নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আধার রাত্রি ভোরের অনেক বাকী স্বপ্ন দেখার সুযোগ এখন তাই

চলে যেতে যেতে বলে যাওয়া কিছু কথা

মাহিরাহি

বাড়ী আখাউড়া। আখাউড়া রেলওয়ে হাইস্কুল থেকে পাস করে সোজা ঢাকায় চলে আসি। কিছুদিন সিটি কলেজে ছিলাম। ছিলাম জগন্নাথেও। তারপর টোকিওতে কাটিয়েছি সাড়ে ছয়টি বছর। দেশে ফিরে এসে চাকুরি আর সংসার নিয়ে আছি। দুটো ছেলে, মাহি আর রাহি। একজনের সাড়ে ছয় আর আরেকজনে সদ্য চার পেরিয়েছে। ওদের নামদুটো জুড়ে দিয়েই আমার নিকের জন্ম। বেশিরভাগ সময়কাটে সন্তানের সান্নিধ্য। ঘরকুনো মানুষ আমি। লেখালেখিতে হাতেখড়ি এই সা ইন বল্গে এসেই। কেউ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিল ফিরিয়ে দেয়ার মত উদ্ধত্য আমার নেই। সবারই বন্ধু হতে চাই।

মাহিরাহি › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প এক অংকের ব্যবধান

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:১৪

প্রায় ৬ বছর পরে দেখা জমির সাহেবের সাথে। পাশাপাশি ভাড়াটিয়া ছিলাম আমরা। ভদ্রলোকের সাথে অদ্ভুত কিছু মিল ছিল আমার, যা রীতিমত ভাবিয়ে তোলার মত। সবকিছুতেই উনি আমার থেকে এক অংকে এগিয়ে ছিলেন। যেমন আমি আমার বাবার দুই নাম্বার সন্তান, উনি তিন নাম্বার। আমার একবছর আগে এইচ এসসি পাশ করেছেন বিয়েও করেছেন আমার একবছর আগে। অবাক হওয়ার মত আরো অনেক সামঞ্জস্য ছিল আমাদের সবকিছুই আবার এক অংকের ব্যবধানে। তার মাঝে একটিত রীতিমত ভীতিকর। এক বছর আগে পরে বেড়াতে গিয়ে প্রচন্ড দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমাদের। একটুর জন্য দুজনেই প্রানে বেচে গিয়েছিলাম।

আরে জমির ভাই যে, প্রথমে আমি শুধাই।

রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা জমির সাহেব চমকে উঠার মত ফিরে তাকান।

কিছুক্ষন কথাবার্তাতেই চিনতে পারেন আমাকে।

আচরনে এবং কথাবার্তায় কিছুটা অন্যরকম মনে হল ভদ্রলোককে। বাসায় আমন্ত্রন জানালাম, রাজী হলেন না। কারো জন্য এখানটায় অপেক্ষা করার কথা, জ্যামে লোকের আসতে দেরি হচ্ছে।

পাশের একটা খাবার দোকানে বসতে রাজী হলে, দুজনে গিয়ে বসলাম সেখানটায়।

কিছু মানুষ এমনিতে খুব কম কথা বললেও, খাবারের সময় বেশ কথা বলতে ভালবাসেন। জমির সাহেব হালকা নাস্তা সারার ফাকে ফাকে অনবরত কথা বলে গেলেন, আমি শুনে গেলাম ধৈর্যের সাথে। ক্রমাগত নিজের গত ৬ বছরের সাফল্যের বয়ান দিয়ে গেলেন। কথা শুনতে শুনতে একসময় টের পেলাম অস্বস্থিকর কিছু একটা মনটাকে ক্রমেই বিক্ষিপ্ত করে তুলছে। তবুও সচেষ্ট থাকলাম তার কথায় মনোনিবেশে। একসময় কথায় কথায় এদিকটায় আসার কারন জিগ্গেস করলাম। বড় করে স্বাস ছাড়লেন। তারপর মুখ অন্ধকার করে বললেন, গতবছরের এই দিনটাতেই এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী আর বড় সন্তান মারা গেছেন। এখানকার বড় একটি কবরস্থানে গোর দেয়া হয়েছে তাদেরকে, তাই কবর জিয়ারত করতে আসা। আমি জানতাম জহির সাহেবের ৩ ছেলে, এক্ষেত্রেও আমার থেকে এক অংকে এগিয়ে ভদ্রলোক, অর্থাত আমার দুই ছেলে।

দু:খজনক এই সংবাদে মন খারাপ হয়ে গেল আমার। কিছুক্ষন চুপ থেকে সমবেদনা জানালাম।

একসময় ভারাক্রান্ত মনে জহির সাহেবকে বিদায় জানিয়ে বাসার পথে হাটা ধরলাম। সারাপথ হাটছিলাম আর জহির সাহেবের কথাগুলোর জাবর কাটছিলাম। ভদ্রলোক বলেছিলেন চার বছর আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন, তিনবছর আগে ঢাকার অদুরে তিনকাঠা জায়গা কিনেছেন, আর দুবছর আগে নিজের ব্যবহারের একটা গাড়ি কিনেছেন। এবার বুঝতে পারলাম কথাগুলো শুনতে কেন অস্বস্থিবোধ করছিলাম। তিনবছর আগে চাকুরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু আমিও করেছি, দুবছর আগে ঢাকার অদুরে দুইকাঠা জায়গা (জহির সাহেবের চাইতে এক কাঠা কম) আমিও কিনেছি, আর গাড়ি কিনেছি গত বছর। আবার সবকিছুতেই জহির সাহেবের চাইতে এক অংকে পিছিয়ে।

হঠাত করেই আমি টের পেলাম মন আমার প্রচন্ড অস্বস্থিকর কিছু একটা থেকে পরিত্রানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, চেষ্টা করলাম অন্য একটা কিছুতে মনকে আকৃষ্ট করার। কিন্তু চেষ্টা বিফলে গেল, শেষ পর্যন্ত ভীতিকর বিষয়টাতে আমরা চিন্তা আটকে গেল, আমি রীতিমত নিজের ভেতর কাপুনি টের পেলাম, আমার কপালে ঘাম জমতে শুরু করল। ঢাকার পার্শবর্তী একজেলায় আমার স্ত্রী আমার ছোট ছেলেটিকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। গতবছর কেনা গাড়িতে করে আজ সন্ধায় ফেরার কথা। ঠিক একবছর আগে আজকের দিনটিতেই জহির সাহেব তার স্ত্রী আর সন্তানকে হারিয়েছেন।

পাগলের মত দৌড়িয়ে বাসায় ফিরলাম। মোবাইলে অনবরত চেষ্টা করে গেলাম স্ত্রীর সাথে যোগাযোগের। আবার ভয়কে বাড়িয়ে দিয়ে প্রতিবার যন্ত্রটিকে উত্তর এল এই মুহুর্তে সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। স্বশুর বাড়িতে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম ২ঘন্টা খানেক আগে রওয়ানা দিয়ে বেরিয়েছে।

নিজেকে খুব অসহায় মনে হল, প্রচন্ড উত্কন্ঠা নিয়ে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার রইল না।

আমার আত্মাকে কাপিয়ে দিয়ে এমন সময় আমার ল্যান্ডফোনটি বেজে উঠল। অসংলগ্নভাবে পা ফেলে কাপা হাতে রিসিভার কানের কাছে ধরলাম।

কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম যাতে খারাপ কিছু না ঘটে।

"কিরে ভাবী এখনো ফেরেননি।"

বন্ধু শফিকের গলা শুনে হাফ ছেড়ে বাচলাম, শুকনো সুরে উত্তর দিলাম "না"।

"তোকে দেখলাম জহির সাহেবের সাথে বসে থাকতে, ভদ্রলোকের সাথে কি কথা হল"।

আমরা সবাই একসময় মর্নিওয়াকের সাথী ছিলাম, তাই শফিক জহির সাহেবকে ভালমতই চেনে।

"তোর সাথেও কি কথা হয়েছে"।

"আজ নয় তবে অন্য একদিন,প্রায় মাস ছয়েক আগে ভাবী অর্থাত জহির সাহেবের স্ত্রী ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের জন্য খুব দু:খ হয়।"

"কিন্তু জহির সাহেব বললেন উনার স্ত্রী আর বড় ছেলে মারা গেছেন বছরখানেক আগে।"

"দু:খটাত ওখানটাতেই। বছর ৪ আগে চাকরী ছেড়ে ব্যবসা ধরেছিলেন আর সেটাই তার কাল হয়েছিল,সর্বশ্রান্ত হয়ে বছরখানেক আগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এখন সবার কাছে ব্যবসার সাফল্য আর স্ত্রী, সন্তানের মৃত্যুর কথা বলে বেড়ান। ব্যবসার অপুরনীয় ক্ষতিটা তার মন কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি।"হঠাত করেই যেন নিজেকে খুব হালকা মনে হল। ইচ্ছে হল গলা ছেড়ে হেসে উঠি।নিজের উপর কিছুটা বিরক্তবোধ হল নিজের অযৌক্তিক চিন্তাভাবনার জন্য।

অনবরত যে কলিংবেল বাজ্ছিল এতক্ষন তা টের পাইনি, শফিকের কথা শুনতে শুনতে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।

শফিকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে,রিসিভার নামিয়েই দৌড়ালাম দরজার দিকে।

"কি হল দরজা খুলতে এত দেরি করলে কেন"

দরজা খুলতেই স্ত্রীর জেরার সম্মুখীন হলাম। আমার স্ত্রী আমার ছোট ছেলেসহ ঘরে ঢুকল।

"পথে তোমাদের কোন অসুবিধা হয়নিত, সব ঠিকঠাক ছিল ত, আমি ত তোমাদের নিয়ে ভয়ংকর দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম"

"অসুবিধা হবে কেন? আর দুশ্চিন্তা করারই বা কি আছে, পাগলের মত কি সব আবোল তাবোল বকছ।" আমার স্ত্রী ধমকে উঠল।

"না আজকাল যে হারে দুর্ঘটনা ঘটছে" আত্মপক্ষ সমর্থনে বললাম আমি।

"বাবা আমাদের ত দেরি হয়নি।" আমার ছোট ছেলে মার পক্ষ নিল।

আর কথা না বাড়িয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। গত কয় ঘন্টা মনের উপর দিয়ে প্রচন্ড ধকল গেছে। অসংলগ্ন আচরন আর চিন্তা ভাবনায় নিজের উপর বিরক্তবোধ করলাম। নিজেকে বোঝালাম কাকতালীয়ভাবে অনেককিছুই ঘটে থাকে, এর বিশেষ অর্থ করাটা শ্রেফ বোকামি।

কিন্তু এক অংকের ব্যবধানে জহির সাহেবের সাথে তার অদৃষ্টের অস্বাভাবিক মিলটির চিন্তাটি কোনভাবেই মাথা থেকে তাড়াতে পারলাম না।

স্ত্রীর মুখে শুনা পাগল শব্দটি আমার মস্তিষ্কে ক্রমাগত অনুরনিত হতে থাকল আর শব্দটিকে ঘিরে আমার চিন্তাগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল অনবরত। এসব ভাবতে ভাবতে প্রচন্ড যন্ত্রনায় আমি দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলাম। জহির সাহেবের মত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার আশংকাটি ক্রমেই আমায় বুকে চেপে বসতে থাকল।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:৪৮

পাতি রাইটার বলেছেন: Awesome !!!

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:৫১

মাহিরাহি বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.