নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
I am a house wife, I love to write something
বাজারে ঢুকতেই এক ঝাঁক কিশোর কিশোরী এসে রাজশ্রীকে ধরলো। ্আামাকে নেন খালাম্মা আমাকে নেন, খালাম্মা আপনার গাড়ীতে বাজার তুলে দেবো, আমাকে ৫ টাকা দিলেই হবে---- ইত্যাদি ইত্যাদি। এ দৃশ্য আজ নতুন নয়, সেই ৮৮ সাল থেকে ঢাকায় বাজার করতে এ দৃশ্য দেখে আসছে রাজশ্রী । তবে ইদানিং এদের সংখ্যা বেড়েছে। ওদের গলায় আবার পরিচয় পত্রও ঝুলানো থাকে । অর্থাৎ ওরা পরিচিত মিন্তি।
প্রথম দিকে বাজারে যেয়ে ওদেরকে মোটেও পাত্তা দিতো না। এখন প্রায়ই ওদের দিয়ে বাজার বহণ করায়। এতে কিছু সুবিধে হয়। বয়স বাড়ায় কিছুটা হলেও শ্রম কমে, ওদেরকে কিছু সাহায্য করা হয়, সর্বোপরি মর্যাদা বজায় থাকে। মিন্তি লাধগবে না বলে সে কিছুটা এগিয়ে গেল। তারপরেই মনে হলো,সে তো বেশী বাজার নিতে পারবে না । মাত্র ৫ টাকায় বাজারটা নিয়ে গেলে ভালই হয়। চিন্তা করতে করতে তাকিয়ে দেখে পাশেই একটা মিন্তি দাঁড়িয়ে। দেরী না করেই তার মাথার ঝুড়িতে বাজারের থলিটা রাখলো। ছেলেটি বুঝে নিল কিছুটা সময়ের জন্য সে নিয়োগ পেল। সে খুশী মনে ঝুড়িতে বাজার তুলতে লাগলো ।
মিন্তি পেয়ে রাজশ্রী একটু বেশী বাজার করলো আজকে। ছেলেটা মথায় ঝুড়ীটা নিয়ে হাঁটছে। সেই প্রথম বলে উঠে, খালাম্মা আপনার গাড়ী কোথায় ? রাজশ্রী হাসতে হাসতে বললো, আমরা গরীব মানুষরে, আমাদের গাড়ী নেই। ও বিশ্বাস করলো না। বললো মিছা কথা কইতাছেন আপা, আপনারা বড়লোক মানূষ, গাড়ী থাকবে না কেন? রাজশ্রী বললো, নারে আমরা গরীব মানুষ। ছেলেটি আবার বলে, আপনারা কি টিনের ঘরে থাকেন? না আমরা দালানে থাকি। তবে যে বললেন, গরীব মানুষ। গরীব মানুষ বুঝি টিনের ঘরে থাকে না? ওর বিশ্ব্াস বড়লোকরা সবসময় দালানে থাকে। রাজশ্রী ওর বিশ্বাসকে ভাংলো না।
ওকে ১০টা টাকা দিল খুশী হয়ে। ১০ টাকা পেয়ে ও ভীষণ খুশী। ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো আপা আপনি আবার কবে আসবেন? বাজার শেষ হবে তবে তো আসবো। এলে কিন্তু আমাকে নেবেন। বড় যতœ করে রিক্সায় বাজার তুলে দিয়ে চলে গেল আবার নতুন ক্রেতার আশায়।
বাড়ীতে এসে রাজশ্রী ভাবতে লাগলো ছেলেটির কথা। কি যেন নাম ছেলেটির। তার মনে হলো তিনি তো তার নাম শোনেনি। ওদের নাম তো কেউ শোনে না। সবাই ওদের পিচ্চি বলেই ডাকে। সেও মনে মনে তাকে পিচ্চি বলেই সম্বোধন করলো ।
আজ ছুটির দিন থাকায় সকলের খাওয়া শেষে রাজশ্রী রবি ঠাকুরের গল্প গুচ্ছ নিয়ে বসলো। ছুটি গল্পে চোখ রাখতেই হঠাৎ করে পিচ্চির কথা মনে হলো ও কি এখনও বাজারে মাথায় বাজার গাড়ীতে তুলে দিচ্ছে? অলস দুপুরে ওর কথা মনে পড়ায় তার মনটা বড় বিষন্ন হয়ে গেল। সে গেল শোবার ঘরে। দেখে জয়ন্ত অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কিছু না বলে সে ফিরে এলো বারন্দায় রাখা গাছের মধ্যে। ফিরে গেলো ছোট বেলায়। মনে পড়ে গেল অলস দুপুরে ধানকল থেকে মাথায় করে ধান ভাংগিয়ে আনার কথা। সেদিন আর পড়া হলো না । ভাবলো একটা কবিতা লেখবে। তাও হলো না। পুরাতন স্মৃতি উকি মেরে মনটাকে বড় এলোমেলো করে তুললো।
সপ্তাখানেক পরের কথা। বিকালে চায়ের আয়োজনে বসে জয়ন্তকে বললো আগামীকাল সে মাছ কিনতে বাজারে যাবে। টাকা দিয়ে যেতে। গত সপ্তায় বাজার আনলে যে, অবাক দৃষ্টিতে জয়ন্ত তাকালো । এ সপ্তাহ চলবে। কিন্তু আগামী সপ্তায় বাজারে যেতে পারবো না। ঘরের কিছু টুকিটাকি কাজ আছে। জয়ন্ত বললো বেশ যাও। রাজশ্রী টাকা নিয়ে রাখলো।
সকালে জলখাবার খাওয়া শেষ হলে রাজশ্রী বাজারের দিকে রওনা হয়। মনে মনে খুঁজতে থাকে সেই ছেলেটিকে। বাজারে ঢুকতেই একই দৃশ্য। তার মনটা কিস্তু খুঁজে চলেছে সেই নাম না জানা ছেলেটিকে। অনেক ভীরের মাঝে ওর মুখটা জ্বল জ্বল করে উঠলো। সে হাত তুলে ওকে তার সম্মতি জানালো। ছেলেটিও বুঝলো আজকে মিন্তি হিসেবে ম্যাডাম তাকেই নেবে।
পিছনে হেঁটে ছেলেটি বাজার ঝুড়িতে নিচ্ছে। রাজশ্রী ওর নাম জিজ্ঞেস করলো। ছেলেটি হেসে উত্তর দিল মায় ডাকতো যাদু টোনা বাপে ডাকতো সোলেমান। এখন তো আর কেউ নেই। বস্তির লোকে পাখী বলে ডাকে। বাপ মারা গেলে মা রিক্স্য়ালার সাথে ভেগে গেছে। একটা বোন ছিল, সে খালার বড়িীতে। অন্যের বাসায় কাজ করে। মাছ কিনতে কিনতে ওর সরল কথাগুলো শুনতে থাকে। তুই তবে একা থাকিস। হ। বস্তিতে থাকি। খুব মায়া হলো। ছেলেটির জন্যে। সে বলে ফেললো আমার সাথে যাবি? থাকতে পারবি, লেখা পড়া করবি---- আরও কত কি। কথা না বলে পাখী তখনই রাজী হয়ে গেল। আর বাজার করা হলে না। তাড়াতাড়ি পাখীকে নিয়ে রিক্সায় উঠে পড়লো, দেরী হলে যদি ওর মনের পরিবর্তন হয়ে যায়।
বাসায় সবাই রাজশ্রীর উপর রাগারাগি করতে লাগলো। রাত থেকে জয়ন্ত এ বিষয়ে কোন কথা বলেনি। হয়তো ব্যস্ত ছিল অথবা কিছু মনে করেনি। সকালে উঠে নিয়মিত সে বারন্দায় যায়। সেখানে একটু হাঁটা হাঁটি করে গাছে জল দিল। সেখানে পাখীর সংগে জয়ন্তর কথা হয়। নাম কিরে তোর? চটপট উত্তর--পাখী । কেমন যেন তার কাজে বাধা পড়লো । সকাল বেলা বাগানে পাখী , বেশতো দিনটি ভালোই্ । এমন সময় গাছের চড়–ই পাখীগুলো কিচিরমিচির শব্দে উড়ে গেল ।
অফিসে বের হরার আগে তার কাজের টেবিলে একটা তলিকা পেল। তাতে লেখা আছে: পাখীর জন্যে আনতে হবে: ১. জামা. ২. হাফ প্যান্ট ৩. ফুল প্যান্ট ৪. জাংগিয়া ৫. গেজ্ঞি ৯. স্লিপার. ৭. জুতা, ৮. ব্রাশ, ৯. টুথ পেস্ট, ১০.চিরুনি। -- ইত্যাদি। জয়ন্ত বাজার করে আর ভাবে, রাজশ্রীর এসব বিষয়ে একটুু বাড়াবাড়ি আছে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। কারণ রাজশ্রীর বড় হবার পিছনে আছে এরকম কিছু মহামানবের সাহায্য। যা না হলে আজকের এ পজিশনে সে আসতে পারতো না। এই যে, মেয়েদের বিদেশে রেখে পড়ানো, নিজে ভাল চাকরী করা, স্বচ্ছল ছেলের সাথে বিয়ে সবই সম্ভব হয়েছে কিছু নি:স্বার্থ সাহচর্যে। জয়ন্ত এ সবই রাজশ্রীর মুখে শুনেছে। সেও চেষ্টা করে পরোক্ষভাবে কিছু -- পরিশোধ করতে পারে। এইতো সে দিনও রাজশ্রী কত কথা শুনলো মিসেস বোসের কাছে।
একটা অসহায় ছেলেকে সাহায্য করার জন্যে সে মিসেস বোসের বাসায় দিয়েছিল, তার ছেলেকে পড়ানোর জন্যে। কিন্ত ফল হলো তার উল্টো। ছেলেটি মনে হয় , ভারত সরকারের বৃত্তির জন্য আবেদন করতে ব্যস্ত থাকায়, কয়েকদিন মিসেস বোসের ছেলেকে পড়াতে যেতে পারে নি। এ জন্য বকাটা খেতে হয়েছে রাজশ্রীকেই। যা হোক তার পরেও রাজশ্রীর অন্যের উপকার করার মানসিকতা ক্ষুন্ন হয় নি। বিশেষ করে পড়াশোনায় ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দিতে তার জুড়ি মেলা ভার। এসব ভেবে ইচ্ছে না থাকলেও অনেক সময় জয়ন্তকে অনেক কিছু করতে হয়। যা হোক সে তালিকা অনুযায়ী সব কিছু নিয়েই বাসায় গেল।
বাসায় ফিরে দেখে রাজশ্রীর স্বভাব মতো পাখীকে পড়াতে বসানো হয়ে গেছে। কাউকে পেলেই রাজশ্রীর একটা নিয়মিত কাজ- দু, একদিন গেলেই বই কিনে দিয়ে তাকে পড়াতে বসানো। কত স্বপ্নও সে দেখে ফেলে তাকে নিয়ে, যেমন প্রাইভেট পড়ে সে নাসিং পড়বে অথবা টেকনিক্যাল কিছু শিখবে। আর এ জন্যই এ পর্যন্ত যতগুলো ছেলে বা মেয়েকে সে এই প্রকল্পের আওতায় এনেছে , সবগুলোই এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে বিদায় নিয়েছে।
কিছু দিনের মধ্যেই পাখী প্রাথমিক অক্ষর চিনে ফেললো । টিভি তে আকবরের গান দেখতে সে খুব পছন্দ করে। রাজশ্রী বললো তুই গান শিখবি ?আমার হারমোনিয়ম আছ্।ে আমার কাছে শুরু কর, পরে কোন গানের স্কুলে ভর্তি করে দেবো। এরই মধ্যে তার স্কুলে ভর্তির সব ঠিক হয়ে গেছে। নতুন বছর পড়লেই ভর্তি হবে। রাজশ্রী তাই সন্ধ্যায় নিয়মিত তাকে পড়াতে বসাচ্ছে।
কয়েকদিন হতে পাখীর মনটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। যখনই খোঁজা হয় দেখা যায় বারন্দায় গাছের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাজশ্রী ভাবে, ছোট মানুষ, হয়তো বাড়ীর কারও কথা মনে হয়েছ্ ে।
সে দিন শুক্রবার। রান্না করতে করতেই খাওয়ার টেবিল গোছানো হয়ে গেছে। স্নান সেরে এসেই সবাইকে খেতে দেবে। পাখী বাইরের ঘরে বসে আনন্দলোকে অমিতাভ বচ্চনের ছবি দেখছিল। খালা তখন ঘর মুছছে, গরম জল নিয়ে রাজশ্রী বাথরুমে ঢুকলো স্নান করতে। বেড়িয়ে গাছের ফ’ল তুলে পুজো সেরে বাইরে এসে দেখে পাখী নেই। রাজশ্রী ব্যাস্ত হয়ে পড়লো খুঁজতে, কিন্তু কোথাও নেই। জয়ন্ত বাসায় আসতেই শুনে সেও চিন্তিত হলো। দু,জনে ঘর চেক করে দেখে না কোন কিছুই সে নিয়ে যায়নি। তার জন্য কেনা নতুন কাপড় চোপড় সব আছে। চিন্তিত মনে খাওয়া সারলো তারা। পরে দু,জনে আলাপ করে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো যে ওরা হারায় না। রাজশ্রীর একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। সেটি হলো যখন সে এবং তার বোন ঢাকাতে এসে প্রথম একটা বাসা নিল্ । তখন একটা মেয়ে জানুকে বাড়ী থেকে নিয়ে এসেছিল, আজ থেকে ২০ বছর আগের কথা। জানুকে আনে বাড়ী থেকে রাত্রীকালীণ কোচে, এরপর প্রায় ৬ মাসের মধ্যে সে কথনও বাড়ীর বাইরে যায়নি। অথচ একদিন জানু বাসা হতে পালিয়ে গেল, এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেল সে ঠিকই বাড়ী পৌঁছেছে। এই কথা স্মরণ করে তারা কিছুটা আশ্বস্ত হলো, কিন্ত জানুর তো বাড়ীর ঠিকানা জানা ছিল। তাই শেষে খোঁজ জানা যায়। এর খোঁজ নেবেন কোথায়? বাড়ী ঘরের তো কোন ঠিকানা রাখা হয় নি । জয়ন্ত ভাবলো, রাজশ্রীর সরলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া তার নিজেরও ভুল হয়েছে। যা হোক ছেলেটি কোন বিপদে না পড়–ক। দ,ুজনে সকাল সন্ধ্যা কেবল এই প্রার্থনা করতে লাগলো ।
এই ঘটনার পর মাস দুয়েক রাজশ্রী বাজারে যায়নি। কিন্তু মেয়েদের ছুটিতে আসার সময় হয়ে গিয়েছে, মেয়েদের পছন্দের ইলিশ মাছ, চিংড়ী মাছ কিনতে সে নিজে জয়ন্তর সংগে বাজারে গেল। রিক্সা হতে নামতেই একটা ছেলে ঝুড়ি হাতে সালাম দিয়ে দাঁড়ালো। রাজশ্রী তাকিয়ে দেখে পাখী। জয়ন্ত দেখে সত্যিই তো এ যে পাখী, ও ভাবে চলে এলি কেন? সে বললো- প্রথমে ভেবেছিলাম বড় লোকের বাড়ীতে খেয়ে পড়ে ভালই থাকবো। ছিলামও তাই। কিন্তু মনে শান্তি পেলাম না। আপনার বাড়ী থাকার জন্যে মিছা বলছিলাম যে মা নেই। মা আছে। বাসা বাড়ীতে কাজ করে। সারাদিন কাজের পর মায়ের আনা বড়লোকের বাসার একজনের খাওয়া দু’জনে ভাগ করে খাওয়া, তারপরে মায়ের বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া এর চেয়ে সুখ যে ঐ দালানে ভাল খাওয়া আর টিভি দেখার মধ্যে নেই। তাই অনেক চিন্তা করে একদিন পালিয়ে এলাম। মা আমাকে পেয়ে যে বড্ড সুখ পেল। এখন আমি সুখেই আছি। কথা গুলো শুনতে শুনতে রাজশ্রী তার শৈশবে হারিয়ে গেল। কিশোরী বেলার ছবি তার চোখে ভেসে উঠলো। সারাদিন টিউশনি করে এসে মায়ের রান্না দুটো ডাল ভাত খেয়ে এক বিছানায় মা আর বোনদের সাথে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। প্রতি দিন সকালে নতুন করে বাঁচার আশা নিয়ে দিন শুরু করার কথা। ততক্ষণে পাখী চলে গেছে। পাশে জয়ন্তও নেই। ফোন দিতেই জয়ন্ত বললো সে তাদের দেশী লোকের মাছের দোকানে তাদের মেয়ের জন্য সবচেয়ে বড় ইলিশ মাছটা নেবে কিনা -তার সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করছে। রাজশ্রী ছুটে গেল তাদের সেই পরিচিত মাছের দোকানটায় । বললো মাছটা ছোট হয়ে গেল। বড় মাছ দেখলে টুনটুন বড্ড খুশী হবে।
©somewhere in net ltd.