নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কবি। কবিতা লিখি আর মানুষের সুন্দর কবিতা গুলো দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছাই হই।

রুবাইয়াত নেওয়াজ

কবিতা লিখি গান গাই মাঝে মাঝে গীটার বাজাই

রুবাইয়াত নেওয়াজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

নীলপদ্ম (রীপোষ্ট)

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:১৫

কনক্রীটে হাতুরী পেটানোর অসহ্য শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তন্ময়ের, কপালের বাম পাশের শিড়াটা দপদপ করছে। বালিশের নিচে রাখা মোবাইলে সময় দেখে নিল, দুপূড় ১:৪০। সময় দেখার সময় তিনটা মিস কল চোখে পড়ল। হাসপাতাল থেকে হয়তো। আবার জরীও হতে পারে, চোখ কচলে মোবাইলটায় চোখ দিয়ে দেখে না জরী না, হাসপাতাল থেকে দুইবার, আর সামাদের মোবাইল থেকে একবার কল এসেছে।
সামাদের কাছ থেকে কেন ফোন আসবে? চিন্তিত মুখে ভাবল তন্ময়। কাল রাত সারে তিনটা পর্যন্ত একসাথেই তো ছিল। হাসপাতাল থেকে আবার ফোন এল, বিরক্ত মুখে তন্ময়বল্ল
হ্যালো।
ওপাশ থেকে কর্কশকন্ঠী এক মহিলার গলা
-ড: খান বলছেন?
-হ্যা। কে বলছেন?
-ডক্টর আমি রোকেয়া হাসপাতাল থেকে নার্স জেসমিন বলছি।
-হ্যা বলেন!
-ডক্টর আপনি কাল সকালে যে পেশেন্ট কে এডমিশান দিয়ে গিয়েছিলেন, উনি কিছুটা আনস্ট্যাবল। ডক্টর হাসান তাকে সিডেটিভ দিয়ে গেছেন, আর বলে গেছেন আপনাকে যেন জানানো হয়। এই মুহুর্তে পেশেন্টের প্রেশার আনস্ট্যাবল। আপনি কী আসতে পারবেন?
-আমি তো লিখে দিয়েছি তার ইমিডিয়েট সার্জারি প্রয়োজন। তাকে তো আমি সার্জন হারুণ কে রেফার করে দিয়ে এসেছি।
- জ্বী, স্যার এসে দেখে গেছেন। পরশু রাতে ওটি শিডিউল।
-পরশু? কিন্তু রোগির তো ইমার্জেন্সী সার্জারী দরকার। ইনটেস্টাইনে ছোট একটা পারফোরেশান দেখলাম। আমি রিপোর্টে লিখে দিলাম, ড: হারুণ কী আমার রীপোর্ট দেখেন নি?
- স্যার দেখেছেন। কিন্তু উনি তো শিডিউল দিলেন না। ডক্টর অাপনি একটু আসবেন, পেশেন্টের ফ্যামিলি আপনাকে চাচ্ছে।
-এখন শিডিউল কার?
- ড: জরী। উনি বলছেন আপনাকে একবার আসতে।
- ও আচ্ছা!
এক মুহুর্ত ভাবল তন্ময়, তারপর বলল
- আমি আসছি।

তন্ময় পেশায় একজন ডাক্তার। পাশ করে বেরিয়েছে প্রায় চার বছর হতে চলল। জরীর সাথে তন্ময়ের পরিচয়, মেডিকেল কলেজের প্রথম দিন থেকেই। দুজনের স্বপ্ন ছিল একদিন অনেক বড় ডাক্তার হবে। নিজেদের একটা ছোট্ট দোতালা বাড়ি হবে, একটা নিজেদের হাসপাতাল। ব্যাস্ততা মুখর, মানব সেবার সুখি জীবন।

কিন্তু ইন্টার্ণি শেষ করার পর যখন ডাক্তার হয়ে বের হয়ে এল বাস্তবতা টের পেল দুজনই। এম বি বি এস ডাক্তারকে কেউ ডাক্তার ভাবেই না। সামান্য কাশি হলেও মানুষ আজকাল এফ সি পি এস, এফ আর সি এস খোজে। তন্ময় খুব চেষ্টা করল, প্রথম দুই বছর। তারপর যেন হাল ছাড়া হয়ে গেল।

জরী চেষ্টা করত তন্ময়কে সাহস দেবার। তন্ময় খুব মেধাবী ডাক্তার, যে কোন সমস্যা চট করে ধরে ফেলতে পারে। আর প্রচন্ড সুইফট ডিসিশান নিতে পারে, একজন দক্ষ ডাক্তার হবার সব গুনাবলী তার আছে। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় সমস্যা মানিয়ে না নিতে পারা। এখন পর্যন্ত তন্ময় পাঁচটা হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছে, শুধু তার আপোষহীণ ব্যাক্তিত্বের জন্য। এফ সি পি এস ফার্স্ট পার্ট শেষ করে আর করলো না। তার ভালো লাগে না এসব লবিং, পা চাটা জীবন। মাঝ খানে কিছুই করত না। এই তো পনেরদিন হল জরীর সাথে এসে রোকেয়া ক্লিনিকে জয়েন করেছে। ক্লিনিকের ডিরেকটার জরীর পরিচিত, অনেক বলে কয়ে জরী তন্ময়কে চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছে, জরী জানে তন্ময় ভেতরে ভেতরে ভেঙে যাচ্ছে। ডাক্তারী পেশা যে এক বিরাট ব্যাবসার অংশ, তন্ময় কিছুতেই মানতে পারছে না। আর দিন দিন যেন আরও বেশীই রগচটা হয়ে যাচ্ছে। সিস্টেমটাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। জরীর তেমন সমস্যা হয় না। প্রথম প্রথম লাগত কিন্তু এখন লাগে না। কিন্তু তন্ময় কিছুতেই পারছে না। কথায় কথায় গালি দেয় নিজে কে পেশা কে। চোখ দুটা প্রাণ হীন, নেশা টেশা করে না তো?

তন্ময় ক্লিনিকে পৌছুতেই দেখল রুগী যায় যায়। প্রচন্ড ব্যাথায় রুগী গোঙাচ্ছে। প্রেশার অনেক নিচে। প্রেশার বাড়ানোর জন্য জরী সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করছে।কপাল চিক চিক করছে ঘামে।
-প্রেশার বাড়ছে ?
-না। প্রচন্ড ব্যাথা। এক্সরে রীপোর্টে দেখলাম ফ্লুইড লিক হচ্ছে।
-ডোপামিন পাচ্ছে?
- হ্যা
-ডা: হারুন?
-আসছেন।
তন্ময় প্রেশার দেখল! ৫৫/২৫
রুগী চোখ খুলে তন্ময়কে দেখেই বলে উঠল।
-ডাকতার আমারে বাচান, আমার ছোট একটা মেয়ে আছে।
-শান্ত হন আপনি, সব ঠিক হয়ে যাবে।
নার্সকে এডমিশান রীপোর্ট আনতে বলল তন্ময়, দেখল রুগী ভর্তির সময় প্রেশার ছিল ১০০/৬০। দেরী হয়ে গেছে।

এর মাঝে সার্জন ডা: হারুন আসলেন, সাথে এনেসথিওলজিস্ট ডা: আরমান। রুগীর অবস্থা নাজুক দেখেই বুঝে গেলেন।ডা: হারুন বললেন লেটস গো ফর ইট।
কিন্তু ডক্টর আরমান বললেন।
- প্রেশার টু লো। এই অবস্থায় এনেসটেশিয়া দেয়া যাবে না।
আই নীড মিনিমাম নাইনটি বাই ফিফটি।
পেশেন্ট এর বয়স, ৩৫ বছর। তন্ময় কে বলা হল, পেশেন্টের ফ্যামিলীকে কনসাল্ট করতে। তন্ময় ঠিক বুঝতে পারছিল না সে কী বলবে।

বারান্দায় একজন অল্প বয়সের রোগা তরুণি দাড়ানো। চোখে মুখে শংকা। কোলে বছর দুইয়ের একটা শান্ত মেয়ে। মেয়েটার ক্ষুদা লেগেছে মনে হয়, বিরক্ত হয়ে দেখছে চারপাশ। কিন্তু এইরকম থমথমে পরিবেশে কী করবে যেন বুঝতে পারছে না। তাই মায়ের কোলে চুপ করে বসে আছে। তন্ময় জানতে পারলো ঢাকায় পেশেন্টের কোন আত্মীয় স্বজন নেই। পেশেন্টের স্ত্রীকেই খুলে বলতে হল সব যে পেশেন্টের অবস্থা নাজুক। অপারেশান করতে হবে, কিন্তু কম্প্লিকেশান দেখা দিচ্ছে। মহিলা শক্ত হয়ে সব শুনল।
শেষে বল্ল
-ভাইয়া যেভাবেই হোক রিমির বাবাকে বাঁচাতে হবে। আমাদের কেউ নাই। যতটাকা লাগে দিব, আপনারা শুধু ওকে ফিরায় আনেন।
মায়ের শক্ত চেহারা দেখেই কিনা? নাকি কথাই বুঝে মেয়েটা কান্না শুরু করল। নি:শব্দ কান্না। তন্ময় অবাক হয়ে বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর চলে গেল আইসিইউ এর দিকে।
রুগীকে সেখানেই রাখা হয়েছে। সবচেয়ে লাভজনক বেড ওটাই। গিয়ে দেখল, রুগীকে ওটির জন্য রেডি করা হচ্ছে।

-প্রেশার বেড়েছে? জরীকে বলল।
-না
-তা হলে?
-জানি না। ড:হারুণ বলল।
-কোথায় উনি?
-রেডি হচ্ছেন, তোমাকে ওটি এসিস্ট করতে বলে গেছেন।
তন্ময় দৌড়ে গেল ওটি তে। ওখানে ড:হারুন এবং ড: আরমান দু জন ছিলেন।
তন্ময় জানতে চাইল
-স্যার এই অবস্থায় ওটি?
-হ্যা
-কিন্তু?
-কোন কিন্তু না। উই আর লুজিং হিম।
তন্ময়ের কানে বেজে উঠল কথাটা!
-কিন্তু স্যার অপারেশান টা তো আমরা আরও আগেই করতে পারতাম। পেশেন্টকে আজকে এ অবস্থায় থাকতে হত না।
আমি রেজিস্টারে দেখলাম ওটি আর আপনি দুজনই ফ্রী ছিলেন।
ড: হারুন চিতকার করে উঠলেন,
-ইয়ংম্যান ডু ইয়োর জব। লার্ন টু টেক রিস্ক। ডোনট টিচ মি ইউ রাসকেল।
তন্ময় বুঝতে পারছিল না কী করবে। আবার মাথার পাশে শিরায় দপ দপ শুরু হয়ে গেল।
পেশেন্টকে অপারেশান টেবিলে শোয়ানো হল। ওটি তে জরী, ড: আরমান, ড: হারুণ আর তন্ময় ছাড়াও দুজন নার্স উপস্থিত। পেশেন্টকে এনেস্টেশিয়া দেবার পর পর। প্রেশার ফল করতে থাকল। তন্ময় মনিটরে পেশেন্টের প্রাণ বায়ু বের হয়ে যাও্য়া দেখতে থাকল। আকাবাকা হতে থাকা আলোর ঝলকানি, স্থীর হয়ে গেল। অনেক চেষ্টার পর ড:হারুন নিস্পৃহ কন্ঠে জানালেন রেকর্ড টাইম অফ ডেথ ফোর ফিফটি পি এম। রিজন: কনজেসটিভ হার্ট ফেইলুর।
তন্ময় ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল ড: হারুণের দিকে। এত সহজে একটা মানুষ কিভাবে মৃত্যু নিয়ে মিথ্যা বলে? ভেবে পাচ্ছিল না। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বের হয়ে এল, ফাক ইউ। ড: হারুন বিষ্ফোরিত চোখে তাকালো তন্ময়ের দিকে। এবার তন্ময় স্পষ্ট করে বলল কথাটা। তারপর গটগট করে বের হয়ে এল। ওটি ড্রেস চেন্জ করে হাসপাতালের বাইরে চলে এল। ওর মাথায় এখন কিছু নাই, ঘুরে ফিরে একটা কথাই বির বির করে বলছে ফাক ইউ।

ফোন করল সামাদ কে। খুশি খুশি গলায় সামাদ বলল
- ডাক্তার সাব কই আপনি?
-হুম আসছি ক্লাবে। দুটা রাখ।
ফোন কেটে দিল।

পুনশ্চ:
দুই ঘন্টা পর। তন্ময় তার নিজ ঘরে বসা। শুন্য চোখে তাকিয়ে আছে ধুলো জমা ডেভিডসনের মেডিসিনের বইটার দিকে। পাশেই দুই টা ফেনসিডিলের খালি বোতল।
তন্ময়ের খুব ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু পারছে না ঘুমাতে, রিনঝিন রিনঝিন শব্দ করছে মোবাইলটা! খারাপও লাগছে না, কারণ স্ক্রীণে লিখা কলিং জরী। তন্ময়ের ঘোলা চোখে স্ক্রীণের লিখা টিকে হঠাৎ মনে হল, নীল জলে পদ্মফুল।
সে বিড় বিড় করতে থাকল
"তোমায় আমি দেখেছিলাম বলে,
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে। "

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.