নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি আমার মত। আমি অনন্য। পৃথিবীতে আমার মত কেউ ছিলনা, নেই আর কেউ আসবেও না। জন্মের আগেও আমি ছিলাম না। মৃত্যুর পরেও এই নশ্বর পৃথিবীতে আমার কোন অস্তিত্ব থাকবেনা। যা থাকবে তা আমার কৃতকর্ম।
১।
নাহিদ নবম শ্রেনীতে উঠেছে। এরই মধ্যে ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। সে অঙ্কে খুব খারাপ করেছিল। কিন্তু তার রেজাল্ট অপ্রত্যাশিত রকম ভাল হয়েছে। সে টেলেন্টপুলে অষ্টম হয়েছে। প্রথমে সে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। পরে গেজেট দেখে বিশ্বাস হয়। আনন্দে সে আত্মহারা। আত্মীয় সজনরা আসছে মিষ্টি নিয়ে। তার মা সব আত্মীয় সজনদের বাড়িতেও মিষ্টি পাঠিয়েছে। প্রথমে এক বুক হাসি নিয়ে তার নানা-নানী এল। এরপর আরও আত্মীয়-স্বজন। একে একে সবাই গ্রামের স্কুল থেকে ভাল রেজাল্ট করায় প্রসংশায় পঞ্চমুখ। এভাবে বেশ কিছু ভাল সময় কেটে যায়।
নাহিদের বয়ঃসন্ধি এসে দাঁড়ায় তার জীবনের দরজায়। এরপর হঠাতই সব বদলে যেতে শুরু করে। পড়াশুনা ভাললাগেনা। বুকের মধ্যে চিন চিন ব্যাথা করে। কোন কিছুই ভাললাগেনা তার। চারপাশের সবকিছুই বদলে যেতে শুরু করে। সবকিছুকেই ফাঁকা আর বিষণ্ন মনে হয়। পরিচিত বলয়ের কারো সাথে মিশতেও তার আর ভাললাগেনা। খেলাধূলাতেও মন বসেনা। সবকিছু অর্থহীন মনে হতে শুরু করে। সে একজন ভাল বন্ধুর কল্পনা স্মৃতিপটে এঁকে যায় যার সাথে সবকিছু শেয়ার করা যায়। কিন্তু কাউকেই খুঁজে পায়না। নিঃসঙ্গতার দুষ্টচক্র এসে ভর করে তার জীবনে। কিছুতেই সেখান থেকে বের হতে পারেনা। নিজেকে হারিয়ে ফেলে অজানা গিরিখাদে। স্কুলে সে সবসময় ফার্স্ট ছিল। সেকেন্ড বয়ের চেয়ে সে সবসময় দেড়শ মার্কের বেশি পেয়ে এগিয়ে থাকতো। রেজাল্টটাও দিন দিন খারাপ হতে শুরু করে। তারপরও সে ফার্স্ট বয়ই থেকে যায়। কিন্তু নাম্বারের ব্যবধানটা কমে যেতে শুরু করে।
২।
এভাবে দেখতে দেখতে এসএসসি পরীক্ষা এসে পড়ে। পরীক্ষা যতই কাছে আসতে শুরু করে তার নিঃসংগতা আর বুকের চিনচিন ব্যাথাটা ক্রমশই বাড়তে থাকে। অনেক চেষ্টা করে কিন্তু ফেরার কোন পথ খুঁজে পায়না। সে মাঝে মধ্যে বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্টের গেজেট উল্টায়। ভাবতে থাকে তার পেছনের কত ছেলে কতইনা ভাল করবে। অথচ সে চরমভাবে পিছিয়ে পড়বে। এই ভাবনায় তার নিঃসংগতা আরও বাড়তে থাকে। পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। পরীক্ষার মধ্যেই কয়েকজন বন্ধু পেয়ে যায়। বন্ধুদের প্রেমিকা দেখে তারও প্রেম করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাউকে অফার দেওয়ার সাহস সে বিন্দুমাত্র পেতনা। পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। রেজাল্টের অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে। কিন্তু দীর্ঘ প্রতিক্ষা তার নিঃসঙ্গতার জগতটাকে আরও বড় করে তোলে। রেজাল্ট হয়। রেজাল্ট প্রত্যাশার টিকিটিও স্পর্শ করেনা। তার জগতটা আরও সংকীর্ণ হয়ে উঠে। সে নিজেকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মনে করতে থাকে। আবার করে পরীক্ষা দেওয়ার চিন্তা করে। অনেক ভেবে চিন্তে সে
পরিকল্পনা থেকে ফিরে আসে।
৩।
কলেজে ভর্তি হয়। প্রথমদিকে ভালই লাগে। কিন্তু এসএসসির রেজাল্ট তাকে পিঁড়া দিতে থাকে। কলেজে ভাল বন্ধু খুঁজে পায়না। তারপরও তার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ভাল বন্ধু খুঁজে পায়। কিন্তু বন্ধুটি অন্য জগতের। সে সারাক্ষণ ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়ে থাকে। এটা নাহিদের কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে। বন্ধু মাঝে মধ্যে কলেজে আসেনা। নাহিদের খুব খারাপ লাগে। বেশিরভাগ সময়ই সে নিঃসঙ্গই থাকে। ইয়ার ফাইনাল এবং অন্যান্য পরীক্ষা যতই কাছে আসে শূন্যতা তত বাড়তে থাকে। শূন্যতার গন্ডি থেকে সে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারেনা। পড়াশুনা করার জন্য অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু মনের মত পড়তে পারেনা। না পড়তে পারার হতাশা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা চলে আসে। পরীক্ষা মানেই তার জন্য ভিসিয়াস সাইকেলের মত হয়ে উঠে। এসময় তার নানান শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। নিজেকে
আরো বেশি নিঃসঙ্গ মনে হয়। নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়েই নাহিদের ইন্টার পরীক্ষা শেষ হয়।
৪।
নাহিদ প্রথম ভাবে যে সে বুয়েট ভর্তি কোচিং করবে। কারণ তার জিপিএ অন্যদের তূলনায় কম। শুধু বুয়েটে পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেই সে চান্স পেয়ে যাবে। না হলে অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিগুলোত রয়েছেই। কিন্তু তার মায়ের ইচ্ছাই মেডিকেল ভর্তি কোচিং এ ভর্তি হয়। নাহিদের কাছের বন্ধুরা ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিং করতে শুরু করে। এর ফলে বন্ধুদের সাথে শিড়িউল মিলিয়ে দেখা করতে পারেনা। সে আরো নিঃসঙ্গ হয়ে উঠে। কোচিং এ আসে আর বাসায় কিছুটা পড়াশুনা করে এভাবেই সময় যেতে থাকে। বিকেলে একা একা ঘুরতে বের হয়। পৃথিবীতে বড্ড একা লাগে নিজেকে। এসএসসির জিপিএ কম থাকাতে কোচিং এ খুব একটা গুরুত্ব পায়না। এরই মাঝে ইন্টারের রেজাল্ট দেয়। সে তার নিজের কাছে অবিশ্বাস্য ভাল রেজাল্ট করে। তার স্পিরিট বেড়ে যায়। সে কোচিং এর স্পেশাল ব্যাচ এও চান্স পেয়ে যায়। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মনে হয় সে পরীক্ষা ভাল দেয়নি। আরেকটু ভাল দিলে হয়তো চান্স হয়ে যেত। সবাইকে
অবাক করে দিয়ে সে প্রথম সারির একটা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে যায়।
৫।
মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর চারমাস বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে ভালই সময় পার হয়। কিন্তু অন্তর্গত রক্তের গহীনে যে নিঃসঙ্গতা আঁকড়ে আছে তা সাময়িকভাবে লুসিড ইন্টারভালের মত সুপ্ত থাকলেও যে আবার জেগে উঠে। মেডিকেল জীবন শুরু হয়। মেডিকেলের পড়ার প্রচন্ড চাপ তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। মেডিকেলে সে উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজে পায়না। মেডিকেলে পছন্দের কোন মেয়ের সাথে প্রেম করে ভবিস্যতে বিয়ে করার খুব স্বপ্ন ছিল। কিন্তু প্রচন্ড অন্তর্মূখিতার কারণে তাও হয়ে উঠেনা। রিডিং পার্টনার খুঁজে বেড়ায়। তাও খুঁজে পায়না। ফলে আবার নিঃসঙ্গতার দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে যায়। একটু আনন্দ আর শান্তির জন্য পথ প্রান্তরে নিঃসঙ্গ হেঁটে বেড়ায়। কিন্তু কিছুতেই সেই নিঃসঙ্গতা আর কাটেনা। এভাবেই তার দিন চলতে থাকে। মাঝে কিছু দুর্ঘটনা এসে জীবনের গতিপথ আর দর্শন পাল্টে দেয়। নতুন জীবন নিয়ে সে সামনে এগুতে থাকে। সমানতালে চলতে থাকে তার নিঃসঙ্গতাও। একটি মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মেয়েটি শর্তের বেড়াজালে প্রেমকে আবদ্ধ করে ফেলে। সেইসব শর্ত নাহিদের পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। আবারও সেই নিঃসঙ্গতা। চলাচলে তীব্র নিরবতা তাকে বিস্মিত করে, শঙ্কিত করে। রাজনীতির সাপ-লুডো খেলায় সে আবার ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
নিঃসঙ্গতা দিয়েই মেডিকেলের জীবন শেষ হয়। ফাইনাল পরীক্ষা দেয়। তারপর বাড়িতে চলে আসে।
৬।
মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে নিজের ইচ্ছার, আকাঙ্খার সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে খালাতো বোনকে বিয়ে করে। শুরু হয় পূর্ণতার বদলে নিঃসঙ্গতার নতুন অধ্যায়। কিছুদিন ভালই কাটে। তারপর সে নিজের ভূবনে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে। বিয়ের কথাটা বন্ধু-বান্ধব সবার কাছ থেকে গোপন রাখে। আর অতি সঙ্গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এমন এক তীব্র নির্জনতা যা কারো সাথে শেয়ারও করা যায়না। মেয়েটির সাথে তার কিছুতেই মিলেনা। অনেকবার ভাঙ্গনের সুর বেজে উঠে। কিন্তু একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হবে ভেবে সে অনেক কষ্টে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। প্রথম বিসিএসে অংশ নেয়। ভাইভা দেয়। কিন্তু সিরিয়াসলি রিটেন না দেওয়া আর ভাইভা বোর্ডে কিছু ভূলের কারণে সে ক্যাডার হতে পারেনা। তীব্র নির্জনতার মাঝে ডুবে যায়। সমাজ সংসার থেকে সে আলাদা থাকতে চায়। কিছুতেই সে ক্রমাগত ব্যার্থতার গ্লানি সইতে পারেনা। জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু তা কি আর সম্ভব? হৃদয়ে নিঃসঙ্গতা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় জীবনের পথ প্রান্তর।
৭।
সে পোষ্ট গ্রাজুয়েশনের পরীক্ষায় একের পর এক অংশ গ্রহণ করতে থাকে। বার তিনেক প্রিপারেশন অর্ধেক করে আর বার দুয়েক প্রিপারেশন কমপ্লিট করে অংশ নেয়। কিন্তু পাশ করতে পারেনা। কোনমতে বিসিএস জুটে যায়। তাও আবার পেছনের দিকে। সে নিজেকে অথর্ব আর নিঃসঙ্গই মনে করতে থাকে। নিজের দেহ-মনকে পবিত্র করার জন্য মেডিটেশন করে। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে। সে ভাবে হয়তো তার মনে কোন কালিমা আছে যার জন্য তাকে এত ধুঁকতে হচ্ছে। প্রানান্তকর চেষ্টা করে যায় সে কালিমা খঁজে বের করে সামনে এগুনোর। কিন্তু সঠিক পথের দিশা আজো খুঁজে পায়না।
©somewhere in net ltd.