নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

....

কায়সার খসরু

আমি মানুষ হতে চাই

কায়সার খসরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

না আলোতে,না আধাঁরে

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:২৫



দুই গ্রুপের মারামারির পর ভার্সিটিতে ধর্মঘট। কতদিন চলবে কে জানে। সজল মনে মনে খুশিই হয়- দূর! প্রতিদিন বাইশ কিলোমিটার যাওয়া আসা ভালো লাগে না। তার চেয়ে ঘরে বসে ইউটিউবে হিন্দি গান দেখা আর জম্পেশ ঘুম অনেক ভালো। মৃদুল বলেছিল ডার্কের নতুন সিজন রিলিজ হয়েছে । ডার্কের নতুন সিজনটাও দেখা দরকার। দুপুরে একটা জাম্পেশ ভাত ঘুমের পর বিকেলে ছোট বোনের ডাকে সজলের ঘুম ভাঙলো। তার সাথে কোন মেয়ে নাকি দেখা করতে এসেছে।
কে, লিজা নাকি? শালী ইঙ্গিত বোঝে না। সেদিন তার হাত ধরেছিল বলে সে কী রাগ! আজ তবে কি চায়?

ড্রয়িং রুমে গিয়ে অবাক হয় সজল। লিজা নয়, বসে আছেন মৃত্তিকা আপু। সৈকত ভাইয়ের প্রাক্তন । চেহারায় কেমন উদ্বিগ্নতার ছাপ। সৈকত ভাইয়ের সাথে মিটমাটের পর এক বছর হলো বিয়ে করেছেন। সজলকে দেখে যেন কেঁদে ফেলবে।

কোন রকম আড়ষ্ঠতা না করেই মূল কথায় চলে গেলেন, এর মধ্যে সৈকতের ওখানটায় গিযেছিলে তুমি? রাজীব বললো না খেয়ে একেবারে শুকিয়ে গেছে। শরীরে অনেক রোগও নাকি বাসা বেঁধেছে।
কই! আমিতো জানি না।
তবে ভাই একবার যেও। দেখে এসে সৈকতের খবরটা আমায় জানিও।

সৈকত ভাইয়ের বাসায় গেলে সজলের মানিক বাবুর কথা মনে হয়। সৈকত ভাইকে মনে হয় রাজকুমার। আর তার বাসাটাকে মনে হয় চতুষ্কোণ । যেখান থেকে কেবল প্রশ্নের উদয় হয়। পার্থক্য এই অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজে খুঁজে উনি এখন বড় ক্লান্ত। অথচ এইতো সেদিনও তিনি কতসব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন সজলের দিকে- দেখো, বিশ্বায়নের কি ক্ষমতা। আমরা যখন সাম্প্রদায়িকতা আর জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতা থেকে বিশ্বকে মুক্ত করবো বলে পণ নিলাম তখন জানলাম সাম্প্রদায়িকতা আর জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি এবং ধ্বংস সেও এখন পুঁজিপতিদের হাতে। ওরা চাইলেই পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যে উস্কে দিতে পারে সাম্প্রদায়িকতা কিংবা জাতীয়তাবাদ। প্রয়োজনে পারে ধ্বংস করতেও। আমার বাঙালীত্ব-মুসলমানিত্বও ওদের হাতের মুঠোয়।

তার কথাগুলো সজল আগা-মাথা কিছুই বুঝতো না। সবকিছুই কেমন স্ববিরোধী আর এলোমেলো মনে হতো। তবুও তার কথা শুনতে ভালো লাগতো। সজল বুঝতে চাইতো যখন উনি বলতেন- সমবায় পুঁজির হাতে এখন বিশ্ব বন্দি। ওদের সবকিছু চলে নিয়মতান্ত্রিক। আমাদের চার পাশের অভুক্ত মানুষগুলো ওদের নিয়মতান্ত্রিকতারই সৃষ্টি। কিন্তু তুমি যখন ওদের বুঝতে যাবে তখন তোমাকে বুঝতে হবে অনেক জটিল সম্পর্ক, যেমনঃ মানুষ-মানুষ, অতীত-বর্তমান দ্বন্দ্ব, মানুষ-প্রকৃতি, রাষ্ট্র-মানুষ বিশ্ব এবং এমন অনেক হাজারো সম্পর্ক। এইসব হাজারো সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে তুমি পড়ে যাবে গোলক ধাঁধায়। মনে হবে এর যেন কোন সমাধান নেই।

সৈকত ভাইয়ের বাসায় আগে সজলের নিয়মিত আড্ডা ছিল। প্রাত্যহিক জীবনের গল্পের মাঝে মাঝে সৈকত ভাই গল্প করতেন জীবন জটিলতার। কিন্তু এখন! সৈকত ভাইয়ের মাঝে যেন জীবনের সব ক্লান্তি। উনার দরজায় কারাো করাঘাতে উনি বিরক্ত হন। অবিশ্বাসের কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন-কে? তারপর দরজা খুলে যাকেই দেখেন, বলেন-
‘তোর চোখে কালি?
ক্লান্ত বুঝি?
প্রশ্নগুলো সব জ্বালিয়ে মারছে?
উত্তরের পিঠে শুধু প্রশ্নের জন্ম হয়,তাই না?
ঘুমোসনি অনেকদিন?
তবে আয়, ঘুমিয়ে পড়ি।’

সৈকত ভাই এখন অস্বাভাবিক। নতুন কোন তথ্য দিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি করেন না। কেবল ঘুমুতে চান, ঘুম পাড়াতে চান। উনার আত্নীয়-স্বজন-পরিচিতজনরা সবাই আফসোস করেন , বেচারা! বেশী পড়ালেখা করে করে অল্প বয়সেই পাগল হয়ে গেল!
কেউ কেউ বলেন, না একটা চাকুরী হলো, না একটা সংসার হলো। অবিশ্বাসীদের এমনই হয়।

অথচ সৈকত ভাই এমনটা ছিলেন না। এইতো সেদিনও কেমন সতেজ ছিলেন। কেবল প্রশ্নের জন্ম দিতেন সমাধান খুঁজে পেতে। প্রশ্ন অনেক কিন্তু সমাধান হবে একটাই। উনি বলতেন- এক একটা মানুষের ভেতর বাস করে অসংখ্য উপমানুষ। এসব উপমানুষ গুলোর মধ্যে সবসময় লেগে থাকে দ্বন্দ্ব। এক পক্ষে থাকে মানববৃত্তি আর আরেক পক্ষে থাকে পশুবৃত্তি। উপমানুষগুলোর পশুবৃত্তি থাকে বেশী শক্তিশালী। মানুষ প্রথম সংগ্রাম করে তার নিজের সাথে। তার নিজের ভেতরকার সবকটা পশুকে মেরে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। এর জন্য তার হাতিয়ার ছিল নিজস্ব বোধ, সাহিত্য- সংস্কৃতি । সেই হাতিয়ার এখন পুঁজিপতিদের হাতে। ওরা তৈরি করেছে এক শক্তিশালী সংস্কৃতি। ওরা একে ব্যবহার করে মুনাফা লাভের জন্য। তাই মুনাফার স্বার্থে ওরা জাগিয়ে তোলে মানুষের ভেতরকার সবকটা পশুকে। মানুষগুলো সব মরে যায়। রয়ে যায় কেবল দেহটা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজ্যান্স বলো আর হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা বলো সে যেমনে নাচায়, আমরা তেমনি নাচি।

আজ যদি সৈকত ভাই সুস্থ থাকতেন তবে সজল উনাকে হয়তো বলতো- ওসব বিশ্ব পুঁজিটুজি আমি বুঝি না। তবে এটা সত্য একজন মানুষের ভেতর বাস করে অনেকগুলো উপমানুষ। তাইতো মৃত্তিকা আপুর ভেতরের একজন মানুষ আপনার উপর অভিমান করে ঘর বাঁধে, আরেকজন আবার আপনার কথা ভেবে সারাবেলা কাঁদে।

সজল সৈকত ভাইয়ের বাসায় আসতো পদার্থবিদ্যা বুঝতে। বলবিদ্যার অংকগুলো এক একটিকে তার মনে হতো জীবন্ত বিস্ময়। সৈকত ভাই বুঝাতে পারতেন ভালো। আর একটা ব্যাপার ছিল উনার বাসায়, পেঁয়াজ-মরিচ আর সরিষের তেলে মাখা মুড়ি খাওয়া যেত নিয়মিত। মাঝে মাঝে সজলও হুট করে প্রশ্ন করে বসতো- সৈকত ভাই, আপনি যাই বলেন বিশ্বতো আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রায় এবং জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে আপনি বহুজাতিক পুঁজির সফলতাকে কিভাবে এড়াবেন?
ঝালে আর ঝাঁজে ভরা মুড়ি চিবুতে চিবুতে উনি বলতেন- হ্যাঁ,তাইতো। জীবনযাত্রার মান এখন অনেক উন্নত হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের নাগরিক হয়েও আমাদের যদি মনে হয় আমরা ভালো আছি তবে তো স্বীকার করতেই হয় আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। কিন্তু এই দেখ এই সময়ে তরুণ বৃদ্ধ সকলে ব্যস্ত হাইব্রীড সংস্কৃতির চর্চায়। সোশাল মিডিয়া, মাদক, পর্নোগ্রাফি, অপ্রকৃতিস্থ যৌনতা, ফাস্টফুড এতসব সুখের উপাদানে সুখে না থেকে কি উপায় আছে? আসলে সুখের মূল্যবোধটা কি? আবার চারপাশে হাজারও মানুষকে অসুখে রেখে সত্যিই কি সুখে থাকা যায়? আমরা মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী বৃত্তে পড়ে আছি বলে না চিনতে পারছি শোষকদের, না চিনতে পারছি শোষিতদের, বুঝতেই পারছিনা জীবনকে। চোখ মেলে দেখ আমাদের চারপাশে সেই মানুষগুলোর সংখ্যাই অনেক অনেক বেশী বিশ্বপুঁজি যাদের একমুঠো সুখ দিতেতো পারেনি বরঞ্চ কেড়েছে। আর সুখ দিতে পারবেও না। কারণ ওদের দুঃখের বিনিময়েই আমাদের এই হাইব্রীড সুখ। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ আর মুনাফাকে কন্ট্রোল করতে পারছে না, মুনাফাই মানুষকে কন্ট্রোল করছে।

সজল অতসব বুঝতে চাইতো না। চাইতো না অন্যের ভালো থাকা না থাকার ব্যাপারটি তার মস্তিষ্কে ঠাই দিয়ে নিজের জীবনের ভালোলাগাগুলোকে নষ্ট করে ফেলতে । সে জানে, survival of the fittest ই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য।

তবুও সৈকত ভাইয়ের কথা শুনতে ভালো লাগতো। ভালো লাগতো পেঁয়াজ-মরিচ আর সরিষার ঝাঁজ মেশানো মুড়ি ।এখন গল্প শোনা হয় না। এখন মুড়ি খাওয়া হয় না। সৈকত ভাইয়ের কণ্ঠে শুধু ঘুমিয়ে পড়ার আহবান-
‘তোর চোখে কালি?
ক্লান্ত বুঝি?
প্রশ্নগুলো সব জ্বালিয়ে মারছে?
উত্তরের পিঠে শুধু প্রশ্নের জন্ম হয়, তাই না?
ঘুমোসনি অনেক দিন?
তবে আয় ঘুমিয়ে পড়ি।’

মৃত্তিকা আপুর কথা রাখতে সব কাজ বাদ দিয়ে সেদিন সন্ধ্যায়ই সজল অনেকদিন পর আবার সৈকত ভাইয়ের দরজার সামনে দাঁড়ালো। দরজার ওপাশে সৈকত ভাই ঘুমোচ্ছে নিশ্চয়তার ঘুম। সজল কড়া নাড়ে। প্রথমে আস্তে। তারপর জোরে। কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দাড়িয়ে থেকেই সজল সৈকত ভাইয়ের সাথে শেষ আলাপটা মনে করে। সেদিন সৈকত ভাই বলেছিলেন - আমার চারপাশে গ্লোবাল সংস্কৃতির মারাত্মক সব উপাদান। এগুলো কেবল আমার ভেতরের সব পশুগুলোকে বের করে আনতে চায়। তাই ভাবছি সব প্রশ্নের ইতি টেনে সবগুলো উপমানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখবো।
সজল আবার কড়া নাড়ে। জোরে, জোরে।
দরজা খুলে দেয় সৈকত ভাইয়ের প্রেতাত্মা। দরজা খুলেই আবার মেঝেতে পাতা তার শক্ত বিছানায় শুয়ে মুহর্তে দুই চোখ বন্ধ করে ফেলেন। সৈকতের আগমন যেন প্রত্যাশিত এবং এজন্যই তিনি অপেক্ষা করছিলেন।
সৈকত ভাই ,আমি সজল।
হ্যাঁ, কেমন আছিস?
আমাকে মৃত্তিকা আপু পাঠিয়েছেন আপনার খবর নিতে।
ও কেমন আছে?
ভালো।
ওর মেয়েটা কেমন আছে? কি যেন নাম গৌধূলি-!
সজল এই প্রশ্নের জবাব কি দেবে ভেবে পায় না। কারণ মৃত্তিকা আপুর কোন সন্তান নেই। তবুও একটা উত্তর দেয়, ভালো।
তোমার খাওয়া দাওয়া হয়েছে? সজল প্রশ্নটা করে একবার সৈকত ভাইকে দেখে নেয়।
খেয়েছি। তুই-? চোখ খুলে সৈকত ভাই তার পাশে রাখা অনেকগুলো কলা থেকে একটা তুলে দেয় সজলের হাতে। সৈকত ভাইকে এখন মনে হচ্ছে একেবারে সুস্থ। সৈকত ভাইয়ের এমন দ্বিমুখি আচরণে সৈকত সংশয়ে পড়ে। তারপর অনেকক্ষণ নীরবতা। সৈকত ভাইয়ের চোখ বন্ধ।

সজল কথা এগিয়ে নিতে হুট করে বলে,জানো সৈকত ভাই বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা এখন ভীষণ বিশৃঙ্খল।। আন্তজার্তিক সম্পর্কের কিছুই আগের মতো অনুমান করা যাচ্ছেনা। শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ ফান্ডের অবস্থা করুণ। বিদেশীদের থেকে তাদের কঠিন শর্তে ঋণ নিতে হবে। চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ..........। হঠাৎ সৈকত ভাই উঠে দাঁড়ায়। গলা টিপে ধরে সজলের। জোর করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিতে চায়।
চুপ কর হারামজাদা! ঘুমা। এখন ঘুমাবার সময়।
সজলের দম বন্ধ হয়ে আসে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। সৈকত ভাইয়ের আঁচড়ে তার মাংস ছিড়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। দরজা খুলে দৌড়ে বেরিয়ে আসে সজল।
বাইরে এসেই সে ফোন করে মৃত্তিকা আপুকে।
মৃত্তিকা আপু, এখন তোমার সৈকত ভাইয়ের পাশে থাকা ভীষণ দরকার।



* হিম শ্রাবণে একমুঠো জোনাকির উষ্ণতা গল্পগ্রন্থে সংকলিত

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.