নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি আসলে বুঝতে পারছি না আমি কে বা কি ?

মাধুকরী মৃণ্ময়

কিংকর্তব্যবিমুড়

মাধুকরী মৃণ্ময় › বিস্তারিত পোস্টঃ

কে হায়! হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে !!

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৮:১২

আমি তখন ক্লাস নাইনে । মুখে নরম লোমের আস্তরন। ছোট্ট শহরের ছোট্ট পাড়ায় আমার নিস্তরং জীবন। তখন জীবনের গুটিকয়েক চাহিদা, বিকাল বেলা ক্রিকেট , দুপুর বেলা ঘুম আর সুযোগ বুঝে স্কুল ফাকি দিয়ে সিনেমা দেখা। এই নিস্তরং জীবন খান খান করে দিয়ে আমাদের বাসার সামনে্র বাসায় দুইটা অতিব সুন্দর মেয়ের আগমন ঘটলো। তখন আমার গুটিকয়েক চাহিদা একটি মাত্র চাহিদায় রুপান্তরীত হলো। তাদের বাসার সামনে ঘুর ঘুর করা। মোটামুটি দিবাস্বপ্নও দেখা শুরু করে দিলাম তাদেরকে নিয়ে। কিন্তু সমস্যা হলো স্বপ্নের ভেতর দুই বোন একসাথে আসা শুরু করলো। ভাবলাম, যা ! তা কি হয় !
একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি আমার বড় আপার সাথে দুই বোন খুব জমিয়ে গল্প করছে।আমি তাদের আসে পাশে চক্কর দেয়া শুরু করলাম। আপা বলল, এইটা আমার ছোট ভাই। তারা উদাস ভংগিতে বলল, ও আচ্ছা। কি রিনিঝিনি কন্ঠ ! পরে জানলাম এক বোন আমার আপার সাথে পড়ে আরেকটা আপার চেয়ে দুই ক্লাস উপরে। আমার স্বপ্নের দ্বার রুদ্ধ হলো কিন্তু তাদের বাড়ির দ্বার আমার জন্য খুলে গেলো।
তাদের বাড়িতে যেদিন প্রথম গেলাম ,দেখি সোকেচ ভর্তি ট্রফি আর আলমারী ভর্তি বই। বললাম , এই গুলা কার। তারা বলল , এইগুলা মাজেদ ভাই এর। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে , এক্স ক্যাডেট। তারপর দেখাতে শুর করলো এইটা ইন্টার ক্যাডেট ফুলবল চ্যাম্পিয়ানের ট্রফি, এইটা হকি, এইট ব্যাডমিন্টন, এইটা দাবা। আমি দেবে মাটির নিচে চলে গেলাম। আমি এই জীবনে স্কুল পালানো আর ঘুর ঘুর ছাড়া আর কিছুই পারিনা। আচ্ছা এই গুলার জন্য কোন পুরস্কারের ব্যাবস্থা নেই ? থাকলে আমিই হতাম চ্যাম্পিয়ান। আমার ঘরেও থাকতো দুইটা ট্রফি।
শীতের ছুটিতে মাজেদ ভাই বাড়ি আসলো। আমি হলাম তার ছায়া সঙ্গি। পাড়ার মেয়েরা জানালা, দরজা, পর্দার ফাক দিয়ে তাকে দেখা শুরু করলো। না দেখার কোন কারন নেই। গ্রীক দেবতাদের মতো তার চেহারা। হিংসায় জ্বলতে জ্বলতে বললাম, আপনার সাথে বেড়াবো না। সে অন্তর্জামির মতো, তোকেও মানুষ দেখবে, বড় হ। আমি সুনিলের কবিতার সুরে বললাম, আমি আর কতো বড় হবো নাদের আলি!
ব্যাডমিন্টন খেলায় তার সাথে পাড়ার কেউ পারে না। আমি হেরে যাওয়ার ভয়ে তার পার্টনার হয়। একদিন সে বলল, শোন , তোর সামনে যে দুনিয়া পড়ে রয়েছে সেখানে তোর একাই লড়তে হবে, তোর পার্টনার কেউ হবে না সুতরাং এখন থেকে তুই আমার পার্টনার না। আমি ঠিক আছে বলে বুক ফুলিয়ে তার সাথে সিঙ্গেল খেললাম আর গো হারা হারলাম। খেলার পর হাপাতে হাপাতে বললাম , আমি একা খেলবো না, একা খেললে হেরে যায়। সে কাছে এসে বলল, তুই যদি ভালো প্লেয়ার হতে চাস তাহলে তোর প্রতিপক্ষ হতে হবে তোর থেকে ভালো। তাইলে তুই বুঝতে পারবি কোন জায়গায় তোকে ইম্প্রুভ করতে হবে। তার দুই বছর পরে আমি অনুর্ধ উনিশে জেলা পর্যায়ে রানার্স আপ হয়ে গেলাম । মাজেদ ভাইকে জানালাম, সে নিরস মুখে বলল , এতো খুসি হওয়ার কিছু নেই , তুই চ্যাম্পিয়ান হতে পারতি।
তারপর ভার্সিটি এডমিশনের জন্য মাজেদ ভাই এর কাছে গেলাম। এফ রহমান হল। বিকালে বলল, চল তোকে বই কিনে দিই। নীলক্ষেতে যেয়ে হুমায়ন আহমেদের বই কাছে আমার পা আটকে গেল। সে বলল, হুমায়ন আহমেদ পড় কিন্তুই এই গুলাও পড়। তার হাতে অরুন্ধুতি রায়ের ,গড অফ দা স্মল থিংস।
বাড়িতে এসে বই পড়ার পর বললাম, কি বই কিনে দিয়েছেন কিছুই বঝিনা।সে বলল, বড় হ বুঝবি। আমি মনে মনে বললা, যেদিন আমার মাথা ছাদ ফুড়ে আকাশে পৌছাবে , সেদিন কি আমি বড় হবো !!
আমি কিছুতেই বড় হচ্ছি না। এইদিকে মাজেদ ভাই পড়াশুনা শেষ করে চাকুরীজিবি হয়ে গেছে। একদিন দেখি বাক্স প্যাটরা নিয়ে বাড়িতে হাজির। বললাম ভাই আপনার চাকরি। সে বলল, চাকরী করবো না। বললাম, কেন? এই দেশে মামা চাচা ছাড়া ভালো চাকরী পাওয়া আর সেই চাকুরী টেকানো দুটোই কঠিন। আমি বি সি এস দিব। এই খানে বলে নি, মাজেদুল ভাই এর মা মারা গেছে সে তখন ক্লান টেনে।বাপ আরেকটা বিয়া করেছে । সেই সৎ মা মাজেদুল ভাই কে কখনো ছেলে হিসাবে নেই নি। দু দিন যেতে পারলো না বাড়িতে অশান্তি শুরু হলো। মাজেদ আবার লোটাকম্বল নিয়ে বলল আমি গ্রামে যেয়ে পড়াশুনা করবো।
সেই যে গ্রামে গেল, ফিরতে লাগলো অনেক দিন। যখন ফিরে এলো তখন সে বদ্ধ পাগল। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে, উদভ্রান্ত দৃষ্টি।
আমি কাছে যেয়ে বললাম ,ভাই ভালো আছেন । আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বলল, হু আর ইউ ? সারাদিন তাকে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয় কারন ছাড়া পেলেই তার কাছে যা ভাল লাগে না সে সব কিছু সে তছনছ করে দেই। তার শরীরে অসুরের শক্তি। আমি জানালা দিয়ে উকি মেরে দেখার চেষ্টা করি মাজেদ ভাই কি করছে। শুনি, অনর্গন ইংরেজিতে কার সাথে যেন কথা বলছে, আর মাঝে মাঝে বলছে , শাট আপ , শাট আপ ।
একদিন বিকালের দিকে শুনি আমাদের মেইন গেইট কে যেন জোরে জোরে ঝাকাচ্ছে। খুলে দিয়ে দেখি মাজেদ ভাই, পুরো উলং। বলল, আমাকে বাচা তুই।ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।পেছনে তাকিয়ে দেখি লাঠি নিয়া তার আব্বা ও আরো কিছু মানুষ আমাদের বাড়ির দিকে আসছে।মাজেদ ভাই পাড়ার ভেতর দৌড় দিল । তখন গ্রিক দেবতা কে দেখে মুখ লুকালো পাড়ার সকল এককালের উতসুক্য রমনীকুল।
মাজেদ ভাই আর পাওয়া গেলো না।আমিও পড়তে ঢাকাতে চলে এলাম।
একদিন মা ফোন দিয়ে বলল, মাজেদ মারা গেছে। আমি বললাম কিভাবে? মা বলল, হাইরোডে জোরে গাড়ি চলছিল। গাড়ির সামনে গিয়ে দাড়িয়েছিলো ঠেকানোর জন্য। তারপর গাড়িটা চাপা দিয়ে চলে গেছে । আমি প্রিয়জন হারানোর বেদনায় কেদে ঊঠলাম।
এত বছরে চাপা পড়ে গেছে তার স্মৃতী।সেদিন নীলক্ষেতে গিয়েছি বই কিনতে । কিনলাম অরুন্ধুতি রায়ের , দা মিনিস্ট্রি অফ আটমস্ট হাপিনেস। অরুন্ধিতি রায় আমাকে মনে করিয়ে দিল আমার প্রয় মাজেদ ভাই এর কথা । আরো মনে করিয়ে দিলো, এই কথা বলতে যে , আমি , গড অফ দা স্মল থিংস পড়ে বঝেছি। বুঝেছি যে , গরীবদের ঈশ্বরও গরীব।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৮:৫৮

অদ্ভুত_আমি বলেছেন: "রোল মডেল" রা কেন এমনভাবে হারিয়ে যায় ? :(

২| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:১৬

মজন০৯ বলেছেন: আইকন! কোথায় কন! তারপরও মাজেদ ভাইরা থেকে যান!

৩| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৫৫

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: শিরোনাম যথার্থই হয়েছে বটে!

কিন্তু কারণটা অনুহ্যই রয়ে গেল!!! মাজেদের এমনটা ঘটার কি এমন ঘটেছিল???
রহস্যই রয়ে গেল!

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৫৪

মাধুকরী মৃণ্ময় বলেছেন: সেটা আমার কাছেও রহস্য। তবে ক্রমাগত পারিবারিক অশান্তি। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরী না পাওয়া। হতাসা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার তার প্রপার ট্রিটমেন্ট না হওয়া। তার পরিবার এই ছেলেটার প্রতি এতো উদাসিন ছিল । ভাবা যায় না! এখন অবস্য বাড়ির নাম দিয়েছে। মাজেদ মঞ্জিল!!!

৪| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:১৩

মাআইপা বলেছেন: লেখাটা যেমন চমৎকার হয়েছে তেমনি মনটা খারাপ হয়ে গেল

৫| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৩১

রাজীব নুর বলেছেন: ঐ বয়সে আবেগ কন্টোল করা যায় না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.