নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রিয় নজরুল

মোঃ কামাল হোসেন

আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। চেষ্টা করি অন্যের উপকার করতে সম্ভব নাহলে লক্ষ্যরাখি যেন অন্তত ক্ষতি না হয়।

মোঃ কামাল হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নজরুলকে যেমন দেখেছি

২৩ শে মে, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৯

সৈ য় দ আ শ রা ফ আ লী

শৈশব থেকেই কাজী নজরুল ইসলামের সুমধুর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ-সৌভাগ্য আমার ঘটেছে। তবে শৈশবে তাকে পেয়েছি ‘থাতা’ হিসেবে। বিদ্রোহী কবি বা অনন্যসাধারণ গীতিকার ও সুরস্রষ্টা বা যুগপ্রবর্তক সাহিত্য প্রতিভা হিসেবে নয়। যখন ভালো করে আমি শব্দ উচ্চারণও করতে পারতাম না, তখন কবি ছিলেন আমাদের পুরাতন প্রতিবেশী। আব্বা সৈয়দ বদরুদ্দোজার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সঠিকভাবে ‘চাচা’ উচ্চারণ করতে পারতাম না বলে তাকে ‘থাতা’ হিসেবে চিনতাম।

১৯ নম্বর ইউরোপিয়ান এসাইলাম লেনের ভাড়া করা বাসায় আব্বা, আম্মা ও আমরা সাত ভাই-বোন বসবাস করতাম। ওই ভাড়া বাড়িতেই আব্বা ও আম্মা ইন্তেকাল করেন। লোকে ভাবত সেটি আব্বার নিজের বাড়ি। কিন্তু কলকাতার মেয়র এবং ব্রিটিশ ভারত ও স্বাধীন ভারতের লেজিসলেটিভ কাউন্সিল, বিধান সভা ও দিল্লির পার্লামেন্টের (লোকসভা) প্রায় ৩৫ বছর সদস্য থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীপৃষ্ঠে আব্বা মরহুমের নিজস্ব কোনো বাড়িঘর ছিল না। কোনো সহায়-সম্পত্তিও ছিল না। মৃত্যুকালে রেখে যেতে পারেননি তিন অঙ্কের কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স। নজরুলের মতোই তিনি ছিলেন পার্থিব চিন্তা-চেতনার নিরাসক্ত মর্দে মুজাহিদ। অন্যায়, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে মানুষকে উজ্জীবিত করাই ছিল তাদের দু’জনেরই সংগ্রামী জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য।

১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ৩/৪ সি, তালতলা লেনের বাড়িতে কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদের আথে থাকতেন নজরুল। এই ৩/৪ সি, তালতলা লেনেই প্রথম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। এখানেই নজরুল তার বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করেন।

৩/৪ সি, তালতলা লেনে নজরুলের বাসা ছিল আব্বার শরীফ লেনের ভাড়াকৃত বাসার খুবই কাছে। হেঁটে গেলে সাত-আট মিনিট লাগত। নজরুল ও আব্বা প্রতিদিনই ‘মর্নিং ওয়াক’-এ যেতেন কলকাতা মাদরাসার পার্শ্ববর্তী ওয়েলেসলি স্কয়ারে। সময় থাকলে এবং আবহাওয়া ভালো হলে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট পার হয়ে সাডার স্ট্রিটের (রবীন্দ্রনাথ ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ এখানেই রচনা করেন) মধ্য দিয়ে গড়ের মাঠে হাঁটতে যেতেন। হাঁটতে হাঁটতে সুখ-দুঃখের গল্প করতেন দুই বন্ধু। সমাজের কুসংস্কার কিভাবে দূর করা যায়, অবহেলিত ও নির্যাতিত মানুষের পরিত্রাণ কিভাবে সম্ভব, ধর্মের সঙ্কীর্ণতা কিভাবে মোকাবেলা করা যায়, সেসব জটিল বিষয়ের আলোচনাও হতো দুই বন্ধুর মধ্যে। ফেরার পথে নজরুল প্রাতরাশ করতেন আমাদের বাসায়।

আমার জন্ম তখনো হয়নি। আব্বার মুখে এসব কথা শুনেছি।

আমার আম্মা ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণ মহিলা। ইসলাম ধর্মে তার বিশ্বাস ছিল অনড় ও অটুট। তবে তিনি আদৌ গোঁড়া বা ধর্মান্ধ ছিলেন না। শালীনতা ও আব্রু সযতনে ও সুষ্ঠুভাবে রক্ষা করে প্রয়োজনবোধে নজরুলসহ আব্বার অন্য বন্ধু-বান্ধবদের সামনে তিনি আসতেন। পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন না। নজরুলের ভাষায় : ‘জরী শাড়ী পরা চকোলেট ওরা, বন্ধ হেরেম বাক্সে’ তিনি ছিলেন না। স্বামীর প্রতিভাবান অথচ খামখেয়ালিতে ভরা বন্ধুটি অন্ততপক্ষে সকালে যেন ভালো করে খেতে পান সে বিষয়ে মা বিশেষভাবে লক্ষ রাখতেন।

আমার বয়স যখন মাত্র পাঁস মাস, তখন আব্বার রাজনৈতিক গুরু শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সহায়তায় আম্মা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে একটি অতি দুর্লভ সাক্ষাৎ পেতে সক্ষম হন। সাক্ষাৎকারের সময় আমাকে তিনি রবীন্দ্রনাথের কোলে বসিয়ে দেন। কবিগুরু আমাকে আদর করেন। মা অত্যন্ত পুলকিত হন।

কিন্তু প্রবলভাবে রবীন্দ্রভক্ত হলেও নজরুল ইসলামের গান শুনতে মা খুবই পছন্দ করতেন। বিশেষ করে তার রচিত অসাধারণ ইসলামি গানগুলো।

নজরুলগীতির প্রতি প্রবল আসক্তি তখন সব বাংলাভাষী মুসলমানেরই ছিল। কারণ অতীতে ইসলাম ধর্মবিষয়ক গান বাংলার লোকসঙ্গীতে প্রচলিত থাকলেও, বাংলা গানের মূল স্রোতে যেমন হিন্দু ঐতিহ্যবাহী ধর্মবিষয়ক সঙ্গীত ছিল তেমন ইসলামি ঐতিহ্যভিত্তিক গান ছিল না। মুসলিম তার গৌরবময় ঐতিহ্য ভুলে, তার সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবদান ভুলে যে নিষ্ক্রিয় অসাড় জাতিতে পরিণত হয়েছিল, সেই মর্মবেদনাই ছিল নজরুলের ইসলামি কাব্য রচনার মূল উৎস। বাংলার সঙ্গীত-বিমুখ রক্ষণশীল মুসলমানসমাজে আজ যে সঙ্গীতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তা নজরুলেরই অবদান।’ (কল্যাণী কাজী)

১৯৩২ সালে হিজ মাস্টার্স ভয়েসে রেকর্ডকৃত ‘ও মন, রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’ গানটি প্রকাশিত হলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সব বাঙালি মুসলমান অভিভূত হয়। এরপর একটার পর একটা নজরুলের ইসলামি গানের রেকর্ড বের হতে থাকে। ইসলামের বিভিন্ন বিষয় অবলম্বন করে নজরুল প্রায় সাত শতাধিক গান রচনা করেন। ‘ত্রিভুবনে প্রিয় মুহাম্মদ’, ‘তৌহিদেরি মুর্শিদ আমার’, ‘আমি আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর’, ‘সাহারাতে ফুটল রে রঙিন গুলে লালা’ প্রভৃতি গানের রেকর্ড বেরোনমাত্র আম্মা তা সংগ্রহ করতেন। কলের গানে সেগুলো বাজিয়ে তন্ময় হয়ে শুনতেন।

আম্মা নজরুলের গানের প্রতি আকৃষ্ট হন আরো একটি কারণে। সেকালের প্রখ্যাত গায়ক কে মল্লিকের গান আম্মা খুবই পছন্দ করতেন। কে মল্লিক ছিলেন অতি উঁচু দরের গায়ক। ১৯১৪ সালে এইচএমভি প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপনে মালকাজাহান, আমীরজান, পিয়ারা সাহেব, সোরাবজী, আর ধোন্ধি, মহম্মদ হোসেন, বেদানা দাসী, চিত্তরঞ্জন গোস্বামী, নারায়ণচন্দ্র মুখার্জি ও কে মল্লিককে ‘ভারতের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত শিল্পী’রূপে পরিচিহ্নিত করা হয়। (দেশ, কলকাতা, ২ অক্টোবর ২০১৩)

সম্পর্কে কে মল্লিক ছিলেন আমার আম্মার খালু। আমরা অনেকেই জানি না যে, কে মল্লিক মুসলমান ছিলেন। তার আসল নাম ছিল মোহাম্মদ কাশেম। ডাক নাম মানু মিঞা। কে মল্লিক ছদ্ম নামে তিনি গাইতেন। স্বয়ং নজরুল ইসলামের প্রশিক্ষণে কে মল্লিক এইচএমভিতে রেকর্ডিং করেন দুটি বিখ্যাত গজলÑ ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ ও ‘আমারে চোখ ইশারায়’। গান দু’টি, বিশেষ করে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯২৮ সালে কাজী নজরুল ইসলামের প্রশিক্ষণে তার ১০টি অতি জনপ্রিয় গান রেকর্ড করা হয় ছয়জন প্রখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠে। ঐ শিল্পীদের অন্যতম ছিলেন আমার নানা কে মল্লিক। অন্যরা হলেন আঙুরবালা, ইন্দুবালা, মানিকমালা, প্রতিভা বসু ও উমাপদ ভট্টাচার্য। সেকালে (এবং পরবর্তী পর্যায়েও) সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, বিশেষ করে বিনোদন জগতে, মুসলমানরা নিজেদের নাম গোপন রাখতেন। ‘হিন্দুয়ানি’ নাম গ্রহণ করতেন। যেমন Ñ দিলীপ কুমার (ইউসুফ খান), তপন কুমার (তালাত মাহমুদ), মীনা কুমারী (মাহজাবীন বানু), মধুবালা (মমতাজ জাহান), নার্গিস (ফাতিমা বেগম) ইত্যাদি।



খালুর অতি জনপ্রিয় গানের রচয়িতা যিনি, স্বভাবতই তার প্রতি মায়ের সমবেদনা ছিল অপরিসীম। তাই ‘চাল-চুলোবিহীন’ এই গীতিকারকে আম্মা যতœ করে খাওয়াতেন। আব্বার বন্ধুটিকে প্রাতরাশে পরিতৃপ্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন।

নজরুল হুগলিতে (এবং পরবর্তী পর্যায়ে কৃষ্ণনগরে) বসবাস করলেও আব্বার সাথে তার বন্ধুত্ব অটুট থাকে। আব্বাও তার শরীফ লেনের বাসা ছেড়ে ১৯ নম্বর ইউরোপিয়ান এসাইলাম লেনের ভাড়াকৃত বাসায় চলে আসেন। এই বাসাতেই আমার জন্ম হয়।

নজরুল যখনই কলকাতায় আসতেন, আমাদের বাসায় আসতে ভুলতেন না। প্রায়-সমবয়সী আমার আব্বা তার বন্ধু হলেও, তিনি আব্বাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। ধর্ম সম্পর্কিত দ্বিধাদ্বন্দ্বের সম্মুখীন হলে আব্বার পরামর্শও নিতেন।

আমাদের বাসায় এলে আমাকে (তখন আব্বার কনিষ্ঠতম সন্তান) আদর করতেন। কোলে নিতেন। (মায়ের মুখে শুনেছি) একবার আমাকে কাঁধে নিয়ে বারান্দায় পায়চারিও করেছিলেন। ঝাঁকড়া চুলওয়ালা এই ‘থাতা’-কে আমার বেশ ভালো লাগত।

কৃষ্ণনগরে থাকাকালীন তিনি ‘স্বদেশী গান’সহ ‘গজল’ রচনাও শুরু করেন। করাচি সেনানিবাসে থাকাকালীনই উর্দু ও ফারসি গজলের সাথে তার পরিচয়-পরিচিতি ঘটে। তবে, এক বাংলাভাষী মুসলমানও তার সুললিত কণ্ঠে উর্দু গজল গেয়ে নজরুলকে অভিভূত করতেন। তিনি হচ্ছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ঈসা, আব্বার মামাতো ভাই। Lawyer Magistrate পদে কার্যরত থাকাকালীন নজরুলের সাথে তার পরিচয় হয়। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে ও ঘরোয়া-অনুষ্ঠানে সৈয়দ মোহাম্মদ ঈসা গজল পরিবেশন করতেন। বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে তার গান শুনে নজরুল গজলের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট হন এবং তার কাছ থেকে শোনা একটি গজলের সুর নজরুল নিজের সুরারোপিত গজলেও ব্যবহার করেন।

আব্বা যখনই নবযুগ অফিসে নজরুলের কাছে যেতেন, আমার বড়ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ আলী ও আমাকে (কনিষ্ঠতম আদুরে সন্তান বিধায়) নিয়ে যেতেন। তবে, আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকতাম। আব্বার কিনে দেওয়া কলা ও হারশি (Hershey) চকোলেট খেতাম।

নজরুলের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের অন্যতম সূফী জুলফিকার হায়দার ও সৈয়দ বদরুদ্দোজার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৪৩ সালে (কিংবা ১৯৪২ সালের শেষার্ধে) শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সভাপতিত্বে ‘নজরুল সাহায্য কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটি নজরুলের পরিবারকে মাসিক ২০০ টাকা অর্থ-সাহায্য প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মাত্র পাঁচ মাস মাসোহারা দেয়ার পর আকস্মিকভাবে তা বন্ধ করে দেয়া হলো। আব্বার কাছ থেকে জেনেছি, একজন মুসলমান কবি, যাকে বাংলাদেশে সবাই শ্রদ্ধা করে, গোপনে শেরেবাংলাকে বলে আসেন যে, নজরুলের বাসায় এখন ‘দীয়তাং ভূজ্যতাং রব’। শাশুড়ি গিরিবালা দেবীর একচ্ছত্র আধিপত্যে বহু চেনা-অচেনা ও আশ্রিত ব্যক্তি ‘চর্বচোষ্য লেহ্য পেয়’ খাচ্ছে। শেরে-বাংলা উত্তেজিত হয়ে সে কথা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে জানান। নজরুলের মাসোয়ারা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৪২ সালের অক্টোবর মাসে নজরুলকে যখন কলকাতার লুম্বিনী পার্ক মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি করা হয়, তখন সৈয়দ বদরুদ্দোজা কলকাতার মেয়র। চার মাস কবি লুম্বিনী হাসপাতালে ছিলেন। সূফী জুলফিকার হায়দার তার ‘হায়, তমসা’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ‘কবি লুম্বিনী পার্ক হাসপাতালে চার মাস ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একমাত্র সৈয়দ বদরুদ্দোজা ব্যতীত বাইরের আর কেউ তাকে দেখতে যায়নি।’

শুধু তাই নয়। অর্থাভাবে যখন কবিকে লুম্বিনী পার্ক হাসপাতাল থেকে জবষধংব করা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন আব্বাই সূফী জুলফিকার হায়দারকে সাথে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শেরে-বাংলার কাছে যান এবং কবির অর্থ-সঙ্কটের বিষয়ে তাকে অবহিত করেন। স্বর্ণ হৃদয়ের অধিকারী শেরে-বাংলা তাৎক্ষণিকভাবে ইম্পেরিয়াল ব্যাংকে তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে আব্বার নামে ১৯০ রুপি অঙ্কের একটি চেক কেটে দিয়ে কবির হাসপাতালের বিল পরিশোধ করার নির্দেশ দেন। আব্বা ও সূফী জুলফিকার যখন তিলজলার লুম্বিনী পার্কে বিল পরিশোধ করতে চান, তখন মেয়রের কনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে আমিও সাথে ছিলাম। অবশ্য আমি তখন পাঁচ বছরের বালক বিধায় লুম্বিনী পার্কের ভেতরে আমাকে নেয়া হয়নি। ড্রাইভার ঈশারাতের সাথে আমি আব্বার গাড়িতেই অপেক্ষা করেছি।

এটিও আল্লাহর রহমত বলে আমি মনে করি। কারণ সুঠাম দেহের অধিকারী ঝাঁকড়া চুলওয়ালা যে ‘থাতার’ কোলে ও কাঁধে চড়ার আমার সুযোগ-সৌভাগ্য হয়েছে, তাকে হাতেপায়ে চেইন দিয়ে বাঁধা ‘উন্মাদ’ অবস্থায় দেখলে বাল্যকালেও হয়তো আমি সহ্য করতে পারতাম না।

আব্বা ও সূফী জুলফিকার হায়দারের নিরলস প্রয়াসে ১৯৫২ সালের ২৭ জুন আমাদেরই বাসায় কলকাতার ১৯ নম্বর ইউরোপিয়ান এসাইলাম লেনেÑ ‘নজরুল নিরাময় কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটির সেক্রেটারি হন কমিউনিস্ট কবি আবুল কাশেম রহিম উদ্দীন। আ. কা. রহিম উদ্দীন আব্বার আশ্রয়ে আমাদের বাসার নিচের তলায় থাকতেন। কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। আমি তখন কলকাতা মাদরাসায় কাস নাইনের ছাত্র। আমার বড়ভাই, মেজভাই ও আমি, সেইসাথে আমাদের বন্ধু-বান্ধবেরা সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করতাম নিরাময় কমিটিকে সাহায্য করার। চিঠিপত্র, নোটিশ ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে সাইকেলে চড়ে আমরাই পৌঁছে দিতাম। টেলিফোন রিসিভ করতাম। মিটিংয়ের সময় কমিটির সদস্যদের আপ্যায়নে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতাম। মনে গর্ব হতো যে অতবড় কবির সাহায্যার্থে সামান্য কিছু খিদমত করতে পারছি। সবার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্নÑ অসুস্থ কবিকে কোনোক্রমে সুস্থ করে তোলা।

নজরুল নিরাময় কমিটি কবিকে প্রথমে রাঁচী মেন্টাল হসপিটালে চিকিৎসার জন্য পাঠান। এরপর নিরাময় সমিতির উদ্যোগে ১৯৫৩ সালের ১০ মে কবি ও কবিপতœীকে বিদেশে পাঠানো হয়।

বন্ধুর চিকিৎসা ও সাংসারিক ব্যয়নির্বাহে সহায়তা করতে আব্বা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত কলকাতার VIP Road-এ কবি পরিবারের জন্য ১০ কাঠা জমি এবং ভারত সরকার কর্তৃক ১৯৭০ সালে প্রদত্ত ১০ হাজার টাকার অনুদানের ক্ষেত্রেও আমার আব্বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কলকাতায় ডা: বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল ঘোষ, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতি বসু প্রমুখ নেতার সাথে যখন তিনি কবির চিকিৎসা ও আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে যেতেন, তখন অনেক সময় আমারও সৌভাগ্য হতো তার সাথে যাওয়ার। অবশ্য আলোচনায় অংশগ্রহণ করার মতো বয়স তখনও আমার হয়নি। তবে আলোচনা থেকে ফেরার সময় অগ্রগতির কথা আব্বার মুখ থেকে শুনে আনন্দ হতো। ভাবতাম আমার ‘থাতা’ হয়তো সুস্থ হয়ে যাবেন আল্লাহর রহমতে। আবার আমাকে আদর করবেন পূর্বের মতোই।

১৯৬২ সালের ৩০ জুন কবির প্রিয়তমা সঙ্গিনী প্রমীলা যখন পাইকপাড়ার বাসায় মৃত্যুবরণ করেন, তখন লোকসভার সদস্য হিসেবে আব্বা দিল্লিতে ছিলেন। টেলিফোনে প্রদত্ত আব্বার নির্দেশে সমবেদনা জানাতে আমি সেদিন পাইকপাড়ায় গিয়েছিলাম। ‘দোলন-চাঁপা’ প্রমীলার মাথার কাছে বসে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ভাবলেশহীন ‘বিদ্রোহী’ কবিকে দেখে মর্মাহত হয়েছিলাম।

এই ক্ষণজন্মা পুরুষকে রাব্বুল আলামীন ক্ষমা করেছেন কি না জানি না। তবে মহানবী সা: এরশাদ করেছেন Ñ ‘খাইরুন্নাসি মাই-ইয়ান ফাউন্নাস।’ সেই সর্বশ্রেষ্ঠ যে মানবের সর্বোত্তম কল্যাণ সাধন করে। আমাদের প্রাণপ্রিয় জাতীয় কবি নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, ব্যথা-বেদনা দূর করার জন্য যুগের পর যুগ নিরলস, নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়েছেন। একই সাথে ইসলামের সুবিমল জ্যোতি বিকিরণ করে বাংলা সাহিত্য-গগনকে যেভাবে তিনি উদ্ভাসিত করেছেন, তাতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস হয় যে, আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তার অবারিত রহমত থেকে আমাদের প্রিয় কবিকে বঞ্চিত করবেন না। আর তার ইঙ্গিত পাই যখন রহমানুর রহিম, তার অননুকরণীয় রহমতে, কবুল করেছেন কবির আন্তরিক মুনাজাত : ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’



মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩১

গোবর গণেশ বলেছেন: হঠাৎ করেই আপনার এই পোষ্টটি চোখে পড়লো। শেষ করলাম পুরোটাই, শেষ করেছি নার্গিসের কাছে লেখা ও কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লেখা চিঠি। আপ্লুত হয়েছি নার্গিসের কাছে লেখা চিঠিতে।

আমি নজরুল অনুসারী। তাঁর গান আমার সংগ্রহে আছে বেশ কিছু। আছে সব্যসাচীর আবৃতি। প্রায়ই শুনি "যদি আর বাঁশি না বাজে"।

সবগুলো পোষ্ট নজরুলকে নিয়ে, ভালো লেগেছে অনেক। আপনার পোষ্টগুলো আরো আগেই আমার চোখে পড়া উচিত ছিল। সবগুলো পোষ্ট না পড়লেও পোষ্টগুলো দেখেছি। পড়েছি কয়েকটি। কিছু গানও ডাউনলোড করেছি।

আমার বাড়ী ত্রিশালের দরিরামপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে। সময় সুযোগ যখন পেতাম, নজরুল জন্মজয়ন্তী উৎসব উপভোগ করতাম। এখন সময়/সুযোগ হয়না কয়েক বছর। কষ্ট পাই, যেতে পারিনা। মাত্র কয়েকদিন পরেই আবার সেই দিন। এবারও যেতে পারবোনা। খারাপ লাগে।

শেষের অনুরোধটি রাখতে সম্ভাব্য চেষ্টা করবে। যদি আপনার সংগ্রহে আরো কোন আবৃতি, গান, আর চিঠি থাকে তবে লিংক দিবে। এটাই অনুরোধ। বিশেষ করে প্রেমের চিঠি।

২| ২৮ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৬

রাকু হাসান বলেছেন: এটা নিয়ে অনেক ভাবছি । আপনার পোস্ট টা পেয়ে অনেক টা উপকার হলো । আমার প্রশ্ন কে সেই সুনাম ধন্য মুসলিম কবি ? খুব জানতে ইচ্ছে করে । যেই দেখে তাকেন আমরা এই প্রশ্ন .উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন দয়া করে । আর যদি আমি পরলোকে চলে যাওয়ার কারনে যদি জানানো সম্ভব না হয় । তাহলে যথাসম্ভব সত্য উন্মোচন করো .জানায় মানুষদের ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.