নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হিসেব..।

কাব্য চৌধুির

কিছু মনে পরেনা।

কাব্য চৌধুির › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবন থেকে নেয়াঃ কখনও বলা হয়নি বাবা...

১৭ ই মে, ২০১৩ রাত ১১:৪৫

অনেকদিন ধরেই খুব ইচ্ছে ছিল বাবাকে নিয়ে একটি দিন নিজের মতো করে কাটাব। কিন্তু কখনও সময় সুযোগ হয়ে উঠেনি। হয়ত বাবা ব্যস্ত ছিলেন নয়ত আমি! এভাবেই কেটে গিয়েছে ২৪ টি বছর। বাবার সাথে একটি দিন নিজের মতো করে কাটানোর আকাঙ্ক্ষা টি আমার কখনই পূরণ হয়নি।



ঘুম থেকে উথেই চুপচাপ বসে ছিলাম পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য। আমার মাঝে মাঝেই এরকম হয়, ঘুম থেকে উঠে চারপাশের সবকিছু বুঝে নিতে একটু সময় লাগে। বাবা কে অনেক অনুরধ করিয়ে আজকের দিনটা ছুটি নিতে বলেছিলাম অফিস থেকে। বাবা তাই ই করেছেন। নিজের বিছানার মায়া ছাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বাবা কে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। তখন ছিল সকাল ৭.৫০ অথবা আগে পরে! আজকে সারাদিন আমি আর বাবা ঘুরে বেরাব। যেখানে খুশি!



আমি আর বাবা নাস্তা না করেই বেরিয়ে পরেছি, দুজনে বাইরে খাবো আজ। একটা অন্য রকম অনুভুতি। কখনও এধরনের পাগলামি আমি করিনি। লালমাটিয়া থেকে একটা রিকসা করে দুজনে মহাম্মাদপুর চলে গেলাম সকালের নাস্তা করার জন্য। সময়টা খুব ভাল ছিল। আকাশে বেশ মেঘ ছিল সেদিন। গরম টাকে সেভাবে বোঝা যাচ্ছিলোনা। আমাদের দুই পাগলের জন্য বেশ ভালই হয়েছে। আমি আর বাবা ক্যাম্পের বাজারের এখানে কোন একটা হোটেল এ বসেছিলাম নাস্তা করার জন্য।

বাবাঃ কি খাবি?

আমিঃ আজকে তো তুমি অর্ডার দিবে আর আমি খাব কিন্তু বিল টা আমি দিব (বাবার চেহারা তে একটা মুচকি হাসি ছিল। ধরতে পারিনি কারণটা)

বাবা ওয়েটার কে ডেকে দুইটা নিহারি আর তুন্দর রুটি দিতে বললেন। আমি জানি বাবা নিহারি এর কথাই বলবেন কারণ এটাই তার সব চাইতে প্রিয়।

আমিঃ বাবা কখনও কি এটা চিন্তা করেছ যে মানুষ সকালের নাস্তা তে অন্য কি খেতে পারে?

বাবাঃ মানে?

আমিঃ মানে কিছুনা। এমনি বললাম। এই ধর এখন তুমি তুন্দর আর নিহারি খাচ্ছ কিন্তু যদি তুমি এগুলো না পাও তাহলে কি করবে?

বাবাঃ ভাত খাবো!! বাসায় কি ভাতের অভাব নাকিরে?

আমিঃ নাআআ!!! কিন্তু ধর তুমি আলাদা থাক তখন?

বাবাঃ আলাদা থাকব কেন? তোর মা কই যাবে?

আমি আর কথা বারালাম না...পাগলের মাথা গরম না করানই বুদ্ধিমানের কাজ।

আমিঃ আমি কিন্তু ওখানে সকালে কিছু খাইনা। সকালের যেই খাবার পাওয়া যায় ওইটা মুখে দেয়ার চাইতে না খেয়ে থাকা ভাল।

বাবাঃ কেন কি দেয়?

আমিঃ একটা প্লেট এ একটা টুকরা কাঁচা মাছের স্লাইস আর কিছু চিজ আর একটা কোণায় একটা টুকরা রুটি। সাথে এক মগ কফি।

বাবাঃ কি বলিস? ভাত রান্না করেই নিলেই তো পারিস!

কিছু বললাম না। সময়ের যে নিদারুন অভাব সেটা বাবা কে বঝান যাবেনা।



খাওয়া শেষ করে আমি আর বাবা হাটতে থাকি। আমরা বাবর রোড দিয়ে শ্যামলী মাঠ এর দিকে যাচ্ছি। হাটতে হাটতে আমি আর বাবা অনেক কথা বলছিলাম। বাবার চাকরি নিয়ে, আমার জীবন পড়া লেখা সব কিছু নিয়ে কথা হচ্ছিল। সকাল থেকে এক কাপ চা ও খাইনি। আমি আর বাবা আশা ইউনিভারসিটি এর পিছনের একটা দোকানে বসলাম।

আমিঃ মাসের প্রথম দিকে আমরা বন্ধু রা কোন ভাল রেস্তরা তে গিয়ে দামি দামি কফি খাই আর মাসের শেষে গিয়ে এক বারের চা পাতা দিয়ে দুবার চা খাই, হা হা হা...আর এখানে এক কাপ চা এর দাম ৪ তাকা।(শময় টা আজ থেকে ৩-৪ বসর আগের)

বাবাঃ হাত খরচ কমিয়ে চল। উল্টা পাল্টা খরচ কম কর দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। ( সব বাবা মাদের একটাই চিন্তা তাদের ছেলে মেয়েরা উল্টা পাল্টা খরচ করে, আমি কথা বারাইনি) তুই কি সারাদিন ওইখানে খেলিশ নাকি পড়া লেখা কিছু করিস? (খবরদারি শুরু)

আমিঃ পড়া লেখা কেন করবনা বাবা? তবে খেলা ধুলা না করলে তো শরীর নষ্ট হবে ঠিক না? ( বাবা চা খাওয়া বন্ধ করে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ২ বার আপাদমস্তক দেখলেন)

বাবাঃ এহ!!! আমার খেলোয়াড়!!!

আমিঃ আচ্ছা বাবা এই ধর তুমি যদি আমার জায়গায় থাকতে তাহলে কি করতে?

বাবাঃ মন দিয়ে পড়া লেখা করতাম।

আমিঃ এহ!!! হইছে... চাপাবাজি কম কর!!! সিম্পল ব্যাংক এর বই তুমি আম্মা রে দিয়ে লেখাও আবার পড়া লেখা করবা!!!!

বাবাঃ আচ্ছা চল সামনে আগাই।



আমি আর বাবা শ্যামলী লিঙ্ক রোড ধরে হাটতে থাকি। পাসপোর্ট অফিস এর সামনে দিয়ে হাটতে গিয়ে আমার পাসপোর্ট করার কাহিনী মনে পরে গেল। বাবা মা কখনও চাননি আমাকে দেশের বাহিরে পাঠাতে। আমি এক সেমিস্টার এর টাকা মেরে দিয়েছিলাম।

শেরে বাংলা বয়েজ স্কুল এর সামনে ঝাল মুড়ি বিক্রি করছিল। অনেকদিন খাওয়া হয়না।

আমিঃ বাবা ঝাল মুড়ি খাবা?

বাবাঃ চল খাই।

আমি তো অবাক। যাকে আম্মা কোন দিন রাস্তার জিনিষ খাওয়াতে পারেনাই, সে আজ ঝাল মুড়ি খাবে!!

আমরা আই.ডি.বি তে গেলাম কিছু টুকটাক জিনিষ কেনার জন্য। বেশিক্ষন ছিলাম না সেখানে। এই আধঘণ্টা! বাবা কখনও Mr. Baker কিংবা K.F.C অথবা pizza hut এ যাননি। জানেন ও না কোনটার স্বাদ কি রকম। শুধু শুনেই গিয়েছেন। জন্মের পর থেকেই দেখছি এই মানুষ টাকে অবিরাম খেটে গেছেন আমার জন্য। নিজে কষ্ট করেছেন মাকে সাথে নিয়ে, কিন্তু কখনও ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। বাবা কে নিয়ে একটা cng তে উঠলাম গুলশান যাব।

আমিঃ বাবা তোমাদের নাকি চাকরির মেয়াদ বেড়েছে?

বাবাঃ হুম!!! তুই কোথা থেকে জানলি?

আমিঃ ওমা! না জানার কি আছে? তোমার জন্য কিন্তু ভালই হইছে! আরেক টু দেরিতে বেকার হবা আর কি!



আমাদের মাঝে আরও অনেক কথা হয়, বাবার চাকরি, বাবার দিন কাল, মার সাথে কাটানো সময়। আমি আর বাবা সেইদিন অনেকটা বন্ধু তে পরিনত হয়েছিলাম। বাবা কে আমার মোটেও মনে হয়নি উনি একজন বয়স্ক মানুষ। কিংবা বাবাও আমাকে সেই দৃষ্টি তে দেখেননি। বাবার অনেক ভাল লাগা মন্দ লাগার কথা শুনছিলাম। ছোটবেলায় কি রকমের একটা বদের হাড্ডি ছিলাম তার কিছু প্রমান বাবার মুখ থেকে শুনেছিলাম। যার অনেক কিছুই আমার মনে নেই।

বাবা কে নিয়ে আমি k.f.c তে ঢুকলাম। দুটো বার্গার আর আমার প্রিয় চকলেট ক্রাশার। বিল দেখে বাবা বলল এই খেয়ে এতো টাকা নষ্ট করার কোন মানে হয়না! আমি কিছু বলিনি বাবাকে। আমার শুধু মনে হচ্ছিল বাবা কে যদি জড়িয়ে ধরে বলতে পারতাম যে “বাবা এই হাজার খানেক টাকা তো তোমার কষ্টের কাছে কিছুই না, সত্যি বলছি কিছুই না।“

আমি আর বাবা সেখান গুলশান থেকে উত্তরা এর দিকে রওনা দিলাম। উত্তরা বরাবরই আমার খুব প্রিয় জায়গা। নিকুঞ্জ এর কাছে এসে আমি বাবা কে বললামঃ

আমিঃ বাবা আমারা কি কিছুক্ষণ হাটতে পারি?

বাবাঃ চল নেমে পরি।

আমি আর বাবা CNG থেকে নেমে নিকুঞ্জ এর ভেতর দিয়ে হাটতে লাগলাম। খুব সুন্দর নিরিবিলি একটা পরিবেশ। এরই মাঝে ৪ টা বেজে গেছে।

আমিঃ বাবা তোমাকে যদি অক্টোপাস ভাঁজি খেতে দেয়া হয়, তুমি খাবা??

বাবাঃ আমাকে এতো জিনিষ থাকতে এই জিনিষ খেতে দেয়া হবে কেন?

আমিঃ না এমনি জিজ্ঞাসা করলাম।

বাবাঃ তুই খেয়েছিস?

আমিঃ হুম! মজা আছে।

বাবাঃ নামাজ তো পরিস ই না, তার ওপর হাবি জাবি জিনিষ খাচ্ছিস। আর কি কি খেয়েছিস?

আমিঃ অনেক কিছু! বাবা আমরা প্রতি রবিবার সব বন্ধু রা মিলে ওখানে একটা পার্টি দেই। বেশ মজা করি। কিন্তু তোমরা থাকলে অনেক মজাই হতো।

বাবাঃ মদ ও কি খাশ?

আমিঃ এমমম! মাসে ২ বার!

বাবা সাথে সাথে হেসে ফেললেন।

বাবাঃ তুই আরও বেশি খাশ। মিথ্যা বলার দরকার নেই।

আমি আর বাবা হাটতে হাটতে কখন যে গ্রামিন ফোন এর অফিস ছেড়ে চলে এসেছি খেয়াল করিনি। ঠিক সামনেই একটা রাস্তা আছে বাম দিকে মেইন রোড এর সাথে। আমি আর বাবা এই রোড টা ধরে হাটতে লাগলাম। দুপাশের গাছ গুলো অনেক বড় হয়ে মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে। এই ছোট রোড টা একদম বিমান বন্দর এর ভিআইপি টার্মিনাল পর্যন্ত চলে গেছে।

আমরা ওখান থেকে ২৭ নং বাস এ করে জশিম উদ্দিন রোড এ গিয়ে থামলাম।

আমিঃ বাবা চল বাউনিয়া যাব।

বাবাঃ দেরি হয়ে যাবেনা তো!

আমিঃ নাহ চল।

আমি আর বাবা একটা রিকসা নিলাম।

বাবাঃ তোর সাথে ঐ মেয়েটার আর কথা হয়?

আমিঃ কোনটা?

বাবাঃ ঐ যে এখানে যে থাকতো?

আমিঃ নাহ! বাবা এখন আর হয়না। ওর কোন খবর নাই আমার কাছে।

বাবাঃ তোরা কি এই বাউনিয়া তে অনেক বেশি আসতি?

আমি অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলাম। ভাবচিলাম কি উত্তর দিবো!

আমিঃ হুম! বাবা আসতাম! যাই হোক বাদ দেও এগুলো এখন আর মনে করতে চাইনা।



আমি আর বাবা অনেকক্ষণ সেখানে ছিলাম। ঠিক মাগরিবের নামাজের পর আমি আর বাবা বড় আপুর বাসায় গেলাম ১০ নং সেক্টর এ। সেখানে মা আমার সব জিনিষ পত্র, লাগেজ সব রেদি ছিল।



আমি সাত দিনের জন্য দেশে এসেছিলাম। বাবার শরীর টা খুব খারাপ ছিল। আমাকে দেখে বাবা অনেক সুস্থ হয়ে গেছেন। বাবার সাথে একটা দিন নিবিড় ভাবে কাটানোর ইচ্ছা অনেক ছিল। আমি সেটা পেয়েছি। আমি ঠিক ১০.১৫ তে চলে যাব। ৭.১৫ টা বাজছিল তখন। একটু আগেই ঢুকতে হবে টার্মিনাল এ। আমি বাবা মা আর বড় আপু ৮.১৫ টা পর্যন্ত এক সাথে ছিলাম।



আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “বাবা আমি ফিরে আসা পর্যন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করো, আমাকে একা রেখে আবার যেওনা! কখনও মুখ ফুটে বলিনি তোমাকে অনেক ভালবাসি, কিন্তু তার মানে এই না যে বাবা তোমাকে ঘৃণা করি। তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসি বাবা।“

আমি ভুলেও বাবা কিংবা মার চেহারা এর দিকে তাকাইনি। শুধু টার্মিনাল এর বাহির থেকে দেখেছিলাম বাবা কেঁদেছিলেন। বাবা কে আমি দ্বিতীয়বার কাঁদতে দেখেছি। প্রথম বার আমি যখন HSC এর রেজাল্ট খারাপ করলাম তখন আর আজ।



-----X-----

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.