পাটক্ষেত, দেবী আর আমি !!

২৫ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৩:২২

বিকেল বেলা মাঠে বউ-চি খেলছি। বর্ষা আসি আসি করছে। মাঠের পাশেই মানুষ সমান পাট গাছের ক্ষেত। আমি ছেলে হলেও এই খেলায় আমাকে সবসময় বউ হতে হত। পাড়ার সকল ছেলে মেয়েরা মিলে খেলতাম। খেলার নিয়ম পুরোটা এখন আর মনে নেই। এটুকু মনে আছে যে, খেলার এক ফাঁকে সুযোগ অনুকূলে থাকলে, জামাই বাড়ি'র বন্দি থেকে বাপের বাড়িতে দৌড় দিতে হবে। এর মাঝে জামাই পক্ষের কেউ যদি বউকে দৌড়ে ছুয়ে দিতে পারে,তাহলে ঐ দল হেরে যাবে।



আমিও একটা সুযোগ পেয়েই বাপের বাড়িতে দৌড় দিলাম। জামাই বাড়ির বন্দী জীবন থেকে মুক্তি। কিন্তু আমার কপালে মুক্তি নাই। জামাই পক্ষের লোকজন সবাই মিলে আমাকে ধাওয়া করছে। আমি এদিক সেদিক করে কোন উপায় না পেয়ে, পাট খেতে নেমে পড়লাম। পাট ক্ষেতের আইল ধরে দৌড়াচ্ছি।

চারদিকে বড় বড় পাট। কিছুদূর পর আর কিছুই দেখা যায় না। এ দিকে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। আমি এক পর্যায়ে হঠাৎ দাড়িয়ে যাই। ক্লান্ত হয়ে গেছি। ভাবলাম আর দৌড়াব না।



আমার পিছনে জামাই পক্ষের একটা মেয়ে দৌড়ে আসছে- দেবী। আমাকে ছুয়ে দিতে। আমাদের হিন্দু পাড়ায় দেবী সবচাইতে সুন্দর। ওর মাথা ভরা লম্বা চুল ছিল। আর ছিল ধবধবে সাদা। এত সুন্দর তারপরও প্রতিদিন গোছলের সময় ও সারা মুখে সাবান দিত!

দেবী কাছে চলে এল, আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ও দাড়িয়ে গেল।

আমি এবার ওর দিকে কিছু'টা এগিয়ে এলাম

- আর খেলব না রে। নে আমার ছুয়ে দে। আমি মরে যাই। (এই খেলায় জামাই পক্ষের লোক, ঘর পালানো বউ কে ছুয়ে দিতে পারলে, বউ মরে যায়।)

আমি আমার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে, দেবী হঠাৎ কি হল। কিছুটা পিছনে সরে গেল।

- আমিও ওর থেকে অবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। আবার বললাম,আজ আর খেলব না। দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। আর চারদিকে কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। নে আমায় ছুয়ে দে, আমি মরে যাই। বলে ওর দিকে আর একটু এগিয়ে গেলাম।

এবারও ও আমি যতটুকু ওর দিকে এগিয়ে ছিলাম। ও ততটুকু পিছিয়ে গেল। আমায় না ছুয়েই।

- কি আমায় ছুয়ে দিবি না।



ও আচমকাই কি মনে করে- উল্টো ঘুরেই দৌড়াতে লাগল। এবার আমি ওর পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগলাম। ভাবলাম, ও মনে হয় শিয়াল দেখেছে। পাট ক্ষেতে সন্ধ্যার পর প্রায়ই শিয়াল ডাকে। আমি শিয়ালের ভয়ে পিছনে না থাকিয়ে আরো জোরে দৌড়াতে লাগলাম। আর বলতে লাগলাম, দেবী তুই কি শিয়াল দেখেছিস? দৌড়াচ্ছিস কেন? দাড়া !

চারদিকে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। শুধু সামনে দেবীর ধবধবে ফর্সা শরীর ছাড়া। ও যেদিকে যায়। আমিও সেদিকে যাচ্ছি।



কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পরই টের পেলাম আমরা পথ হারিয়ে ফেলছি। না হলে এতক্ষণে মাঠে চলে আসার কথা। আমি চিৎকার করে দেবীকে বললাম- এই দেবী দাড়া। আমরা পথ হারিয়ে ফেলছি। ও মনে হয় বুঝতে পারছে।আমার কথা শুনেই দাড়িয়ে গেল। আমি দৌড়ে ওর কাছে চলে এলাম। এবার চাইলেই আমি ওকে ছুয়ে দিতে পারি।

- আমি প্রচন্ড রেগে আছি। বললাম, তুই ওমন করে দৌড় দিলি কেন? শিয়াল দেখেছিস?

ও কোন কথা বলল না। চুপ করে রইল। এখনও হাপাচ্ছে। জোরে জোরে দম নিচ্ছে বোঝাই যায়।

- কথা বলছিস না কেন? শিয়াল দেখছিলি?

- ও বলল, না।

-তাহলে দৌড় দিলি কেন?

- তুই আমাকে ধরতে চাইছিলি কেন?

-আজ আর খেলব না, তাই ধরা দিতে চাইছিলাম।

ও অনেকটা রাগ করেই বলল- না তুই ধরা দিতে চাস নাই। তুই আমাকে ধরতে চাইছিলি !



আমি ওর কথায় মন না দিয়েই কয়েকবার উপরের দিকে লাফ দিতে লাগলাম। আমরা চকে'র ঠিক কোথায় আছি বোঝার জন্য। লাফ দিয়ে চারদিকে দেখার চেষ্টা করছি। পারছি না। পাট বেশ উচু হয়ে গেছে। ওতদুর লাফিয়ে দেখতে পারছি না। আমি কয়েকবার চেষ্টার পরে না পেরে, দেবীকে বললাম-

তুমি আমায় জাগিয়ে ধর। দেখি আমাদের পুকুরপাড়ের নারকেল গাছ দেখা যায় কিনা।

ও একটু ইতস্তত করে পরে কি মনে করে এগিয়ে এল। আমাকে জাগানোর জন্য চেষ্ট করল। লাভ হল না। আমাকে বেশি জাগাতে পারল না। বললাম, তুই দেখ, আমি তোকে জাগাই।

আমি দেবীকে আমার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে উচু করে ধরলাম।

বলল আমাকে ছাড়, তোদের পুকুর পাড়ের নারকেল গাছের মাথা দেখেছি।



আমরা প্রায় চকের মাঝখানে চলে এসেছি। এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। কয়েকটা পাট গাছ ভেঙে পাটখড়ি বের করে হাত নিলাম। আমি আর দেবী বাড়ি'র দিকে হাটছিলাম। হাতের পাটখড়ি দিয়ে সামনে ক্ষেতের আইলে, বাড়ি দিচ্ছিলাম, যাতে সাপ-টাপ পাড়া না পরে। হাটছিলাম আর একটু পর পর একটা দু'টো করে পাট ভেঙে আইলের উপর ফেলে রাখছিলাম। যাতে একই পথে আবার ফিরে না আসি।

কিছুক্ষণ পরেই, বাড়ির কাছাকাছি চলে এলাম। নারকেল গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে।

হঠাৎ আমি দেবীকে বললাম,- তুই তো আমাকে ছুয়ে দিলি না। নে আমিই তোকে ছুয়ে দিলাম। বলেই ওর হাত'টা ধরলাম। আমার হাত থেকে ওর হাত'টা ছাড়িয়ে নিয়ে, বলল- না তুই মুসলমান। পাপ হবে !

আমার মাথা স্থির হয়ে গেলাম। দেবী, পাপের কথা বলল কেন ? ওকে ছুয়ে দিলে পাপ হবে কেন? একটু পরেই, যা মনে এল, সেটা ভেবে আমার বুকের শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেল। বুক ধড়ফড় করছে।

আমি ওর হাত'টা আবার ধরে বললাম, আমি হিন্দু হয়ে যাব।

ও বলল, আজকে না। আজকে অনেক রাত হইছে।তুই বাড়িতে যা। তোর আম্মা মারবে।

বলেই এক দৌড়ে ওদের বাড়ি'র দিকে চলে গেল।





দেবী'র সাথে সেদিনের পর আর আমার দেখা হয়নি। আমি এর দুই/তিন দিন পর ঢাকায় চলে আসি।ক্লাস এইটের পরীক্ষা শেষ। মামা বাড়িতে বেড়াতে। ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে শুনলাম, দেবী'র বিয়ে হয়ে গেছে। বরের বাড়ি কলকাতা। দেবীকেও নিয়ে গেছে।

৪৬ টি +৮/-০