নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলমাহবুব

আলমাহবুব › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন মুক্তিযুদ্ধা এবং সময় অসময়ের গল্প

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:৫১



সুবলপুর গ্রামের মসজিদে মাইক এসেছে নতুন। আজানের শব্দে মানুষ এখনও অভ্যস্থ হয়নি। মাইকে প্রথম ফু দিলে তাই কেঁপে ওঠে সবাই। গ্রামবাসীর কাছে এ শব্দ অনেকটা অজানা, অচেনা। ইস্রাফিলের সিঙ্গার মত অচেনা এক সুর তাদের কানে আসে।

মাইকে হঠাৎ ফু পড়ে। অজান্তেই কান জাগ্রত হয় সবার। কিছুক্ষণের জন্য হলেও থমকে যায় কর্মব্যস্ত হাত। যেন মোয়াজ্জিনের কথা শুরু না হলে কাজ শুরু করতে পারছে না কেউ। আজকের ফুটা বড়ই অবেলায়। সন্ধ্যার আজানের এখনও বেশ বাকি। শেষ বিকালের ম্লান সূর্যরশ্মি এখনও ছড়িয়ে আছে বড় আমগাছটাতে। হঠাৎ এমন কি হল। আজান ছাড়া অবেলায় এখনও এ মাইক বেজে ওঠেনি।

সবাই তাই একটু বেশিই মনযোগ দেয়। মোয়াজ্জিনও যেন সবার এ ব্যগ্রতা বুঝতে পারে। শুধু ফু দিয়েই সে থেমে থাকে। জাদুকরের চৌম্বক কোন মুহুর্তে থেমে যাওয়ার মত। মানুষ অধৈর্য হয়ে ওঠে। অনেকে ভাবে বুঝিবা মোয়াজ্জিন ভ’ল করেছে। অথবা মাইকে কোন সমস্যা হয়েছে।

আবার বেজে ওঠে ফু। এবার আর মোয়াজ্জিন দেরি করে না। সে ক্লান্ত সুরেলা স্বরে বলে- ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বাক্যটা কয়েকবার বলে সে। আবার বিরতি নেয়। যেন গুছিয়ে উঠতে পারছে না কী বলবে।

সবাই বুঝে ফেলে কোন দুঃসংবাদ। হয়ত কেউ মারা গেছে। পাশের কদমতলী গ্রামের বড় মসজিদটাতে কেউ মরলে এভাবে বলতে শুনে সবাই। তারপরও সবাই সচেতন হয়। এ মাইকে এটাই প্রথম কোন মৃত্যুসংবাদ। এবার যেন মাইকের অন্য এক ব্যবহার সম্পর্কে সবাই জানতে পারছে।

মোয়াজ্জিন ঘোষণাটি দিয়ে চলে। সবাই শুনে কান খাড়া করে। প্রথমবার ঠিক যেন বুঝতে পারে না। হয়ত মাইকে প্রথম মৃত্যু সংবাদ দেয়া হচ্ছে- এটাই সবার মনে খেলা করছিল। কিন্তু আবার যখন শুনে তখন সবাই চুপসে যায়। যেন মাইকে এ ঘোষণা না দিলেই ভাল হত। কেমন যেন অবিশ্বাস- ঠিক অবিশ্বাস ও নয়, যেন অসহায় ভাবে সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়া চাউয়ি করে।

কফিল উদ্দিন মারা গেছেন। বীর মুক্তিযুদ্ধা কফিল উদ্দিন।

লোকজন সবাই কফিল উদ্দিনের বাড়ির দিকে যেতে শুরু করে। গ্রামের বৃদ্ধ- জোয়ান, শিশু- নারী সবাই। মুহুর্তেই ভীর লেগে যায় কফিল উদ্দিনের ছোট উঠানটায়। ভীরের মাঝে মেম্বার আলীম উদ্দিনকেও দেখা যায়। শোনা যাচ্ছে চেয়ারম্যান সাহেবও নাকি আসবেন।

সবাই ভীর করে দাঁড়িয়ে থাকে। এখন কী করতে হবে সবার যেন তা অজানা। কেউই নড়ে না। কথাও বলে না। ইমাম সাহেব পর্যন্ত চুপ করে দাড়িয়ে আছেন। ভিতর বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে চাপা কান্নার আওয়াজ সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছে- দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না।

ইমাম সাহেবই প্রথম কথা বলেন। দীর্ঘ নিরবতা ভেঙ্গে তিনি বলেন, ভাইসব। বলে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেন। আবার বলেন, এ গ্রামের গর্ব কফিল উদ্দিনকে কবর দিতে হবে। মরা দেহ বেশিক্ষণ রাখতে নেই। জানাজা ও কাফন দাফনের ব্যবস্থা কর।

ইমাম সাহেবের কথায় কেউ তেমন ব্যস্ততা দেখায় না। তিনিও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন।

ভীর থেকে হঠাৎই একজন বলে ওঠে- পুলিশ! পুলিশ আইব না?

কথাটা বেরোয় রহিম কাজীর মুখ থেকে। সে ই কফিল উদ্দিনের সবচেয়ে ভাল বন্ধু। একসাথে তারা যুদ্ধও করেছে।

কেউ কোন উত্তর দেয় না। সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে সবাই পুলিশ আসার অপেক্ষা করে।

পুলিশ আইব না।

সবাই চমকে মুখ তুলে। উত্তরকারীর মুখ খোঁজে সবার চোখ। হ্যাঁ, মেম্বার আলিম উদ্দিনই কথাটা বলেছে। সবাই যেন কেমন আহত চোখে তাকায় তার দিকে। পুলিশ আইব না- এ যেন একদমই বেহক কথা। যেন মেম্বার আলিম উদ্দিন অন্যায় কোন কাজ সবার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

প্রথম একজন মৃদু স্বরে বলে ওঠে, এ কেমন কথা! পুলিশ আইব না কেন?

সকলেই একথাকে সমর্থন করে। একজন নিজের মনেই বলে, কফিল ভাইর বড় শখ ছিল! সকলকে একথা বলে বেড়াত।

এভাবে ক্রমে একটি গুঞ্জন ওঠে। সবাই মৃদু স্বরে একই সাথে কথা বলতে থাকে।

অনেক্ষণ চলে এভাবে। ক্রমে রাত হতে থাকে। মেম্বার আলিম উদ্দিন এবার একটু সামনে আসে। একটি হাত উঁচু করে সবাইকে থামতে বলে। তারপর গলা খাকাড়ি দিয়ে সে বলতে থাকে- ভাইসব। আমরা সকলেই জানি কফিল ভাই গরিব হলেও তার খুব গর্ব ছিল, সে মুক্তিযুদ্ধা। আমাদের গর্ব করে বলত- মরলে তারে সবাই স্যালুট করবে। পুলিশ তারে সম্মান দেখিয়ে লাইন ধরে দাঁড়াবে। জাতীয় পতাকা দিয়ে তারে সসম্মানে কবরে রাখবে।

এখানে এসে মেম্বারের গলা ধরে আসে। সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে সমর্থন করে। দু একজন চোখের কোনে জমে ওঠা পানি মুছতে মাথা নিচু করে। মেম্বার আবার বলতে থাকে, এখন রাত হয়ে গেছে। এতদুর থেকে পুলিশ আসতে না চাইলে আমরা কি করব? যোগাযোগ ব্যব¯থা ভাল নয়। পুলিশের তাই এককথা, তারা আজ আসতে পারবে না। কিন্তু লাশ তো সারা রাত রাখা যায় না। এখন আমরাই তারে পতাকা দিয়ে কবরে রাখব।

সবাই চুপ করে থাকে। সত্যিইতো। পুলিশ আসতে না চাইলে কার কি করার। তাই মেম্বারের কথার উপর কোন কথা কেউ খুঁজে পায় না। তবে কেউই কোন নড়াচড়া করে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে নিজ নিজ জায়গায়।

এবার ইমাম সাহেব তাড়া দেন। লাশ বেশিক্ষণ রাখা যাবে না বলে বার বার সতর্ক করেন।

এবার ও রহিম কাজী কথা বলে। বড় করুন স্বরে সে বলে, কফিল ভাইর খুব শখ ছিল। সে কোন প্রশ্ন করে না। কোন অভিযোগও না। নিজের মনেই যেন বলে। ফলে কেউ কোন উত্তর দেয় না। এর উত্তর হয়ও না।

একটু পর একজন একজন করে নড়তে থাকে। সবাই যেন বুঝতে পারে কিছু করার নেই। কেউ যায় লাশ ধুঁতে। কেউবা কবর খুঁড়তে। ইমমি সাহেব জানাজার প্রস্তুতি নেন।

একসময় জানাজাও শেষ হয়। বড় একটি পুরাতন পতাকা পাওয়া যায় কফিল উদ্দিনের ঘরে। এ পতাকা দিয়ে মুড়ে কফিল উদ্দিনকে কবর স্থানের দিকে নিয়ে চলে সবাই।

বীর মুক্তিযুদ্ধা কফিল উদ্দিনকে কবরে শুইয়ে দেওয়া হয় চিরদিনের জন্য।

রহিম কাজী কবরের কাছে দাঁড়ায়। ডান হাত তুলে সালামের মত ভঙ্গি করে স্যালুট করে। দেখাদেখি পাশে দাড়ানো আরো কয়েকজন স্যালুট করে।

একজন বলে, চল কাজী। আর দাঁড়িয়ে কি করবা। বাড়ি চল।

রহিম কাজী সবার সাথে বাড়ির পথ ধরে নীরবে। শুধু একবারই বলে- কফিল ভাইর বড় শখ ছিল!!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.