নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

....

কায়সার খসরু

আমি মানুষ হতে চাই

কায়সার খসরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

সংশয়ের বৃষ্টি

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:৪৯


একদিন কবে, দিন ভ’র বৃষ্টিতে, শেষ বিকেলে শিল্পকলায় মেতেছিলাম আমরা। আমি আর কঙ্কা। সে আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল, বলোতো মন কি?আমি বললাম, স্নায়ুকোষে জমে থাকা অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট বুদ্ধি, এ দুয়ের যোগসাজশের ফলাফল হল মন। মন বলে তাই আলাদা কিছু নেই।শুনে কঙ্কা বলেছিল, তুমি একটা শয়তান। আমি শয়তান কিনা জানিনা। তবে কারও অমঙ্গল করি না। কারও বিশ্বাস ভঙ্গ করি না। তবে খুব হিসেব কষি, আজও যেমন কষছি। সম্পর্কের বৃষ্টি, বৃষ্টির সাথে সম্পর্ক। আর সংশয়ে থাকি কঙ্কাকে ঘিরে আবর্তিত আমার পৃথিবী নিয়ে। প্রতিক্ষণ তাকে হারানোর ভয়ে ভীত থাকি। কাছে পেরে যতটুকু ভালবাসা যায় ততটুকু দিয়ে তার মন ভরাতে চাই। আবার সংশয়ে- সন্দেহে ওর গলাও চেপে ধরি।বন্ধুরা বলে, এটা আমার ভালবাসা না, অবসেশন। আমার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত।

কবে জানি সিআরবি সবুজ পাহাড়ের মাঝে উদ্দেশ্যহীন ঘুরছিলাম আমরা। আমি আর কঙ্কা। দিনটা আমার জম্মদিন ছিল । বাসায় সবাইকে ম্যানেজ করে ঘর থেকে বের হতে তার অনেক কষ্ট হয়েছিল নিশ্চয়ই। করোনাকালে কীসের অজুহাত তুলবে? তবু সে চেয়েছিল সকল কাঁটা ধন্য করে প্রিয়জনকে একটা রঙিন দিন উপহার দিতে। বিদেশ থেকে তার বাবা একটা মালটিপ্লেয়ার এনেছিল তার জন্য । রেপিং পেপারে মুড়ে সেটাই উপহার দিল আমাকে । কীসের রোমান্টিকতা, কীসের ভালবাসা আমি তার গলা চিপে ধরি - জানোয়ার, তোর মোবাইল বন্ধ ছিল কেন? মোবাইল কেন বন্ধ থাকে আমি বুঝিনা? মাল্টিপ্লেয়ারটা আছড়ে ফেলি চলন্ত রিকশা থেকে। তার ফর্সা গলায় আমার আঙুলের কালো ছাপ আমার পশুত্বের স্বাক্ষী হয়ে যায়।রিকশাচালক রিকশা থামিয়ে কুড়িয়ে আনে ভাঙ্গা মাল্টিপ্লেয়ারটা।
কী আশ্চর্য এত কিছুর পরও সে আমাকে বোঝাতে চায়।
অভিমান ভাঙাতে চায়।
আমার রক্তে তবু অবিশ্বাসের বিষ।
পশুদের আছে নাকি কোন অনুভূতি, নাকি থাকে?

তুলকালাম বৃষ্টিতে আজ উত্তাল পৃথিবী। লাভলেন - ডিসি হিল ধরে হাঁটছি শাহ আমানত মার্কেটের উদ্দেশ্যে। বুক পকেটে আগলে রাখা সস্তা কবিতা ইতোমধ্যে ভর্তা। প্যান্টের বাম পকেটে আছে সেলফোন আর ডান পকেটে সেই নষ্ট মাল্টিপ্লেয়ার। মাঝে মাঝে বৃষ্টি চলে যাচ্ছে সেদিকে।

ভেজা কাক হয়ে একদল তরুনী রিকশায় চড়ে গেল হৈ চৈ করে।বৃষ্টির যথার্থতা যেন কেবল তারাই জানে।
হাঁটছি।
একা।
আজ বৃষ্টিকে এত আপন মনে হচ্ছে কেন?
বন্ধুত্বের কোটা শূণ্য। যন্ত্রের সাথেও হচ্ছেনা মিলমিশ ।বিশ্বাস-অবিশ্বাসের টানাপড়েনে ভালবাসা। সঙ্গী তাই বৃষ্টি।

শাহ আমানত মার্কেটে একটা মোবাইল সার্ভিসিং এর দোকানে গিয়ে পকেট থেকে মাল্টি প্লেয়ারটা বের করে দিই দোকানীকে।
কি হইছে।
চার্জারের পোর্ট নষ্ট। চার্জ হয় না।
ঠিক হতে সময় লাগবে। এই বলে তরুন ছেলেটা মুহূর্তের মধ্যে খুলে ফেললো মাল্টিপ্লেয়ারটা। তার বামে-ডানে, সামনে-পেছনে পড়ে আছে এমন খোলা-আধখোলা হাজারটা যন্ত্র। যন্ত্রাংশগুলোর মাঝে ছেলেটাকে আমার মনে হয় আশ্চর্য কারিগর একটার অঙ্গ খুলে আরেকটাতে লাগিয়ে সচল করে অচল।
হয় নাকি এমন সম্পর্কের ক্ষেত্রে?
জোড়া-তালি, ঝালানো-পোড়ানো?

আমার আর কঙ্কার সম্পর্কেও চলছে এমনটা। ঝালানো- পোড়ানো। সর্বদা সংশয়ে দুলি। এত সুন্দরী একটা মেয়ে, সত্যিই আমাকে ভালবাসে? ফাঁকি-ঝুঁকি নেইতো কিছু? বাথরুমে গেলেও মোবাইলটা সঙ্গে করে নিই। ওর নিজের ফোন নেই। লুকিয়ে মায়ের মোবাইল হতে কল করে। অনেক কষ্ট করে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা ফোন করবে, তাও যদি আমি মিস করি-। তাছাড়া হঠাৎ করেই সে ফোন করে বলতে পারে, তুমি কাজীর দেউড়ি দাঁড়াও- আমি আসছি। অভিমানের দিনগুলোতে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ইচ্ছে করে তাকে ফোন করি। জানতে ইচ্ছে করে সেও জেগে আছে কীনা। তারপর অভিমান শেষে অনেকদিন পর যখন তার সাথে দেখা হতো প্রথমেই আমার ঠোঁট চলে যেতো তার ঠোঁটে। দুহাত থাকতো তার কোমড়ে। দুজনের চোখেই থাকতো পানি। দীর্ঘসময় পর তার ঠোঁট থেকে ঠোঁট নামিয়ে পৃথিবীর অসহায়তম প্রাণী হয়ে বলি- আমাকে ক্ষমা করো, ছেড়ে যেও না প্লীজ।

আপনার মোবাইলের নেটওয়ার্ক আইসি জ্বলে গেছে। নতুন লাগাতে হবে। অনেক দাম পড়বে। পাশের আরেকজন কারিগর বলছে তার কাস্টমারকে।
ও, নতুন অঙ্গও তাহলে লাগানো যায়?
অনেক দাম!
হোক পুরনো কিংবা নতুন, একদেহের অঙ্গ আরেক দেহে হয় নাকি আপন কোনদিন?

মাল্টি প্লেয়ারটাকে এখন মনে হচ্ছে কতগুলো যন্ত্রাংশের স্তুপ মাত্র। সবাই আলাদা, আবার সবাই এক।

যন্ত্রাংশের জগৎ ছেড়ে মার্কেটের বারান্দায় এসে দাঁড়াই। বাহিরে এখনও তুলকালাম বৃষ্টি। ভেজা কাপড়ে শীত লাগছে এক-আধটু।
আপনার এটা চায়না মাল। ওয়ান টাইম। ঠিক হবে না। যেমন আছে তেমনে চালান। বারান্দা থেকেও দোকানির কন্ঠ শোনা যায়। কাকে যেন বলছে।
কিছু কিছু সম্পর্কও বুঝি হয় ওয়ান টাইম?
যেমন আছে তেমনি চালাতে হয়!
অঙ্গের অদল-বদল, ঝালানো-পোড়ানো, যত্ন-ভালবাসা কিছুতেই কিছু হবে না।

একদিন ভরা দুপুরে আমরা রিকশায় ছুটছিলাম । কঙ্কা হাত তুলে দেখালো দূরের কৃষ্ণচূড়া। আমি বলি কৃষ্ণচূড়ার গল্প থাক। চেয়ে দেখো, ভরা দুপুরে অতিজাগতিক নক্ষত্র জ্বলে। পীচ ঢালা পথে, সীসা আর কালো ধোঁয়ার ভিড়ে, দেখো এক ঝাঁক জোনাকি জ্বলতে জ্বলতে যায় নিভে, নিভতে নিভতে উঠে জ্বলে। সে হেসেছিলো। তারপর আবার কেঁপেছিলে ভয়ে। দৈত্যকার ট্রাক গিলে খেতে চায় নিরীহ রিকশা। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই সত্যি, কিন্তু সে অতিজাগতিক মুহূর্তে কী জানি কিসের স্পর্শে ভেবেছিলাম, এই অতিজাগতিক আলোকে কেননা দুজনে হারাই একসাথে। সেদিন দেড়-দুই ঘন্টা কোন গল্পের শাটলে চড়েছিলাম আমরা?
কবিতা কি শুনিয়েছিলাম কোন?
সুনীলের কোন কবিতা-
‘‘সখী, আমার তৃষ্ণা বড় বেশি, আমায় ভুল বুঝবে?
ড়ড়ডিজেল কিংবা মোবিল পোড়া গন্ধ নয়, ব্যস্ত শহরে হঠাৎ বুনোফুলের গন্ধ আসে। পীচ ঢালা পথে, ভর দুপুরে চাঁদ ভাঙে, বুনোফুলের সুবাস ভাসে। আমি পাশ ফিরে তাকে দেখি। ভর দুপুরে তার শরীরে চাঁদের আলো হাসে।
পাগল নাকি আমি?
অতি উম্মাদ কেউ?
ছিলাম নাকি এতটা সুখী কোনকালে?
তারপর- স্বর্গেও ঝড় ওঠে। সন্দেহের ভয়ালতায় আচ্ছন্ন হয় সুখ সময়। আগামী দিন সে থাকবে তো পাশে?
তারপর?
তারপরও আমি সংশয়ে দুলি।
রহস্যময়তা কেড়ে নেয় বিশ্বাস। নক্ষত্র থেকে ভেসে আসে অবিশ্বাসের বিষ। অতিজাগতিক অন্ধকারে পথ হারাই আমরা দুজন।
চোখে-চোখ।
হাতে-হাত।
কানে-ফিস ফিস।
কী আশ্চর্য, তবু সম্পর্কের কোন নাম হয় না।
সংশয়ের বৃষ্টি ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব।
এই যে ভাই শুনুন। আমাকেই ডাকছে কারিগর। এগিয়ে গেলাম। দেখি শীত বৃষ্টিতেও কারিগরের কপালে ঘাম।
ভাই, আপনার এটা ঠিক হবে না।
ঠিক তবে হবে না!
হ্যাঁ, এটাও কি চায়না মাল?
ওয়ান টাইম!!
প্রধান কারিগর এগিয়ে আসে। মাল্টিপ্লেয়ারের এলোমেলো অবস্থা দেখে রেগে উঠে। যে কাজে বিশ্বাস নেই, সে কাজে হাত দিলে কেন?
আশ্চর্য!
শুধু ঝালানো-পোড়ানোতে চলবে না।
অঙ্গের অদল-বদলে হবে না।
সেবা-যত্নেও হবে না।
বিশ্বাসটাও চাই।
মাল্টিপ্লেয়ারটা নিয়ে এখন প্রধান কারিগর ব্যস্ত। চায়না মাল! ওয়ান টাইম!! তবুও তার বিশ্বাস আছে, সে পারবে।

কঙ্কার সাথে শেষবার দেখার কথা মনে করার চেষ্টা করি। ওর বাসা থেকে কলেজে যাওয়ার মাঝখানে পড়ে কাজীর দেউড়ি।বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে আছি তার জন্য। অবশেষে সে এলো। রিকশায়। তার পাশে বসা আরেকজন যুবক। দ্রুত চলে যাওয়া রিকশায় বসেই সে যেন আড়চোখে একটু তাকালো মাত্র। কিছুই বললো না। আমি অস্থির হয়ে উঠি। কে এই যুবক? ঘন্টাখানেক পর একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে সে বললো- সরি, জান। তুমি থাকো। ফেরার পথে তোমার সাথে মিট করবো। সে আসে।দুজনে একটা মার্কেটে পাশাপাশি হাটছি। হঠাৎ আমি তার গলা চেপে ধরি- অন্য বেটার সাথে ঘুরতে তোর অনেক ভালো লাগে তাইনা?
ও অসহায়ের মতো বলে- ছি! উনি আমার মামা।

প্রধান কারিগর ঠিক করে ফেলেছেন মালটি প্লেয়ারটা।চারজার কানেক্ট করে বললো , দেখেন চার্জ হচ্ছে।আমি আশ্চর্য হই। বিশ্বাসে তবে সব মেলে।

বৃষ্টিটা কমে আসছে। থেমে যাবে যে কোন সময়। আরেকবার ভিজতে ইচ্ছে করছে। বৃষ্টি, আমি তোমায় সত্যিই ভালবাসি! তুমি ধুয়ে মুছে নিয়ে যাও আমার ভেতরকার যত সংশয়-অবিশ্বাস। আমি শেষবারের মত কঙ্কার সামনে দাঁড়াবো, আমার সবটুকু বিশ্বাস নিয়ে ।





* হিম শ্রাবণে একমুঠো জোনাকির উষ্ণতা গল্পগ্রন্থে সংকলিত

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:০৭

মনিরা সুলতানা বলেছেন: যন্ত্রাংশগুলোর মাঝে ছেলেটাকে আমার মনে হয় আশ্চর্য কারিগর একটার অঙ্গ খুলে আরেকটাতে লাগিয়ে সচল করে অচল।আমি আশ্চর্য হই। বিশ্বাসে তবে সব মেলে।

গুছিয়ে লেখা, চমৎকার !!
আপনার হিম শ্রাবণে একমুঠো জোনাকির উষ্ণতা গল্পগ্রন্থ কী প্রকাশিত হয়েছে ? প্রকাশিত হয়ে থাকলে, সংগ্রহ করা যাবে ?

২| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৮

কামাল৮০ বলেছেন: মানুষের কল্পনা করার যে শক্তি,যেটা আসলে করে মস্তিস্ক,সেটাকেই আমরা মন বলি।এর সাথে যুক্ত করে প্রান।মন প্রান মস্তিষ্কের কাজ ছাড়া আলাদা কোন কিছু না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.