নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস... খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে... কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়। আমার অদক্ষ কলমে... যদি পারো ভালোবেসো তাকে... ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে, যে অকারণে লিখেছিল মানব শ্রাবণের ধারা.... অঝোর শ্রাবণে।।
মছলি মুসল্লম ও পাঁচ সের ঘিয়ের পরোটা....
আওধের নবাবদের খাবার প্রতি দুর্বলতার কথা ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে। আর তাই সেখানের বাবুর্চিদের কদরই ছিল অন্য রকম। কেউ পাঁচ সের ঘিয়ে একটা পরোটা ভাজতেন, তো কেউ শর্ত মানা হয়নি বলে বানানো ডাল মাটিতে ফেলে চাকরি ছেড়ে চলে যেতেন! এমনই সব আজব কিসসা আওধের নবাবদের ঘরে ঘরে। শুনবেন নাকি তার কয়েকটা?জয়িতা দাস
আপনি বাঙালি হলে নিশ্চয়ই আওধি কাবাবের ভক্ত।
আওধি কাবাব শুনে আপনাদের নিশ্চয়ই এখন 'তুণ্ডে কাবাব' এর কথা মনে পড়ছে। অমন নরম-তুলতুলে কাবাবের জন্য খাদ্যরসিকদের জান কোরবান। লখনৌয়ের বাবুর্চি মহলে কান পাতলেই শোনা যাবে তুলতুলে কাবাব-রহস্য সম্পর্কে দু’-চারটি গোপন কথা। সেই ফিসফাস বলছে, লজ্জতদার খানা খেয়ে খেয়ে নাকি আওধের বাদশাদের দাঁত নষ্ট হয়ে যেত অল্পবয়সেই। শক্ত খাবার তখন নৈব নৈব চ। আর খাওয়ার সুখই যদি না থাকল, তাহলে বাদশা হয়ে লাভটা কি! আর বাদশাদের যদি খানার শখ না থাকে, তাহলে বাবুর্চিদের হাতযশের তোয়াজই বা করবে কে!
অতএব, নিত্য-নতুন এক্সপেরিমেন্ট। বাদশা-পসন্দ খানা তৈরির চেষ্টা। সেই চেষ্টা থেকেই আওধি ডিশ অমন নরম তুলতুলে। কাবাব থেকে পোলাও, কিংবা পরোটা-খামির-মোরব্বা, যাই মুখে দাও- নিমেষে মিলিয়ে যাবে তা। চিবোনোর প্রয়োজনই পড়বে না।
বিশ্বাস হচ্ছে না! ক্যাপ্টেন মেডান লিখিত এক সরকারি রিপোর্টের ইঙ্গিতও কিন্তু সেরকমই। নবাব আসফউদ্দৌলার কথা লেখা ছিল সেই রিপোর্টে-- যে আসফউদ্দৌলা তাঁর হাজারটি হাতির খাবারের পেছনে যত না খরচ করতেন, তার চেয়ে বেশি খরচ করতেন নিজের খাবারের পেছনে।
আর এই খাবারের প্রতি দুর্বলতা ছিল বলেই আওধের বাদশাদের মাথার ওপর রাজ করেছে বাবুর্চিরা। দু’-দু’জন বাবুর্চিকে তো তাঁরা বসিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যের প্রধান উজিরের পদেও! আবার বাবুর্চিদের মান রাখতে উজিরদের হেনস্থা করতেও ছাড়েননি।
বাদশা গাজিউদ্দিন যেমন। তাঁর খাস বাবুর্চি রোজ ছ’টি পরোটা তৈরি করত ত্রিশ সের ঘি দিয়ে। পরোটা পিছু পাঁচ সের। উজির জানতে চেয়েছিলেন, রোজ ত্রিশ সের ঘি কোন কাজে লাগে!
‘পরোটা তৈরি করতে’-- বাবুর্চি বেশ রোয়াবের সঙ্গেই জবাব দিয়েছিল। উজির তখন নিজে দাঁড়িয়ে পরোটা তৈরি করিয়ে দেখলেন প্রচুর ঘি বেঁচে গেছে। স্মার্ট বাবুর্চি তখন উজিরের চোখের সামনেই সমস্ত ঘি ফেলে দেয়। তার যুক্তি, ‘একবার ঘি আঁচে চড়ালে, তা তেল হয়ে যায়। সেই ঘিতে আর অন্য খাবার তৈরি করা যায় না।’ সেদিন থেকে উজিরের হুকুমে বাদশার পরোটার জন্য বরাদ্দ হয় ছয় সের ঘি। পরোটা পিছু এক সের।
তবে শেষ রক্ষা হয়নি। বাদশার কানে কথাটা উঠতে খেপে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘কেন, তুমি লুটে নিচ্ছ না! একটা গোটা রাজ্য লুটেপুটে খাচ্ছ তুমি! আর বেচারা বাবুর্চি আমার খানা তৈরির জন্য সামান্য ঘি বেশি নেয় বলে তোমার চোখ টাটায়!’
আওধে বাবুর্চিদের দাপট ছিল ওমনই। নবাব আসফউদ্দৌলার এক মেজাজি বাবুর্চি তো তার শর্ত মানা হয়নি বলে কাজ ছেড়ে চলে যায়। সেই বাবুর্চি আবার গোটা মাষকলাই ছাড়া অন্য কিছু রাঁধত না। এদিকে আকাশছোঁয়া মাইনে। সেই আমলে পাঁচশো। তা তার শর্ত ছিল বাদশার ডাল খাওয়ার ইচ্ছে হলে সেকথা জানাতে হবে একদিন আগে। আর তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নেওয়া চাই।
তা যেদিন বাদশার ডাল খাওয়ার ইচ্ছে হল সেদিন ঠিক সময়ে দস্তরখানে হাজির হওয়ার নওতা পাঠিয়েছিল সে হুজুরকে। বাদশা তখন গল্পে মত্ত। বাবুর্চি অপেক্ষা করেনি। সমস্ত ডাল এক মরা গাছের গোড়ায় ঢেলে চলে যায়। শোনা যায়, যে গাছের গোড়ায় ডাল ফেলা হয়েছিল, কিছুদিনের মধ্যেই সেই মৃত গাছ নাকি ফুলে-ফলে ভর্তি!
আওধের বাবুর্চিদের নিয়ে এমনি কত গল্প! এই বাবুর্চিদের মধ্যে আবার রকমফেরও ছিল। দেগশোর, বাবুর্চি আর রকাবদার-- ছিল এই তিন দল। রান্নার পাত্র থেকে ডেকচি সাফাই আর বাবুর্চির ফাইফরমাশ খাটত যারা, তারা দেগশোর। আর বাবুর্চি যে, সে রান্না করত বড় বড় ডেকচিতে।
আর রকাবদার! সে বড় নাক উঁচু। বড় ডেকচিতে হাতই দেবে না। তার কাজ-কারবার সব ছোট হাঁড়িতে। মোরব্বা আর আচার বানাতেও সে ওস্তাদ। ওস্তাদ গার্নিশেও। আর তাদের নেশা? নেশা, রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা। নতুন নতুন সব ডিশ নিয়ে তারা হাজির হত বাদশা আর লখনৌয়ের খানদানি রইসদের সামনে।
কেমন সে খাবার! নবাব নাসিরুদ্দিন হায়দরের এক বাবুর্চি বাদাম-পেস্তার খিচুড়ি তৈরি করে চমকে দিয়েছিল সবাইকে। বাদাম কেটে চাল আর পেস্তার ডাল দিয়ে তৈরি হয়েছিল তা। দেখে বোঝার সাধ্য কি যে এ সত্যিকারের ডালচালের খিচুড়ি নয়!
আর শিরমাল! বাখরখানির স্বগোত্রীয়। তবে এমনই লজ্জতদার যে লখনৌভিরা বলত, এ হল রুটির সরতাজ। মেহমুদ বলে এক রকাবদার নাকি এর আবিষ্কর্তা! জুড়ি ছিল না মলিদারও। রুটি ভেঙে তার ভেতর ঘি আর চিনির পুর ভরে তৈরি এই মলিদা। মুখে দিলে আর চিবোনোর প্রয়োজন পড়ত না, সেই চিনির পুর তখন গলে শরবত।
আর নান জলেবি! একমাত্র অভিজ্ঞ রকাবদারের হাতেই এর আসলি স্বাদ খুলত। দুধ কি গ্যিলেরিয়াঁও তাই। গ্যিলেরি, অর্থাৎ খিলি। আর খামিরি রুটির সঙ্গে যে খাওয়া হয় ‘নহারি’-- সেও এই লখনৌয়ের রকাবদারদেরই আবিষ্কার।
আওধের এক শাহজাদা ইয়াহিয়া আলির বাবুর্চি আলম আলির খ্যাতি ছিল ‘মছলি মুসল্লম’ তৈরিতে। খানদানিরা ছিলেন আলমের এই মছলি মুসল্লমের দিওয়ানা। তাদের বাবুর্চিরা আলমের মতো মুসল্লম তৈরি করার জন্য কম কসরত করেনি। তবে আলমের এলেম তাদের ছিল না।
সত্যিই আওধের রকাবদাররা ছিল এক একজন ম্যাজিশিয়ান। অতিথিদের ধোঁকা দিতে ফল বা মিষ্টির সাজে দারুণ দারুণ সব মাংসের প্রিপারেশন তৈরি করত তারা। ওয়াজিদ আলি একবার তাঁর দস্তরখানে ওমন ছদ্ম মিঠাই সাজিয়ে অপ্রস্তুত করেছিলেন এক মুঘল শাহজাদাকে। নাম তাঁর মির্জা আসমান কদ্র। শাহজাদা অবশ্য এর বদলা নিয়েছিলেন। আর সে ওই দস্তরখানেই।
সেসব কাহানি রূপকথার গল্পের মতো। সবই আজ ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তবে লখনৌয়ের শান তুণ্ডে কাবাব এখনও আছে। আছে কাবাবের আরও শ’খানেক ভ্যারাইটি। সেসবের স্বাদ চাখার পর লখনৌয়ের বাবুর্চিদের পায়ে যে আপনি হাজারটা পেন্নাম ঠুকতে রাজি, সে বাজি ধরে বলতে পারি।
(এই পোস্টে কলকাতার ভাষারিতী প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেছি)
©somewhere in net ltd.