নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি পেশায় একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সংবাদকর্মী, সমাজসেবক এবং প্রযুক্তিবিদ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে থাকি।

ছোট কাগজ কথিকা

আমি পেশায় একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সংবাদকর্মী, সমাজসেবক এবং প্রযুক্তিবিদ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে থাকি।

ছোট কাগজ কথিকা › বিস্তারিত পোস্টঃ

দীপালিদের ভুলে গেছে সবাই!

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:২২

ভালোবাসার নিচে চাপা পড়েছে যে ইতিহাস..
স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস ১৪ই ফেব্রুয়ারী


শাহবাগের যে রাস্তাগুলো আজ ভালোবাসার লাল গোলাপের ঝরে পড়া পাপড়িতে লাল হয়ে উঠেছে, ঠিক ৩৩ বছর আগের এই দিনে এই রাস্তাগুলো আরো বেশি লাল হয়ে উঠেছিল। না, সেটা ঝরে পড়া ফুলের পাপড়িতে নয়, সেদিন এই রাস্তাগুলো লাল হয়েছিল হায়েনার তপ্ত বুলেটের আঘাতে সৃষ্ট ছাত্র-যুবাদের বুকের তাজা রক্তে।

শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোতে আজ যে তরুণ-তরুণীরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মনের মানুষের জন্য ফুল কিনতে যাবে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কিংবা টিএসসিতে বসে সে ফুল দিয়ে প্রিয়জনকে ভালোবাসা জানাবে, তাঁদের কয়জন সে ইতিহাস জানেন?

হলফ করে বলা যেতে পারে, ৯০ শতাংশই জানে না। এবং বাকি ১০ শতাংশ ঠিক কতটা জানে কিংবা আদৌ জানে কি না, তা-ও যাচাই করে দেখার প্রয়োজন আছে। দেশের অন্যান্য প্রান্তের বাদবাকি শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীর কথা না হয় বাদই দিলাম।

সে যা হোক, আজকের মতো একটি রোমান্টিক দিনে সে ইতিহাসের বর্ণনা দিতে গেলে তা অনেকের কাছেই কাঠখোট্টা ঠেকতে পারে। তবু বিবেকের দায়মুক্তি বলে একটা কথা তো আছে।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ যেদিন সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতা দখল করে নিয়ে সামরিক আইন জারি করে, সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করেন। এর পর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন ছাত্রমৈত্রীর তিন সদস্য—শিবলী কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান ও আবদুল আলী। সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাঁদের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। এ ঘটনার পর সূচনা হয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের আপসহীন সংগ্রাম।

এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই সব ধরনের রাজনৈতিক দল ও তাদের সব রাজনৈতিক তৎপরতা করে দিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতে থাকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের দেয়াল লিখন। একদিকে ছাত্ররা দেয়াল লিখে, অন্যদিকে এরশাদের তল্পিবাহী পুলিশ বাহিনী সে লেখা চুন দিয়ে মুছে সাদা করে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সাভারের স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে গিয়ে সেখানেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলেন বামপন্থী ছাত্রনেতারা। খবর পেয়ে সাভার ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনী এসে তাঁদের ওপর চালায় নির্মম নির্যাতন।

মোটকথা, সবাই একরকম নীরবে স্বৈরশাসনকে মেনে নিলেও ছাত্ররা মেনে নিতে পারেননি, এভাবেই তাঁরা ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ। শাসকগোষ্ঠীও নির্যাতনের মাঝেই খুঁজে নেয় টিকে থাকার পথ।

২৩ সেপ্টেম্বর স্বৈরশাসকের নির্দেশে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. আবদুল মজিদ খান ১৯৮২-৮৭ সালের জন্য প্রণয়ন করেন চরমভাবে সাম্প্রদায়িক এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত একটি নতুন শিক্ষানীতি, যা পরবর্তীকালে পরিচিত হয় ‘মজিদ খানের শিক্ষানীতি’ হিসেবে। এই শিক্ষানীতিতে শিক্ষাকে বিনিয়োগনির্ভর পণ্যে পরিণত করা হয়। মোট ব্যয়ের অর্ধেক বহনে সক্ষমদের জন্যই কেবল রাখা হয় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ। পরীক্ষায় ফল ভালো হওয়াটা এ ক্ষেত্রে শর্ত ছিল না। এ শিক্ষানীতির কারণে এরশাদ বিরোধিতার পালে লাগে নতুন হাওয়া। ছাত্ররা এর প্রচণ্ড বিরোধিতায় ঝাঁপিয়ে পড়েন।

৮ নভেম্বর কলাভবনের একটি মিছিলের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে তার পরের দিন মধুর ক্যান্টিনে গঠিত হয় ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। সব ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে খুঁজতে থাকেন প্রতিরোধের উপায়।

১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন নতুন শক্তি পায়। এ সময় আঘাত আসে ভাষা আন্দোলনের চেতনার ওপর। ২১ ফেব্রুয়ারির বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ইসলাম পরিপন্থী ঘোষণা করে শহীদ মিনারে আলপনা আঁকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এরশাদ। মূলত ক্ষমতায় টিকে থাকার মাধ্যম হিসেবে দেশের সাধারণ জনগণকে বোকা বানানোর জন্য এরশাদ ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল গ্রহণ করেন শুরু থেকেই। সাধারণ জনগণ বুঝতে না পারলেও সংগ্রামী চেতনাধারী ছাত্রসমাজ ষড়যন্ত্রটা ঠিকই ধরতে পেরেছিল।

জানুয়ারির শেষ ভাগে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ১৪ ফেব্রুয়ারিতে গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে।

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী মিছিল নিয়ে সচিবালয় অভিমুখে যাত্রা করে স্মারকলিপি পেশ করার উদ্দেশ্যে। মিছিলটি হাইকোর্টের মোড়ে শিক্ষা ভবনের সামনে এসে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়। কাঁটাতারের সামনে এসে মিছিলের অগ্রসারীতে থাকা ছাত্রীরা বসে পড়েন, নেতৃবৃন্দ কাঁটাতারের ওপর দাঁড়িয়ে জানাতে থাকেন বিক্ষোভ। এই সময় লাঠি, টিয়ার গ্যাস, জলকামান সহযোগে নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীর ওপর গুলি চালায় পুলিশ। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে হাইকোর্ট, প্রেসক্লাব, কার্জন হল ও শিশু একাডেমি এলাকায়। এতে জাফর, জয়নাল, দীপালি, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চনসহ বহু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী হতাহত হন।

আগের দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৫ তারিখ ছাত্র-জনতা আবার রাস্তায় নেমে আসে। আবার সংঘর্ষ বাধে পুলিশের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে মিরপুর, আমতলী, তেজগাঁও, বাহাদুর শাহ পার্ক, ইংলিশ রোড, মতিঝিলসহ সারা দেশে। চট্টগ্রামে নিহত হন মোজাম্মেলসহ আরো কয়েকজন।

এই আন্দোলন ছিল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রথম গণআন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের পর এটাকেই বলা যায় ছাত্রসমাজের একটি স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান, যা পরবর্তীকালে এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানকে সম্ভব করে তোলে। তাই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে আখ্যা দেওয়া হয় স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে।

স্বৈরাচার পতনের পর কয়েক বছর দিবসটি ভালোভাবে পালিত হলেও নব্বইয়ের দশকে এর স্থলে আমদানি করা হয় ভিনদেশি সংস্কৃতির ভ্যালেন্টাইনস ডে-কে। উদ্দেশ্য, সমাজের সবচেয়ে প্রাণবন্ত লড়াকু অংশ—তরুণদের দিবসটির কথা ভুলিয়ে দেওয়া। যাতে করে ‘আমি-তুমি’র স্বার্থপর ভালোবাসায় মগ্ন থাকে এবং গণতন্ত্রের খোলসধারী শাসকগোষ্ঠীর স্বৈর আচরণের প্রতি সচেতন না হয়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া দিবসটিকে বাণিজ্যের মহোৎসবে পরিণত করার পুঁজিবাদী লক্ষ্য তো ছিলই।

আজ আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ষড়যন্ত্রটা সফল হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম আমাদের সূর্যসন্তানদের অমরকীর্তিকে একরকম ভুলেই গেছে। ব্যাপারটা যদিও সম্ভব হয়েছে মিডিয়ার কারসাজিতেই। আমাদের সব মিডিয়া ১৪ ফেব্রুয়ারি আসার কয়েক দিন আগে থেকেই ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ চমকপ্রদ আয়োজন হাতে নেয়। চলতে থাকে জোর প্রচার। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে পত্রিকার এক কোণে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস সম্পর্কিত একটা ছোট লেখা চোখে পড়ে হয়তো। এটা আমাদের মিডিয়াগুলোর দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রেম-ভালোবাসার বিরোধিতা করা কোনোভাবেই এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। একটি সুখী-সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠার জন্য নর-নারীর মধ্যকার অটুট বন্ধন অপরিহার্য। তবে তার জন্য নিজের ইতিহাসকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে বিশেষ কোনো দিবসের উন্মাদনায় মেতে ওঠা কতটুকু দরকারি, তা ভেবে দেখার আবেদন করছি।

বাংলাদেশে যখন ভ্যালেন্টাইনস ডে ছিল না, বোধ করি তখনকার ভালোবাসা আরো বেশি দায়িত্বশীল ছিল। উদযাপনের এ পদ্ধতি ভালোবাসার পথকে মসৃণ না করে আরো বেশি সন্দেহপূর্ণ করে তুলছে কি না, তা-ও বিবেচনার দাবি রাখে।

মনে রাখতে হবে, যে জাতি তার ইতিহাসকে ভুলে যায়, সে জাতি একদিন ইতিহাসের গহ্বরেই হারিয়ে যায় এবং সত্যিকার ভালোবাসা কখনো মানুষকে স্বার্থপর হতে শেখায় না। সুতরাং আমাদের উচিত হবে, সত্যিকার ভালোবাসার পথে হাঁটা এবং জাতির অস্তিত্বের স্বার্থে সোনালি অতীতকে কোনোভাবেই ভুলে না যাওয়া।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৩২

বিজন রয় বলেছেন: আমরা ভীষণ ভুলো জাতি।
লেখায় ++++++++++++++।

২| ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০১

সপ্তাংশু অর্পণ বলেছেন: অজানা তথ্য জানলাম। লেখক আপনাকে ধন্যবাদ তথ্যটি প্রকাশ করার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.