নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মামুন মোহাম্মদ

মামুন মোহাম্মদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

লাল মিয়া

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:২৬

জারিয়ার ট্রেনে করে গৌরীপুর থেকে মাইমেনসিং যাচ্ছি আমি। এডমিশন কোচিং করি তখন। এই ট্রেন গুলোতে কি পরিমাণ যে ভিড় হয়ে থাকে সেটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যদি কারো না থাকে তো তাকে লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। আপাতত তাই এ নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে লাভ নেই। ট্রেনের দরজার হাতল ধরে বাইরে প্রকৃতি দেখছি আমি। আমার মিটার খানেক দুরে বছর বারোর এক বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার হাতটা যে ক্রমশ সামনের দিকে বড় হয়ে যাচ্ছে তাই বড় বড় চোখে দেখছিলাম আমি। ভয় পাবেন না- ভুত প্রেতের কাহিনী শোনাচ্ছি না। ছোট হাত খানা খটাশ করে ডুকে গেল একটা প্যান্টের পকেটে। কিছুক্ষন পরে পাকা হাতের মতই বেরিয়ে এল এক খানা মানিব্যাগ সহ। আমার চোখ জুড়ে তখন সীমাহীন আশ্চর্য। যাই হোক সম্মোহন কেটে যেতেই তড়িৎ গতিতে বাচ্চার হাত খানায় আমার বজ্র কঠিন থাবা বসালাম। কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আমার দিকে টেনে আনলাম। আমি কিছু বলার আগেই আমার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে হাউ মাউ করে কেদে ওঠল। পরিস্থিতি যে এই পর্যায়ে যাবে তা আমি ভাবি নি। বলাই বাহুল্য যে আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। দ্রুত ছেলেটাকে টেনে তুলে পাশে দাড় করালাম। আগ্রহী জনতা ব্যাপার খানা বুঝে ওঠার আগেই ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা যাকে বলে আর কি। যাই হোক লোক জন কিছু বুঝতে পারে নি কেউ।
বাচ্চাটির মুখ খানা পুড়া- কিছুটা লালচে মুখে কালো কালো হেমাটোমা ( জমাট রক্ত)। করুণা এমনিতেই এসে যায়। ছেলেটা ভীত চোখে আমার দিকে সজল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে- আমি তাকে নির্ভয় দেওয়ার মত করে বললাম-
বাবু, কি নাম তোমার?
বাবু নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। আমি আবার একটু জোরের সাথেই বললাম- বাবু কি নাম?
বাবু এইবার মনে হয় শুনতে পেল। মাথা ঝাকিয়ে বলল- কোন নাম নাই। আপনের যা মোন চায় হেইডা কইয়া ডাইকতে পারেন।
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম- তাইলে তোমারে লাল মিয়া কইয়া ডাইকবো নে...
লাল মিয়া রসিকতায় যোগ দিল না দেখে- আমি বেশ গম্ভীরভাবে বললাম- লাল মিয়া থাক কোথায়? লাল মিয়া এইবারও নিরবে মাথা ঝাকাল যার অর্থ এই- কোন থাকার জায়গা নেই, অথবা থাকলেও বলব না। দুটোই হতে পারে। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার বললাম- এই বারও লাল মিয়া মাথা ঝাকাল। পরে আস্তে করে বলল- থাকনের জায়গা ইস্টিশন। ইস্টিশনেই খাই, ধাই , ঘুমাই , আগি ( হাগু)...
আমি এই বার আসল ব্যাপারে তলব করলাম- চুরি কর কেন? ধরা পড়লে তো তোমারে খুজে পাওয়া যাবে না। লাল মিয়া বেশ কড়া সুরেই বলল- চুরি না করলে খাওন দিব কেডায়? কেউ কামে নিতে চায় না। বেগোড় কাডাইয়া টেহা কম দেয়। হেইর লাইজ্ঞা চুরি করি। অবস্থা আচ করতে পেরে আমি অন্যদিকে মোর নিলাম- তোমার বাবা-মা কি করে? ওরা তোমাকে কি খাওয়ায় না? লাল মিয়া ঈশৎ বিরক্ত হয়ে বলল- আপনে বেশী কথা কইন। আমার বাপ মায় কেউ নাই। আমি এলহা (একলা)। আমি বললাম- লাল মিয়া কি ইস্কুলে যাও না। এইবার লাল মিয়া ফিক করে হেসে দিল। তার হলুদ দাত জোড়া থেকে বেশ কড়া রকমের দুর্গন্ধই আসল। যাই হোক সহ্য করলাম। আপনে যে কি মজার কথা কইতারোইন... হে হে হে... আমি অবস্থা আরো কিছুটা আচ করলাম। লাল মিয়ার হাতে একশ টাকার একটা নোট গুজে দিয়ে বললাম- আমার কাছে পড়বা। লাল মিয়া আমার দিকে বাকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিশ্বাস টা পাকাপোক্ত করে নিতে চাইল। আমি তাকে বিশ্বাস টা বাড়ানোর জন্য মুচকি হাসলাম। যাই হোক ট্রিকটা কাজে লেগেছে। লাল মিয়া পড়তে রাজী হয়েছে। জারিয়ার ট্রেন প্রতিদিন দশটায় মাইমেনসিং এসে পৌছায়, আমার ক্লাশ সাড়ে এগারোটায়। প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে লাল মিয়া পড়তে রাজী হয়েছে। বিনিময়ে সে পাবে ৫০ টাকা করে।

লাল মিয়া রোজ পড়ছে। তার স্মৃতি শক্তি খুবই ভাল। আমার বিশ্বাস সে আগে কোথাও পড়েছে যদিও আমার কাছে স্বীকার করছে না। ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক ক্রমশ উন্নতি হচ্ছিল। লাল মিয়ার এক গার্ল ফ্রেন্ড আছে। গার্ল ফ্রেন্ড এর সাথেও এক দিন কথা বলেছি। কিন্তু গার্ল ফ্রেন্ড দেখতে মোটেই ভাল নয়, চুল খুবই জট পাকানো, দাত সব কটাই হলুদ, মুখে খুবই দুর্গন্ধ। আমার পছন্দ হয় নি। যাই হোক লাল মিয়াকে আমার অপছন্দের কথা বলায় সে খুবই রাগ করেছে। অনেক কষ্টে তাকে কনভাইন্স করতে হয়েছে। দুদিন পর থেকে লাল মিয়া আর টাকা নেয় না। আমাকে এক মতন ভালবেসে ফেলেছে সে। আমাদের সম্পর্ক আরো অনেক উন্নতি হচ্ছে দিন দিন। যাই হোক মাস তিনেক লাল মিয়াকে রেগুলার পড়িয়েছি। এর মাঝে অনেক আগ্রহী শ্রোতা মজা দেখার লোভে ভিড় করেছে, অনেকে বেশ মজাও পেয়েছে, কিছু আগ্রহী কুলি মজুর বেশ আনন্দের খোরাকও পেয়েছে। মাস তিনেক পরে একদিন আকস্মিক ভাবেই লাল মিয়া উধাও হয়ে গেল। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুজেও তার কোন পাত্তা পেলাম না। দু তিন দিন খুজে শেষে হতাশ হয়ে আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের পড়াশুনার দিকে মনোযোগ দিলাম। এমনি করেই আরো মাস তিনেক কেটে গেল। আমার পরীক্ষাও এসে গেল। লাল মিয়ার আর কোন খুজ পেলাম না।

আমার কোচিং এর ক্লাশগুলো শেষের দিকে। গৌরীপুর স্টেশনে জারিয়ার ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। পেছন থেকে কে যেন ভাইজান বলে ডাকল। পেছন ফিরে দেখি হাসি হাসি মুখে লাল মিয়া। পড়নে লাল জামা। নতুন কিনেছে। লালে লালে একাকার লাল মিয়া। আমি আর হাসি আটকাতে পারলাম না। লাল মিয়ার হাতে একটা শপিং ব্যাগ। হাসি মুখে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল- ভাইজান, আইপনের লাইজ্ঞা কিনসি। আপনে না করলে আমি খুব কষ্ট পাইয়াম। এই কয়দিন আপনেরা না বইলা চইলা যাওনের লেইজ্ঞা সোরি... লাল মিয়ার কথার ধরনে আমি আর না হেসে পারলাম না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাগটা হাতে নিলাম। চোখের জলের উপর কারো শক্তি চলে না। আমারও চলে না। না চাইলেও দু ফোটা ঝড়ে যায়। এত টুকু ভালবাসা মিশ্রিত কথা আমি ফেমিলির বাইরে কারো কাছে কখনোই আশা করি নি। যাই হোক- লাল মিয়াকে ধমকের সুরে বললাম- টাকা কই পেলি লাল মিয়া? লাল মিয়া তার বিখ্যাত দাত বের করা হাসি দিয়ে বলল- কাম করছি ভাইজান। এই দেহেন , হাত দেহেন। আমি লাল মিয়ার হাত দেখলাম। সত্যিই হাতে ব্লিস্টারিং ছিল (blister)। আমি লাল মিয়াকে দক্ষিন বাহুর কাছে টেনে এনে বললাম-লাল মিয়া-চল পড়া শুনা করি। অনেক পড়া বাকি আছে। লাল মিয়া বলল- ভাইজান আপনে গাড়িতে ওডেন- আমি আমড়া নিয়া আইগা। বরিশাইল্লা আমড়া !!! আমি বাধা দিতে চাইলাম। কিন্তু লাল মিয়া আর কোন কথা শুনল না। আমি গাড়িতে ওঠে দাঁড়িয়ে রইলাম। লাল মিয়া আমড়ার দোকানের সামনে। গাড়িতে তখন হর্ন বাজাল। আমি সজোড়ে ডাকলাম- লাল মিয়া, গাড়ি ছেড়ে দিবে। লাল মিয়া হাসল। ছাড়ব না বাইজান। আপনে অপিক্ষা করেন। গাড়ি ততক্ষনে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল। লাল মিয়া আমড়া নিয়ে দৌড়াল। গাড়ীর স্পিড বাড়াচ্ছিল। এমন অনেক হয়। আমিও এমন কত দৌড়ে গাড়িতে ওঠেছি। লাল মিয়া দৌড়াচ্ছে। এখনও কিছুটা দুরে, লাল মিয়া জোড়ে দৌড়ে দৌড়ে আসছে। এসে গেল, এসে গেল......... আরেকটু... আমি হাত বাড়ালাম। লাল মিয়া ডান পা টা ট্রেনের সিড়ির দিকে বাড়াল। না টিক জায়গায় পা পড়ে নি- ফসকে গেল। আমার এক হাত- লাল মিয়ার ভার নিতে পারে নি। একটা মৃদু আর্তনাদ ভেসে আসল আমার কানে। ছোট একটা শরীর দলা পাকিয়ে নিচে পড়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম কি ঘটতে চলেছে। তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে পড়লাম নিচে। আমার নিজের শরীরের দিকে তখন আর খেয়াল নেই আমার। একটা লালে লালে একাকার ছোট্ট শরীর তখন গড়া গড়ি খাচ্ছে রেল লাইনের উপর। চার পাশ লালে লাল হয়ে গেছে। আমি দ্বিগিধিকশুন্য হয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম রেল লাইনের উপরে। ততক্ষণে সব কিছুই শেষ হয়ে গেছে। আমি লাল মিয়ার লাল শার্ট খানা জড়িয়ে জ্ঞান শুন্য হলাম।

আজ অনেক দিন হল- লাল মিয়াকে স্টেশনে হাড়িয়েছি আমি। লাল মিয়ার সেই অকৃত্রিম ভালবাসা আজো তাড়া করে আমাকে। ইউনিভার্সিটি ফেরার পথে স্টেশনে কত সময় আমি কাটিয়েছি- লাল মিয়াকে আর পাই নি। দুর আকাশে প্রতিদিন সকাল-বিকাল লাল মিয়া আকাশের প্রান্তে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হলুদ দাতের হাসিতে তাকিয়ে থাকে। আমিও লাল মিয়াকে সঙ্গ দিই। অংক শিখাই তাকে। জীবনের কঠিন সমীকরণের অঙ্ক..................

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.