![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নাহ্ পারছি না। মাথায় কিছুই আসছে না! হাসির গল্প লেখার কথা, কিন্তু সেরকম কোন প্লটই তো মাথায় আসছে না। ভাবছেন, আমি কে? না না! আমি মোটেও কোন হোমড়া-চোমড়া কেউ নই। আমি নিতান্তই ম্যাংগো পাবলিক অর্থাৎ আম জনতার মধ্যে একজন।
আমার সম্পর্কে আরও কিছু বলা দরকার। বাংলা ব্যাকরণে আ-কার, ই-কার এর মত আরেকটা ‘কার’ এর প্রচলন করার দরকার ছিল। সেটা ‘বে-কার’। আমি সেই ‘বে-কার গোত্র’ এর একজন গর্বিত(!) সদস্য। তবে আজকাল নামের পাশে এম.এ. পাশ এর সাথে ‘বেকার’ শব্দটা যোগ করতে একটু কেমন যেন লাগে। তাই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নিজেকে ‘লেখক’ নামে পরিচয় দেই। আরও যদি ফোলাতে হয়, তাহলে বলতে হয় পেটের দায়ে লেখক। তারপরও যদি ফোলাতে হয়... তাহলে হয়তোবা শেষ পর্যন্ত নিজেই ফেটে যাব। সেই ভয়ে নিজেকে আর ফোলাচ্ছি না। আমাদের দেশের মন্ত্রী-আমলাদের মত অমন ফ্লেক্সিবল শরীরতো আর আমার নেই। বেকার মানুষ; পেটে-পিঠের শরীর। মাঝে-মধ্যে পত্রিকায়, বিভিন্ন সাময়িকীতে কিছু লেখা পাঠিয়ে কোনমতে পেট চালাই।
আজকাল দিবসের অভাব নেই। হাঁটা দিবস, ঘোরাঘুরি দিবস, ভালোবাসা দিবস... আরও অনেক দিবস! কোন দিন হয়তবা শুনবো, বিশ্ব পায়খানা দিবস! তবে আমার মত বেকার মানুষের কাছে প্রতিটি দিনই ‘জাতীয় ঘুম দিবস’। দিবস নিয়ে ব্যক্তিগত ক্যাচাল বন্ধ করা যাক। আজকে আমাকে লেখা পাঠাতে হবে “বিশ্ব হাসাহাসি দিবস” উপলক্ষে। (সাধারণ পাঠকরা এ দিবস সম্পর্কে তেমন কিছু না জানলেও আমার মত মানুষকে এগুলো জানতেই হয়, পেটের দায়ে।) কিন্তু সমস্যা হল, আমি আমার কষ্টার্জিত উপার্জনের পয়সায় কেনা সিগারেট টেনে টেনে ধোঁয়ার কারখানা করে ফেললেও তথাকথিত হাসির গল্প নামক কিছুই বানাতে পারছি না। হয়তোবা মাথায় যা-ই বা কিছু আছে, সিগারেট এর ধোঁয়ার সাথে সাথে উড়ে যাচ্ছে।
আরে ! পেয়েছি পেয়েছি!! হাসির গল্প পেয়েছি!!! আজ সারাদিন যা দেখলাম, যা শুনলাম, তার একটা মিক্সচার করে ফেললেই তো অতি সুন্দর হাসির গল্প হয়ে যায়! শুরু করা যাক তাহলে।
###
সকাল বেলা ঘুম ভাঙল বাপের ধমক শুনে ।(প্রতিদিনকার মতোই, নতুন কিছু না)
“নবাবজাদা, সকাল নয়টা বেজে গেছে, এখনও ঘুমচ্ছিস! বলি, আজকের ইন্টার্ভিউতেও কি টেকার ইচ্ছে নেই? আর ঢাকার রাস্তা-ঘাটের যানজট কি তোর জন্য ‘প্রযোজ্য নহে’ এরকম সাইন-বোর্ড লাগিয়ে ঘুরে? বহুদিন তো বাপের ঘাড়ে বসে পার করলি, এবার নিজে কিছু একটা কর।”
মনে মনে বাবাকে সাড়ে পঁচাশি হাজার বার অভিশাপ দিতে দিতে ঘুম থেকে উঠলাম। ওয়াশ রুমে ঢোকার আগ পর্যন্ত অভিশাপ দিয়েই গেলাম। কিন্তু বাবারই বা কি দোষ দিবো! আমি বাবা-মা’র একমাত্র পুত্র। আমাকে ঘিরে তাঁদের আশা থাকাটাই স্বাভাবিক। এম.এ. পাশ করার পর বন্ধু-বান্ধব সবাই যেখানে চাকরী নিয়ে, বিয়ে করে, বাচ্চা ফুটিয়ে বসে আছে; সেখানে, আমার এই “কিছু একটা হবে!! কিছু একটা করব!!!” টাইপ জীবন দেখে তাঁদের কাছে খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। তবুও তো তাঁরা আশাবাদী এই ভেবে যে, তাঁদের এই সুপুত্রের(!) কোন একটা গতি হবে। কিন্তু আমি তো ভালো করে জানি, আজকালকার এই দিনে চাকরী পাওয়াটা সোনার হরিণের সমার্থক শব্দের মত। টাকা ঢেলে চাকরী পাওয়াটাই আজকাল স্বাভাবিক আর যোগ্যতার কারণে চাকরী পাওয়াটাই যেন অস্বাভাবিক!
আমার ইন্টার্ভিউ দেওয়ার ঘটনা থেকেই তার বেশ খানিকটা বুঝতে পারবেন।
প্রতিবারের মত এবারও সাদা শার্ট, নেক-টাই, কালো প্যান্ট পরে ফুলবাবু সেজে গেলাম ইন্টার্ভিউ দিতে। (এইসব জামা-কাপড় বরাবরের মতই বন্ধুদের থেকে ধার করা) আমার কাঠ-খোট্টা চেহারার মধ্যে একটা ভদ্রলোকের আবরণ দেয়ার প্রচেষ্টা আর কি! যদিও আয়নায় নিজেকে দেখে স্কুল-পড়ুয়া কিশোরের মত মনে হচ্ছিল।
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর আমার ডাক পড়লো। ইন্টার্ভিউ বোর্ডে ঢুকে, ভালোমতো একটু তাকিয়ে আমার চক্ষু চড়ক গাছ! (চড়ক গাছটা যে আসলে কোন গাছ, সে বিষয়ে আমার কোন ধারণা নেই। আপনারা জেনে থাকলে জানাবেন!) এটা ইন্টার্ভিউ বোর্ড নাকি গাবতলির গরুর হাঁট!!!
ইন্টার্ভিউ বোর্ডে তিনজন ব্যক্তি। একেবারে বাম পাশের ভদ্রলোককে, রুমে ঢোকার পর থেকেই দেখছি, নাক খুঁচিয়েই চলছেন। আর একটু পর পর হাই তুলছেন। একেবারে ডান পাশের ভদ্রলোককে দেখলাম, মনের আনন্দে পান চিবচ্ছেন, আর লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পাশের সাদা রঙ করা সুন্দর দেয়ালটার দিকে। হয়তোবা মনে মনে খুশি হচ্ছেন, দেয়ালটার উপর পানের পিক ফেলার পর কি সুন্দর দেয়াল-চিত্রই না হবে, তা ভেবে। আর এই দুই ‘ভদ্রলোক’ এর মাঝখানে নিতান্তই বেরসিকের মত সুপুরুষ টাইপ চেহারার আর একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তারা তিনজন তিন দিকে তাকিয়ে থাকলেও নিজেদের মধ্যে অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছিলেন। এক সময় হঠাৎ তাদের বোধোদয় হল যে, আমি দাঁড়িয়ে আছি।
সুপুরুষ টাইপ ভদ্রলোক মহা বিরক্ত হয়ে আমাকে বসার অনুমতি দিলেন। আমি হাসিমুখে বসে পরলাম। বাম পাশের ভদ্রলোক তার নাক খোঁচানো বন্ধ করে টেবিল থেকে চশমা নিয়ে নাকের উপর বসিয়ে চশমার উপর দিয়ে একবার আমার দিকে তাকালেন, আবার চশমার ভেতর দিয়ে আমাকে দেখলেন। তারপর চশমা খুলে টেবিলে রাখতে রাখতে হাই তুললেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“নাম কি?”
আমি আমার নাম বললাম।
“নামের অর্থ জানেন?”
আমি মাথা দুলিয়ে না-বোধক ইঙ্গিত করলাম। একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ইন্টার্ভিউতে নামের অর্থ জানা যে খুবই জরুরী, তা আমার ঠিক জানা ছিল না।
“নিজের নামের অর্থ জানে না, আসছে চাকরী করতে! কোন-খান থেকে যে আসে এইগুলা চাকরী খুঁজতে...” আপনমনে গজ গজ করতে করতে আবার নাক খোঁচাতে লাগলেন উনি। মনে মনে ভাবলাম, ইন্টার্ভিউ থেকে বের হয়েই একটা নামের অর্থের বই কিনে ফেলবো। কত হতে পারে দাম? ৫০ না ১০০? নিজের নামের অর্থ দেখে নিলাম, পরবর্তীতে না হয়, নিজের ছেলেমেয়ের নাম রাখার সময় কাজে লাগবে। খারাপ কি!
খুক খুক কাশির শব্দ শুনে ভাবনায় ছেদ পড়লো আমার। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা ভদ্রলোক আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন। প্রশ্ন করলেন, “গতকাল রাতে কি আপনি কোন স্বপ্ন দেখেছেন?”
এইবার আমি হাসিমুখে উত্তর দিলাম, “জী স্যার। দেখেছি।”
“কি দেখলেন?”
“স্যার, আমি স্বপ্নে দেখলাম আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, কংগ্রাচুলেশন, মাই বয়! তোমার চাকরী হয়ে গেছে!!!”
আমার কথা শুনে ভদ্রলোকের হঠাৎ বোধহয় গলায় পান আটকে গেল। বেদম কাশতে কাশতে বললেন, “কি বললেন?”
আমি আবারও হাসিমুখে বললাম, “আমি কি তাহলে দিবা-স্বপ্ন দেখেছি স্যার? আপনি নিশ্চয়ই আমার জায়গায় অন্য কাউকে দেখেছেন?”
“আপনি... আজ আসতে পারবেন।”
“শুকরিয়া জনাব। অনেক অনেক শুকরিয়া।” অতি বিনয়ের সাথে কথাগুলো বলে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলাম আমি।
ফিটফাট স্যার আমাকে কোন প্রশ্ন করলেন না। উনি একমনে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে টিকটিকিশুমারী করছেন হয়তোবা। ব্যস্ত মানুষ। খুবই ব্যস্ত!
আসলে আজকালকার ইন্টার্ভিউ বোর্ডের প্রশ্নগুলোই বেশ মজার। কেউ জিজ্ঞেস করেন, স্বপ্ন কি? আবার কেউ জানতে চান, রাশি কি? কেউ কেউ আবার রসিক মানুষ। জিজ্ঞেস করেন, গার্ল ফ্রেন্ড আছে কি না। আবার কেউ ঘটকালির উপর ডিগ্রীপ্রাপ্ত। জিজ্ঞেস করেন, “লাভ ম্যারেজ আর আরেঞ্জ ম্যারেজ এর মধ্যে কোনটা বেশী ভালো বলে মনে হয়?” ইন্টার্ভিউতে জিজ্ঞেস করা এসব প্রশ্নের যদি একটা সংকলন তৈরি করে বইমেলাতে প্রকাশ করা হত, তাহলে অনেক সাড়া ফেলত বলেই আমার বিশ্বাস। গোপাল ভাঁড়ের হাসির গল্পের বই, এর কাছে পাত্তাই পেত না!
আগেই নির্ধারণ করে রাখা এসব চাকরীর নিয়োগে, শুধু শুধু ইন্টার্ভিউ বোর্ড নামক নাটকের অবতারণা করে হাজারো তরুণের স্বপ্ন নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করার সাহস যে এরা কোথা থেকে পায়!!! অবাকই লাগে! এইসব ভেবে আমার মুখে ফুটে উঠে হাসি। হাহাকারের হাসি!
রাস্তায় নেমে কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা চা এর দোকানে দেখতে পেলাম, কিছু লোক জড়ো হয়ে তর্ক জুড়ে দিয়েছেন। আমিও গিয়ে তাদের সঙ্গী হলাম। তাদের একজনের কাছে একটা পুরনো পত্রিকার কাটিং দেখলাম। কাটিংটা সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীর। তারপর আমরা সবাই মিলে সাবেক যোগাযোগ্মন্ত্রীর গাড়ির ছবিসহ পত্রিকার কাটিং এ থাকা প্রতিবেদনটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলাম। গাড়িটি একটা বিশালাকার গর্তকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে-এরকম একটা ছবি ছাপা হয়েছে। “বাংলাদেশের রাস্তায় কোন খানা-খন্দ নেই।”-সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীর এই কথা বলার পাঁচ মিনিট পরই তোলা হয়েছিল, ছবিটা। আসলেই তো! উনি ঠিকই বলেছিলেন। এটা তো কোন খানা-খন্দ নয়! আস্ত জলাশয়!!! পাশেই যোগাযোগ মন্ত্রীর ‘বি-খ্যাত’ দাঁত কেলানো হাসির ছবি। একটা মানুষ কি পরিমাণ নির্লজ্জ হলে এতো এতো অপমানিত হওয়ার পরও সুন্দর করে মুখ চওড়া করে হাসি হাসতে পারেন, তা এই মন্ত্রীকে না দেখলে, হয়তোবা কখনোই জানা হত না! আমাদের এই মন্ত্রী মহোদয় অবশ্য বাকি সবার থেকে আলাদা! উনি দৌড়ে মন্ত্রী হয়েছেন! তাই হয়তোবা নিজের কাজ-কর্মের মাধ্যমেই তার প্রকাশ ঘটান নিয়মিত। “তারেক মাসুদ”, “মিশুক মুনীর” এর মত মানুষ যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করে তখনও তিনি তার কেলানো দাঁতের হাসি দেখিয়ে অনায়াসে বলে ফেলেন, “আমাদের করার কিছু নাই। সড়ক দুর্ঘটনা হবেই ।” মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় যখন প্রায় চল্লিশ জন শিশু একই সাথে মৃত্যুবরণ করে; তখনও তিনি আশানুরূপ কিছু করে দেখাতে পারেন নি। উলটো তারই এক সহকর্মী নেতা সৈয়দ আশরাফ বলে উঠেন, “অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট। আমাদের করার কিছু নাই।” বাহ্ ! চমৎকার কথা! জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় জীবন ধারণ করছেন কি “কিচ্ছু করার নাই” বলার জন্যই? চল্লিশটা শিশুর পরিবারের কান্নার শব্দ হয়তোবা উনার সাউন্ড-প্রুফ,এয়ার কন্ডিশন্ড গাড়িতে পৌঁছায় না। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনিরের মত জাতির সেরা কিছু সন্তানের অসহায় মৃত্যুর পর পুরো দেশবাসীর কান্নার শব্দ তার মনে একটুকুও দাগ কাটে না। সত্যিই তিনি সবার থেকে আলাদা! বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনও এরকম মন্ত্রী কোনোকালে এসেছে বলে মনে হয় না। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, ভবিষ্যতেও যেন না আসে। উনার এই কেলানো দাঁতের হাসি দেখে নিজের অজান্তেই আমার মুখেও যেন হাসি ফুটে উঠে। সেই হাসি বিদ্রূপের, তিরস্কারের। আর মনে মনে বলি... “হাসুন, মাননীয় মন্ত্রী, হাসুন। যত পারুন হেসে নিন। পাঁচটা বছর তো ভালোই দেখাচ্ছেন। কিন্তু মনে রাখবেন, তারপর একটা দিন কিন্তু আসবেই, আমাদের জন্য। আপনার ঐ দাঁত কেলানো হাসির, দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্য সেই একটা দিনই আমাদের জন্য যথেষ্ট!”
তবে আশার কথা হল, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে তাকে সরিয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে। (এই মন্ত্রণালয়ের এখন মাথা খারাপ হবে... জানা কথা!)
আর হতাশার কথা, মন্ত্রী মহোদয়, যাওয়ার আগেও কেলানো দাঁতের হাসি দেখিয়ে বলে গেছেন, “পরবর্তী মন্ত্রী এসে দেখবেন, আমি কত্ত ভালো অবস্থানে রেখে গেছি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে।” মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, এত ভালো অবস্থানে রেখে গেলে আপনাকে বদলী করা হচ্ছে কেন তাহলে? হাওয়া বদল করার জন্য?
মন্ত্রী মহাশয়কে বিদায় জানিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম আমি। সূর্যটা যেন আজ তার শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দরদর করে ঘামছি। হাঁটতে হাঁটতে এই গরমের মাঝেও দেখতে পেলাম, একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে।আমিও গিয়ে তাদের সাথে দাঁড়ালাম। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা “সাগর-রুনীর হত্যাকারীদের বিচার চাই”। আরেকজনের হাতে দেখলাম, সাংবাদিক সাগর,রুনী এবং তাঁদের পাঁচ বছর বয়েসী ছেলে, মেঘ এর হাসিমাখা মুখের ছবি। হায়রে হাসি! দেশের এ-গ্রেড ধারী দু’জন সাংবাদিকের নৃশংস হত্যার পর আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভাগ এর ‘তৎপরতা’ কিন্তু চোখে পড়ার মত ছিল। তারা প্রথম কয়েকদিন খুব হম্বি-তম্বি দিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনী খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়ে, খবরের প্রথম পাতায় উঠে এলেন। যা দেখে আমার মত কাজ-কাম ছাড়া মানুষরা বলে উঠেছিল, “সূর্য কি পশ্চিম দিক দিয়া উঠল? সাহারা আফা দিছে এই নির্দেশ!!!!!!” শুধু এটুকুই না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, স্বয়ং আপা থুক্কু প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারে চোখ রাখছেন।– একথার মাধ্যমে হয়তোবা তিনি বুঝাতে চাইলেন, “আমরা চোখ-কান খুলেও ঘুমাইতে পারি।” এটুকু গেল... কয়েকদিন পরই দেখা গেল, পুলিশ কাগুদের গা-ছাড়া ভাব। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তো একসময় বলেই ফেললেন, “হত্যাকাণ্ড হয়েছে বেডরুমে। কারও বেডরুমে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে।” বাহ! বড়োই চিত্তাকর্ষক উক্তি!!! প্রতিদিনকার পত্রিকায় চোখ বুলালে কত শত ছিনতাই, রাহাজানি, হত্যার খবর পাওয়া যায়। যার প্রায় সব গুলোয় হয় ঘরের বাইরে। প্রধানমন্ত্রী কি পেরেছেন সেই সব অপরাধ দমন করতে? এখন যদি তিনিই বলেন, যে কারও ঘরের নিরাপত্তাও দিতে পারবেন না, তাহলে আমরা যাবো কোথায়? রাতে কি তাহলে রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে গিয়ে ঘুমাবো? নাকি গণভবনে গিয়ে ঘুমাবো? .........আমাদের সরকার এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে উৎসাহ হারিয়ে প্রায় ঘুমিয়ে পড়লেও ব্লগে বা ফেসবুকে সাধারণ মানুষজন কিন্তু উৎসাহ হারায় নি। তারা এখনও আন্দোলন চালিয়েই যাচ্ছেন, সঠিক বিচারের জন্য। সেরকম কিছু মানুষের একটা দলই আজ এই প্রখর রোদের মাঝেও দাঁড়িয়ে আছেন, শুধুমাত্র প্রাপ্য শাস্তি যাতে পায় অপরাধীরা... তার জন্য। কে তারা? সাগর-রুনী কি তাদের কোন আত্মীয়? কি দরকারে আজ তারা এতটা কষ্ট সহ্য করছেন? ...না। তারা কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কাজ করছেন না। তাদের এই আন্দোলন... বাঁচার জন্য। বাঁচানোর জন্য। আমাদের যে ভাইটিকে বা বোনটিকে আজ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার সুষ্ঠু বিচারের জন্য এই আন্দোলন। সম্মান জানাতেই হয় তাঁদেরকে। ফেসবুকে কয়েকদিন আগে দেখলাম, জাতিসংঘের সদর-দপ্তরের সামনে কিছু প্রবাসী বাংলাদেশী মানব-বন্ধন করে, সাগর-রুনীর হত্যার বিচার দাবি করেছেন।[সূত্র: ফেসবুক পেজ “অপ্রকাশিত”]
এত দূর-দূরান্ত থেকে তাদের মনেও দেশ সম্পর্কে এতোটা নজরদারি। এখন মনে প্রশ্ন আসতেই পারে এত সচেতন নাগরিক থাকার পরও অপরাধী চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে কেন তাহলে? উত্তরটা খুবই সহজ। আমাদের সরকারই যে নির্বিকার!
[একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আমাদের দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এর বেঁধে দেওয়া ৪৮ ঘন্টার আজ একমাস পার হতে চলল। জানতে ইচ্ছে করে উনি কোন ঘড়িতে মাপছেন সেই সময়সীমা?কত মাসে এক দিন হয়,সে ঘড়িতে? তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সাহারা খাতুনের সেই ‘বিশেষ’ ঘড়ি যদি দেশের স্কুল-কলেজে পরীক্ষার সময় ব্যবহৃত হত, তাহলে শিক্ষার্থীরা অনেক উপকৃত হত!!!]
আমি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই ৪-৫ জনের পুলিশের একটা দল এসে বাংলা ছবির ভিলেন টাইপ হাসি দিয়ে খুনীদের বিচারের দাবি চেয়ে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিল। পাশাপাশি ধরে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেবার হুমকিও দিতে লাগল। আমরাও আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেলাম না। পুলিশ কাগুরাও ভীষণ খেপে আছে। বলা যায় না, হয়তোবা আমাদের ধরে নিয়ে বলবে আমরাই এই জোড়া খুন করেছি! আর তাছাড়া আমাদের সাথে কোন ককটেল নেই, পিস্তল নেই, কোন নেতাও নেই! প্রতিবাদ করা তো আমাদের সাজে না! যাদের সাথে ককটেল থাকে, পিস্তল থাকে, নেতা-মন্ত্রীদের সাথে মধুর সম্পর্ক থাকে, প্রতিবাদ করতে তো তাদেরকেই মানায়। আমরা কারা? আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা সকালে উঠি, সারাদিন কাজ করি বা কাজের সন্ধানে ঘুরি, রাতে ঘরে ফিরি, খাই-দাই ঘুমিয়ে পড়ি। আশেপাশে কে, কোথায়, কি করছে, কে খুন হল বা কোথায় দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেল তা দেখে আমাদের কাজ নেই। আমাদের উচিৎ, সবকিছু দেখে না দেখার ভান করা। তবুও যদি সহ্য না হয়, তাহলে চোখ বন্ধ করে হাঁটাচলা করা। নির্বাচনের একটা দিন ভোট দেওয়া। আর পরবর্তী পাঁচটা বছর “বাঁশ গেলা”। আমাদের সরকার তো তা-ই চায়! আমি না হয় বেকার মানুষ। কাজ-টাজ নাই দেখে এসব বলে বেড়াচ্ছি। কিন্তু আমাদের সরকার তো অতি বিচক্ষণ!!! অতএব, আমাদের জীবিত থাকতে হলে আমাদের উচিৎ সরকারকে তালিম দিয়ে বেড়ানো। তাদের আচার-আচরণে তো এরকমই মনে হয়। তাই নয় কি?
দলছুট হয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম আমি। আমার মুখে আবারো হাসি ফুটে উঠেছে। এ হাসি পরাজয়ের। আমি যেন নিজে, নিজের কাছে পরাজয় স্বীকার করছি!
বলতে ভুলে গিয়েছিলাম... আমি ক্লাস টু এর একটা ছেলেকে পড়াই। [যুগ সত্যিই পাল্টে যাচ্ছে! যার কারণে আজ আমাকে এইটুকু বাচ্চাকে বাসায় গিয়ে নামতা শেখাতে হচ্ছে।] বিকেলের দিকে পড়াতে গেলাম আমি ওকে। বাচ্চাটার নাম ‘মান’। এই নামের উৎপত্তিস্থল কোথায়... সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। শুধু মান কেন? কয়েকদিন পর ‘গজ,ইঞ্চি,ফুট’ এসবও যদি নাম হিসেবে রাখা হয়, তাতেও খুব একটা অবাক হব না আমি! বরং হাসিমুখে বলবো, “বাহ! নামটা সুন্দর তো! ইউনিক!!!”
মানকে পড়াতে গিয়ে দেখলাম ও হাসি-মুখে বসে আছে। আমাকে দেখেই বলে উঠলো, “আপকো ক্যয়া হুয়া স্যার? ইস তারাফ কিউ লাগতা হ্যয়?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এসব কি?”
“ক্যায়া আপকো হিন্দী নেহি আতি?” পুরো বুদ্ধু বনে গেলাম আমি। এইটুকু পিচ্চি এত সাবলীল ভাবে হিন্দি বলছে!!! কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীরভাবে বলার চেষ্টা করলাম, “বাংলাতে কথা বল, নাহলে আমি তোমার মা এর কাছে নালিশ করবো।” মান হাসতে হাসতে তার মা কে ডেকে আনলো। ভদ্রমহিলার সাথে মানের কিছু কথা হল, যার পুরোটাই হিন্দিতে!!! আবারো অবাক হওয়ার পালা আমার। একটু পর ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে যা জানতে পারলাম, তার সারমর্ম হল, “আজ ডোরেমনের নায়লা’র জন্মদিন। এই উপলক্ষে মান আজ সারাদিন হিন্দিতে কথা বলবে।” আমি আবারো বেকুব হয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম... “ ডোরেমনের নায়লা কে? ওর কোন কাজিন? আর এর সাথে হিন্দিতে কথা বলার কি সম্পর্ক? হিন্দি শিখেছে কিভাবে?” ভদ্রমহিলা তখন হাসতে হাসতে জানালেন, ডোরেমন ভারতীয় একটা কার্টুন অনুষ্ঠান আর তার একটা চরিত্র নায়লা। মান এই কার্টুন দেখে দেখেই হিন্দিতে কথা বলা শিখেছে।
অজানা একটা ভয়ে প্রায় কেঁপে উঠলাম আমি। ভদ্রমহিলা কি হাসিমুখেই না কথাগুলো বলছেন! মনে হচ্ছে তার ছেলে অনর্গল হিন্দিতে কথা বলে অনেক মহৎ একটা কাজ করে ফেলেছে! হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ল, প্রায় এরকমই একটা ঘটনার কথা আমি পড়েছিলাম পত্রিকায়। যেখানে ভারতীয় এই কার্টুনকে এক ধরণের ‘আতংক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। [সূত্র: Click This Link আমার তখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল বাংলাদেশে থেকে, বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বড় হয়ে এই বাচ্চাটা কি না ধারণ করছে ভিন্ন দেশের সংস্কৃতি! আর মান এর মা ও, তাতে কোনোরকম বাঁধা না দিয়ে, বরং যেন একধরণের নীরব সম্মতি দিচ্ছিলেন। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলাম, এই ভেবে যে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই আজ মৃত। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরাও যে আমার এই লেখাটি পড়বেন সেরকম সম্ভাবনাও অনেক কম। যদি তাঁরা বেঁচে থেকে আমার এ লেখাটি পড়তেন, তাহলে তাঁরা রাগে-দুঃখে-অপমানে হয়তোবা আত্মহত্যা করে ফেলতেন!!!
আমি একেবারেই সহজ-সরল একটা মানুষ। ‘রাগ’ শব্দটা আমার অভিধানে তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু হঠাৎ করে আমার কেন যেন মান এর মায়ের উপর রাগ উঠছে। ইচ্ছে করছে, মহিলার গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু তথাকথিত ভদ্র সমাজে বসবাস করে এরকম কাজ করা যায় না। তাই হাসিমুখে বেরিয়ে গেলাম আমি। আমার মুখের এ হাসির মাঝে লুকিয়ে থাকা আফসোস এর কথা কেউ জানেনি। জানবেও না। মনে কষ্ট ধারণ করে এরকম হাসি শুধু আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষেই সম্ভব!!!
বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম, এক ভদ্রলোককে চ্যাংদোলা করে করে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, কাঁচামরিচের কে জি ২০০ টাকা ; একথা শুনে ভদ্রলোক জ্ঞান হারিয়েছেন। আবারো হেসে ফেললাম আমি। মনে পড়ে গেল, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে করা ‘বিখ্যাত উক্তি’র কথা। যিনি বলেছিলেন, “জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কি করার আছে? কম কম খান।” আর অর্থমন্ত্রী তো আর এক ডিগ্রী উপরে! বলেছিলেন, “ মাসে একদিন বাজারে কম গেলেই তো হয়!” হায়রে অর্থমন্ত্রী! জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে... “আপনি নিজে কি কোনোদিন না খেয়ে থেকেছেন? না তো! বরং আরও বেশী করে গিলেছেন। এয়ার-কন্ডিশনন্ড গাড়ি ছাড়া বের হয়েছেন কখনো? কখনো কি লক্ষ করেছেন, রাস্তার পাশের ছিন্নমূল মানুষগুলো কি খায়? কেমন করে বেঁচে আছে এই উর্ধ্বমূল্যের বাজারে? অবশ্যই লক্ষ করেন নি! আপনার এত সময় কোথায়? এর থেকে কত্তো জরুরী কাজ করতে হয় আপনাকে!!! কয়েকজন মানুষ না খেয়ে মারা গেলেও কিচ্ছু আসে যায় না আপনার। ৭ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত একটা বাচ্চা মেয়ে যখন নিজের জন্মদিনে বাসায় গিয়ে দেখে যে, বাসায় চাল নেই, তাই ভাত রান্না করা হয়নি। কারণ, চাল কেনার মত টাকাও সেই মেয়েটির পরিবারের কাছে ছিলনা। তখন জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে মেধাবী সেই মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি এই শব্দটার অর্থ জানেন তো? আ-ত্ম-হ-ত্যা ! নিজেকে হত্যা! সামান্য অন্নের অভাব মেটাতে না পারায় বাচ্চা এই মেয়েটি জীবনের মায়া ত্যাগ করার মত দৃষ্টান্ত রেখে গেছে! আর আমাদের জন্য রেখে গেছে এক সীমাহীন লজ্জার দৃষ্টান্ত। হয়তোবা বলবেন... বাচ্চা মেয়ে, তাই আবেগ বেশী! হুমমম... মেনে নিলাম। কিন্তু বাকিটা? কতটা দরিদ্র হলে একটা পরিবারের অন্নসংস্থান থাকতে পারে না বলে আপনি মনে করেন, মাননীয় মন্ত্রী? না খেতে পেয়ে এই যুগের ক’টা ছেলে-মেয়ে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে আপনি মনে করেন? কেন এই রাগ? কেন এই ক্ষোভ? কেন মেয়েটা এতো হতাশাগ্রস্ত হয়েছিল?শুধুমাত্র কি ঐ একদিনের আবেগের বশবর্তী হয়ে?... জানতে চেয়েছেন কখনও? হাহ্! পারেনও বটে আপনারা! শেয়ার বাজারে মাত্রাতিরিক্ত হারে দরপতন হওয়ার পর মানুষজন যখন টাকা-পয়সা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে, আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে লাগছিল, ঠিক সেসময় সংবাদ সম্মেলনে আপনি বলেন কি না, আপনি শেয়ার বাজার কি... সেটাই জানেন নাহ! বাহ! আপনি যদি শেয়ার বাজার সম্পর্কে কিছু না জানেন, তাহলে জানবে কারা? আমাদের পাড়ার চা এর দোকানদাররা?”
অজ্ঞান হয়ে থাকা লোকটাকে দেখে এসব ভেবে যাচ্ছি আমি। মাঝেমাঝে ভাবি, ভাল্লাগে না আর। যেদিকে চোখ যায়, চলে যাই। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এদেশে “ভবঘুরে” হয়ে থাকাটাও নিরাপদ নয়!
রাতে বাড়ি ফিরে দেখি সেই চিরাচরিত দৃশ্য। আমার মা, তাঁর একমাত্র কন্যা(আমার ছোট বোন)কে নিয়ে বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখছেন(পড়বেন... গিলছেন)। শুধু তা দেখেই থেমে থাকছেন না। কাহিনীগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন, যুক্তি খণ্ডনও করছেন। দেশের খবর দেখব বলে উনাদের কাছে হাত জোড় করে কাকুতি-মিনতি করেও রিমোট নামক যন্ত্রটাকে বাগাতে পারলাম না। বরং “যার নিজেরই খবর নেই, উনি রাখবেন দেশের খবর”-এই টাইপ বাঁকা বাঁকা মন্তব্য হজম করতে হল। আজ রাতের খবরটা হয়তো আমাকে না দেখেই থাকতে হবে। বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে বসে গেলাম। এরাই কি আমাদের বাঙ্গালী নারী? বাঙ্গাল নারী তো কখনও এরকম ছিল না! বাংলার ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ভাষা সৈনিক আসাদুজ্জামানের দরিদ্র জননী আসাদের বাবা’র রেখে যাওয়া, তাদের শেষ সম্বল স্বর্ণের নেকলেস পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিলেন। জাহানারা ইমাম স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অসম্ভব মেধাবী ছেলে, রুমিকে পাঠিয়েছিলেন... যুদ্ধ করার জন্য। নিজ সাধ্যমত ছেলেকে সাহায্যও করেছিলেন। ভাবতেও অবাক লাগে, বাংলার সেই মহীয়সী নারীদের কেউ কি কংকালরুপেও আজ অবশিষ্ট নেই? এমন কেউ কি নেই যিনি হিন্দি সিরিয়াল হজম না করে থাকতে পারবেন? আজকের নারীদের সাথে বাংলার সেই সব মহীয়সী নারীদের তুলনা করলে লজ্জার সাথেই বলতে হয়, কোথায় আগরতলা... আর কোথায় খাটের তলা! ......... ঘুরে ফিরে আমার আবার সেই মান এর কথাই মনে পড়ছে। ছোটরা বড়দের অনুকরণ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমরা বড়রাই ... যেমন, ধরা যাক মান এর মা এর ব্যাপারটা। ভদ্রমহিলা যদি নিজেই সারাদিন হিন্দি সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকেন, তাহলে তাদের ছেলে-মেয়ে তো তা-ই শিখবে! ভারতের শাহরুখ-ক্যাটরিনার খোলামেলা উদ্যম নাচ-গান যদি আমাদের বিনোদনের মাধ্যম হয়ে থাকে, তাহলে... এগুলোর মিনি প্যাক হিসেবে ডোরেমন কার্টুনও হতে পারে মান এর মত বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের বিনোদনের মাধ্যম! সেটাই স্বাভাবিক! কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে আজ আমরা ভারতীয় চ্যানেল ‘আমদানি’ করছি। আমাদের সীমান্ত দিয়ে ভারতের পেঁয়াজ, গরু, কসমেটিকস এর পাশাপাশি ঢুকে পড়ছে তাদের সংস্কৃতিও। প্রমথ চৌধুরীর একটা উক্তি ছিল, “ব্যাধিই সংক্রামক। স্বাস্থ্য নয়।” ভারতীয়দের এসব সংস্কৃতির ভালোটাকে না নিয়ে আমরা ধারণ করছি মন্দ ব্যাপারগুলোই! ভারতের কি আছে না আছে, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমার মাথায় ঘোরে ভারতীয় চ্যানেল দেখা কি আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক? আজকালকার বিয়ে বাড়িতে, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে, এমনকি মোবাইলের রিং টোনে পর্যন্ত হিন্দি গান ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু কেন? আমাদের দেশীয় গানের মান কি খুব খারাপ? জাগো, আমার বন্ধু রাশেদ এর ছবিগুলো বা ইফতেখার আহমেদ ফাহমী, রেদোয়ান রনি’র মত পরিচালকদের তৈরি আমাদের দেশীয় নাটকগুলোর মান কি খারাপ মনে হয়? আমরা কি আমাদের দেশটার দিকে তাকিয়ে, দেশের অনুষ্ঠানগুলোর দিকে একটু মন দিতে পারি না? পারি, না পারি একটু চেষ্টা তো করতে পারি, নাকি? ভারত সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে, আমাদের দেশের সব চ্যানেল আইন করে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আর আমরা কি না, সেই দেশেরই অনুষ্ঠানমালা গোগ্রাসে গিলেই চলেছি! এমনকি মান এর মত অনেক বাচ্চাই নিজ দেশের ভাষা ভুলে আজ হিন্দিতে কথা বলছে! ফেসবুক এ লগইন করলেই দেখা যায়, হিন্দি স্ট্যাটাস পূর্ণ হোমপেজ! সন্দেহ হয়, আমি বাংলাদেশেই আছি? নাকি ভারতে?
ভারত বিষয়ে আমার মাথা ব্যথাটা ছিল শুধু এক দিক দিয়েই... সব জায়গায় শুধু হিন্দি আর হিন্দি। মহা বিরক্তিকর টু দ্য পাওয়ার টেন! কিন্তু আজ ভারতের কৌশলের কাছে আমরা নিজেরাই বন্দি!বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে চৌদ্দ বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে ফেলানীকে তারা গুলি করে। আর সে লাশ ঝুলতে থাকে কাঁটাতারে। আর এ সম্পর্কে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মণি বলেন, “ফেলানী, বাংলাদেশী ছিল না!” আহা! জানতে ইচ্ছে করে উনি কিভাবে সেটা জেনেছিলেন? উনি কি ফেলানীর মায়ের কান্নার দৃশ্য দেখেছিলেন? আজ যদি তার মেয়ের লাশ তিনি কাঁটাতারে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেতেন, কি করতেন? তারপরও ভারতের স্তুতি গেয়ে বেড়াতেন? জানতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে... খুব!
সীমান্তে হাবিবুর রহমানের উপর অমানুষিক নির্যাতন... চোখ তুলে নিয়ে মেরে ফেলা...বিষ ভরা ইনজেকশন পুশ করে মেরে ফেলা... সীমান্তে দেখা মাত্রই গুলি করে মেরে ফেলা... বি এস এফ এর এরকম নির্যাতন এর বর্ণনা কম-বেশী আমরা সবাই শুনেছি। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছি না। কারণ, হিন্দি গান শুনতে শুনতে বি এস এফ এর গুষ্ঠি উদ্ধার করার কথা বলা যথেষ্ট পরিমাণে হাস্যকর! তারপরও আমাদের দেশের কিছু মেধাবী ছেলে সাইবার যুদ্ধের ডাক দিয়ে, ভারতের এইসব অত্যাচার-অবিচার এর বিরোধিতা শুরু করে। আমরা অনেকেই তার সমর্থন জানালাম। কিন্তু মনের মাঝে একটা খুঁত-খুঁত ভাব, থেকেই গেল! সেই সন্দেহ ভাবটা আমাদের নিজেদেরকে ঘিরেই! আবারো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটা উদ্ধৃতি না দিয়ে পারলাম না। যিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “ যারা ভারতীয়দের সাইবার স্পেস ধ্বংস করছে, তারা স্বাধীনতা বিরোধী এবং ইসলামী সন্ত্রাসী।” অছাম জোক!
টিভি রুম থেকে শব্দ শোনা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত মা আর আমার ছোট বোনটার হিন্দি সিরিয়াল দেখা শেষ হয়েছে। আমি গিয়ে লেট নাইট নিউজটা দেখে ঘুমোতে গেলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারাদিনের কথা ভাবতে লাগলাম। একটু একটু হাসছিও । গত সরকারের আমলে তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলাম, এ সরকারকে। এ সরকারও কম যায় না। তারাও তাদের “ক্ষমতা”র প্রকাশ করছে। বি এন পি’র আমলে দেখা যায় পাকি-প্রেম... আওয়ামীলীগ আমলে দেখা যায়... ভারত-প্রেম। আচ্ছা............বাংলাদেশ-প্রেম দেখা যায় না কেন? কি দোষটা করেছিলাম আমরা, এ দেশে জন্মে? এ রকম দুই সরকারের শোষণে জর্জরিত হয়ে? ’৭১ এ আমাদের নেতাদের মাঝে যে দেশপ্রেম দেখা গিয়েছিল কোথায় গেল, আজ সে সব? আজ আমরা বিজয়ের মাসে গালে ফা*স্তানের পতাকা গালে এঁকে খুশি মনে খেলা দেখতে চাই। আমাদের দেশের মেয়েরা “আফ্রিদি... আই লাব্যুউউউউ......” লেখা নিয়ে যায় মাঠে খেলা দেখার সময়। সারা বিশ্বে, ভাষার মাস বলে পরিচিত ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা দলবেঁধে ভারতীয় ‘চুপ্পার ইস্টার’দের উদ্যম নাচানাচি দেখতে যাই স্টেডিয়ামে, আর সাথে কান-ফাটানো হিন্দি গান তো আছেই!!! হা হা হা! আমার ভাবনা চিন্তা গুলোই আমাকে হাসায়। এর থেকে ভালো হাসির গল্প আর কি-ই বা হতে পারে!!!!!
###
আজ আমাদের চারপাশে কেবল হাসি আর হাসি। আমি লিখছিও হাসির গল্প! চোখের কোণে অশ্রুজল নিয়ে হাসছি... কষ্টের হাসি।এই যে আমি এখন লেখাটা লিখছি, আজও দেশের সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মারপিট হয়েছে।এরকম নানা ভাবেই, আজ আমাদের চারপাশে ঘিরে রেখেছে, দুঃখ, বেদনা,বঞ্চনা, পরাজয়, হাহাকার মেশানো হাসি। সত্যিই তো! এত হাসি কোথায় রাখি! এরকমভাবে হাসতে কখনও কি কেউ দেখেছে আমাদেরকে? কেউ কি বলে দিতে পারবেন, আমাদের এই ‘হাসি-মাখা’ জীবনের শেষ কোথায়? আজ এই দুঃখ, কষ্ট, হাহাকার মেশানো হাসির মধ্যে কেউ কি ভুবন ভুলানো হাসি হাসছেন না? হাসছেন... হাসছেন!! আলবত হাসছেন!!! তিনি আমাদের নিয়তি। আমাদের এই ‘মহা হাস্যময়’ জীবন দেখে কি তিনি কি অট্টহাসিটাই না হাসছেন!!!
পরিশিষ্ট: আমি মানুষটা খুবই নরম মনের। তাই হয়তোবা একটু বেশীই আবেগী! আজও আনিসুল হকের মা, হুমায়ুন আহমেদের জোছনা ও জননীর গল্প, জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ- বইগুলো পড়ি আর কাঁদি। খুব কষ্ট হয়, যখন স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের কথা গুলো পড়ি। বই পড়তে পড়তেই আমি যেন নিজেকে খুঁজে পাই স্বাধীনতার মঞ্চে। 'স্বাধীনতা' শব্দটার ব্যাপকতা যে কত... তা আমরা আজও ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারি না! যদি পারতাম...তাহলে কখনোই ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলতাম না, আজকের এই দিনে আমরা সাত মাস যুদ্ধ শেষে জয়ী হয়েছি!!!
এন.টি.ভি. তে দেখলাম বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোক ক্যামেরার সামনে বলছেন “এ দেশের কোন সরকারের প্রতিই আমার কোন অভিযোগ নেই। আমার শুধু আক্ষেপ, আমি এই দেশে জন্মগ্রহণ করেছি।” ফেসবুকে এ প্রসঙ্গে একজন মন্তব্য করেছেন, “ঐ লোক নিজে কিছু করেছে দেশের জন্য? নিজে তো কিছু পারেই না, পারে শুধু উল্টা-পাল্টা কথা বলতে।” আচ্ছা, কতটুকু কষ্ট থেকে একজন লোক এরকম কথা বলতে পারে? লোকটা তো নিজের দেশকে খারাপ বলতে চায় নি, বোঝাতে চেয়েছেন এদেশের সরকার ব্যবস্থা আজ কোন পর্যায়ে গিয়েছে, যা আজ তাকে এরকম কথা বলতে বাধ্য করেছে...।
এত এত হতাশার কথা বলায়, আপনি হয়তোবা মনে মনে আমাকে 'একচোখা' হিসেবে অভিহিত করে ফেলেছেন, যে কি না শুধু মন্দটাই দেখে, ভালোটা দেখে না! নারে ভাই! আমিও এদেশেরই ছেলে। আমিও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, এদেশে একদিন ঠিকই আশার ফুল ফুটবে। অথৈ জলের ওপার থেকে, কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে আমাদের মাঝেও আসবে সূর্যের আলো। আমাদেরও শুভবুদ্ধির উপলব্ধি হবেই ইনশাল্লাহ! সে আশায়ই তো বুক বেঁধে বেঁচে আছি!
১৬ ই মার্চ, ২০১২ দুপুর ১২:৪৮
~ একজন দুর্বল মানুষ ~ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, ভাই!!!
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই মার্চ, ২০১২ ভোর ৬:১১
ঈশান হাওয়া বলেছেন: ভাই প্রথম মন্তব্য আর প্লাস আমি দিলাম... হ্যাপি ব্লগীং