![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কৃষ্ণা নদীর বুকে ছোট একটি দ্বীপ। কয়েক ঘর মানুষ। তাদের নিয়ে একটি গ্রাম। নাম নীলকণ্ঠরায়ানাগাড্ডি। নদীর জোয়ার-ভাটার মতো এখানকার মানুষের জীবনেও আছে সুখ-দুঃখের খেলা। আর আছে বেঁচে থাকার নিত্য সংগ্রাম।
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বেঙ্গালুরু শহর থেকে ৪০০ কিলোমিটার উত্তরে কৃষ্ণা নদীর বুকে জেগে আছে দ্বীপটি। একে ঘিরে দিনরাত চলে পানির খেলা। নদীর দক্ষিণ পাড়ের কিছু দূরে আছে শহুরে জীবনের ছোঁয়া। আছে বাজার ও চিকিৎসার সব আয়োজন।
নীলকণ্ঠরায়ানাগাড্ডি গ্রামে নেই বিদ্যুৎ। চিকিৎসার জন্য নদী ভেঙে যেতে হয় ওপারে। দুঃখের বিষয়, কোনো আধুনিক প্রযুক্তি এখানকার মানুষদের আজও স্পর্শ করেনি। ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ট্রলার বা লঞ্চ এখনো তাদের কাছে স্বপ্ন। নদী পারাপারের জন্য তাদের সম্বল বাঁশ বা কলাগাছের ভেলা। কিন্তু বর্ষাকালে একটি দিয়াশলাইয়ের জন্যও সাঁতরে নদী পার হতে হয় এ গ্রামের মানুষদের।
ইয়েলাবা বালাপ্পি গাড্ডি। বয়স ২২ বছর। এ গ্রামের এক নারী। নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিছু দিনের মধ্যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে তার। ডাক্তার নেই, হাসপাতাল নেই। প্রসবকালীন অনেক সমস্যা থাকে। যদি কোনো সমস্যা হয়, তবে কী হবে? বালাপ্পি গাড্ডি এ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলেন।
অবশেষে ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন, হাসপাতালেই তার সন্তান প্রসব করাবেন। কিন্তু নদী পার হবেন কী করে? এখন তো বর্ষাকাল। কৃষ্ণা নদীর বুকে ভরা যৌবন। স্রোত আর ঢেউয়ের আলিঙ্গনে উথাল-পাতাল। এ অবস্থায় ভেলা ভাসানো দুষ্কর। কিন্তু যেতেই হবে হাসপাতালে- ইয়েলাবার সোজা কথা।
ইয়েলাবার কথায় রাজি হলেন তার পরিবারের সদস্যরা। ঝুঁকি আছে কিন্তু নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য নদী পাড়ি দিতেই হবে, এ কথা তারাও বুঝলেন।
গত বুধবারের কথা। নদী পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। ইয়েলাবার সঙ্গী হন তার বাবা, ভাই এবং চাচাতো ভাইয়েরা মিলে সাতজন।
ইয়েলাবারা যখন নদী সাঁতরে পাড়ি দেন, তখন তারা বড় বড় কুমড়া ও লাউয়ের সাহায্য নেন। এগুলো শুকনো। ভেতরটা ফাঁকা। সহজেই পানিতে ভেসে থাকে। এসব লাউ ও কুমড়া শিকেয় পুরে একটি শক্ত দড়ি দিয়ে সেগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত করে তৈরি করা হয় ভেলা। তারপর তা পানিতে ভাসালে এর সাহায্য নিয়ে ভেসে থাকতে পারেন যে-কেউ। তা ছাড়া বড় বড় কয়েকটি হাঁড়িরও সাহায্য নেন তারা।
নদীতে সাঁতারের সময় ইয়েলাবার ভাই ছিলেন সবার আগে। তারপর ইয়েলাবা। পাশে ও পেছনে তার বাবা এবং চাচাতো ভাইয়েরা। তাদের সবার শরীরের সঙ্গে লাউ-কুমড়ার ভেলার দড়ি বাঁধা ছিল। স্কট দিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো ইয়েলাবার বাবা ও ভাইয়েরা তাকে নদী পার হতে সাহায্য করেন। ইয়েলাবারা ভেসে ভেসে এবং সাঁতার কেটে অবশেষে কূলে পৌঁছে যান।
এ দুঃসাহিক অভিযানের পর ইয়েলাবার কাছে পৌঁছায় অনেক গণমাধ্যম। তিনি অকপটে বলে যান তার ইচ্ছার কথা, সন্তান নিয়ে তার স্বপ্নের কথা। ইয়েলাবা বলেন, ‘সাঁতরে নদী পাড়ি দেওয়ার মতো অবস্থা আমার ছিল না। কিন্তু সবই করেছি আমার আনাগত সন্তানের জন্য। সে যেন সুস্থাবস্থায় পৃথিবীর আলো-বাতাস পায়। আমার সংকল্পই আমাকে উত্তাল নদী পাড়ি দেওয়ার সাহস জুগিয়েছে। আমি পেরেছি। বর্ষাকালে কৃষ্ণার বুকে দাপিয়ে বেড়ানো ১২ থেকে ১৪ ফুট উঁচু ঢেউও আমাকে বিচলতি করতে পারেনি।’
নদীর মধ্যে পৌঁছানোর পর ভয়ংকর সেই অভিজ্ঞতার কথা শোনা যায় ইয়েলাবার মুখে। তারা যখন মাঝনদীতে গিয়ে পড়েন তখন প্রচণ্ড স্রোত আর ঢেউ। ১২ থেকে ১৪ ফুট হবে সেসব ঢেউ। ভয়ও পেয়েছিলেন তারা। ভাটার টানে তারা ভেসে গিয়েছিলেন বেশ খানিকটা দূর। অবশেষে সব বাধা উতরে লক্ষ্যে পৌঁছে যান তারা।
এমন প্রতিকূলতার মধ্যে সাঁতার কাটায় খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েন ইয়েলাবা। নদীর ওপারে কেক্কেরা গ্রামের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার দেখভাল করছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ইয়েলাবা ভালো আছেন। এক আত্মীয়র বাড়িতে থেকে বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি। তার গর্ভের সন্তানটিও সুস্থ আছে। ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে প্রসবের সম্ভাবনা রয়েছে।
হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, সাত বছর ধরে তিনি এখানে কাজ করছেন। সাঁতার কেটে নদী পার হওয়ার অনেক গল্প তিনি শুনেছেন। কিন্তু একজন অন্তঃসত্ত্বা এভাবে উত্তাল ঢেউ ভেঙে নদী পাড়ি দেবেন- এ তিনি কল্পনাও করতে পারেন না।
ইয়েলাবাদের নদী পাড়ি দেওয়ার তথ্য পেয়ে ভেঙ্কটশ দোর নামের একজন স্থানীয় সাংবাদিক ছুটে আসেন। কূলে পৌঁছানোর পর তাদের ছবি তোলেন। ইয়েলাবার চোখে-মুখে যে দীপ্তি তিনি দেখেছেন, তার ভাষায় তা এক বিস্ময়, আর সব নারীদের জন্য সাহসের দৃষ্টান্ত
তথ্যসূত্র : বিবিসি অনলাইন।
©somewhere in net ltd.