নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রকৃতির কথা

মানিক সরেন

প্রকৃতিকে ভালো লাগে। নিজেকেও একজন প্রকৃতি পূজারী মনে করি।

মানিক সরেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাওয়া সেরমা পরব

২১ শে এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৩:১৬

সুদীর্ঘ অতীত থেকে এ দেশের আদিবাসীরা তাদের রীতি-নীতি অনুযায়ী পুরনো বছরকে বিদায় জানায় এবং নতুন বছরকে বরণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তুলনায় সমতলে বসবাসরত আদিবাসীরা নৃতাত্ত্বিক জাতি সংখ্যা ও পরিমাণে বেশি থাকলেও তাদের জীবনাচরণ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয় পাহাড়ি আদিবাসীদের মতো আলোচনায় আসতে পারেনি। যা-ই হোক, আজকের এ লেখায় সমতলের সাঁওতাল জাতির বর্ষবরণ উৎসব বিষয়টাই আলোচনার মূল বিষয়। প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জাতিগোষ্ঠীর এ মানুষেরা নিজেদের ভেতর ‘হড়’ নামে পরিচিত হলেও বাইরের লোকজন তাদের সাঁওতাল, সান্তাল, সান্থাল, সান্তাড়, সাঁতাড়, সাঁওতাড় ইত্যাদি নামেই চেনে। এখানে সাঁওতালি হড় শব্দের অর্থ মানুষ। সাঁওতালি ভাষায় ‘হড়দের নাওয়া সেরমা পরব’ মানে ‘সাঁওতালদের বর্ষবরণ উৎসব’ বোঝায়। নাওয়া মানে নতুন। আর এখানে সেরমার অর্থ বোঝাচ্ছে বছর এবং পরব অর্থ হচ্ছে উৎসব।
সাঁওতালি ভাষায় মাস বলতে বঙ্গা, চান্দো শব্দ ব্যবহার করা হয়। বাংলা মাসের সঙ্গে সাঁওতালদের এ মাসগুলোর নামেরও অনেক মিল। সাঁওতালি ভাষায় বারো মাসের নাম হচ্ছে: ফৗগুন (ফাল্গুন), চৗত (চৈত্র), বৗইশৗখ (বৈশাখ), ঝেট (জ্যৈষ্ঠ), আষাঢ় (আষাঢ়), শান (শ্রাবণ), ভাদর (ভাদ্র), দাঁশায় (আশ্বিন), কৗর্তিক (কার্তিক), আঘন (অগ্রহায়ণ), পুষ (পৌষ) ও মাগ (মাঘ)। মাসের নামে মিল থাকলেও বাংলায় ষড় ঋতুর সঙ্গে সাঁওতালদের গণনাকৃত ঋতুচক্রের মিল নেই। সাঁওতালরা মূলত চারটি ঋতু গণনা করে। সেগুলো হলো: সিতুং (গ্রীষ্মকাল), জৗপুত (বর্ষাকাল), নীরন (শরত্কাল) ও রাবাং (শীতকাল)।

ফাল্গুন মাস থেকে সাঁওতালরা বছর গণনা শুরু করে। অর্থাৎ ফাল্গুন মাসকে বছর শুরুর মাস হিসেবে ধরা হয়। তবে অন্য সবার মতো সাঁওতালদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসবের মধ্যে পার্থক্য আছে। বেশির ভাগেই দেখা যায়, বছরের প্রথম দিনই নববর্ষ পালনের উৎসব পালন করে থাকে। কিন্তু সাঁওতালরা মাসজুড়ে বা নিজেদের মতো করে দিন-তারিখ ঠিক করে নতুন বছরকে বরণ করে। সাঁওতালদের বছর গণনার হিসাব অনুযায়ী প্রথম মাসে অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে বাহা পরব পালিত হয়। আর এ বাহা পরবই হচ্ছে সাঁওতালদের বর্ষবরণের উৎসব।

কলেয়ান গুরু বাহা পরব সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাহা হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় বৃহৎ উৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব পালন করা হয়। শাল গাছে তখন ফুল ফোটে, ইচৗক আর মুরুপ্ ফুল ফোটে এবং মহুয়া গাছে ফুল ধরতে শুরু করে। বাহা উৎসব পালন না করা পর্যন্ত আমরা ইচৗক আর মুরুপ্ ফুলের মধু খাই না, শাল ফুল মাথায় দিই না। আর মহুয়া ফুলও খাই না। যারা খায় তাদের বাড়িতে নায়কে (পুরোহিত) বাহা উৎসব না হওয়া পর্যন্ত প্রবেশও করে না, তাদের দেয়া কোনো খাবার গ্রহণও করে না। বাহা হচ্ছে আমাদের ধর্মীয় উৎসব।’

প্রখ্যাত সাঁওতাল লেখক ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে লিখেছেন, ‘মাঘ মাস শেষ হলেই আমাদের বছর শেষ হয়। রাখাল, বাড়ির কাজের লোক, নাপিত, মুচিদের বছরের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হয়। গ্রামপ্রধানসহ গ্রাম পরিচালনাকারী অন্য ব্যক্তিরা নতুন করে নির্বাচিত হন। গাছে নতুন পাতা আসে, নতুন পাতা-ফুলের গন্ধে মন ভরে ওঠে। জঙ্গলে শাল গাছের ফুলের গন্ধে চারপাশের বাতাস মোহিত হয়ে ওঠে। বোঝা যায় যে, দিন বদল হচ্ছে, বাতাস বদল হচ্ছে।’

বাহা পরব মূলত দুই দিনব্যাপি হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও তিন-চার দিনব্যাপীও চলতে থাকে এ পরব। বাহা পরবের প্রথম দিনকে উম ও দ্বিতীয় দিনকে বাহা সৗরদি দিন বলা হয়। বাহা পরবের জন্য নির্দিষ্ট পূজার স্থানকে জাহের থান বলে। এটি সাধারণত গ্রামের সবচেয়ে পবিত্র ও শান্ত জায়গায় হয়ে থাকে। সেখানে তিনটি ছোট ছোট খড়ের ঘর দিয়ে জাহের থান তৈরি হয়। গ্রামের নাইকে অর্থাৎ পুরোহিত পরিষ্কার ধুতি পরে পূজা স্থানে যায়। নাইকের হাতে কাঁসার থালায় সিঁদুর, কলা, ধূপ আর নতুন নতুন ফুল থাকে। গোবর দিয়ে নাইকে জাহের থান লেপন দিয়ে পরিষ্কার করে। তার পর সেখানে নাইকে পূজা করে গ্রামে ফিরে আসে।

পূজা থেকে ফিরে গ্রামের ছেলেরা শিকারে যায়। তারা সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে। তার পর সবাই মিলে নাইকের বাড়িতে জমায়েত হয়। সেখানে নাচে-গানে সবাই মেতে ওঠে। এ সময় সাঁওতাল তিন দেবতা জাহের এঁরা (গ্রামের দেবী), মারাঙবুরু (সাঁওতালদের প্রধান দেবতা), পারগানা বঙ্গা (এলাকার দেবতা) তিন যুবকের ওপর ভর করে। জাহের এঁরা পুরোহিতের কাছে সাকম (হাতের বালা) দাবি করে। মারাঙবুরু তীর-ধনুক দাবি করে। পারগানা বঙ্গা ডালি ও ঝাড়ু দাবি করে। এর পর সবাই মিলে পূজা স্থানে যায়। পারগানা বঙ্গা জাহের থানের চারপাশ ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে। জাহের এঁরা খড়ের তিনটি ঘরে লেপন দিয়ে দেয়। মারাঙবুরু তীর-ধনুক হাতে নিয়ে পাহারা দিতে থাকে। এ সময় গ্রামের সবাই মিলে গান ধরে—

‘অকয় মায় চিয়ালেৎ হো বির দিসম দ
অকয় মায় দহলেৎ আতোরে পাঁয়ড়ি
মারাং বুরুয় চিয়ালেৎ হো বির দিসম দ
জাহের এঁরায় দহলেৎ আতোরে পাঁয়ড়ি।’

(জঙ্গলময় এ দেশ হো কে আবিষ্কার করেছিল, গ্রাম তৈরি করে বসতি কে স্থাপন করেছিল, মারাঙবুরু এ জঙ্গলময় দেশ আবিষ্কার করেছিল, জাহের এঁরা গ্রাম তৈরি করে বসতি গড়েছিল)

এভাবে গান ও নাচ চলতে থাকে। একপর্যায়ে মৗঞ্জহি হাড়াম (গ্রামপ্রধান) তিন দেবতাকে গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা নিবেদন করে। রোগ-শোক যেন না হয়, বৃষ্টি-বাদল যেন ভালো হয়, ফসল যেন ভালো হয় এবং সবাই যেন সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে, তা গ্রামপ্রধান তিন দেবতার কাছে আরজি জানান। এর পর নাচে-গানে মেতে ওঠে সাঁওতালরা। এর মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো হয় তিন দেবতাকে। গাছে গাছে নতুন নতুন ফুল ফোটার গান ও সেই সঙ্গে নাচ চলতেই থাকে।

বাহা বঙ্গা পিরিল পিরিল চান্দোয় মোলোঃএন,
বাহা জ-তে পুরুই পুরুই দিশৗম পুলুঃএন;
হালায় হালায় বাহাএনা সৗরি সারজম,
দারে পেরেচ গ্যেলেএনা খোদে মাতকম।

(ফুলের দেবী উঠল চাঁদ উঠল, ফুলে ফুলে দেশ ভরে উঠল, থোকা থোকা শাল ফুল ফুটল, মহুয়ার ফুলে গাছ ভরে উঠল)

বাহা উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে নববর্ষকে পালনের এ রীতির পাশাপাশি বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চৈত্রসংক্রান্তিতে বাংলা বর্ষবিদায় উৎসবে সাঁওতালরা পাতা উৎসব পালন করে থাকে। এটাকে অৗচুর পাতাও বলে। ‘অৗচুর’ শব্দের বাংলা আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ঘোরানো। চৈত্রসংক্রান্তিতে যে চড়ক পূজা হয়, এটি আসলে সেই উৎসব। কিন্তু পাতা উৎসবকে অনেকেই মনে করেন, এটি হিন্দুদের পূজা বা উৎসব। আদতে পাতা পূজা বা চড়ক পূজা হচ্ছে অনার্যদের পূজা। পাতা পূজার মতো সাঁওতালসহ অন্যান্য অনার্য জাতির অনেক পূজা, পার্বণ, রীতি-নীতিকে আর্য সভ্যতা নিজের করে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আদিবাসী জ্ঞান যেভাবে আত্মসাৎ হয়েছে, সেভাবে আদিবাসীদের ধর্ম, সংস্কৃতিও চুরি হয়েছে বা দখলে নেয়া হয়েছে। কালী ও শিবের মতো অনার্য দেব-দেবীরাও আজ আর্য দেব-দেবীতে পরিণত হয়েছে। আজ আদিবাসীদের ইতিহাস-সংস্কৃতিকেও বিকৃতভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে।

সাঁওতালদের সব উৎসবের সঙ্গে প্রকৃতির ঋতুচক্র ও ফসল উৎপাদনের খুবই নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ফলে সাঁওতালদের বিভিন্ন উৎসব থেকে প্রকৃতির কোন সম্পদ কখন ব্যবহার করতে হবে, সেটি ব্যবহারের এক ধরনের নির্দেশনা পাওয়া যায়। এর মধ্য দিয়ে সময়সূচিভিত্তিক সম্পদ ব্যবহারের ফলে প্রকৃতি নিজের ঘাটতিগুলো পূরণ করার সময় পায়। এটা আমাদের আজকের আধুনিক বিজ্ঞান না বুঝলেও সাঁওতালদের বিজ্ঞান সেটি বোঝে। আর তাই এখনো তারা প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে।

বাহা পরবের সময় অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে যখন প্রকৃতিতে নতুন নতুন ফুল ফল পাতা আসে, সেই সময়কে সাঁওতালরা মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালের সঙ্গে তুলনা করে। সাঁওতালি ভাষায় মেয়েদের এ বয়ঃসিন্ধকালীন সময়কে ‘বাহাঃ কানায়’ বলে। এর আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ফুল ফুটছে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্য দিয়ে নতুন জীবনী শক্তি সঞ্চারের বিষয়টিই বোঝানো হয়। নারীরা বয়ঃসন্ধিকাল পার করে নতুন জীবনী শক্তি সৃষ্টির অধিকারী হয়, তেমনি ফাল্গুন মাসে পৃথিবীটাও নারীদের মতো বয়ঃসন্ধিকালীন সময় পার করে। নতুনভাবে প্রকৃতিতে জীবনী সঞ্চার করে। তাই তো সাঁওতালরা এ সময় বাহা পূজার আগে নতুন ফুল খোঁপায় দেয় না, নতুন ফল খায় না। কিন্তু আজকের এ আধুনিক পৃথিবীতে আমরা শুধু ভোগ-বিলাসিতার জীবনযাপনের জন্য পৃথিবীর সম্পদ কোনো হিসাব ছাড়াই আহরণ ও ব্যবহার করছি। আমাদের পৃথিবীকে তার সম্পদের ঘাটতি পূরণেরও সময় দিচ্ছি না। এভাবেই হয়তো আমাদের এ সুন্দর পৃথিবী একদিন তার যৌবন হারাবে, বন্ধ হবে তার ঋতুচক্র, শেষ হয়ে যাবে পৃথিবীর সব সম্পদ।

বাংলাদেশের আদিবাসীদের সংস্কৃতিচর্চার জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০ প্রণীত হয়েছে। কিন্তু শুধু আইন দিয়েই আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করা যাবে না। এর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিরও প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতিসত্তার মানুষদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাদের আত্মপরিচয়ের অধিকার, মানবাধিকার, বন-জঙ্গল-জলাধারের অধিকারও বাস্তবায়ন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধকরণ, বিভিন্ন উৎসব ইত্যাদিতে আদিবাসীদের যেমন অবদান রয়েছে, তেমনি সুন্দর বাসযোগ্যময় বাংলাদেশ গড়ার পেছনে আদিবাসীরাও তাদের অবদান রেখে যাবে। সাঁওতালসহ আদিবাসীদের সংস্কৃতি এ দেশের সম্পদ। তাই এ সম্পদকে রক্ষা করা জরুরি। সরকারিভাবেই আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৩:২১

চাঁদগাজী বলেছেন:



সুন্দর পোস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.