নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছাইয়ের নেই আগুনের ভয়

জুলিয়ান সিদ্দিকী

জগতের সব কাজই আমি পারি না। অনেক কাজে অলস হলেও লিখতে কখনও ক্লান্তি বোধ করি না। এতে করে আমার সময়গুলো ভালো কাটে।

জুলিয়ান সিদ্দিকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

সংখ্যাবর্ত

১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ৩:২৬

বিষণ্ণতা সংক্রামক। আর সীমানাকে দেখলেই কথাটা মনে পড়ে আসাদের। ভাবনাটিও প্রায় মনের উঠানে ছুটাছুটি করতে যেয়ে আছড়ে পড়ে চেতনার বেষ্টনীতে। আমাদের আশপাশে বা হতে পারে ঘরের মানুষটিই যার কাছে বিলাসের বিষয় হচ্ছে বিষণ্ণ হয়ে থাকা। কেউ যখন তার উদ্দেশ্যে শব্দের ঢিল ছুড়ে মারে, আপনাকে আজ কেমন বিষণ্ণ মনে হচ্ছে যেন? বা আপনার কি মন খারাপ? জিজ্ঞাসিত জন ভেতরে ভেতরে পুলক বোধ করে থাকবেন হয়তো এমনটা ভেবে যে, তাকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে অন্যজন। কিন্তু সীমানার ব্যাপারগুলো আজ অবধি বুঝে উঠতে পারেনি আসাদ বা চেষ্টা করেও বুঝতে পারছে না কিছু। কিন্তু সম্পর্কটা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেখান থেকে ফিরে আসবার অপচেষ্টা হবে আত্মহত্যার সামিল। যা দুজনের জন্যই সত্য হয়ে উঠতে পারে কিংবা যে কোনো একজনের ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী। সকালের দিকে অফিসে আসবার সময় সীমানা ফোনে জানিয়েছিল, আজ তোমার সঙ্গে ঝগড়া আছে। সারাটা রাত এক রত্তি ঘুমাতে পারি নি।



উলটো সে জানতে চেয়েছিল, কেন ঘুমাতে পারলে না, উপলক্ষ্যটা কি আমি?



-আমার বলতে ইচ্ছে করছে না!



কথাটা শুনেই প্রচণ্ড রেগে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল আসাদের। এমন খামখেয়ালীপনা কেন? বলতে ইচ্ছে করছে না মানে কি? আড়াল আসবে কেন দুজনের সম্পর্কে? আর দুদিন পরপর কী হয় তোমার এসব? ভাল থাকতে ইচ্ছে করে না বুঝি? আশপাশের করুণা পেতে আর আহা চুকচুক শব্দে আসক্ত হয়ে গেছ? কিন্তু এসবের কিছুই বলে না সে। আর বাসের ভেতর অন্যান্য কলিগরা যে উৎকর্ণ হয়ে আছে তা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল। বিশেষ করে পাশের মামুন আলি তো বটেই পেছনের আসনের দুজনও যদি খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েন তাহলে সীমানার কথা স্পষ্ট শুনতে পাবেন। মোবাইল দুনিয়ায় আজকাল প্রাইভেসি শব্দটা মূল্যহীন বা অর্থহীন হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলে কারো কারো গোপন কথোপকথনের পুরো রেকর্ড বাজিয়েই শুনিয়ে দিতে পারবে কেউ কেউ। এমন দুর্দিনে ফোনে কোনো কথা বলে শান্তি বা নিশ্চয়তা নেই। এই বুঝি কেউ কোথাও আড়ি পেতে রাখল। কেউ বা কারো গোপনীয়তা ফাঁস করে দিতে শখের হ্যাকার হয়ে গেল কারো ভার্চুয়াল ঠিকানায়।



সীমানার এইসব দুঃখ বোধ বা খুব ঘনঘন বিষণ্ণতা মাঝে মধ্যে তাকেও ভীষণ ভাবে আক্রান্ত করে। কিন্তু তার কিছু তো এভাবে সীমানার চোখে পড়ে না বা জানার কথাও নয়। একটা ব্যাপার মাঝে মধ্যে হলে, তার প্রতি মানুষের সতর্ক দৃষ্টি থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তা যদি বছর জুড়েই চলতে থাকে, ব্যাপারটা যত কঠিন আর মনোবেদনার থোক না কেন, তাও এক সময় স্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে। আর তাই হয়তো আজকাল পথে ঘাটে কোনো লাশ পড়ে থাকতে দেখেও লোকজন অনায়াসে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারে।



কোনো একজন মানুষ যখন নিজ থেকেই কোনো কিছুর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলতে থাকে তাহলে পৃথিবীর যাবতীয় যুক্তি-প্রমাণ এক সঙ্গে জড়ো করলেও সেই আস্থা ফিরে আসবে না তার। আসলে সীমানা নিজেও যেমন ভাল থাকতে পারে না, তার সম্পর্কে সম্পর্কিত মানুষগুলোও যাতে ভাল থাকতে না পারে কোনোভাবে এটাই তার অবচেতনের চাওয়া যা নিজেই কখনও টের পাবে না। এমনও হতে পারে তা অন্য কেউ ধরিয়ে দিলেও তার বোধে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হবে।



আসাদের মনে কোনো রকম বিপরীত ভাবনা এলে তা সীমানাকেই জানায় প্রথম। এমন কি তার জীবনের অনেক স্পর্শকাতর ব্যাপারও সীমানার গোচরে আছে। অথচ সীমানার এমন হেয়ালীপনা মাঝে মধ্যে কথাবার্তায় ধোঁয়াশার আবহ তৈরি করে রাখা কতটা মানসিক চাপের ভেতর তাকে ফেলে দেয় তা জানানোর পরও কোনো পরিবর্তন নেই। একটা মানুষ কি সত্যিই অতটা নির্বিকার থাকতে পারে, নাকি কারো পক্ষে পুরোপুরি নির্বিকার থাকা সম্ভব? কেবল নিজের ভাল-মন্দ আর লাভালাভের ব্যাপারগুলোর প্রতিই উৎসাহী থাকবে বা আর কারো দিকে তার খেয়াল রাখার প্রয়োজন নেই ধরনের একপেশে ভাবনাগুলোকে কেবল নিষ্ঠুরতা বা স্বার্থপরতা ভাবতে কষ্ট হয়। অথচ সীমানার ব্যাপারগুলো এ থেকে আলাদা করতে গেলে মৌলিক কথা-বার্তা খুঁজে পাওয়া যায় খুব সামান্যই।



টেন্ডার সেকশন থেকে বেরিয়ে প্রপোজাল সেকশনের হামিদ সাহেবের রুমের দিকে যেতে যেতেই কী মনে করে গেটের দিকে একবার তাকিয়েছিল আসাদ আর তখনই দেখতে পেল একটি শপিং ব্যাগ হাতে গেট পেরিয়ে আসছে সীমানা। হয়তো কিছু কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিল বা সদ্য পরিচিত হওয়া কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে থাকতে পারে। এমন কিছু না হলে তো তার এদিকে তেমন আসা হয় না। দেহের তুলনায় সীমানার পা দুটোকে বেজায় সরু মনে হয় দূর থেকে। মনে হয় এত ভারি দেহের ভার বইবার জন্যে প্রস্তুত নয় পা দুটো। যেন টলোমলো পায়ে চলছে কোনো রকমে ভারসাম্য বজায় রেখে।



তাকে দেখতে পেয়েই পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় আসাদের। সকালের দিকে ঝগড়া আছে বলে আভাস দিয়েছিল। কিন্তু এখন ঝগড়া করার মতো অবস্থা তার নেই। আলাপের শুরুটা কোনো না কোনো অভিযোগ নয়তো হতাশা ব্যঞ্জক কিছু দিয়ে আরম্ভ করবে। এ নিয়ে সে কিছু বলতে চায় না। সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়া বা কোনো কারণে ঝগড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে মূলত মানুষের সঙ্গে মিশতে সাহস পায় না সে। তবু ঘুরে ফিরে তার জীবনে এমন ব্যাপারগুলোই ঘটে চলেছে দীর্ঘকাল যাবত।



বিগত বছর খানেক ধরে রুবীর সঙ্গে তার দাম্পত্য তিক্ততা ছাড়াছাড়িতে গড়ালেও কাগজপত্র এখনও হাতে আসেনি তার। এ নিয়েও বেশ কয়েকবার কথাও হয়ে গেছে সীমানার সঙ্গে। অথচ তার সে ব্যাপারে তাগাদা দিতে কোনো ক্লান্তি নেই যেন। যদিও রুবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক টিকে থাকা না থাকার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি সম্পর্কটা তবু তার আচরণে মনে হচ্ছে, তাকে নয় তার দাম্পত্য বিচ্ছেদের প্রমাণগুলোই তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আসাদ ইদানীং প্রায়ই ভাবে যে, সব মেয়েরাই কি মনের ভেতর একটি মহা পরিকল্পনা রেখে তার যৎসামান্যই মুখে প্রকাশ করে? এটা কি কোনো রকম চাতুরী বা হঠকারিতার পর্যায়ে পড়ে না? আর এমন ব্যাপারগুলো কি সম্পর্কের স্বচ্ছতার পরিপন্থী নয়? একজন শিক্ষিত মানুষের ভাবনা কোনো অশিক্ষিত মানুষের ভাবনার পর্যায়ে নেমে এলে তার বিদ্যাপীঠকে দুয়ো দিলে কি তার সমাধান হয়ে যায়, নাকি তার শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্ন তুলে তাকে উঁচু ভাবনার পথে পরিচালনা করা যায়?



মরে যাওয়া ঘাসগুলোর ওপর দিয়ে চলতে চলতে সীমানা অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে এদিক ওদিক তাকায়। হয়তো আসাদের খোঁজেই। কিন্তু দৈনিক কাজের তালিকা হিসেবে তার অফিসে থাকার কথা নয় আজ। প্রতিদিন এ সময়টাতে ডিরেক্টর বা কোনো ক্লায়েন্টের সঙ্গে নানা দিকের প্রজেক্ট দেখতে বের হয়। আজই তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আর দিনক্ষণ বুঝে কি না আজই সীমানা অফিসে চলে এলো? নাকি নিজেই কথায় কথায় কোনো এক সময় বলে দিয়েছিল বুঝতে পারছে না সে।

সীমানাকে বেশ কয়েকবার সে বলেছেও যে, কোনো সংঘাত বা বিপর্যয় এড়াতে সে পালিয়ে যাওয়াটাকেই পছন্দ করে বেশি। যদিও সীমানার ভাষায় পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে সমস্যার মুখোমুখি হওয়াটা ভালো, এতে করে যাই হোক সমস্যাটা দীর্ঘ বা জটিল হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু এখন সে যে বিষয় নিয়ে কথা বলবে তার পিঠে কোনো যুক্তি দিতে গেলেই তর্ক বেধে যাবে। অথচ তার বোঝা উচিত যে, সন্দেহ বা ভরসা করতে না পারার মানসিকতা নিয়ে একটি সম্পর্ককে আঁকড়ে থাকা যায় না বেশিদিন। তবু কথাগুলো শুনলে সে বলে উঠবে, আমার সবই মনে আছে, তবু মনে করিয়ে দিয়ে কেন অপমান করছো?



সে কথার পালটা যদি আসাদ বলে যে, মনে থাকলে আবার একই প্রশ্ন তুলেছ কেন? এ পর্যন্ত তো সবই তুমি বললে, আমি সায় দিয়ে গেছি, মানা তো করিনি কোনোটাতে?



তখনই হয়তো আবার বলে উঠবে সীমানা, আসলে কী চাও তুমি পরিষ্কার করে বল তো? আমার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে কি এখন তুমি নিজ থেকে পিছু হটতে পারছো না, যা আমার মুখ দিয়ে বলাতে চাও?



সে কথা শুনে আর হোঁচট খাবে না আসাদ। প্রথম প্রথম এমন কথা শুনলে বা সীমানার নীরবতা তাকে অস্থির করে তুলত, কখনও খানিকটা অসুস্থও। কিন্তু আজকাল ব্যাপারগুলো এমনই আটপৌরে মনে হয় যে, নির্বিকার মন কোনো প্রতিক্রিয়াই প্রকাশ করে না।



নয়তো তার একটা সময় বেশ স্বস্তি এসেছিল মনে যে, দীর্ঘকাল কানের কাছে আর চোখের সামনে জীবন্ত যন্ত্রণাদের উদ্বাহু নৃত্যের অবসান ঘটতে চলেছে হয়তো। কিন্তু সীমানার ইদানীংকালের কর্মকাণ্ডে সে আবার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে যে, জেনে বুঝে ফের একই যন্ত্রণার সাগরে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে কি না? মাঝ নদীতে না গেলে জলের ওপর থেকে তার গভীরতা অনুভব করা খুব কঠিন ব্যাপার। আর তাই হয়তো সম্পর্কের জটিলতাগুলো নিবিড় সম্পর্কে না জড়ালে টের পাওয়া যায় না। সীমানার সঙ্গে সম্পর্কটার গভীরতা না এলেও ঠিক বোঝা যেতো না তার ভাবনাগুলো বা দূরত্বের কারণে ফুটে উঠতো না তার মানসিকতার গভীরে লালিত সনাতন মূল্যবোধগুলো। আর তার ফলেই আসাদের জানা হয়ে গেছে সাবেক স্ত্রীর প্রতি কোনো ধরনের সহানুভূতি থাকা চলবে না। বিচ্ছেদ মানেই সব কিছু মুছে ফেলতে হবে জীবন থেকে। কিন্তু যেখানে দুজনের সম্পর্কিত সন্তান বর্তমান, সেখানে এতটা বিচ্ছিন্নতা কী করে সম্ভব? সাবেক স্বামী-স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতি থাকাটা বা তার খাওয়া-খরচের যোগান দিতে চেষ্টা করা তো প্রেম-ভালবাসার পর্যায়ে পড়ে না। আর তেমনটা যদি হতোই তাহলে কি সম্পর্কটা ভাঙে? কোনো বাড়িতে একটি বিড়াল থাকলে তার প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ হিসেবে কোনো গৃহকর্তৃ বিড়ালটাকে কর্তার আগে যদি খেতে দেন, তাহলে কি গৃহকর্তা বিড়ালটার চেয়ে গুরুত্বহীন হয়ে গেলেন বা স্ত্রীর কাছে উপেক্ষিত হয়েছেন বলে শালিস বসাবেন?



সহানুভূতির ব্যাপারটা আসে মনুষ্যত্ব বোধ থেকে। আর ছেলে-মেয়ের মা, যার সঙ্গে তার বাইশ বছরের সম্পর্ক ছিল, অনেক অভ্যাস দিয়েও হয়তো দুজন তাড়িত হবে পরবর্তী আরো অনেকগুলো বছর, তার প্রতি সহানুভূতি থাকাটা কি পাপ? আর বাইশ বছর পর হঠাৎ করে তার প্রতি সহানুভূতিহীন হতে গেলে পশুত্বের পর্যায়ে নেমে আসতে হবে না? তা ছাড়া সমগোত্রের পশু বা জানোয়ারদেরও পারস্পরিক সহানুভূতি থাকে। সে তুলনায় মানুষের সহানুভূতি তো আরো বেশি থাকার কথা। দাম্পত্য জীবনে সম্পর্কের মাঝে নানা বিকৃতি, মতাদর্শ আর অনমনীয় কিছু মানসিকতার কারণে দুটো মানুষ আলাদা হয়ে যায় বা পরস্পর দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। যেখানে ঘৃণাও একটি প্রধান কারণ হতে পারে। কিন্তু তাই বলে সহানুভূতিও প্রকাশ করা যাবে না এ কেমন কথা বললে তুমি? নারী হয়ে তুমি এতটা নিষ্ঠুর ভাবনা মনে ঠাঁই দিতে পারলে? এমন ভাবনা তো মনুষ্যত্বকেও লজ্জায় ফেলে দেবে। একবার ভেবে দেখ, ব্যাপারটা বুঝতে পারলে তোমার নিজেকে সেই লজ্জাটা কোন পর্যায়ে পেতে হবে? যদিও কথাগুলো সরাসরি না বলা হলে সীমানাকে বোঝানো কঠিন ব্যাপার। কিন্তু এমন ধরনের কথা তো মুখের ওপর বলতেও যে কারো রুচিতে বাধার কথা।



সীমানার এদিক ওদিক উৎসুক দৃষ্টিতে তাকানো দেখেই আসাদ দূর থেকে একটি হাত উঁচিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস পায়। আর তা দেখতে পেয়েই হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে আসতে থাকে সে। হবু স্ত্রীর চন্দ্রমুখের দিকে তাকিয়ে খুশি হতে পারে না আসাদ। যদিও তার খুশি হয়ে ওঠা উচিত ছিল। তবু তার বিগত বছর খানেকের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারে এখান থেকে সে যখন ফিরে যাবে, মুখটাতে অতটা রশ্মি বজায় থাকবে না। কথার ভেতরেই নানা হিসেব কষতে কষতে আসন্ন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির পরিমাণ নির্ধারণ করতে যেয়ে সুন্দর মুখটাকে দুর্ভাবনা আর হতাশার কালি দিয়ে কুৎসিত করে ফেলবে খুব দ্রুত। আর গ্রিক পুরাণের নিয়তি নির্ধারিত ঘটনাগুলোর মতো ব্যাপারটিও যেন সেদিকেই মোড় নেয় সীমানার আকস্মিক প্রশ্নে। সে এগিয়ে এসেই যখন বলল, কেমন আছ? গ্রামের বাড়ি ফোন-টোন দিয়েছিলে বা কেউ মিসকল দিয়েছিল?



আসাদ খানিকটা গম্ভীর হয়ে জানায়, হুম, মিসকল দিয়েছিল।



-কে, আপা নাকি রুবী?



-না।



-তাহলে কে?



-মনিরা।



সঙ্গে সঙ্গেই আঁধারে ছেয়ে যায় সীমানার মুখ। খানিকটা রুষ্ট কণ্ঠে বলে ওঠে, বলেছি না তার সাথে সম্পর্ক না রাখতে? সময়-সুযোগে এই সিমটা পালটে ফেলবে। নতুন নাম্বারটা জানাবে না তাকে!



বার বছরের বেশি সময় ধরে তার আমার সম্পর্ক। তার স্বামী-সন্তান সহ বাপ-মা ভাইবোন সহ পুরো পরিবারটার সঙ্গেই আমার সম্পর্ক। যে কোনো বিপদ বা সমস্যায় পড়লে কাছের মানুষ হিসেবে ভাই বোনদের পর আমাকেই স্মরণ করে আগে। তা ছাড়া তার ঘোরতর কোনো বিপদে বাইরের মানুষ আমি ছাড়া আর দেখার কেউ নেই। এমন একটি মানুষের সঙ্গে আমি সম্পর্কিত বলে তার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক মানুষ সম্পর্কিত। আমার সহোদর ভাইবোনের শ্বশুর বাড়ির সঙ্গেও এমন যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি আমার। আর তুমি মেয়ে গতকাল আমার জীবনে এসে চারদিকে কাঁটা তারের বেড়া দিতে আরম্ভ করলে? খাঁচার ভেতর আমাকে নিয়ে কি সুখী হতে পারবে? একটা কথা ভুলে যাও কেন যে, লখিন্দরকে কিন্তু বেহুলা বাঁচাতে পারে নি সাপের ছোবল থেকে। বেহুলার চেয়ে বেশি ভালবাসা যে ধারণ করে সে নারী হয়তো নারীই নয়। এমন তো না যে, তার সঙ্গে আমার প্রেম বা দেহজ সম্পর্ক বিদ্যমান। তা ছাড়া তেমনটি হলে তোমার অস্তিত্ব আমার পাশে কি কল্পনাতীত নয়? কিন্তু সব কথা মুখে আনে না আসাদ। তরল কণ্ঠে যথা সম্ভব স্বর নামিয়ে বলে, আরে, এক যুগের পীড়িত এক দিনে ভাঙা যায় নাকি? আর তুমি এলে গতকাল, আজকেই খাঁচাবন্দী করে ফেলবে?



আসাদের কথায় প্রচ্ছন্ন কোনো খোঁচা থেকে থাকবে হয়তো, যে কারণে গাঢ় দুটো ভাঁজ ফুটে উঠতে দেখা যায় সীমানার কপালের মাঝামাঝি। আর সে অবস্থাতেই সে মৃদু স্বরে মুখ নাড়ায়, এত বেশি বোঝো কেন তুমি? তোমার এই রোগটাও খারাপ কম না!



-কোনটা বেশি বুঝলাম? তোমাকে কতবার বলেছি যে, খাজুরে আলাপ করতে ফোন দেয় না সে।



-নিশ্চয় টাকা-পয়সা চেয়েছে!



-চেয়েছেই তো! তার মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেলে টাকা-পয়সা কিছু তো দিতেই হবে সাধ্য মতন!



-আচ্ছা দিও! তোমার কোনো ব্যাপারে আমি বাধা দিচ্ছি না। এখন বল তোমার প্রগ্রেস কতদূর?



সীমানার কথা হয়তো ধরতে পারে না আসাদ। তাই তার মতো করেই বলে ওঠে, এখানে দাঁড়িয়েই সব কথা কথা সেরে ফেলবে নাকি? কোথায় গিয়েছিলে, শপিঙে?



-শপিঙে না। রাজু আর ফরিদ এসেছিল শাহবাগ। গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে। আমিও তাদের সঙ্গে ছিলাম।



-পারলে দিন-রাতের পুরো সময়টাই সেখানে দিতাম। কিন্তু শাহবাগে দেরি করে অফিসে যাওয়া নিয়ে আমাদের বন্ধু সাহাদাত উদরাজীর চাকরি নিয়ে সমস্যা হয়েছে শুনলাম। এ নিয়ে রাগারাগি করে চাকরিতেও নাকি রিজাইন করে ফেলেছে সে। আমি তো এমন সাহসী মানুষ নই।



-একাত্তরে এত কিছু ভেবে তো মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে যান নি! এখনকার এ জাগরণ কি খুব একটা সাদামাটা মনে হয়? রাজু ফরিদ বা সেখানে যারা যারা আছেন তাদের চেহারা দেখে তো সাধারণ কোনো জমায়েত মনে হচ্ছে না।



-ঠিক আমার ভাবনার সঙ্গে তোমারটাও মিলে গেল দেখছি। আর কী কী আলাপ হলো তাদের সঙ্গে? সব রাজাকারের ফাঁসি চাই এই একটি দাবিতে অনড় থাকতে পারলে পৃথিবীকে এমনকি পাইক্যাদেরও ভাবনা বদলে দেয়া যেত। বলতে বলতে হঠাৎ সীমানার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ফিতে ধরে টানে আসাদ। টানতে টানতে বলে, চল ক্যান্টিনের পচা চা খেতে খেতে কথা বলি।



সীমানা মাথা দুলিয়ে জানায়, না, তাদের সঙ্গে কথা হয় নি তেমন একটা। তারা ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে শ্লোগান দিচ্ছিল। লাকি মেয়েটার কী যে অসাধারণ প্রাণশক্তি! সামনা সামনি না দেখলে ঠিক ঠিক বোঝানো যাবে না।



-তুমি ও তো শ্লোগান দিয়েছ। গলার স্বর কেমন খরখরে মনে হচ্ছে।

সীমানা হাসে। বলে, বেশি জোরে দিতে পারি নি। গলা ব্যথা করছিল। কিন্তু আমার বুকটা এখনও ভরে আছে ভাল কিছু একটা করার অহংকারে।

-দেশের মানুষগুলো সবাই যদি এভাবেই জেগে উঠত তাহলে আমাদের দেশটাও অতীতের কলঙ্ক মুছে ফেলতে পারত সব! তারপরই হঠাৎ করে প্রসঙ্গান্তরে যেতেই যেন আসাদ ভিন্ন কথা আরম্ভ করে। নিজের ঘাড়ের পেছন দিকটা এক হাতে চাপতে চাপতে বলল, আমাকে বিয়ে করলে তো তোমার বন্ধুদের তেমন সময় দিতে পারবে না। তখন না তারা আমাকেই লাঠি হাতে তাড়া করে?



-অর্থহীন কথা বল কেন? সীমানার চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তি। আমি দেরি করতে পারবো না। অফিসে কিছু বলে বের হয়ে আসি নি।



-অফিস চুরি কর তুমিও? বলে, আসাদ ক্যান্টিনের দিকে না এগিয়ে মাঝ পথেই থেমে পড়ে। তারপর দু হাত কোমরে রেখে ফের সীমানার চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে, তাহলে চা খেয়ে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না তোমার। ঝগড়াটা এখানেই মুক্ত হাওয়ায় সেরে ফেল!



-কীসের ঝগড়া? কেমন অবাক দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকে সে আসাদের দিকে।



-সকালে ফোনে বলছিলে না আজকে ঝগড়া আছে আমার সঙ্গে?



-কোন প্রসঙ্গে বলেছিলাম ভুলে গেছি!



-আমি একটা বিচ্ছিরি সম্পর্কে ঝুলে আছি।



-ওহ, তাহলে কি তুমি এমন একটা বাজে সম্পর্কে ঝুলেই থাকবে? রুবীর সঙ্গে তোমার কথা হয়েছিল আর বা সে ফোন দিয়েছিল আজকে কালকে? তা ছাড়া কাগজ-পত্রের ব্যবস্থা কবে নাগাদ করতে পারবে?



-রুবীর সঙ্গে আর কথা হয় নি আমার।



-টাকা-পয়সা পাঠিয়েছিলে?



-টাকা না পাঠালে খাবে কি ওরা? রুবী যে কারো বাসায় বুয়ার চাকরি নেবে সে যোগ্যতাটাও তার নেই।



-তার জন্য এখনো তোমার সফট ফিলিং রয়ে গেছে বেশ, এটা কিন্তু আমার পছন্দ না মোটেও। তার জন্যও দরদ দেখাবে আবার আমাকেও স্বপ্ন দেখাবে ব্যাপারটা কন্ট্রাডিক্টরি হয়ে গেল না?



-দেখ সোনা, দুজনের মাঝে সেতু হিসেবে সন্তানগুলো রয়ে গেছে না! আর তাদের কারণেই নানা ভাবে যোগাযোগটা আর শতভাগ বিচ্ছিন্ন হয় না। তোমার কথা মানতে গেলে সন্তানগুলোকে কষ্ট দিতে হবে। তুমি কি চাও তোমার মুন্নি কোনো কারণে খাওয়া পরার কষ্ট পাক? যদিও অন্য কিছু দিয়ে তার বাবার অভাবটা পূরণ করতে পারবে না, তবু তুমি চাইবে মুন্নি যেন সে অভাবটা কখনো বুঝতে না পারে। নাকি একজন পারভার্টের ঔরসে তার জন্ম হয়েছে দেখে তাকেও নানা ধরনের কষ্ট দিয়ে তার বাবার কৃতকর্মের শোধ তুলবে? তা ছাড়া বাবা হিসেবে মুন্নির বাবার মতো অতটা দায়িত্বহীন হওয়া তো আমাকে সাজে না।



তখনই সীমানা আসাদের কথার মাঝে বলে ওঠে, আমিই তার থেকে কিছু নিতে আগ্রহী ছিলাম না। বরং আমার কাছে তার বাড়ি-গাড়ি, অলংকার যা ছিল তার সবই ফিরিয়ে দিয়েছি।



-সেটা তোমার সামর্থ্য আছে বলে, নয়তো উদারতা বলে ধরে নিতে পারি কিন্তু সবাই যে অমন হবে তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি তো অনেক নারীকেই দেখেছি কেবল খাওয়া-পরাটা যাতে চলে যায় তার জন্যেই কত ভান-ভণিতা লোক ধরাধরি বিচার-শালিসের কোনোটাই বাদ রাখে না। সে যাই হোক, আজ আমার ছেলে-মেয়েদের প্রতি যদি কোনো কারণে দায়িত্বহীন হতে পারি তা হলে ভবিষ্যতে যে তোমাকেই অবহেলা করবো না, তারই বা নিশ্চয়তা কি?



-কথাটাকে এত প্যাঁচাচ্ছ কেন তুমি? আমি তো অত প্যাঁচের কথা বলি নি!

-তাহলে সহজ কথাটা কি আরেকবার শোনাবে দয়া করে?



-আমি স্যরি। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করে যাও বাকি জীবন। আমি কখনও বলি নি যে, তোমার ছেলে-মেয়েদের খাওয়া-পড়া বা লেখাপড়া বন্ধ করে দাও!



-কিন্তু তাদের মায়ের খাওয়া-পরা যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কি তারা ভাল থাকবে, নাকি স্বাভাবিক জীবনটা যাপন করতে পারবে?



-এইটাই তোমার বড় দোষ। একটা সাধারণ কথাকে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে তুলাধুনা করে ফেল!



-বুঝলাম, এটা নিয়ে আবার নিজের ঘুমটা নষ্ট করো না! চোখের নিচে কালি পড়লে দেখতে খারাপ লাগবে।



-আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, গেলাম!



সীমানার যাবতীয় আগ্রহে যেন ভাটা পড়ে গেছে। এ পর্যন্ত যা যা ভেবে এসেছে সবটাতেই যেন নিরুৎসাহের জল পড়ে গেল আসাদের অক্ষমতায়। আসাদকে ফের কিছু বলার সুযোগ না দিতেই হয়তো আর দাঁড়ায় না সীমানা। যে কারণে হয়তো আধ পাক ঘুরেই গেটের দিকে চলতে আরম্ভ করেছিল। পেছনে পড়ে গেছে বলে তার মুখটা দেখতে পায় না আসাদ। তবু একবার ম্লান মুখে হাসি ফুটিয়ে হাত নাড়ায় প্রায় ধাবমান সীমানার উদ্দেশ্যে। হয়তো তা চোখে পড়ে না তারও। গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময়ও তার মুখটা আড়াল হয়ে থাকে পথ চলতি আরো লোকজন আর নানা আকৃতির ছোট-বড় যানবাহনের ভিড়ে। সেই সঙ্গে যেন কক্ষচ্যুত একজন আসাদ সময়ের ভুলে মাঝপথেই অকস্মাৎ ছিটকে পড়ে সড়ক ভবনের কোনো এক অন্ধকারাছন্ন করিডোরে অথবা একজন সীমানা জীবনের হিসেব-নিকেশের জটিল সংখ্যাবর্তে পাক খেতে খেতে গড়িয়ে চলে সময়ের ঢাল বেয়ে। যার সমাপ্তি আদৌ আছে কি না, দুজনের কারোরই হয়তো জানা হবে না শেষ পর্যন্ত।



(সমাপ্ত)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:৫৫

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: ভালো লেগেছে।

১৪ ই জুন, ২০১৩ রাত ৩:৫৯

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

২| ২৮ শে জুন, ২০১৩ ভোর ৪:২৫

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: চমৎকার। আপনার এই লেখাটা পড়ে মনে হলো, ভালো লেখা বড় হলেও কোণ ব্যাপার না। একটানেই পড়ে ফেলা যায়।

শুভেচ্ছা রইল।

২৮ শে জুন, ২০১৩ ভোর ৫:২৬

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে। আসলে লেখা যদি পাঠককে আকর্ষণ করতে পারে তা যত বড় হোক, পাঠকের ক্লান্তি আসবে না। আর তেমন লেখাই টিকে থাকে অনেকদিন।

ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.