নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার জন্ম টাঙ্গাইলের হামজানি গ্রামে। শৈশব, কৈশোরে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ছিলাম; বাবার সরকারী চাকুরীর জন্যে। কলেজ ছিল টাঙ্গাইল জেলায়। তারপর পড়াশুনা ঢাবি\'র ফিন্যান্স বিভাগ। গত নয় বছর যাবত প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মজীবন চলছে। www.facebook.com/khokonz

খোরশেদ খোকন

এই শহরে কিছু কিছু শব্দ কলম নয় হ্রদয় থেকে নেমে আসে, একা। এই শহরে বিনয় ঝুলে থাকে মরা গাছের ডালের মতো, একা।

খোরশেদ খোকন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতির জোনাকিরা... (শৈশবের দিনগুলি-০৪)

২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:২০

১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসের এক সকালে আমার চাচাতো ভাই (বড়চাচার বড়ছেলে, নাম দুলাল) আমাকে সকাল ৬টায় ফজরের আযানের সাথে সাথে ঘুম থেকে ডেকে তুললো...।

আমাদের গ্রামের বাড়ীতে তখন বিদ্যুৎ ছিল না, আম-জাম-কাঁঠাল-তাল আর নারিকেল গাছের আড়ালে শোলার বেড়া দেয়া দোচালা (যে টিনের ঘরের চাল দুই দিকে ঢালু থাকে) টিনের ঘরে আমি আর আমার চাচাতো ভাই ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘরে একটি মাত্র চকি (যারা সুন্দর নকশা করা কাঠের তৈরি খাটে ঘুমাতে যান, তারা চকি জিনিসটা বুঝবেন কিনা জানিনা!?) আর একটি টেবিল ছিল। টেবিলের ওপাশে রাশিয়ান ম্যাগাজিন কেটে কেটে শোলার বেড়ায় লাগানো ছিল। সেই সময় খুব সস্তায় রাশিয়ান ম্যাগাজিন পাওয়া যেতো।

সেই আশির দশকে রাশিয়ার ‘প্রগতি’ প্রকাশনালয় ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রকাশনালয়। ‘প্রগতি’ থেকে পৃথিবীর ৫৬টি ভাষায় অনুবাদ সাহিত্য প্রকাশিত হতো। যার মধ্যে বাংলা ছিল অন্যতম। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের সবচাইতে ভাল অনুবাদকেরা তখন রাশিয়ার ‘প্রগতি’ প্রকাশনে কাজ করতো। ভাবতে অবাক লাগে, ‘প্রগতি’ মুদ্রণসংখ্যা ছিল বছরে ১ কোটির বেশী। আর আজকের জেনারেশনের, হয়তো কেউই বলতে পারবেনা “প্রগতি” কি জিনিস!?

ছোটবেলায় যখন রাশিয়ান বইগুলো বিশেষ করে রূপকথার গল্পগুলো পড়তাম তখন ভীষণ আনন্দ হতো – রাশিয়া ছিল আমার রূপকথার জগত মানে স্বপ্নের দেশ।

রাশিয়ার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ছবি থেকেই আমি সীমাহীন সবুজ প্রান্তর, অথই জলের হ্রদ, নদী-সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত, তুষার-ঝড়, মেঘে ঢাকা কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের কথা জানি।

আমাদের নতুন ক্লাসে উঠা মানেই ছিল নতুন বই; আর নতুন বইয়ের মলাট মানেই রাশিয়ান ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনের আলো ঝলমলে সুন্দর রঙিন কাগজে মোড়া হতো বই - কি যে চমৎকার ছিল সেই ছবিগুলো আর তার ভাললাগা আবেশ। নতুন বইয়ের দিকে তাকালেই মনে হতো, যেনো রাশিয়ায় চলে গেছি।

যাই হোক, গ্রামের তীব্র শীতরাত শেষে যে সকাল এসেছিল, সেটা ছিল ভয়ানক সকাল। ঘুম ভেঙে লেপের আদর থেকে বাইরে আসা ছিল কষ্টের কাজ; আর হাত-মুখ ধোঁয়া ছিল বরফের ছুড়ির কাছে নিজেকে সপে দেয়া।

কিছুই করার ছিল না, তাই ঘুম ঘুম নিজেকে হিম শীতল সকালের কাছে পরাজিত হতে দিয়েছিলাম।
সেই সময় আমি কাক ডাকা ভোর কাকে বলে জানতাম না, তবে মসজিদে আযানের আগেই মোরগ চিৎকার করে উঠার কথা আমার এখনও মনে আছে।

চাচাতো ভাইয়ের সাথে পায়ে হাটা পথে রওনা দিলাম টাঙ্গাইল শহরের দিকে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় ঘাসে লেগে থাকা শিশিরে নতুন কেনা কেডস ভিজে গেলো, কুয়াশা গাঁয়ে মেখে হাটতে হাটতে গাঁয়ে কাটার মতো বিঁধে গেলো শীত।

আমরা কদিম হামজানি গ্রামের শেষে মাথায় নদীর দিকে যাচ্ছিলাম, পথে দেখলাম গ্রামের মানুষগুলো তীব্র শীতের সকালে একফালি রোদের আশায় বাড়ীর উঠানে বসে-বসে পাটের-সোলা, ধানের-খড়, আর নল-খাগড়ায় আগুন জ্বেলে “আগুন তাপাচ্ছে” মানে আগুনে হাত-পা গরম করছে।

আমরা হাটতে হাটতে গেলাম সেই ছোট নদীটার পাড়ে। নদীর জল থেকে তখন ধোঁয়া উঠছিল, যেমন বরফের গা থেকে ধোঁয়া উঠে।
ধোঁয়া আর কুয়াশায় মিলেমিশে ছিল ঝাপসা একটা নদী। আমরা সেই নদীটা পাড় হলাম।

তারপর হাটতে হাটতে গেলাম সল্লা বাজারের পথ ধরে বড় একটা বটগাছের তলায়; যেখানে ভ্যান পাওয়া গেল। ভ্যানে চেপে রওনা হলাম সয়া বাসস্ট্যান্ডে। সয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে লোকাল বাসে চেপে কুয়াশার রাস্তায় ঠাণ্ডা বাতাসের জাপটায় কাঁপতে কাঁপতে একঘণ্টা পরে পৌঁছে গেলাম টাঙ্গাইল নতুন বাসস্ট্যান্ডে।

টাঙ্গাইল নতুন বাসস্ট্যান্ডের কাছে আমার বাবার খালাতো ভাই (মিনহাজ কাকা) এর বাস-ট্রাক মেরামত করার লেদ-মেশিনের ওয়ার্কশপ, সেই ওয়ার্কশপের পেছনে কাকার বাসায় কিছুটা জিরিয়ে হালকা নাশতা করে রওনা হলাম রিক্সায় সন্তোষ।

সন্তোষ হচ্ছে টাঙ্গাইল শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মওলানা ভাসানীর স্মৃতি বিজরিত একটি ছোট্ট গ্রাম। সন্তোষ গ্রামে সেই সময় একটি টেকনিক্যাল কলেজ, একটি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, একটি বালিকা বিদ্যালয় (যার প্রাথমিক শাখায় ছেলেরা পড়তো, আর প্রাথমিক শাখাকে বলা হতো ইবি শিশু স্কুল)। এছাড়াও একটি মাদ্রাসা, একটি মসজিদ আর ভাসানীর মাজার শরীফ। মওলানা ভাসানী ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করা হতো।

সেই সময় বোর্ডিং স্কুল বলতেই বুঝাতো ইবি শিশু স্কুল।

আমার বাবা ১৯৮৮ সালের শুরুতে একটি দীর্ঘ মেয়াদী ট্রেনিং করার জন্য রাজশাহী শহরে চলে যান। আর আমাদের পরিবারের সবাই মিলে আমরা জামালপুর সদর থেকে চলে আসি টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানার কদিম হামজানি গ্রামে।

গ্রামে দাদা-দাদি মারা যাবার পরে দাদার বাড়ীটা একটা পরিত্যক্ত বাড়ীতে পরিনত হয়, যে বাড়ীকে আমরা বলতাম “পুরাণ বাড়ী”।
বাবার কেনা “পাল-বাড়ীতে” মানে “নতুন বাড়ীতে” আমরা ৬জন মানে “মা” আর আমরা দুইবোন- তিনভাই মিলে বসবাস শুরু করি।
আমাদের নতুন বাড়ীর পূর্ব দিকের বাড়িটাই হচ্ছে বড়চাচার বাড়ী। সে সময় গ্রামে বাবার অবর্তমানে আমাদের পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল বড়চাচার (নাম মনসের আলী) উপর।

আমার বড়চাচা আর বড়চাচার বড়ছেলে কেন জানি ভাবলো, আমি যেহেতু দুষ্ট স্বভাবের তাই আমাকে গ্রামে রাখা ঠিক হবে না। আর এই ভাবনায় আমাকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করা হলো!?

রিক্সায় সন্তোষ যাবার সময় আমার চাচাতো ভাই আমাকে একে একে দেখালো, বিন্দুবাসিনী সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়, শহরের বিখ্যাত নিরালা মোড়, টাঙ্গাইলের বিখ্যাত মিষ্টিপট্টি, সরকারী এম এম আলী কলেজ, মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের বাড়ী, মাওলানা ভাসানীর বাড়ী, সন্তোষ বাজার, সন্তোষ বড়পুকুর আর মাওলানা ভাসানীর মাজার শরীফ।

মওলানা ভাসানীর মাজার শরীফের উত্তর দিকের ট্রাস্টি বোর্ড অফিসে সেদিন সকালে ইবি শিশু স্কুলের ইন্টারভিউ চলছিল। সেই ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের কুয়াশা মাখা দিনটা ছিল আমার জীবনের একটা কঠিন পরীক্ষার দিন।
কারন আমি জীবনের প্রথম ভাইভাটা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। তীব্র শীতের সকালেও আমার হাত-পা ঘেমে যাচ্ছিল।
আমি ভাবছিলাম, এই ইন্টারভিউতে কোয়ালিফাই করতে পারলে, আমাকে বোর্ডিং স্কুলে থাকতে হবে। বোর্ডিং স্কুল মানেই একা থাকা, যেখানে মা থাকবে না!?

আমার মনের মাঝে একরাশ বেদনা উকি দিচ্ছিল, কেননা মা’কে ছাড়া বোর্ডিং স্কুলে থাকতে হবে!?
অন্যদিকে আমি ভাবছিলাম, আমি যদি কোয়ালিফাই না করি; তাহলে আমি জীবনের কাছে পরাজিত হয়ে যাবো। আমার সৎসাহস ছিল যে, পরাজয় মেনে নেয়ার আগে আমি যুদ্ধটা সত্যিই করবো...।

আমি যেহেতু দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে ছিলাম তাই আমার জেদটাও ছিল ভীষণ কড়া...।
হ্যা, ১০ টা বাজার পরেই আমার জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ শুরু হল...।

আমাকে কি জিগ্যেস করেছিল, তা এখন আর পরিষ্কার মনে নেই। (একজন তৃতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে উঠা বালক, কি করে সব মনে রাখবে?)
তবে, আমার হাতে উপহার পাওয়া একটা ঘড়ি ছিল, (সে সময় জাপানি casio wrist watch এর খুব প্রচলন ছিল)।
আমাকে তারা কোন প্রশ্ন করে পরাজিত করতে পারেনি...। সেদিন সেই ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রাধান ব্যক্তিটার নাম ছিল সৈয়দ ইরফানুল বারী,

সেই লোক আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, “এই তুমি হাত-ঘড়ি পরে ইন্টারভিউ বোর্ডে কেন ঢুকেছ?”
আমি থতমত খেয়ে বলেছিলাম, “স্যার, এই হাত-ঘড়ি আমি উপহার পেয়েছি”।
সে বলেছিল, “তোমার গার্ডিয়ান তোমাকে এই শিখিয়েছে?”
আমি বলেছিলাম, “স্যার হাত-ঘড়ি পরা আর সময় দেখা কি অন্যায়?”
সে বলেছিল, “তুমি একটা বেয়াদব ছেলে, এটা বুঝতে পারছ?”
আমি বলেছিলাম, “স্যার, আমিতো বেয়াদবির কিছুই দেখছি না।“
সে বলেছিল, “আর কোন কথা বলবে না, যাও... বেড়িয়ে যাও...।“
আমি বলেছিলাম, “ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি?”

ইন্টারভিউ শেষে; চাচাতো ভাই আর অন্যান্য অভিভাবকদের আমি হাত-ঘড়ির বিষয়টা জানালাম। হাত-ঘড়ি পড়ার জন্য আমাকে ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, এটাও বললাম...।

আমি দেখলাম, অভিভাবকরা মৌন-সম্মতি দিল যে, স্যারদের মানে গুরুজনদের সামনে হাত-ঘড়ি পরা অন্যায়। ...কিন্তু আমি কিছুতেই সেই হাত-ঘড়ির ঘটনা ভুলতে পারলাম না, আর আজও বুঝিনা হাত-ঘড়ি পরাটা কেন অন্যায়!?

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময় মানে ১৯৯৯ সালে মোবাইল কেনার পর থেকে হাত-ঘড়ি পরি না। মোবাইলে যেহেতু সময় দেখা যায় তাই “হাত-ঘড়ি” আমার কাছে বাহুল্য মনে হয়...।

১৯৮৮ থেকে ২০১৫ মানে এই ২৭ বছর পরেও আমার শৈশবের সেই সৈয়দ ইরফানুল বারী স্যারকে মনেপড়ে;
আমার ইচ্ছে করে তাকে গিয়ে বলি, স্যার এখনো কি হাত-ঘড়ি পড়াকে অন্যায় মনে করেন, আপনি?
আমি সেদিন সময় দেখার প্রয়োজনে হাত-ঘড়িকে দরকারি মনে করেছিলাম, তাই পড়েছিলাম। আজ দরকারি মনে করিনা, তাই পরিনা।
আপনি যদি দেখতেন, আমি হাত-ঘড়ি পড়া পছন্দ করি না, তাহলে কি খুশি হতেন?

আমি জানি না, আপনি জীবিত আছেন কিনা? আমার দুর্ভাগ্য যে আপনাকে আর কোন দিনই পাইনি, হয়তো আর পাবোও না। আপনি যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন; এটাই আমার কামনা। মহান আল্লাহ আপনার সহায় হোন। আমীন।

পুনশ্চঃ ১৯৯৯ সালে সরকারীভাবে মাওলানা ভাসানীর স্মৃতিধন্য সন্তোষে মনোরম নৈসর্গিক পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত হয় “মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়”। বর্তমানে ক্যাম্পাসের অধিভুক্ত জায়গার পরিমাণ প্রায় ৫৭ একর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫টি অনুষদ, প্রশাসনিক ভবন, ৫টি আবাসিক শিক্ষার্থী হল, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ ইত্যাদি ছাড়াও ক্যাম্পাসের অধিভুক্ত জায়গার ভেতরই মাওলানা ভাসানীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত ঐতিহাসিক দরবার হল, প্রখ্যাত সুফি সাধক পীর শাহ জামানের নামানুসারে পীর শাহ জামান দীঘি, মাওলানা ভাসানীর মাজার, একটি মসজিদসহ আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
---------------------
১৩ আগস্ট ২০১৫

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.