নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

....

কায়সার খসরু

আমি মানুষ হতে চাই

কায়সার খসরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

চেতন ফন্দি, অবচেতন অপেক্ষা

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৮:০৩



সারারাত তীব্র গরমে আধো ঘুম আধো জাগরণে বিছানায় ছটফটিয়ে সকালে আমিন যখন বিছানা ছাড়ার আয়োজন করছে সে সময় পৃথিবী শীতল করে নামলো তুলকালাম বৃষ্টি। ঘড়িতে সাড়ে ছয়টা। পৃথিবী আলোকিত হয়ে গেছে অনেক আগে। তবু বড় ভাইয়ের বকা-ঝকার তোয়াক্কা না করে আমিন সিদ্ধান্ত নিলো রাতের ঘুমটা পুষিয়ে নিতে আরেকটু সময় সে বিছানায় কাটাবে। দোকান না হয় আজ সে একটু দেরীতেই খুলবে।

একস্ট্রা ইনিংস ঘুম দিয়ে যখন আমিন বিছানা ছাড়লো তখন ঘড়িতে সাড়ে নয়টা। বড় ভাইয়ের হাঁক-ডাক নেই। নিশ্চয়ই সকাল-সকাল কোথাও গেছে। তবুও কখন আবার কোথা হতে উদয় হয়। আমিন হাত মুখ ধুয়ে নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়ে। বৃষ্টি এখনও ঢিমে তেতালে ঝরছে। রাস্তায় পানি উঠে গেছে অনেকটুকু। এভাবে ঘন্টা আধেক চললে দোকানেও পানি ঢুকবে। আমিন দোকানের কাছে আসতেই দেখে লুনা ভাবী দাঁড়িয়ে। আমিনকে দেখে যেন স্বর্গ পেল।
সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।
বৃষ্টি হচ্ছিলো, তাই- ।
আমি ভাবলাম আজ আর দোকান খুলবে না।

পাবলিক ফোনের দোকান আমিনদের। ফোন করতে এখন কেউ আর খুব একটা আসে না। এক পাশে একটা ফটোকপি মেশিন আছে। এক আধটু ওটার কাজ চলে। মোবাইল রিচার্জ আর মোবাইলে টাকা পাঠাতে-রিসিভ করতেই মানুষ আসে বেশী। চেয়ার-টেবিল মুছে লুনা ভাবীকে ভেতরে ডাকে আমিন।

লুনা ভাবী ওদের পাড়াতেই থাকে। স্বামী থাকে ঢাকায়। অনেকদিন হয়ে গেল স্বামী তার কোন খোঁজ খবর নেয় না। কেউ তার ঠিকানাও জানে না। জানে না কি কাজ সে ঢাকায় করে। কেবল একটা মোবাইল ফোন নাম্বার। লুনা ভাবীকে আমিনের ভীষণ ভালো লাগে। দুই-তিন বছর আগেও যখন লুনা ভাবীর বিয়ে হয়নি তখন পুরো পাড়ার উঠতি সব যুবক ছিল লুনা ভাবীর পাগল। অন্য সবার মত সেও চাইতো লুনা ভাবীর কাছে পাশে থাকতে। তখন সুযোগ ছিল না। মাদকাসক্ত রিপন কেমন করে যেন ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিয়ে করে ফেললো লুনাকে। তখন থেকে লুনা হয়ে গেল লুনা ভাবী। পাড়ার অন্য সকলের কপাল পুড়লো। বিয়ের কয়েক মাস পর রিপন ভাই উড়াল দিলো।
কোথায় কল করবেন, ভাবী?
তোমার ভাইয়ের নাম্বারে দাও।
নাম্বার ডায়াল করতে করতে আমিন ভাবে, লুনা ভাবীর সৌন্দর্য এখনও কমেনি কিছুতেই। রিপন ভাইটা যে কী- আচ্ছা, সেও তো নিতে পারে লুনা ভাবীর দায়িত্ব। সে নিশ্চিত, লুনা ভাবীর ফিগার এখনও বোম্বে নায়িকাদের চেয়ে কম সুন্দর না। বলবে নাকি সে কিছু লুনা ভাবীকে? বিয়েতে যদি সামাজিক সমস্যা হয় অন্যভাবেও তো সম্পর্কটা গড়া যায়!
হ্যালো, কথা বলেন। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করতেই লুনা ভাবীকে ধরিয়ে দেয়। লুনা ভাবী প্রথমে চুপ থাকে। তারপর নিত্যদিনের মত ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, ‘তুমি কবে আসবা? বাবুর অসুখ।‘ চক্রাকারে দশ-বারো মিনিট এই একই কথা চলতে থাকে। মাঝে মাঝে আমিনের খুব মেজাজ খারাপ হয়। ইচ্ছে করে লুনা ভাবীর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। পারে না। এমনটা করার মানুষ ও সে না। লুনা ভাবী কথা শেষে কত টাকা হয়েছে জেনে নিয়ে চলে যায়। তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে আমিন ভাবে, বাবুর অসুখ-এই কথা বলেও তো লুনা ভাবীর বাসায় যাওয়া যায়। রাত বারোটা-একটা যতটাই বাজুক যখনই ডাকুক, সে তো আছে।

দোকানের বর্ডার পর্যন্ত পানি চলে এসেছে। যে কোন সময় ভেতরে ঢুকবে স্যুয়ারেজের কালা পানি। কাস্টমার আসলে তাকে কালা পানিতে পা ভিজিয়েই আসতে হবে। নোংরা পানির গন্ধ আসছে। সেই সাথে পাশের মুরগির দোকানের নাড়ি ভুড়ি পচা গন্ধ। একটা রিকশা এসে থামলো প্রায় দোকানের বর্ডার ঘেঁষে। আরেকটু এদিক সেদিক হলে চাকা পড়াতো নালায়। কালা পানিতে পা না ভিজিয়ে কালো জামা পরা একটা মেয়ে নামলো রিকশা থেকে। সাবরিনা। আমিনের দোকানের নিয়মিত কাস্টমার।

কেমন আছেন আমিন ভাই? মেয়েটা প্রতিবার দোকানে ঢুকেই মিষ্টি হাসি হেসে একথাটা জিজ্ঞাসা করে। আমিনের খুব ভালো লাগে। মনে হয়, কত কাছের কেউ-কত আন্তরিক।
আমিন ভাই, এই নোটগুলো একটু ফটোকপি করে দেন।কালি একটু বেশী দেন যাতে পড়া যায়। আমিন খুশি হয়েই ফটোকপি আরম্ব করে কিন্তু তার এই ভালো লাগা বেশীক্ষণ থাকে না। যখনই সাবরিনা ফোনে কথা বলতে থাকে আমিনের মেজাজ চড়তে থাকে।
‘........ ও তাই। তাড়াতাড়ি চলে এসো বাড়ি থেকে। আমার একা একা একদম ভালো লাগছে না। তোমাকে খুব ফিল করছি। আম্মু বলেছে আমাকে আর মোবাইল ব্যবহার করতে দেবে না। বের হতে গাড়ী ভাড়া ও দিতে চায়না.......... তুমি আসো জান। তোমাকে খুব ফিল করছি। ’
সাবরিনার কথা শেষ হয়। আমিনের ধড়-ফড়ানি তবু বন্ধ থাকে না।
আমিন চেয়ে থাকে সাবরিনার দিকে। কালো জামায় মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। সাবরিনাকে অনেক দিন ধরে মনে মনে পছন্দ করে আমিন। যোগ্যতা তার কম কিসের? বি এ টাই শুধু পাস করতে পারলো না। সাবরিনা আবার কথা শুরু করে।
‘....... ছেলেদেরকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। ও-তাই-না?আমার কথা বিশ্বাস হয় না। ঠিক আছে দেখা যাবে তোর দৌড়... ধরা খেয়ে যখন পস্তাবি এই সাবরিনাকে মনে করবি...... বাবা আবার ঢাকায় যাক সময় করে আরেকদিন ....... আচ্ছা ঠিক আছে ভালো থাকিস।’

বিল দেওয়ার সময় ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে আমিনকে দেয় সাবরিনা। প্রতিদিনই দেয়। দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা করেই আবার চলে যায় সাবরিনা। চকোলেটটার দিকে তাকিয়ে আমিন ভাবে সাবরিনার এই চকোলেট দেওয়ার অর্থ কি? এই রাস্তাটার শেষে কাটা বটগাছ মোড় পেরিয়ে আরও অনেকটুকু পথ পেরিয়ে সাবরিনাদের বাসা। ওখানেওতো ফটোকপির দোকান আছে। সাবরিনা তবে এতটুকু পথ পেরিয়ে এখানে আসে কেন? কারণতো একটা নিশ্চয়ই আছে। চকলেটটা কি কোন ইশারা হতে পারে না? বলবে নাকি সে সাবরিনাকে কিছু? এরপর আরও অনেকে আসে রিচার্জ করতে, মোবাইল ব্যাংকিং করতে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কেউ আসে না।

আমিন সেই মেয়েটার কথা ভাবে, কি জানি নাম তার, সেহেনা। ঐ মেয়েটাকেও বাকি দিত আমিন, ধার দিত নগদ টাকাও। সেও লুনা ভাবীর মত ফোনে কান্নাকাটি করতো। আমিনের বড় ভালো লাগতো। ওর হাসিটা ছিল সেই। আর কথাও বলতো খুব সুন্দর করে। মাঝে মাঝে মেয়েটার জন্য বড্ড মায়া হতো আমিনের। কতবার ভেবেছে সেহেনাকে বলবে, তুমি তোমার কিছু কষ্ট আমাকে দিয়ে দাও। বলা হয়নি। সেহেনার কাছে আমিনের পাচশ টাকার মতন বাকী হয়েছিল। তারপর মেয়েটা অনেকদিন আসেনা। টাকার চেয়ে ওর জন্যই বেশি কষ্ট হতো আমিনের। তারপর অনেকদিন পর সেহেনা এলো। আমিনকে একটা ১০০০ টাকার নোট ধরিয়ে বললো, আপনার পাওনা। বাকীটা দিয়ে আপনি মিষ্টি খেয়েন। আমিন কি যে বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। যাওয়ার সময় সেহেনা একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললো, আমার বিয়ে, আসবেন কিন্তু। সেদিন সারাদিন আমিনের মেজাজ খারাপ ছিল। বাসার সবার সাথে খারাপ আচরণ করেছে। তরকারিতে নুন হয়নি বলে বাটি আছড়ে ভেঙেছে। কাজের ছেলেটার উপর হাত তুলেছে অযথা।

বৃষ্টি বাড়তে থাকে । বাড়তে থাকে কালা পানির গন্ধ, মুরগীর নাড়ি ভুড়ি পচা গন্ধ। এই বৃষ্টিতে কাস্টমার আর আসবে বলে মনে হয় না। তবু আমিন বসে থাকে। একদিন সেহেনা হয়তো ঠিকই এসে বলবে, আমি ভুল পৃথিবীতে ছিলাম। এতদিন মুখোমুখি বসে জানতে পারিনি তুমি আমাকে এতটা চাও।

কিংবা আসতে পারে লুনা ভাবী, ‘চলো না আমিন, বাবুর অসুখটা বেড়েছে, হাসপাতালে যেতে হবে।‘

সাবরিনাও কি আসতে পারে না, এসে বলবে-‘ চলেনতো আমিন ভাই, আপনাকে নিয়ে আজ সারাদিন ঘুরবো।‘

না, অলৌকিক কিছু ঘটে না।
বৃষ্টি আরও বাড়ে সেই সাথে আকাশে মেঘের গর্জন।
গর্জনটাই শুধু শোনা যায়।
আলোর দেখা মেলে না।
* হিম শ্রাবণে একমুঠো জোনাকির উষ্ণতা গল্পগ্রন্থে সংকলিত

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৯:১৭

অপ্‌সরা বলেছেন: আহারে কোথাও তাহার হারিয়ে যবার নেই মানা মনে মনে।

আহারে আমিন। :(

২| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১১:১২

শেরজা তপন বলেছেন: @ব্লগার কায়সার খসরু- ভাল লিখেছেন!
* হিম শ্রাবণে একমুঠো জোনাকির উষ্ণতা গল্পগ্রন্থে সংকলিত~ কবে প্রকাশ করেছেন?

৩| ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:০৮

কায়সার খসরু বলেছেন: অন্যপ্রকাশ,বইমেলা ২০২২।

৪| ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:৪২

অঙ্গনা বলেছেন: বই এর নাম টা অনেক সুন্দর।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.