![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৮৯ বাংলাদেশে মাদক গ্রহনকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই লাখ। যদিও মাদক গ্রহনকারীদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য নেই । তবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা অর্থকোটির ও চেয়ে অনেক বেশী। ওই পরিসংখ্যানে বলা হয়, মাদক গ্রহনকারীদের ১৫ শতাংশের বয়স ২০-এর নিচে, ৬৬ শতাংশ ২০-৩০ বছরের মধ্যে, ১৬ শতাংশ ৩০-৪০ বছর এবং ৪ শতাংশ ৪০ থেকে তদূর্ধ্ব বয়সের।
যদিও বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য উত্পাদিত হয় না। তথাপি ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সব ধরনের স্মাগলিং এবং মাদকদ্রব্য পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকে।
মাদকের পরিচিতি:
হেরোইন
হেরোইন আসলে কোন প্রাকৃতিক উপাদান নয়। মরফিনের রাসায়নিক রূপান্তর ঘটিয়ে হেরোইন প্রস্তুত করা হয়।অপিয়াম পপি থেকে প্রাপ্ত অপরিশোধিত ক্ষয়িত পদার্থকে অপিয়াম বলা হয়। অপিয়ামকে পৃথক ও পরিশুদ্ধ করলে বিশটি ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়। উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত বস্তুটির নাম মরফিন। কোডেইন অপিয়াম থেকে প্রাপ্ত অন্য একটি প্রাকৃতিক উপাদান।
কোকেইন
অন্যান্য মাদকের মতই কোকেইন আসক্তি, নির্ভরশীলতা, মাদক প্রত্যাহারজনিত বিষণ্নতা এবং মানসিক পীড়া সৃষ্টি করে। অ্যামেফটেমাইন ইওফোরিয়াও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে বলে বিশ্বজুড়ে এ উপাদানটির মারাত্মক অপব্যবহার হচ্ছে
প্যাথেডিন
প্যাথেডিন বহুল পরিচিত একটি সিনেথটিক ওষুধ। ঘুম আনয়নে এবং মাংসপেশীর খিঁচুনি উপশমকারী হিসেবে প্যাথেডিন ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়।
ফেনসিডিল
এটি মাদকসেবীদের কাছে ডাইল হিসেবে পরিচিত। প্রথমে ফেনসিডিল মিষ্টিযুক্ত কাশির সিরাপ হিসেবে মে এন্ড বেকার প্রস্তুত করতো। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতির আওতায় বাংলাদেশে ফেনসিডিল বাতিল ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশে ফেনসিডিলের উত্পাদন বন্ধ হয়ে গেলেও পাশের দেশ ভারত থেকে প্রতিদিন সীমান্ত পাচার হয়ে প্রচুর পরিমাণে ফেনসিডিল বাংলাদেশে ঢুকছে। তবে ওষুধ হিসেবে নয়, মাদক হিসেবে। প্রতি পাঁচ মিলিলিটার ফেনসিডিল সিরাপে রয়েছে ৯ মিলিগ্রাম কোডেইন ফসেফট, ৭(২ মিলিগ্রাম এফিড্রিন হাইড্রোক্লোরাইড এবং ৩(৬ মিলিগ্রাম প্রোমেথাজিন হাইড্রোক্লোরাইড। কাশির ওষুধ হিসেবে স্বাভাবিক ডোজ হলো প্রতিবার এক থেকে দু'চামচ বা পাঁচ থেকে দশ মিলিলিটার। মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ফেনসিডিলের ব্যবহারে আসক্তি সৃষ্টিকারী গুণাগুণ রয়েছে।
ইয়াবা
বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত ও বহুল পরিচিত মাদকটি হলো ইয়াবা। এটি মিথাইল অ্যামিফটামিন বা মেথামিফটামিন এবং ক্যাফিনের সমন্বয়ে গঠিত একটি মিশ্রণ। ক্যাফিন আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি বস্তু। চা ও কফিতে ক্যাফিন থাকে। ক্যাফিন মৃদু কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম উত্তেজক। তন্দ্রা দূর করার জন্য সাধারণত আমরা ক্যাফিনসমৃদ্ধ চা বা কফি পান করি। কর্মক্ষমতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য চা বা কফি অনেকের জন্য উপকারী। মিথাইল অ্যামিফটামিন অত্যন্ত শক্তিশালী নেশাসৃষ্টিকারী একটি মস্তিষ্ক উত্তেজক বা উদ্দীপক। থাইল্যান্ডে ইয়াবাকে ক্রেইজি মেডিসিন হিসাবেও আখ্যায়িত করা হয়। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ইয়াবা উত্পাদনের জন্য প্রসিদ্ধ।
ইয়াবা মূলত ট্যাবলেট বা পিল আকারে প্রস্তুত করা হয়। ট্যাবলেটিতে মূলত লাল গোলাপী এবং সবুজ রং ব্যবহার করা হয়। ট্যাবলেটের আকর্ষণ ও কাটতি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন রং-এর সাথে বিভিন্ন ফলের ফ্লেভার বা সুগন্ধি যোগ করা হয়। ইয়াবা ট্যালেটে (আর) এবং (ডব্লিউওয়াই) লগো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইয়াবা মুখে খাওয়া হয়। ইয়াবা ট্যাবলেটে প্রায়শই আঙ্গুর কমলা এবং ভেনিলা ক্যান্ডির স্বাদ থাকে বলে ইয়াবা মুখে খাবার ব্যাপারে মাদক সেবীদের আগ্রহ থাকে বেশি। ইয়াবা গ্রহণের আরো একটি সহজ পদ্ধতি রয়েছে। এই পদ্ধতি নাম চেইজিং। এই পদ্ধতিতে ইয়াবা মরফিন বা হেরোইনের মত অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে রেখে মাদকের তলা দিয়ে উত্তপ্ত করা হয়। আগুনের উত্তাপে মাদক গলে যায় এবং বাষেপ পরিণত হয়। এই বাষপ মাদকসেবীরা নাক বা মুখ দিয়ে শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে টেনে নেয়। অনেক সময় মাদকসেবীরা ট্যাবলেটকে ভেঙ্গে পাউডার তৈরি করে নাক দিয়ে শ্বাসের মাধ্যমে সজোরে শরীরের ভেতর টেনে নেয় অথবা এই পাউডার দ্রাবকের সাথে মিশিয়ে ইনজেক্শনের মাধ্যমে শরীরে গ্রহণ করে।
মাদকাসক্তির কারণ:
মাদকাসক্তির অনেক কারণ হতে পারে। কেননা মানুষ বিভিন্ন কারনে কিংবা একই মানুষ একাধিক কারণে মাদকাসক্ত হতে পারে। -
১)অনেক পরিবারের অভিভাবকগণ নিজেদের ব্যবসা- বানিজ্য বা অন্যান্য কাজে এত বেশী ব্যাস্ত থাকেন যে, সন্তানদের খোজ-খবর রাখার সুযোগ পান না। ফলে এসব পরিবারের সন্তানেরা বাবা-মা’র অবাধ্য হয়ে উঠতে পারে এবং এ সন্তানরা অভিভাবকদের অজান্তেই দুষ্ট চক্রের কবলে পড়ে ক্রমে মাদকাসক্ত হতে পারে।
২)কোন পরিবারের কোন ব্যাক্তি যদি মাদকাসক্ত হয়, তবে তার প্রভাব সে পরিবারের সন্তানদের উপর পরতে পারে। এরুপ বেশীরভাগ পরিবারের সন্তানেরা মাদকাসক্তিকে একটি অনুকরনীয় বিবেচনা করে মাদকদ্রব্য সেবন করে থাকে।
৩)যেসব পরিবারের পিতা- মাতা দীর্ঘদিন ব্যাক্তিগত মনমালিন্যের কারণে স্বামী-স্ত্রী পৃথক পৃথক অবস্থান করেন অথবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, সেসব পরিবারের সন্তানদের মধ্যে হতাশা ও উদ্দেশ্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে। ফলে, এসব পরিবারের সন্তানেরা অনেক সময় মাদকাসক্ত হয়।
৪) বাংলাদেশে বিভিন্ন কারনে ব্যর্থতা ও হতাশার পরিমান অনেক বেশী। যেমনঃ কেউ প্রেমে ব্যর্থ হচ্ছে অথবা প্রেমিক কতৃক প্রেমিকা প্রতারিত হচ্ছে অথবা প্রেমিকা কতৃক প্রেমিক প্রতারিত হচ্ছে, যোগ্যতা থাকা সত্তেও সংগত বা অসংগত কারনে কেউ হয়ত পাচ্ছে না নিয়োগ, অথবা পাচ্ছে না প্রমোশন, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও পরিবারে নানা অভাব অভিযোগ ইত্যাদি নানা দুঃচিন্তা, ব্যর্থতা ও হতাশা থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য অনেকে ক্রমে ক্রমে মাদকাসক্ত হয়ে পরছে।
৫) অনেকে সঙ্গদোষের কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পরছে। কেউ নেশাগ্রস্ত হলে তার সঙ্গীদেরকেও নেশার জগতে নেয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। আবার অনেকে মাদক দ্রব্যের গুণাগুণ ও কার্যকারিতা সম্পর্কে শুনতে এবং কৌতুহল নিবারণের জন্য দুই-একবার মাদকদ্রব্য সেবন করতে আগ্রহী হয়ে উঠে। ফলে এ কৌতুহল করতে গিয়ে ক্রমে ক্রমে অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পরে।
৬) অনেক ছেলে-মেয়ে স্যোসাল মিডিয়া কিংবা সিনেমা দেখে বিদেশী ফ্যাশন মনে করে মাদকাসক্তিতে আসক্ত হয়ে পরে।
৭) ধর্মীয় অনুশাসনের অবক্ষয় মাদকাসক্তির অন্যতম কারন হতে পারে।
৮) আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য চোরাচালানের সংযোগের ফলে ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, নেপাল সীমান্ত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান হতে এদেশে বহু মাদকদ্রব্য প্রবেশ করে, ফলে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য পাওয়া অত্যন্ত সহজ হয়ে পরেছে। ফলে এদেশের অধিক লোক মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
৯) বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের ওপর কোন কঠোর আইনের ব্যবস্থা করা হয়নি। “মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন ১৯৯০” এদেশে কঠোরভাবে পালন করা সম্ভব হচ্ছেনা। তাছাড়া প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের প্রবেশ পথগুলো দিয়ে ক্রমেই বেশী বেশী পরিমাণে মাদকদ্রব্য আসছে। ফলে মাদকদ্রব্য হয়ে পড়েছে সহজলভ্য। এ ছাড়া, যেসব এলাকায় মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় সেসব এলাকায় প্রশাসন অধিকতর কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে বলে মনে হয় না।
মাদক থেকে উত্তরনে কিছু পরামর্শ-
১) মাদক গ্রহণ সমস্যা যত না সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়, তার চেয়ে বেশি মনস্তাত্ত্বিক। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী বা উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের যাবতীয় সমস্যা বিবেচনায় নেয়া উচিত। প্রয়োজনবোধে বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন বা শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের সাহায্য-সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মত অনুন্নত দেশে সন্তান-সন্ততির সাথে বাবা-মা বা শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীর দূরত্ব বেশি। দূরত্বের কারণে প্রায় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক মূল্যবোধ ও শ্রদ্ধাবোধের অবনতি ঘটে। মাদকাসক্তির পেছনে এসব ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক সমস্যা মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সভা সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে মাদক গ্রহণের কারণ ও পরিণতি সম্পর্কে নিয়মিত সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করতে হবে পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় গন মাধ্যম এবং স্যোসাল মিডিয়ার কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
৩) অধিকাংশ স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাদকের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা না ভেবেই বা না জেনেই মাদক গ্রহণ শুরু করে। তারা জানে না, আসক্তি ও নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়ে গেলে মাদক প্রত্যাহার সহজ নয় এবং মাদক প্রত্যাহারের মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বাবা,মা, ভাইবোন আত্মীয়-স্বজন বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পর্যাপ্ত ধারণা দেয়া আবশ্যক।
৪)সার্কভুক্ত দেশগুলো বিশেষ করে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালে মাদক সমস্যা গুরুতর বলে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিওিতে মাদক নিয়ন্ত্রণে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক। বিশেষ করে সিমান্তে মাদক পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
৪) এলাকা ভিত্তিক মাদকবিরোধী সংগঠন তৈরী করে সচেতনতা সৃষ্টি ।
৫) স্থানীয় পর্যায়ে মাদক সেবীদের চিকিৎসা কেন্দ্র তুলতে হবে। কার্যকরভাবে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা গেলে আশা করা যায় এ অন্ধকার অপরাধ জগত্ থেকে অনেকেই সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ পাবে।
-তথ্য সহায়তায় -দৈনিক ইত্তেফাক, যুগান্তর, youtube,facebook
©somewhere in net ltd.