নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার সীমিত জ্ঞান কারো উপকারে আসলে শান্তি পাই...
।৬ ডিসেম্বর ২০১৮।
সকাল ৭টায় মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমাদের ট্যাক্সির ড্রাইভার বাংলা জানেন। আব্বু যাওয়ার সময় সকালের নাস্তা কিনে নিলো। মক্কা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। মন প্রচন্ডরকমের খারাপ। আমি আর পল্টু নাস্তা না করেই গাড়িতে ঘুমিয়ে গেলাম। একবার মা ডেকে উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা রাঃ এর কবর দেখালো। আবার ঘুমিয়ে গেলাম। যথারীতি ঘুম ভাঙলো আম্মুর ডাকে। আমরা মদিনার হেরেম এরিয়ার কাছাকাছি চলে এসেছি। চোখ মেলে দেখি গাড়ি তখনো হাইওয়ের মতো বিশাল রাস্তায়। ড্রাইভার রাস্তা ও পাহাড়ের গায়ে বানানো তোরণগুলো দেখিয়ে বললো, "এই তোরণগুলো মদিনার হেরেমের শেষ সীমা, এর ভিতর দাজ্জাল ঢুকতে পারবে না"
মদিনায় আমাদের চল্লিশ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ পড়ার ইচ্ছে আছে। গাড়ি এতো ধীরে যায় কেন!? নামাজ পাবো তো!? আর কতদূর!? হেরেম এরিয়ায় সেই কখন ঢুকলাম! এখনো পৌঁছাতে পারলাম না! জামাতে নামাজ পাবো তো!? মাথার ভিতর প্রশ্নগুলো কুট কুট করছিল। গাড়িতে আমরা হাল্কা নাস্তা করে মোটামুটি তৈরি, নামাজের সময় হয়ে গেলে আগে হেরেমে চলে যাবো। হাইওয়ে ছেড়ে গাড়ি মদিনা শহরে। উঁকিঝুঁকি চলছে, কখন একনজর দেখতে পাবো নবীজী সাঃ এর রওজার সেই সবুজ গম্বুজ!
আলহামদুলিল্লাহ! পেয়েছি! দরুদ ও সালাম পেশ করলাম। হোটেলের সামনে আমাদের নামিয়ে ড্রাইভার বিদায় নিলেন। মোয়াল্লেম অন্য গ্রুপ নিয়ে ব্যস্ত, আসতে পারছেন না। আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়ে দিলেন। রিসিপশনে গিয়ে প্রথম যখন কথা বললাম, তখন ওরা বললো চেক-ইন আসরের পর। এই দুই-তিনঘন্টা কি করবো তাহলে!? আবার কথা বললাম। বুকিং নাম্বার দেখে বললো, "রুম খালিই আছে, এখনই চেক-ইন করতে পারবেন"। হোটেলে চেক-ইন করে, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে, তৈরি হয়ে আমরা পাচজন একসাথে গেলাম মসজিদে নববীতে।
রাস্তায় ট্রাফিক লাইট নেই। লাল বাতি জ্বলে আছে, এমনটাও নয়। অথচ গাড়ি দাড়িয়ে আছে। নামাজীরা রাস্তা পার হচ্ছেন। কেউ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গ্রুপের অন্য সদস্যের জন্য অপেক্ষা করছেন। গাড়ি সব দাঁড়িয়ে আছে, কোনো হর্ণ নেই, চোখেমুখে বিরক্তিভাব নেই! সবার আচার-আচরণ অদ্ভুত লাগছিল! মসজিদে প্রবেশ করলাম। অনুভব করলাম, আমরা নবীজী সাঃ এর মেহমান।
নামাজের পর আব্বু কোথায় দাঁড়াবে সে জায়গা দেখিয়ে আমরা নামাজের জন্য মসজিদের ভিতর ঢুকলাম। মহিলাদের নামাজের জায়গাকে যদি কোডিং করি, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। "D"- সবচেয়ে বাহিরের দিকের অংশ, বাহির থেকে মসজিদে ঢুকতেই যে জায়গা সেখানে মহিলাদের জন্য কার্পেট বিছানো থাকে; এই জায়গাটা উন্মুক্ত, পুরুষ-মহিলা সবাই হাটাচলা করে। " C"- মহিলাদের জন্য দেয়ালঘেরা সংরক্ষিত অংশ, পুরুষ প্রবেশ নিষেধ। "B"- মূল মসজিদের বাহিরের অংশ। " A"- মূল মসজিদের ভিতরের অংশ, কাঠের পার্টিশান দেয়া, এই অংশে বাচ্চা allow করে না; মোটা, সাদা পর্দা দিয়ে চারটি ভাগ করা, বামদিক থেকে নাম্বারিং করলে চারটি ভাগের নাম্বার আসে A1, A2, A3, A4। কোড দেয়ার একটা কারণ আছে। মহিলাদের জন্য রওজা জিয়ারা সহজ হয় ২৫ নাম্বার গেট দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলে। বেশিরভাগ সময় A1 অংশের নামাজীদের আগে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়।
আমরা যোহরের নামাজ A2 তে পড়লাম। জিয়ারাতের সময় জেনে রুমে চলে এলাম। আসরের নামাজ পড়লাম বাহিরের কার্পেটে। নামাজ শেষে মসজিদ চত্বরে হাটলাম। বাবে বাকীর সামনে গিয়ে নবীজী সাঃ কে সালাম জানালাম। দেশ থেকে যারা সালাম পৌঁছাতে বলেছে তাদের সালাম পৌঁছে দিলাম। মাগরিব-এশার নামাজ পড়ে রুমে ফিরে এলাম। আগামীকাল জুমআ'বার। মসজিদে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আজকে সবাই ক্লান্ত, বিশ্রাম নেয়া জরুরি।
।০৭ ডিসেম্বর ২০১৮।
তাহাজ্জুদ আর ফজরের নামাজ আদায় করলাম A1 এ। নামাজ শেষে বোকার মতো বের হয়ে এলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর হুশ হলো। এটা কি করলাম! রওজা জিয়ারাতে না গিয়ে বের হয়ে এলাম কেন!? মানুষ খুঁজে পায় না। আর আমি সুযোগ পেয়েও ছেড়ে এলাম! আর যদি সুযোগ না পাই! ভয় ঢুকে গেল। কি করলাম। এখন কি করবো!? দরুদ শরীফ পড়তে শুরু করলাম। খুব অস্থির লাগছে। ভয় লাগছে, আমি কি তাহলে নবীজী সাঃ এর রওজা জিয়ারাত করার যোগ্য না। আল্লাহ আমাকে বের করে আনলেন কেন!? নানান প্রশ্ন মাথায় কুন্ডলী পাকাচ্ছে। আব্বু সান্ত্বনা দিলো।
জুমআ'র নামাজের জন্য আমি আর পল্টু আলাদাভাবে অন্যদের আগেই মসজিদে চলে গেলাম। গিয়ে ঠিক A1 এ বসেছি। ফ্লোর খুব ঠান্ডা তাই জায়নামাজ নিয়ে গিয়েছিলাম। এক পাকিস্তানি পাশে বসলো। জায়নামাজ ঘুরিয়ে দিয়ে তাকে বসতে দিলাম। আমাদের কাছে জুমআ'র নামাজ কিভাবে পড়তে হয় জানতে চাইলেন। শিখিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর ভলিন্টিয়ার সামনের কাতারের সবাইকে ভালোভাবে লাইন করে বসালেন। কার্পেটে অনেক জায়গা ফাকা হয়ে গেল। আমরা কার্পেটে গিয়ে বসলাম। এবার আমার পাশে বসলো পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এরাবিয়ান। আরবি ছাড়া আর কোনো ভাষা জানে না। আমার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বললো। ওদের কথাবার্তা আমার ভালো লাগেনি। এমনিই অস্থির হয়ে আছি, তার উপরে ওদের কথাবার্তা অসহ্য লাগছিল। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছিলাম অনবরত।
জুমআ'র খুতবা শুরু হলো। আরবি বুঝি না, এজন্য আফসোস হলো খুব। দেশে আসার পর দেখলাম, জুমআ'র খুতবার অনুবাদ এফএম চ্যানেলে সরাসরি প্রচার করা হয়। আগে জানলে হা করে বসে থাকতে হতো না। জুমআ'র খুতবা দিলেন এবং নামাজ পড়ালেন শায়খ হোসাইন আস শেখ। নামাজে সুরা আ'লা পড়তে গিয়ে এতো কাদলেন, এতো কাদলেন! আল্লাহ সবাইকে কবুল করে নিক। আমীন।
১ঃ৩০টায় রওজা জিয়ারাত। অনেকেই উঠে চলে যাচ্ছে। সামনে ফাকা জায়গা পেয়ে আমি আর পল্টু সামনে চলে গেলাম। এবার বসেছি এক ভারতীয় মহিলার পাশে। আল্লাহ উনাকে উত্তম জাযা দান করুক। বাকী নামাজ শেষ করে দরুদ শরীফ পড়ছিলাম আর আল্লাহর সাহায্য চাইছিলাম। ভারতীয় আন্টি আগ বাড়িয়ে কথা বললো। আমিও কথাবার্তা বললাম। উনি ৬বার গিয়েছেন। আমরা প্রথমবারের মতো যাচ্ছি শুনে ভিতরে কি আছে, কোথায় কি করতে হয়, কিভাবে সালাম দিতে হয় শিখিয়ে দিচ্ছিলেন। আমিও এই সুযোগে আবদার করে বসলাম, উনি যেন আমাকে সাথে নিয়ে যান। উনি রাজি হলেন।
অপেক্ষা সবসময় কঠিন আর এই অপেক্ষা তো কঠিনতম পরীক্ষা। সময় যেন থেমে আছে। ১ঃ২০ থেকে ১ঃ৩০ কতোবার যে ঘড়ি দেখেছি হিসেব নেই! কাঠের পার্টিশানের ওপাশে মানুষের আনাগোনা বুঝা গেলে এপাশে সবাই অস্থির হয়ে যায়। ভলিন্টিয়াররা বলতেই থাকে, "বাজি, আভি নেহি", "বাজি, বেইঠ যাও", " সবর...সবর", "সাবকো মওকা মিলে গা", "বেইঠ যাও"। সবর করছি, দরুদ পড়ছি। কি প্রচন্ডরকমের অস্থিরতা দরুদ শরীফ দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছি। চাইছি, আল্লাহর সাহায্য চাইছি। কাদছি, একবার রওজা জিয়ারাতের সুযোগ পাওয়ার জন্য কাদছি। ঠিক ১ঃ৩০ টায় কাঠের পার্টিশান দরজার মতো করে খুলে গেল। সবাই উঠে দৌড়ে যেতে লাগলো। ভলিন্টিয়াররা চিৎকার করে বলছে, "ধীরে বাজি, ধীরে যাও", " সবর, সবর"। আমরা আন্টির সাথে উঠে হাটা দিলাম। আমি উনাকে ধরে রেখেছিলাম, আর পল্টু আমাকে।অন্যদের দৌড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে খুব জোড়ে হাটছিলাম। একটা জায়গায় গিয়ে উনি বললেন, "ব্যাগে দামি কিছু না থাকলে ব্যাগ এই পাশ দিয়ে ফেলে দাও, যাওয়ার সময় নিয়ে নিও"। আমার কাছে জায়নামাজ, জুতার ব্যাগ আর পল্টুর ছোট ব্যাকপ্যাক। উনি যা বললেন তাই করলাম।
হাটতে হাটতে একনজর দেখলাম রওজার গোল্ডেন গেইট! উপরে গম্বুজ দেখা যাচ্ছে। পা বসে যাচ্ছে। জোড় খাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। লাল কার্পেট শেষ, আমি সবুজ কার্পেটে দাঁড়ানো! আলহামদুলিল্লাহ! আমাদেরকে দুই রাকাআত নামাজ পড়তে বললেন। নামাজ পড়ে তাড়াতাড়ি উনার সাথে সামনে এগিয়ে গেলাম। সাদা পর্দা ঘেসে নামাজ পড়ার জন্য মানুষের ভীড় লেগে আছে। একজনের হলেই আরেকজন দাড়িয়ে যাচ্ছে। আমরাও লাইন এ দাড়ালাম। নামাজের সুযোগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে প্রতিটা পয়েন্ট চিনিয়ে দিলেন। রাসুল সাঃ কে কাছ থেকে সালাম জানানোর সুযোগ পেলাম। রিয়াজুল জান্নাত এর সীমানা নিয়ে আমি স্টাডি করেই গিয়েছিলাম কিন্তু আন্টির সাহায্যের...কি লিখবো!? আমি যে কতোটা কৃতজ্ঞ! উনার এই ঋণ শোধের সাধ্য আমার নেই! উনার এই সাহায্য ছিলো আমার জন্য বোনাস! আল্লাহ উনাকে নেক হায়াত দান করুক এবং জান্নাতী হওয়ার সৌভাগ্য দান করুক।
এক পর্যায়ে উনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, নামাজের লাইনে। আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ সুযোগ দিলেন। নামাজ শেষে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দোয়া করে আমরা বেরিয়ে এলাম। আনন্দে আকাশে উড়ছিলাম। তাড়াতাড়ি রুমে এসে আব্বু, আম্মু, নানুকে পুরো ঘটনা শোনালাম। সব শুনে নানু আফসোস করতে করতে শেষ। আম্মুকে বারবার বলছিল, "আমি ওদের সাথে গেলেই ভালো করতাম!"
আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ চত্বরে হাটাহাটি করলাম। মাগরিব -এশা পড়ে রুমে এসেছি। শনিবার মদিনা জিয়ারাহ। আজ এখানেই ইতি টানি।
ছবি- নেট
১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:১৭
মায়মুনা আহমেদ বলেছেন: জাজাকাল্লাহ খাইরান
©somewhere in net ltd.
১| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২৩
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন।