নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পদার্থবিজ্ঞানের ‘তাপ আয়নকরণ তত্ত্ব এবং তারকার আবহাওয়া পরিমন্ডলে তার প্রয়োগ’ সম্পর্কিত সাহা সমীকরণের প্রবক্তা বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। যিনি সমাজের সব স্তরে বিজ্ঞানের কল্যানমুখী ভূমিকা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। জগদীশচন্দ্র বসুর পর, মেঘনাদ সাহাই প্রথম বাঙালি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানের স্রষ্টা হিসেবে বিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে অতি পরিচিত। মেঘনাদ সাহা পরমাণু বিজ্ঞান, আয়ন মণ্ডল, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা করেন। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানকে সাধারণের মাঝে গ্রহণযোগ্য করে তোলার অন্যতম প্রয়াসী ছিলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। এ দেশের পরমাণু বিজ্ঞান, আয়নমণ্ডল, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা বিষয়ে সবচেয়ে বড় গবেষক মেঘনাদ সাহার ১২০তম আজ জন্মদিন। জন্মদি্নে তাঁর জন্য আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা।
মেঘনাদ সাহা ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকার বিক্রমপুরের শেওড়াতলী গ্রামে এক গরীব ঘরে জন্মগ্রহন করেন । জগন্নাথ সাহা এবং ভূবনেশ্বরী দেবীর আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। তার পিতা ছিলেন গ্রামের এক মুদি দোকানদার। ফলে এই আয়ে যে সংসার চলতো তাতে উপযুক্ত শিক্ষা পাওয়া সহজসাধ্য ছিল না। এ কারণে অত্যন্ত মেধাবী ও স্মরণশক্তির অধিকারী হয়েও মেঘনাদ সাহার বিষয়-সংসারে অমনোযোগ; কিন্তু পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করে তার পিতা বিরক্ত হতেন। মেঘনাদ সাহা তাতে দমে যাননি। গ্রামের অদূরে একটি ইংরেজি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। স্থানীয় চিকিৎসক অনন্ত কুমার দাসের সহায়তায় মেঘনাদ সাহা ঐ স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান এবং এই চিকিৎসকের বাসায় থেকেই তিনি লেখাপড়া করেছেন। অর্থাভাবে বহুপ্রতিকুলতা সত্বেও ১৯০৫ সালে ঢাকা মিডল স্কুলে বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান।
১৯০৫ সালের ঘটনা। সারা ভারতে তখন স্বদেশী আন্দোলনের হাওয়া বইছে। এ থেকে বাদ পড়েনি স্কুল কলেজও। বারো বছরের একটি বালক। স্বদেশী আন্দোলনে সাড়া দিয়ে যে খাদির পোশাক পরতে শুরু করেছে, খালি পায়েই স্কুলে যাতায়াত করছে। সেই বিস্ময় বালকটির নাম মেঘনাদ সাহা। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে জড়িত হওয়ার অপরাধে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। বাধ্য হয়ে তিনি কিশোরীলাল জুবিলী স্কুলে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই তিনি পূর্ববঙ্গের সব পরিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হয়ে ১৯০৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এন্ট্রাস পাস করেন। ১৯১১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন।
এখানে তার সতীর্থ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নিখিলরঞ্জন সেন, জ্ঞান মুখার্জি, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ এবং তার শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন রসায়নে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, পদার্থবিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্র বসু, গণিতে ডি এন মল্লিক ও সি ই ক্যালিস। ১৯১৩ সালে গণিতে সম্মানসহ বিএসসি ও ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতে এমএসসি পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
তাপীয় আয়নবাদ (Thermal Ionaisation) সংক্রান্ত তত্ত্ব উদ্ভাবন করে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন মেঘনাদ সাহা। ১৯১৭ সালে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ‘অন ম্যাক্সওয়েল স্ট্রেসেস’ প্রকাশিত হয় ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে। এরপর ১৯২০ সালেই এই ম্যাগাজিনে 'On ionization in the Solar Chromosphere' (সূর্যের বর্ণমণ্ডলে আয়নকরণ) শিরোনামে তার তাপ আয়নকরণতত্ত্ব প্রকাশিত হয় যা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত সূচনা করে। কারণ এই তত্ত্ব দ্বারাই প্রথম তাপবলবিদ্যা ও কোয়ান্টামতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণীর তারকার বর্ণালী ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছিল। কেন সূর্যের বর্ণালীতে সিজিয়াম বা রুবিডিয়াম থাকবে না এর উত্তর দেয়ার সাথে সাথে তিনি এও ভবিষ্যদ্বানী করেন, যদি সূর্যের দেহের অপেক্ষাকৃত কম তাপবিশিষ্ট অংশের বর্ণালী নেওয়া যায় তবে সেখানে কম ভারী মৌলগুলির উপস্থিতি দেখা যাবে। এই তত্ত্ব পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন সংযোজন। মেঘনাদ সাহার গবেষণা ‘তাপীয় আয়ননবাদ’ নামে সুপরিচিত। তার এই তত্ত্বটিই পরে সাহার সমীকরণ নামে পরিচিতি লাভ করে। পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে ততদিনে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। মেঘনাদ সাহা সম্পর্কে আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তি “Dr. M.N. Shaha has won an honoured name in the whole scientific world ”
মেঘনাদ সাহা ১৯১৮ সালে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯১৯ সালে তিনি ‘প্রেসার অব লাইট’এর উপর গবেষণা করে ডি এস সি ডিগ্রী, ১৯২০ সালে ‘অ্যাস্ট্রোফিজিকস’ এর উপর গবেষণা করে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পান। পর্যায়ক্রমে গবেষক ও বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। গবেষণাকর্মের জন্য তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি তাঁকে ফেলোশিপ প্রদান করেছিল। ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ নামে একটি মাসিক পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করতেন। ১৯৪৮ সালে তিনি কলকাতায় 'সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ প্রতিষ্ঠা করেন । আয়নকরণ তত্ত্ব ছাড়াও মেঘনাদ সাহা তারকার বর্ণালী, নিবাচিত বিকিরণ তাপ, বণালী তত্ত্ব, আয়নিক বিশ্লেষণ, আয়নস্ফিয়ারে বেতার তরঙ্গের পরিচলন, সূর্যের করোনা, সূর্যের বেতার বিকিরণ, চৌম্বক এক মেরু, বিটা তেজস্ত্রিয়তা, শিলার বয়স প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা করেন। পদার্থবিদ্যা, জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা, পরমানুবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে তিনি বাংলায় ২৮টি এবং ইংরেজিতে ১১৯টি প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর রচিত উল্লেখ্যোগ্য গ্রন্থাবলীঃ
১। The Principle of Relativity,
২। Treatise on Heat
৩। Treatise on Modern Physics
৪। Junior Textbook of Heat with Meteorology
১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী এই কৃতি বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন। বাংলার বিজ্ঞান চর্চার এই অন্যতম পথিকৃৎ মেঘনাদ সাহার কর্ম ও আবিষ্কার আগামী প্রজন্মের কাছে সবসময়ই অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
বিজ্ঞান চর্চায় প্রেরণাদায়ক এই স্বাপ্নিক বিজ্ঞানীর ১২০তম জন্মদিন আজ। জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায় ।
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১২:৫৫
ইলুসন বলেছেন: এই মহান ব্যাক্তিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। সাথে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমন একটা লেখা আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। আমাদের দেশে এমন গুণি ব্যক্তিদের অনেক বেশি দরকার এখন। দেশে মৌলিক গবেষণা প্রায় হয় না বললেই চলে। অথচ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ করা উচিত ছিল অনেক আগে থেকেই। ভাল ভাল স্টুডেন্টরা সবাই দেশের বাইরে যায় পিএইচডি করতে, তারপরে অনেকে আর ফিরে আসে না। ব্যাপারটা অত্যন্ত দুঃখজনক।