো জমিই। এ ছাড়া কী বা আছে! আজকালকার ছেলেমেয়েরা ভাবাবেগের মূল্য দিতে শেখে নি। শেখেনি পূর্ব পুরুষের রক্তের মূল্যায়ন করতে। যে মাটিতে প্রোথিত তার পূর্বপুরুষের রক্ত আর অস্থিমজ্জা, সে মাটিকে পর করে দেবেন কোন প্রাণে? এই যে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, তার তো মনে হচ্ছে না যে, এ দেশে তার আপনজন কেউ নেই। মনে হচ্ছে সবাই তো আছে এখানেই। বেড়া দেওয়া জায়গাটিতে। মাটির নিচে।



মন্দিরের পেছন দিকটাতে একটি আমগাছ ছিল। স্বাদের দিক দিয়ে যার ফল পাকার পরও ভয়াবহ রকমের টক ছিল বলে সে আম কাঁচা থাকতেই টক রান্নার জন্য যার যেমন পেড়ে নিয়ে যেতো। চাচা-জ্যাঠারা কেউ কখনো বাধা দিয়েছেন বলে চোখে পড়ে নি। স্বাধীনতার পরপরই এ গ্রামের বদরউদ্দিন সেই গাছটি কেটে লাকড়ি বানিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল। অথচ তার জানা মতে চাচা-জ্যাঠারা বেঁচে থাকতে কারো কাছে বিক্রি করে যান নি। সে সময় গাছ কাটার ব্যাপার নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করেছেন বলেও শোনা যায় নি। অবশ্য বদরউদ্দিন আজ বেঁচে নেই। নয়তো একটি বার হলেও তিনি তাকে জিজ্ঞেস করতেন কোন অধিকারে সে গাছটি কেটেছিল। তারা হিন্দু বলে? যুদ্ধের সময় ভারতে পালিয়ে যাওয়াতে শত্রু সম্পত্তি ভেবে গাছটি কেটে ফেলবার অধিকার পেয়ে গিয়েছিল, নাকি এর পেছনে আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল? গাছটি না থাকাতে একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। শূন্য জায়গাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন বিভূতি সাহা।



যুদ্ধের বছর যেদিন জব্বর মুন্সি তার সঙ্গীদের নিয়ে বাড়িতে আগুন দিয়েছিল তার দুদিন আগেই ছোট পিসিকে মুসলমান বানিয়ে বিয়ে করবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল লোকটি। বাবা-কাকা বা জ্যাঠারা কেউ না করতে পারেন নি পাকি মিলিটারিদের সঙ্গে তার আর তার দলবলের সখ্য রয়েছে বলে। বাধ্য হয়েছিলেন তাদের প্রস্তাবে সম্মতি দিতে। কিন্তু পিসি সহ্য করতে পারেন নি সে অপমান। সে রাতেই সেই আমগাছটিতে ফাঁসিতে ঝুলে মুক্তি পেয়েছিলেন আসন্ন অনাচার থেকে। কিন্তু পিসি হয়তো নিজেকে মুক্ত করার ভাবনায় আচ্ছন্ন থেকে ভুলে গিয়েছিলেন অন্যদের কথা। বাবা কাকা আর জ্যাঠারা মুক্ত হতে পারেন নি তখনও। পরদিন ভোর না হতেই আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল ছোট পিসির আত্মহত্যার সংবাদ। আর সন্ধ্যার দিকেই দশ-পনের জন পাকি সেনা নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল জব্বর মুন্সি। পাকি সেনারা ঘরের ভেতর ঢুকে কিছু খুঁজছিল যেন, বাইরে থেকে বেতের ঝোপে লুকিয়ে থেকে শুনতে পাচ্ছিলেন বালক বিভূতি। মা-কাকি বা জেঠি কারো সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। হয়তো তারাও পালিয়ে ছিলেন তার মতোই। ঘরের টিনের বেড়ায়, দরজায় লাথি বা কিছু দিয়ে আঘাতের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। একটু পরই জ্বলে উঠেছিল আগুন, শোনা গিয়েছিল গুলির শব্দ। এক সময় জব্বর মুন্সির কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল ধনু কাকার নাম। সন্ধ্যায় তিনি পূজায় বসতেন প্রতিদিন। দীর্ঘ সময় মন্দিরে কাটিয়ে ঘরে ফিরতেন। কিন্তু আবারও গুলির শব্দ হলে বেতের ঝোপে লুকিয়ে থাকার সাহস হয় নি বালক বিভূতির। আরো পেছনে সরে গিয়েছিলেন বেতের ঝোপ সামনে রেখে।



আগুনে পোড়া বাড়ির উত্তপ্ত উঠোনে দুদিন পড়েছিল তিন ভাইয়ের লাশ। মন্দিরে পড়েছিলেন পূজারি ধনু কাকা। পাঁচটি লাশ দেখেও কেন যেন কান্না পায়নি সেদিন, যার কারণ অনুসন্ধানে আজও ব্যর্থ বিভূতি সাহা। গভীর রাতে হামিদের বাবা আরো কয়েকজনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে একটি বড় গর্ত করে মাটি চাপা দিয়েছিলেন চারটি মৃতদেহকে। অন্যপাশে আরেকটি ছোট গর্তে জায়গা পেয়েছিলেন ছোট পিসি। ওরা পাঁচজনই অমুসলিম বলে যানাযা পাওয়ার যোগ্য ছিলেন না। আর পাকি মুসলিমদের অধিকারে থাকার কারণে শ্মশানের আগুন জোটেনি হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও। কতটা দুর্ভাগা হলে মানুষ তার জীবনের শেষ অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত হয় অদৃষ্টবাদীরাই হয়তো ভাল বলতে পারবেন। মা-কাকি জেঠিদের বুকফাটা কান্না আর আহাজারি সহ্য করতে না পেরে ফের পালিয়ে গিয়েছিলেন বিভূতি।



আগে যেখানে শ্মশান ছিল, সেখানে একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসা হয়েছে। অল্প বয়সের বাচ্চারা এখানে এসে ভর্তি হয় কোরআনে হাফেজ হতে। তারা দিনে রাতে উঁচু কণ্ঠে কোরআনের আয়াত বা সুরা মুখস্থ করে সমস্বরে। অন্যদিকে অদৃশ্যলোকে বেহেশতের কোথাও তাদের পিতা-মাতার জন্যে নুরের টুপি বানাতে ব্যস্ত সময় কাটান কারিগর ফেরেশতারা। আর কোরআনের ঐশী শব্দাবলীর আড়ালে হয়তো নিঃশব্দে মাথা কুটে মরে দীর্ঘকাল ধরে শ্মশানে পোড়া পাপাত্মা হিন্দুগুলো। এমন ধরনের কথাই নাকি বাচ্চাদের হাসিমুখে জানান মাদ্রাসার বড় হুজুর। মজা পেয়ে বাচ্চারা কণ্ঠস্বর আরো জোরালো করে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত হেফজ করতে থাকে।



গ্রামটিতে যে কটি হিন্দু পরিবার ছিল, তাদের কেউ আর নেই। এটি এখন বলতে গেলে পুরোপুরি মুসলমানদের হয়ে গেছে। কেবল হিন্দু বা নমশূদ্র বিভূতি সাহা এবং তার পূর্ব-পুরুষদের ভিটে-মন্দিরের মালিকানা কোনো মুসলমানের হাতে যায় নি বলে খানিকটা মিশ্র ভাব রয়ে গেছে। তবে, বাংলাদেশে এমন অনেক গ্রাম পাওয়া যাবে- যে গ্রামে একটিও হিন্দু পরিবার থাকা তো দূরের কথা, কোনো হিন্দুর এক চিমটি সম্পদও নেই। কিন্তু এমন কোনো গ্রাম পাওয়া যাবে না- যে গ্রামে দুচারটি মুসলিম পরিবার নেই।



বাঁশের ফালি মাটিতে গেঁথে বেড়া দেওয়া জায়গাটির কোথাও মাটির গর্তে দীর্ঘকাল যাবত চাপা পড়ে আছেন বিভূতি সাহার পূর্বপুরুষদের কজন। সুদীর্ঘকাল আগে অন্যায়ভাবে ঝরে পড়া তাজা রক্ত মিশে আছে এ মাটিতে। যে মাটির সঙ্গে তার রক্ত আর প্রাণের সম্পর্ক সে মাটি থেকে শিকড় উপড়ে ফেলা খুব সহজ কাজ নয়। কাজেই যে যত মূল্য দিতেই প্রস্তুত থাকুক না কেন নিজ থেকে কখনোই কাজটি করতে পারবেন না তিনি।



দুদিন পর ফিরে এসে মা কাকি জেঠি কাউকেই বাড়িতে দেখতে পান নি বিভূতি। গ্রামের ভেতর যে কটি হিন্দু পরিবার ছিল, সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখেছিলেন পুরো বাড়িই ফাঁকা। কারোরই সাক্ষাৎ পাওয়া যায় নি সেখানে। কোনো বাড়ির ভেতরকার আলমারি খাট টেবিল চেয়ার এমন কি কাঁসার থালা-বাটি কলসগুলোও বের করে নিয়ে যাচ্ছিল জব্বর মুন্সির লোকেরা। কেউ কেউ খুলে নিচ্ছিল ঘরের টিন বা দরজা জানালার কাঠগুলো। বালক বিভূতি যদিও সব রহস্য পুরোপুরি বুঝতে পারছিলেন না, তবে একটি কথা বেশ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেদিন যে, এ গ্রামই শুধু নয় পুরো দেশটাতেই তার আপন বলতে কেউ নেই। তাই হয়তো তার সাহসে কুলোয় নি সে কথা কারো কাছে প্রকাশ করবার।



পোড়া বাড়িতেই বেশ কদিন একা একা কাটিয়ে ছিলেন বিভূতি। হামিদের বোন মাবিয়া তাকে ভাত রেঁধে দিয়েছিলেন দুদিন। কিন্তু একটি হিন্দু বালকের প্রতি একজন মুসলিম যুবতীর এতটা স্নেহ-মমতার প্রদর্শন কারো কারো চোখে ভাল লাগে নি হয়তো। যে কারণে তৃতীয় দিনের দিন সকাল আর দুপুরটা অভুক্ত থেকে নিজে নিজেই ভাত রান্নার আয়োজন করেছিলেন বিভূতি। কিন্তু ঠিক মতো আগুন জ্বালানোর কৌশল জানা না থাকায় বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তিনি চলে গিয়েছিলেন হামিদের বাড়ি। মাবিয়া তাকে দেখতে পেয়েই বলে উঠেছিলেন, এত দেরি কইরা আইলি? তর ভাত মনে কয় আবার সব চাইল হইছে।



সে বাড়িতে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়েছিল তাকে।



একদিন মাবিয়া সন্ধ্যার মুখে তাকে চুপি চুপি জানিয়েছিলেন যে, এ গ্রামের সব হিন্দুদের মুসলমান হতে হবে। নয়তো জোর করে খৎনা করানো হবে পুরুষদের। সে কেন এ গ্রামে পড়ে আছে? তারা মুসলমান হয়েও নিরাপদ বোধ করছে না, সে হিন্দু হয়ে কোন সাহসে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়? ভারতে তার কাকার বাড়ি চলে গেলেই তো পারে।



বিভূতির জানা ছিল না তার কোন কাকা ভারতে থাকে বা সেখানকার কোথায় আছে। তা ছাড়া সেখানে যেতে হলে কোন দিক দিয়ে যেতে হবে তাও জানা ছিল না। কিন্তু তার একদিন পরেই মাঝ রাতে মাবিয়া এসে তাকে ডেকে তুলেছিলেন ঘুম থেকে। তারপর বলেছিলেন, আমরা মাইয়া বউরা গ্যারাম ছাইড়া পলাইতাছি আরো অনেকের লগে। তুইও চল। মুক্তিগো লগে ইন্ডিয়া যাইসগা। বাবায় কার লগে জানি আলাপ করছে।



সত্যি সত্যিই রাতের বেলা অনেক নারী-পুরুষের সঙ্গে গ্রাম ছেড়েছিলেন তিনি। একটি বাড়িতে প্রায় সপ্তাহ খানেক থাকার পর নয়জনের একটি দলের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন সীমান্ত পার হয়ে। কৃষ্ণ নগরের লক্ষ্মী নারায়ণ সাহার ঠিকানা লেখা একটি কাগজ পকেটে গুঁজে দিয়েছিলেন হামিদের বাবা মোহাম্মদ বকশি।



দূর থেকে হামিদকে আসতে দেখে তিনি বেড়া ছেড়ে দিয়ে সরে আসেন কিছুটা। তারপর হামিদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন নিজ থেকেই। কাছাকাছি হতেই হামিদ বলল, তুই এখানে থাকতে থাকতে আমি কত কাজ কইরা আবার ফিরাও আইলাম। মনে করছিলাম তরে ঘরেই পামু। বাইত্যে চল। গাও গোসল দিয়া খাইয়া বিশ্রাম লইবি। কি মাছ আনামু ক? নাকি অন্য কিছু আনামু, মুরগা, কবুতর?



-না। তোরা যা খাবি তাতেই হবে।



বিভূতি সাহা আর হামিদ বকশি পাশাপাশি গ্রামের পথ ধরে চলতে বিগত দিনের ঘটনা নিয়ে কথা বলে। কথার এক পর্যায়ে খানিকটা রুষ্ট কণ্ঠে বলে ওঠে হামিদ, আমরা পাবলিক পুরাই ছাগল। এই গ্যারামের কে না জানে জব্বর মুন্সি রেজাকার? তাও তারেই ভোট দেই পরতেকবার। আর হেয় পাশ কইরা খাসি জবাই দিয়া খাওয়ায় অন্য রেজাকারগোরে। একটা স্বাধীন দেশে রেজাকাররা চেয়ারম্যান-মন্ত্রী হইলে কি আমাগো শরম পাওন দরকার নাই?



বিভূতি সাহা এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলতে চান না। কিন্তু হামিদ যখন বলে চলে, শুনতে পাইলাম তুই যদি এইবার তর সম্পদ বিক্রি কইরা না যাস, তাইলে কয়দিন পরে জব্বর মুন্সি জাগাটার দখল নিব। বেওয়ারিশ সম্পদ হিসাবে তসিল অফিসে সরকারের নামে নাম জারি করাইব। হইতে পারে সরকারের নাম দিয়া নিজের নামেই পরচা খতিয়ান বানাইয়া ফালাইব। তার লাইগাই কইতাছিলাম যে, এইবার তুই ইন্ডিয়া যাওনের আগে আগেই কিছু একটা কর!



জায়গা দখলের কথা শুনে হামিদের দিকে সতর্ক চোখে তাকান বিভূতি সাহা। বলেন, কইলেই হইলো? রাগের মাথায় যেন তিনি প্রায় ভুলে যাওয়া মাটির ভাষায় কথা বলে উঠলেন। তারপর মনে মনে ভাবতে আরম্ভ করলেন যে, এরা কি তার জন্মভূমির সঙ্গেও সম্পর্কটাকে বাঁচতে দেবে না? আর যারাই খানিকটা মাথা উঁচিয়ে থাকতে চাইবে তাদের শিকড়ই কেটে দেবে ধীরে ধীরে? তাহলে কি সেই দিন সমাগত- যেদিন সন্ধ্যায় কোথাও কাঁসা কিংবা শঙ্ক্ষধ্বনি শোনা যাবে না। মাত্র একটি ধর্মের লোকজনই বাস করবে এই বাংলায়? যে কারণে সময়ের চাপে অথবা মুসুল্লিদের প্রয়োজনে গির্জা-মন্দির আর প্যাগোডাগুলো রূপান্তরিত হবে পাঞ্জেগানা মসজিদে?



আর তখনই তার মনে হয় পরিস্থিতি এখনও অতটা নাজুক হয়ে পড়েনি। খানিকটা সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালে তিনিও পারবেন। কী হবে না পারলে? অন্তত ইঁদুরের জীবন থেকে তো বেরিয়ে আসতে পারবেন। সেই ভাবনাই যেন তাকে আরেকটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। মনে মনে তিনি ঠিক করে ফেলেন যে, সম্পত্তি হস্তান্তর তো দূরের কথা, ভারতেও আর ফিরে যাবেন না। আজই ফোন করে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন স্ত্রী সন্তানদের যে, পুরোনো ভিটাতেই নতুন করে ঘর তুলবেন। ইটের গাঁথুনি দিয়ে পাকাপোক্ত করে। আর সেই ঘরটাই তার জন্যে হয়ে উঠবে একটা বিশাল মন্দির। যে মন্দিরের নিচে নিরাপদ থাকবেন পিসি, ধনু কাকা, বাবা আর জ্যাঠারা। প্রাণ থাকতে এ মাটির অধিকার কিছুতেই ছাড়বেন না।



(সমাপ্ত)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৮:০৫

পাঠক১৯৭১ বলেছেন: সেই সময়ে ফিরে গিয়েছিলাম, '৭১ সালে। মানুষ সাথে মাটির সম্পর্ক বড় হয়ে ওঠে অনেক কারণে; সব কারণের মাঝে যে কারণটা সব সময় থাকে, সেটা হলো জন্মভুমির মাটি।

লেখা খুবই সুন্দর হয়েছে, সাবলীল হয়েছে।

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ২:৫২

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: ধন্যবাদ পাঠক ১৯৭১। সঙ্গে থাকার জন্যে ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.