নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নুজ্জাত জেরিন

যাহরা আফরিন

নুজাত জেরইন

যাহরা আফরিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার বাবা

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:৪৩

কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা নিজেদের জন্য স্বপ্ন দেখেন না বা দেখতে চান না তবে অন্যদের স্বপ্ন দেখতে সবসময় উৎসাহিত করেন। আমার বাবা তাদের মধ্যেই একজন। আমার যখন ৬ বছর বয়স আর আমার ছোট বোনের বয়স ১ বছর তখন বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে আমার বাবার স্ট্রোক হয়ে গেলো। তার বাম পা এবং বাম হাত তার ক্ষমতার বাইরে চলে গেলো। স্ট্রোকের আগে আমার বাবার স্বভাবে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের একটা ছাপ ছিল। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে তিনবার কলিং বেল টিপতেন আর তাতেই বাসার সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিত। আমার মা সাথে সাথে আমাদের সাদা কালো টিভি বন্ধ করে দিতেন, আমরা সবাই বই নিয়ে বসে পড়তাম, আশেপাশের যে সব প্রতিবেশিরা আমাদের বাসায় টিভি দেখতে আসতেন তারাও পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতেন । আম্মু যত মজারই চা বানিয়ে আব্বুর সামনে দিক না কেন আব্বু চা মুখে না নিয়েই বলতেন

"এইটা কি চা হয়েছে? এর চেয়ে ভালো এক কাপ বিষ দাও, খেয়ে তোমাদের মুক্তি দিয়ে যাই।"

মনে আছে একবার আম্মু আমাকে দেখিয়ে বললেন

" মেয়েটাকে একটু পড়াও না, দেখো দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে!!"

আব্বু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ডাকলেন। আমার বইপত্র নিয়ে ভয়ে ভয়ে তার সামনে যেতেই চটাশ করে একটা চড় খেলাম। আমি অবশ্য জানতাম এই রকমটাই হবে। আমরা দুই ভাই বোন (তৃতীয় জন তখনও কোলের শিশু) তাই সচরাচর বাবার সামনে খুব একটা আসতাম না।

" বই বের কর, কোন পড়া পারিস না দেখি!!"

"ড্রয়িং"

" ড্রয়িং কি কোন সাবজেক্ট হল? দেখি একটা আম আঁক দেখি।"

আমি একটা আম আঁকলাম। বাবাকে দেখালাম এবং আরেকটা চড় খেলাম। এবং বারংবার খেতেই থাকলাম কারন প্রতিবার আমার আম নাকি দেখতে বাংলা পাঁচের মত হয়ে যাচ্ছিল!! একসময় আমার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হল এবং আমি নিঃশব্দে বেহুঁশ হয়ে গেলাম। (বিঃদ্রঃ আমি মোট ২ ঘণ্টা ধরে আম আঁকার চেষ্টা করেছিলাম এবং প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি, শাস্তি স্বরুপ প্রতিবারই আমার বাবার বিশাল হাতের ভয়াবহ চড় খেয়েছি কিন্তু মজার ব্যপার আমি এক বিন্দু চোখের পানি ফেলিনি বা উফ ও বলিনি!!)

সেইদিন অনেক রাতে আমি আমার মাথায় জলপট্টি অনুভব করলাম, চোখটা ভয়ে ভয়ে খুলে দেখতে পারলাম আমার টাইগার বাবা পাশে বসে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছেন। আমার মা তার পাশে ঘুমাচ্ছেন। আমাকে চোখ খুলতে দেখে বাবা জিজ্ঞেস করলেন " কি খাবে আম্মু?"

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম

"পুলাও"

আমার বাবা পাশের রুমে চলে গেলেন। একটু পরে ফিরলেন এক প্যাকেট তেহারী হাতে করে। তখন মধ্যরাত তিনটার মত বাজে হয়ত।

"অফিস থেকে নিয়ে এসেছিলাম আজকে তোর জন্য। খাইয়ে দিব?"

"হুম"

"গান শুনবি?"

"আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে"

বাবা তার ভরাট গলায় গান গাইতে শুরু করলেন আর আম্মু কানে বালিশ চাপা দিলেন।

বলে রাখা ভাল আমার বাবা প্রাইভেট কম্পানির কেরানিগিরি করা ছাড়াও বাংলাদেশ বেতারে মাঝে মাঝে গান গাইতেন। বাসায় তার অনেক শিক্ষার্থী আসতো সে সময়। আমিও তাদের মাঝে বসতাম কালে ভাদ্রে। কারন বাবা আমার বসাটাকে ধনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিতেন না। একদিন সবার সামনেই আমার সঙ্গীত শিক্ষার ইতি টেনে দিলেন। সেইদিন সবাইকে আলাদা করে পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। আমিও ভাবলাম একটু পরীক্ষা দেই। যেই গান শুরু করলাম সঙ্গে সঙ্গে বাবা এক চড় বসিয়ে দিলেন।

"পাখির মত চি চি করলেই গান হয়না, তোমাকে দিয়ে আর যাই হোক গান হবেনা"

সেইবার ই শেষ। আমার বাবার বাড়িতে আজো হারমোনিয়াম তবলা পরে আছে অযত্নে। আমি পরিস্কার করার জন্যও তা স্পর্শ করিনা।

আম আঁকা আর গান গাওয়া কোনটাই আমার দ্বারা আর কখনোই সম্ভব হয়নি।

সেই রয়্যাল বেঙ্গল বাবা আমার প্যারালাইজড হয়ে বিড়াল বনে গেলেন। একদিনে অবশ্য বিড়াল হোন নি। ধীরে ধীরে হয়েছিলেন। আমরাই বানিয়েছিলাম তাকে একজন আদর্শ বিড়াল।



প্যারালাইজড হবার পর সবার আগে তার কেরানির চাকরী টা চলে গেলো। চাকরি থাকা অবস্থায় অনেক কষ্ট করে নিজের সব পুঁজি এবং হাউজ বিল্ডিঙয়ের লোন নিয়ে একটা চার তলা বাড়ি বানিয়েছিলেন। যা থেকে উপার্জন হত যা তার চেয়ে খরচ হত বেশি। ভাইয়া কেও জমানো সব টাকা দিয়ে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন সেটাও প্যারালাইজড হওয়ার আগেই।



ফল স্বরুপ চাকরী যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মা হয়ে গেলেন কিংকর্তব্যবিমুড়। এবং যেই বাবার ভয়ে সর্বদা তথস্ট থাকতেন। তাকেই ছেড়ে চলে যাবার হুমকি চলত রাত দিন। মাঝে মাঝেই চলে যেতেন নানার বাড়িতে। আমাদের দুই বোনের কথা মনে পড়লে আবার ফিরে আসতেন। আমাকে আর আমার ছোট বোন কে আমার টাইগার বাবা এক হাতে গোসল করাতেন, খাওয়াতেন। ধীরে ধীরে আমরা অভাবের টানাপড়েনে বড় হচ্ছিলাম। আমাদের প্রবাসী ভাই মাঝে মধ্যে কিছু অর্থ সাহায্য পাঠাতেন যার হিসাব কড়ায় গণ্ডায় উসুল করতেন। আমার বাবাকে মুখ বন্ধ করে সব অপমান সহ্য করতেই হত । বাবার এই হঠাৎ বিড়াল বনে যাওয়াটা কেন জানি আমি সহজে মেনে নিতে পারিনি। তবে আমার ছোট বোন তাকে বিড়াল হিসেবেই দেখেছে তার শৈশবে। তাকে ছোট বেলা থেকেই বলতে শুনেছি আমি

"খাওয়াতে পারোনা, পড়াতে পারোনা, তুমি আবার কিসের বাবা?"

আমার বিড়াল বাবা চুপ করে থাকতেন। মাঝে মাঝে সহ্য করতে না পেরে বোনের গায়েই হাত তুলতেন। পরিনামে তাকে আরো বেশি শাস্তি ভোগ করতে হত। সেসব শাস্তি যে কতটা ভায়াবহ ছিল তা মনে করতেও চাইনা। আজো মাঝে মাঝে বাসায় গেলে দেখি আমার বৃদ্ধ বিড়াল বাবাকে অপমানের ক্রুব্ধ শুল কিভাবে চারপাশ থেকে বিদ্ধ করে চলেছে! তবে আজকাল বোধ করি তিনি ব্যথা পান না। তার চোখে আমি কোন অনুভুতি দেখিনা।

তবে মজার ব্যপার হল এই লোকটি আমার সঙ্গে সব সময় বাঘের মতই আচরন করতেন এবং এখনো করেন!! আজো বাসায় গেলে আমার সাথে ধমকের সুরেই কথা বলেন।

" শুধু সংসার আর চাকরী বাকরি ই করছিস? লেখাপড়া কি আর করবিনা?"

" আর কত পরবো?"

" এক চড় মেরে দাঁত ফেলে দিব। পড়ার কি কখনো শেষ আছে?"

" এখন সংসার, চাকরি, বাচ্চা কাচ্চা ফেলে কি আমি পি এইচ ডি করতে যাব?"

" কেন যাবিনা? হঠাত করে কোন এক উড়নচণ্ডী কে বিয়ে করে ফেললি। বউ বাচ্চা হয়ে গিয়েছে এখনো চাকরি বাকরি করছেনা!! এটা কিছু হল?? তুই পড়া বন্ধ করবি কেন?"

"আহ, আব্বু!!!"

"চুপ থাক!!!"

"আচ্ছা ঠিক আছে চুপ করলাম"

" সব গুলা ভাই বোনদের মধ্যে তুই হয়েছিস চরম বেয়াদ্দপ। চুপ করে আছিস কেন? মাঝে মাঝে তো একটু লিখালিখিও করতে পারিস নাকি তারো সময় নাই?"

"আমি লিখতে টিকতে পারিনা জানোইতো!!"

(আমার বাবা লিখালিখিও করতেন একসময়।)

"হুম জানিতো, তা পারবি কেন? শুধু পারিস হিন্দি সিনেমা দেখতে!!! জত্তসব রাবিস!!"

"হুম। আচ্ছা আব্বু বাসায় যাই। বাবু আর তার বাবা একা আছে বাসায়"

" যাবি? যা, এখনি চলে যা, আর শোন, এইটা নিয়ে যা"

বাবার হাতে কিছু পুরানো পত্রিকার কপি। হয়তো তাতে কিছু গল্প-উপন্যাস অথবা প্রবন্ধ আছে। আব্বুর পড়ে হয়তো ভালো লেগেছিল। আমার জন্য সংগ্রহ করে রেখে দিয়েছেন!! আমি কপি গুলো নিয়ে বাবার জড়া- জীর্ণ হাতে আমার হাত দিয়ে একটু আদর করি। অমনি তিনি ঝর ঝর করে চোখের পানি ফেলেন।

"ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করিস। পোলাও খেতে ইচ্ছে হলে চলে আসবি। তোর মাকে আমি ম্যনেজ করব। কোন ব্যপার না।"

আমি কিছু বলিনা, তার চোখের পানি মুছে ঘর থেকে বের হয়ে আসি।



আজকাল আমার চোখ দিয়ে কেন যেন পানি পরেনা, শুধু জ্বলে!!!

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:০৮

আহলান বলেছেন: সত্য নাকি? আম আঁকতে না পারায় তিন চড় ... অজ্ঞান ... কঠিন চরিত্র দেখি ....

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ৯:২২

যাহরা আফরিন বলেছেন: মাত্র তিন চড় খাইনি, মোট ২ ঘন্টা যাবত চড় খেয়েছি। তারপর পরে গিয়েছিলাম। কঠিন আর হলাম কই!!!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.