![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...
আগের পর্ব-৮
পরীক্ষার সময় আজাদের সাথে আমার পরিচয়। আজাদ থানা নির্বাহী অফিসারের ছেলে। জয়পাড়া পাইলট হাইস্কুল থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে। ও আমাদের স্কুলের ছাত্র না, তারপরও কিভাবে যেন আমার পাশের সীটটা পড়ে আজাদের।
আজাদ ছেলেটা খুবই মিশুক এবং বন্ধুবৎসল। অল্প কয়েকদিনেই সে আমার অত্যন্ত অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলো।
আরেকটি কথা বলা আবশ্যক, তা হলো আজাদ অতি সুদর্শন বালক (বরং তরুণ বলাই ভালো), ভদ্র ও মিষ্টভাষী, স্মার্ট তো বটেই। তার ওপরে উপজেলার সর্বময় কর্মকর্তার ছেলে। ছেলেরা যেমন প্রজাপতি দেখার লোভে এখানে সেখানে ছাদের ওপরে ঘোরাঘুরি করে, মেয়েরা তেমনি আজাদের দর্শন লাভের আশায় সময়ে অসময়ে ওদের বাসায় আড্ডা জমাতো। ছেলেরা যখন তখন মেয়েদের সান্নিধ্যে যাওয়ার সাহস ও সুযোগ পায় না। মেয়েদের ক্ষেত্রে ভিন্ন, ওদের জন্য সব সময় হাজারটা সুযোগ উন্মুক্ত থাকে।
সেদিন বিকেলের শিফ্টে শারীরবিদ্যা পরীক্ষা ছিল। সকালে প্রথম শিফ্টের পরীক্ষা শেষ হয়েছে, মাঝে ঘন্টা খানেকের বিরতি। স্কুলের মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে বটগাছের ছায়ার নিচে বসে আমরা কয়েকজন লাষ্ট আওয়ার রিভিশন দিচ্ছিলাম।
আজাদ আমার ডান পাশে বসে হাজারটা ফাজলামোর কথা বলছিল। আমার সচরাচর এমন লাষ্ট আওয়ার রিভিশনে মনোযোগ হয় না, এর অভ্যাসও বড় একটা নেই। কিন্তু সেদিন বইয়ের প্রতি সহসা আমার দরদ উথলে ওঠে। কাজেই আজাদের দুষ্টুমিতে আমি যারপরনাই বিরক্তবোধ করছিলাম।
হঠাৎ আজাদ আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, এই মিয়া, তুমি কি যাদু জানো?
আমি কৌতূহলী চোখে আজাদের দিকে তাকাই।
আজাদ মুচ্কি হেসে বলে, জুঁই যে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, তা কি তুমি জানো?
আজাদ কথাটা এতখানি জোরে বললো যে ওখানে বসা অন্যান্যদের কানে অন্তত 'জুঁই' শব্দটা গিয়ে ধাক্কা খেল (জুঁই একটা মেয়ের নাম, তাই শব্দটা কারো ঠোঁট থেকে বেরুবার আগেই মেয়ে-পাগল ছেলেগুলো ওটা শুনে ফেলে)।
আমি কৃত্রিম রাগ ঝেড়ে বললাম, এসব বাজে কথা এখন রাখো তো। পাশ করতে চাইলে ব্যাঙের পরিপাকতন্ত্রটা একটু ভালো করে পড়ো-
আজাদ আমার পিঠ চাপড়ে ঠাট্টা করে উঠলো, ওরে ব্বা, ছেলের তো দেখি আবার ঝালও আছে।
ঠিক এই সময়ে আমাদের পেছন দিক থেকে একটি ছাত্রী-কণ্ঠ মিষ্টি স্বরে ডেকে উঠলো, আজাদ ভাইয়া....
আমরা একযোগে পেছন ফিরে তাকাই। বেহায়া ছেলেগুলো হাঁ করে ওদিকে তাকিয়ে থাকলেও আমি এক পলক দেখেই চোখ ফিরিয়ে আনলাম। ওদিকে আর তাকিয়ে থাকা যায় না। এখন, ঠিক এই মুহূর্তে বটবৃক্ষের ছায়া সুশীতল স্থানটুকুতে আমার অবস্থিতি অসমীচীন। অবাঞ্ছিত।
হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই ধরেছেন। ঝর্ণা এবং রাণী। দু-জন প্রাণোচ্ছল সুন্দরী তরুণী। পরীক্ষার আগের মুহূর্তে আজাদের সান্নিধ্যে থেকে ওরা কিছু মধুর সময় কাটাতে চায়।
আমি ভাবলাম, ওরা কি আমার চেহারা মনে রাখতে পেরেছে? নিশ্চয়ই। ওরা এদিকে এগিয়ে আসছে। ওরা আমাদের মতই এই ঘাসের ওপরে বসে পড়তে পারে, আমাদের পাশেই। আর তা যদি হয় তাহলে ঝর্ণা কিংবা রাণী ঠিক আমার দিকে মুখ করে বসবে। তা কি হয়?
আজাদ বললো, আরে পাখি যে, কী খবর? এসো, এসো।
পাখি! আমি হাঁফ ছাড়ি। যাক বাবা, কি আতঙ্কেই না ছিলাম। ঝর্ণা কিংবা রাণী এখন যদি এই ভরা মজলিশে এসে উপস্থিত হতো, কে জানে, আরো বেশি অপমানকর, ভয়ঙ্কর একটা কিছুও তো ঘটে যেতে পারতো। কিন্তু কি আশ্চর্য, ঝর্ণা আর রাণীর সাথে এ দু-জনের অবয়বের কত মিল! আসলে এই বয়সে সব মেয়েকে যেমন সুন্দরী মনে হয়, আবার সব সুন্দরী মেয়েকেই মনে হয় একই চেহারার। কি জানি, এ আমার মনের কিংবা চোখের ভ্রমও হতে পারে। আরো একটা জিনিস হতে পারে, ঝর্ণা আর রাণীর কাছ থেকে অপমানিত হবার পর থেকে সব সময় ঐ কষ্টটা আমাকে তাড়া করে ফেরে। সেই ভয় থেকেই হয়তো দাঁড়ানো মেয়ে দুটোকে এক পলকের দেখায় ঝর্ণা কিংবা রাণীর মত মনে হয়েছে। তাছাড়া আমি তো ওদেরকে ভালো করে চেয়েও দেখি নি; দেখলে হয়তো দেখতে পেতাম ওরা সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারার ভিন্ন দুটি মেয়ে, যাদের একটির নাম পাখি।
পাখি বললো (এর নাম পাখি না হয়ে অপর মেয়েটির নামও পাখি হতে পারে), আজাদ ভাইয়া, একটা জরুরী কথা ছিল যে-
আজাদ বললো, এসো না, আরে লজ্জা কিসের, এসো-
সবাই হাসি হাসি লোলুপ চোখে মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়েছিল। আমি মাথা নিচু করে যদিও শারীরবিদ্যা বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বাস্তবিক আমি কিছুই পড়ছিলাম না। আমার কান দুটো খাড়া ছিল ওদের কথা শোনার জন্য।
টের পেলাম মেয়ে দুটি হাঁটতে হাঁটতে আমাদের ডান পাশে এসে দাঁড়ালো। বাতাসে ওদের শরীর থেকে উড়ে এসে নাকে লাগলো চমৎকার বেলী ফুলের ঘ্রাণ। অন্য ফুলের ঘ্রাণও হতে পারে। অবশ্য যে কোন ভালো ঘ্রাণকেই আমার কাছে হয় হাসনাহেনা অথবা বেলী ফুলের ঘ্রাণ বলে ভ্রম হয়।
আজাদ আরো একটা গাঢ় দুষ্টুমি করলো। ওর বাম হাতে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে ডান হাতে চিবুক উঠিয়ে বললো, তুমি তো দেখছি ভাই মেয়েদের চেয়েও লজ্জাবতী। একটু তাকিয়ে দেখো না এরা কারা।
চোখ তুলে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। আমি চোখে ভুল দেখি নি। এতখানি ভুল হবার কথাও নয়। ওরা ঠিক ঝর্ণা এবং রাণী। দুটি অতি রূপসী মেয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।
চোখাচোখি হতেই ঝর্ণার হাসি মুখটি ধীরে ধীরে নিভে যেতে যেতে কঠিন হতে থাকলো। আর রাণী, ওর চেহারায়ও একটা বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠলো।
আজাদ ওদেরকে বললো, এই বসো না, পাখি- মিতা- বসো না?
পাখি আর মিতা বসলো না। পাখি ওর সখির বাহু ধরে বললো, চল্ পাখি যাই। এতক্ষণে বোঝা গেল কোন্টা পাখি আর কোন্টা মিতা।
আজাদ বললো, আরে আরে যাচ্ছো কেন? (আমাকে দেখিয়ে) একে চেনো? এসো পরিচয় করিয়ে দিই।
মিতা মেয়েটি, যাকে আমি আগে ঝর্ণা এবং পরে পাখি বলে ভুল করেছিলাম, বললো, আসলে আমাদের একটা কাজ আছে আজাদ ভাইয়া, অন্য সময়ে না হয় আপনার বন্ধুর পরিচয়টা জেনে নিব। এখন তবে আসি, কেমন? ---- আবার দেখা হবে --- বাই ---। আমার দিকে কঠিন তীর্যক চোখে তাকিয়ে থেকে মিতা হাত নেড়ে আজাদকে টাটা জানালো। পাখিও। তারপর দু-জন প্রিয় সখি পরস্পর হাস্যোচ্ছন্দে শান্ত ধীর পদক্ষেপে চলে গেল।
এতখানি তাচ্ছিল্য! আমার অন্তরে আগুন জ্বলতে লাগলো। কলজে ছিড়ে গেল! জ্বলে গেল! পুড়ে গেল! আমি ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছি। ওহ্ ---
সবার মত সকুল জীবনেই মেয়েদের সম্বন্ধে আমার একটা ধারণা হয়েছিল - সেটা হলো - মেয়েরা হলো চুম্বক - এরা যেখানেই থাক না কেন, এদের চারপার্শ্বে একটা অনির্দিষ্ট দূরত্ব অব্দি একটা চৌম্বক ক্ষেত্র ~েতরী হয়ে যায়। এদের আকর্ষণ ক্ষমতা এত বেশি যে একবার যে ছেলেটি কোন একটা মেয়েকে এক নজর দেখতে পেয়েছে, আনমনে হলেও সে ঐ মেয়েটির পুনর্দর্শন লাভের আশায় এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে এবং অলৌকিকভাবে একবার তার দেখা পেয়েও যায়।
আমার মনে পড়ে সকুলে কোন ফুটবল কিংবা ভলিবল কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলে মাঠের একধারে মেয়েদের জন্য বেঞ্চি পেতে বসার সুব্যবসহা করা হতো। মাঠের চারপাশে তখন ছেলে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় হতো। প্রিয় দলকে সাপোর্ট করার জন্য অপূর্ব দেহ-ভঙ্গীমায় নেচে নেচে ছেলেরা উপবিষ্ট মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতো। আর মাঝ মাঠে খেলোয়াড়দের তেজ তখন দেখে কে! মনে হতো ওরা একেকটা পেলে কিংবা ম্যারাডোনা, হয়তো বা ওদের ক্ষিপ্রতার কাছে ম্যারাডোনা কিংবা পেলেও কিছুই নয়। মেয়েরা যখন শোরগোল করে হাততালি দিয়ে উঠতো তখন মাঝ মাঠে খেলোয়াড়দের ক্ষিপ্রতা দেখে মনে হতো, সত্যি আমাদের সকুলের সোনার ছেলেরা একদিন জাতীয় ফুটবল বীরে পরিণত হবে।
আমি সব খেলাই কম-বেশি খেলতে পারি, কিন্তু কোন খেলাই আহামরি ধরণের কিছু পারি না। তবে খেলতে পারার চেয়ে খেলা দেখাটায়ই আমার উত্তেজনা ছিল বেশি।
একবার স্কুলে ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। সকুলের সব ক্লাসের ছাত্রকে লটারী করে আটটি দলে ভাগ করা হলো। আমাকে একটা দলের দল-অধিনায়ক নির্বাচন করা হলো। তবে আমার পারঙ্গমতার জন্য নয়, আমি নবম শ্রেণীর ফার্স্ট বয়, এই কৃতিত্বের জন্য ক্রীড়া-শিক্ষক আমার পারদর্শিতা যাচাই না করেই আমাকে টিম ক্যাপ্টেন বানিয়ে দিলেন। ক্রীড়া-শিক্ষক হয়তো ভেবেছিলেন লেখাপড়ার মত খেলাধুলায়ও আমি সমধিক পারদর্শী।
কোন একদিন টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে খেলা শুরু হলো। আমি মাঝ মাঠে ষ্ট্রাইকার। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মনে হলো আমি মেয়েগুলির দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে। একবার হঠাৎ করে দেখি মেয়েরা হাততালি দিয়ে উঠলো, সেই সঙ্গে পুরো দর্শক। ব্যাপারটি ছিল এই - একটা বল মাটি গড়িয়ে আমার দিকে আসছিল, আমি বল আয়ত্ত্বে আনার জন্য ছুটছি, হঠাৎ আমাকে অতিক্রম করে প্রতিপক্ষের একটা জুনিয়র ছেলে ছোঁ মেরে বলটা নিয়ে নিল। আর আমি চরকির মত ছেলেটির পেছনে ছুটতে লাগলাম। আমার মনে হলো, এই যে ছেলেটির পেছনে আউলা হয়ে চরকির মত ঘুরছিলাম, এটা বেশ দর্শনীয় ও উপভোগ্য ছিল, এবং দারুণ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিল।
তারপর আর মাত্র মিনিট দুয়েকের মত আমি মাঠে ছিলাম এবং ততক্ষণে খেলা শুরু হওয়ার মাত্র সাত মিনিটের মাথায়ই আমার দল মাত্র দুটি দর্শনীয় গোল হজম করতে পেরেছিল। আমি হয়তো জানি না, বা হয়তো জানানো হয়নি, হয়তো আমার জ্ঞঅসাধারণ কৃতিত্বেরঞ্চ জন্যই অতি দ্রুততার সহিত অমন দুটি দর্শনীয় গোল হজম করা সম্ভব হয়েছিল।
খেলা শেষ হওয়ার মিনিট দশেক আগেই মাঠ একেবারেই দর্শক শূন্য হয়ে গেল - কারণ মেয়েরা বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে। মেয়েরাও নেই ছেলেরাও নেই। চুম্বক না থাকলে কি চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্তিত্ব থাকে? মাঠে খেলোয়াড়রা যেন নেতিয়ে গেল - দেখে মনে হলো ওরা কত দিনের অনাহারী, রোগা, এতিম - মা-মরা। ওদের পা চলে না।
পরীক্ষা দিতে এসে কয়েক দিনের মাথায় আমি ভিতরে ভিতরে চুম্বকের প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলাম। জুঁইয়ের সাথে দেখা হবার পর থেকে এটা আরো প্রকট হয়ে উঠলো। কিন্তু আমি প্রকাশ করতে পারি না, জ্ঞপাছে লোকে কিছু বলেঞ্চ।
চুম্বকের টান উপেক্ষা করা সত্যিই দুরূহ হলো। একদিন বিকেলে আমি ঠিক ঠিক উপজেলা সদরের পুকুর পারে চলে এলাম। এখানে এলে আমার নয়ন জুড়িয়ে যায়। স্বভাব মত গেইটটি দিয়ে ঢুকেই পুকুরের দক্ষিণ পারে দাঁড়ালাম। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম - আমার নয়ন জুড়িয়ে গেল।
পুকুরের উত্তর পারে একটা ছাদের ওপর একটা রঙ্গিন পাখি দেখতে পেলাম - আমাকে দেখতে পেয়ে পাখিটি ছাদের এ পাশে এসে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো - মুখ চেনা যায় না। মুহূর্তে পাখিটি উধাও এবং একটু পরেই দেখি সে ঐ বিল্ডিংয়ের নিচতলা থেকে আমার দিকে দৌড়ে আসছে। অল্পক্ষণেই চিনে ফেললাম - এ দেখি জ্ঞআমারঞ্চ জুঁই!
জুঁই হাঁপাতে হাঁপাতে কাছে এসে দাঁড়ালো। সে কথা বলতে পারছে না।
বললাম, কেমন আছেন?
জুঁই অভিমানের স্বরে বলে, আপনি খুব নিষ্ঠুর! খু-উ-ব! বলে সে ওড়নার কোণা আঙ্গুলে গুঁটিয়ে মাটির দিকে তাকায়।
আমি হেসে দিয়ে বলি, নিষ্ঠুর আমি নই। বরং আপনিই নিষ্ঠুর। হৃদয়হীনা!
একদম না! জুঁই বলে।
তাহলে আসেননি কেন? আমি বলি।
আপনারই তো আসার কথা ছিল! আহ্লাদিত স্বরে জুঁই বলে।
আমি তো প্রতিদিনই আসি। আমি জবাব দিই।
মিথ্যে কথা! জুঁই সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে ওঠে।
মিথ্যে নয়, প্রতিদিন আসি। যখন বিকেল হয়, আমি আসি। সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়, রাত্রি নামে, চারদিকে জোছনা খলখল করে। আমি একাকী দাঁড়িয়ে থাকি। আপনি আসেন না! আচ্ছা, আমার কথা কি আপনার একবারও মনে পড়েনি? বলতে বলতে আমার গলার স্বর নরম হয়ে আসে। জুঁইয়ের কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ে। সে বলে, জানি না আমার কি হয়েছে! আপনি কি জানেন, আমি কিছুই পড়তে পারি না! পড়ায় আমার মন বসে না। আমার মন অন্য কোথাও পড়ে থাকে!
আমারও এমনি দশা। কি যে করি!
হঠাৎ জুঁই বলে বসে, আপনি একটা ডাকাত!
আমি হেসে হেসে বলি, পুলিশে ধরিয়ে দিন!
আমার কি যে হলো, আপনি আমার সব চুরি করে নিয়ে গেছেন! কি যে করি, আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না! জুঁইয়ের কণ্ঠে যন্ত্রণার স্বর।
আচমকা কে যেন পেছন দিক থেকে ধাক্কা দিল। হ্যাঁ, এটা করিম। আমার কল্পনার মাঝ পথে এ ফাজিলটা ছাড়া আর কে উদয় হতে পারে?
করিম বললো, চল্ যাই।
কোথায়?
জুঁই তোকে যেতে বলেছে।
অমুকে তোকে যেতে বলেছে - এ ধরণের কথায় আমার মনে বেশ সন্দেহের উদ্রেক হয়। তদুপরি আমার সাধ হলো, দেখি না কি হয়। নো রিস্ক নো গেইন। উৎপল স্যার এ কথাটি অনেক বলেন। আমি তো পুরুষ মানুষই, মেয়ে তো আর নই।
বললাম, চল যাই।
করিম আমাকে আজ দারুণ হতাশ করলো। এতদিন আসতে চাইনি, সে প্রতিদিন বলতো, চল্ জুঁই যেতে বলেছে। আজ আমি নিজে থেকে যখন এলাম তখন জুঁইদের ওখানে না গিয়ে ঢুকলো আজাদের বাসায়।
আজাদের সঙ্গে করিমের চেয়ে আমারই অন্তরঙ্গতা বেশি। তারপরও দেখি অত্যন্ত সহজ ভাবে আজাদের ঘরে ঢুকে পড়লো করিম। তাও ড্রইং রুমে নয়, একেবারে বেডরুমে, যেখানে আজাদ, ওর অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া দুই বোন এবং ওর মা। সবাই টিভি দেখছিলেন।
আমি সংকোচে জড়ো হয়ে গেলাম, কিন্তু মনে হলো করিম ওদের নিজেদের বাসায় ভাইবোন কিংবা মা-চাচীদের সাথে কথা বলছে।
আজাদ আমাকে ওর মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি যে একজন তুখোড় ছাত্র এ কথা ওর মাকে বলতে ছাড়লো না। আজাদের মা বেগম আয়েশায় একজন শিক্ষয়িত্রী। আজাদের কাছে বর্ণনা শুনে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার কথা নাকি শিক্ষকরা প্রায়ই বলাবলি করেন।
আজাদের মায়ের হাতে একটা ইংলিশ নভেল। তিনি মনোযোগ দিয়ে ওটা পড়তে থাকলেন। ওর বোন দুটো মাঝে মাঝে ফিসফাস করে আজাদের কানে কানে কি যেন বলে, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হেসে কুটি কুটি হয়। করিমের মুখ অবশ্য বন্ধ নেই - ওর বক্তব্য বিষয়েরও কোন আগা-মাথা নেই, সার-সংক্ষিপ্তহীন। গল্প করতে করতে ওরা এক যোগে হেসে ওঠে, আমি চুপ থাকি, বোবা তো!
আজাদ আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললো, এই মিয়া, এত চুপচাপ কেন?
আমি নির্বাক সিমত হাসলাম।
আজাদ ওর মাকে উদ্দেশ্য করে বললো, জানো মা, পুরো কবর কবিতাটা নাহিদের আগাগোড়া মুখস্ত।
আজাদের মা বই থেকে চোখ না তুলেই বললেন, তাই?
আজাদ বললো, ওর আবৃত্তি শুনলে তুমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারবে না। আজাদের মা বই থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, তারপর আবার পড়তে থাকলেন।
আমি আজাদের হাতে চাপ দিয়ে বললাম, বাইরে বের হবে? নইলে আমি আসি।
আজাদ বললো, এক কাজ করি, চলো ছাদে গিয়ে বসি।
কাজের ছেলেটি ছাদের ওপর বেশ কয়েকটি চেয়ার দিয়ে এল। আমরা ছাদে গিয়ে বসলাম। আমি, আজাদ আর করিম।
এমন একটি সুন্দর সন্ধ্যা আমার জীবনে আসবে তা কোনদিন কল্পনা করিনি। আমরা সবাই ছাদে গিয়ে বসেছি, ঠিক এমন সময় জুঁই এবং আরো তিন চারটি মেয়ে কলকলিয়ে হাজির হলো সেখানে। আমার মনে হলো মুহূর্তে হাসনাহেনার ঘ্রাণে চারদিকে ছেয়ে গেল, আমি সেই সুরভিতে কেবলই বিমোহিত হতে থাকলাম।
জুঁই বললো, বাব্বাহ্, আপনার দেখা পাওয়াই ভার।
আমি বললাম, কেমন আছেন?
ভালো নেই।
কেন?
পরীক্ষা ভালো হয়নি।
কি বলেন?
সব পড়া ভুলে যাই।
এ সময়ে আজাদ হাত বাড়িয়ে জুঁইয়ের পিঠ চাপড়ে বলে, বাহ্, এ তো দেখছি মডার্ন পার্বতী!
একটা তরুণীর পিঠ চাপড়ে কথা বলাটা শালীনতাবোধের পরিচয় বহন করে না। আজাদের এরূপ আচরণে আমি মনে মনে কিছুটা ক্ষিপ্ত হই, তবে তার চেয়েও বেশি ঈর্ষাণ্বিত হয়ে পড়ি। আমার চোখের সামনে অন্য কেউ জুঁইয়ের সাথে রঙ্গ-রস করবে, এটা কি সওয়া যায়? আশ্চর্য, আজাদের মত ছেলেরা কিভাবে এসব পারে?
এটা কোন শোভন আচরণ নয় বলেই জুঁই একটু সংকুচিত হয়ে নড়েচড়ে দূরে সরে বসলো, কিছুটা বিব্রতও হলো।
জুঁই নয়, অন্য একটা মেয়ে আমাকে আচমকা জিঞ্চাসা করে ওঠে, চোখে মুখে মুচ্কি হাসির রং ছড়িয়ে, আচ্ছা ভাইয়া, জীবনে আপনি কটি প্রেম করেছেন?
ওর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। অপরাপর সময়ে এমন প্রশ্নে আমি ভীষণ রাঙা হয়ে উঠতাম। আজকাল সেই সংকোচ ও লজ্জাবোধ বহুলাংশে কমে গেছে।
ডাটের সাথে একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই করিম তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো, হ্যা-হ্, নাদু ভাইয়ার জীবনে আবার কটি প্রেম, না? মেয়েরা কি মায়ের হাড়ির মুড়ি, যে হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে যায়? একটা প্রেমই ওর পোড়া কপালে জুটলো না, আবার উনি কতগুলো প্রেম করেছেন। যত্তো সব আজগুবি প্রশ্ন।
মেয়েটি বেশ চপল ভাবে আবার জিঞ্চাসা করলো, আহা, বলুনই না ভাইয়া। আমরা তো আর আপনার প্রেমের পথে কাঁটা ছড়াতে যাচ্ছি না।
আমি অকপটে বলে ফেললাম, মাত্র একটা প্রেম করেছি।
করিম অ-হাসি দিয়ে হেসে উঠলো। এমন উদ্ভট গল্প হয়তো এর আগে কখনো সে শোনেনি।
আমার প্রেমের ব্যাপারে মেয়েগুলোর মধ্যে বেশ আগ্রহের ভাব ফুটে উঠলো।
করিম ক্ষে
©somewhere in net ltd.