নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
আফরিন এই নিয়ে তৃতীবার নিজের চোখের কাজল মুছলো। এখন তার রীতিমত কান্না পাচ্ছে। তার চোখ গুলো এত অসুন্দর কেন? গরুর চোখ বলে ভুল হয়। কাজল টেনেও কেন সেটাকে সুন্দর করা যায় না? সেই সাথে তার মুখের রংও কালো। বেশির ভাগ কালো মেয়েই নিজেদের "উজ্জ্বল শ্যামলা" পরিচয় দিয়ে নিজেদের মনকে মানিয়ে নেয়। কিন্তু আফরিন তো অন্ধ না। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের মুখ নিজের চোখেই দেখতে পায়। ড্রেসিং টেবিলের উপরেই ঘরের টিউব লাইট বসানো। ওটার আলো সরাসরি মুখেই পড়ে। তারপরও সে আলো তাকে ফর্সা দেখানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
আফরিন মুখে হালকা করে ফাউন্ডেশন দিচ্ছে। এতে তার ত্বকের রং খানিকটা ঢাকা পড়ার সম্ভাবনা আছে। তবে সেটাও খুব সাবধানে করতে হবে। মা দেখতে পেলে সহজেই বুঝে যাবেন যে তার এই সাজগোজ সিয়াম ভাইয়ার জন্য করা! সিয়াম ভাইয়া তাদের প্রতিবেশি, আর আফরিনের ছোট ভাই আদিলকে ঘরে এসে পড়ান। আফরিন তাকে ভালবাসে।
আফরিন ভিকারুন্নেসা স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশোনায় খুব ভাল না, আবার গাঁধা গর্ধবও না। তার পড়াশোনা নিয়ে তার মা বাবার চিন্তার অন্ত না থাকলেও এই নিয়ে তার নিজের কোন মাথা ব্যথা নেই। তাঁর সব চিন্তা তার রূপ নিয়ে। সে জানে, একটি মেয়ে, সে যত যোগ্যই হোক না কেন, দেশের সাংসদ মন্ত্রীও যদি হয়ে যায়, তার চেহারা সুন্দর না হলে লোকে তাকে পাত্তা দেয় না। তার কি আফশোস, তার গায়ের রংটা যদি আরেকটু ফর্সা হতো! এদেশে তো চিরদিনই মেয়ের গায়ের রংই তার রূপের শেষ কথা।
এই দিকে সিয়াম ভাইয়া কি সুন্দর দেখতে! লম্বা, ছিপছিপে শরীর। সে নটরডেম কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। যেমন পড়ালেখায় ভাল তেমনি খেলাধুলায়ও ওস্তাদ! বাসার সামনের এক চিলতে খোলা জায়গায় যখন সব ছেলেরা মিলে ক্রিকেট খেলে, আফরিন তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তার খেলাই দেখে। এছাড়া সিয়াম ভাইয়ার গানের গলাও বেশ ভাল। তিনি তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একটা ব্যান্ড দল গড়ে ফেলেছেন। তারা আধুনিক সুরে বাউল, নজরুল বা রবীন্দ্র সংগীত গায়। পাড়ার এক বড় আপুর বিয়েতে তারা গেয়েছিল, বাউল গান, "হৃদ মাঝারে রাখিবো, ছেড়ে দিব না!"
আফরিনও ছিল সে বিয়েতে। সিয়াম ভাইয়ার গানের সময়ে সে খুব লজ্জা পাচ্ছিল। আর আফশোস করছিল। ইশ্, সিয়াম ভাইয়া যদি সত্যি সত্যিই তাকে নিয়েই গানটা গাইতো! তাহলে এই জীবনে তার আর কোন চাহিদা থাকতো না।
তবে সিয়াম ভাইয়া ভাল গান গায়, বা পড়াশোনায় ভাল, কিংবা ভাল ক্রিকেট খেলে; এই জন্য কিন্তু সে প্রেমে পড়েনি। সে সিয়াম ভাইয়াকে ভালবাসে, কারন লোকটা একদম মাটির মানুষ। তার মাঝে কোন অহংকার নেই। ও যে কোন মানুষের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই এমনভাবে মিশে যেন কত দিনের চেনা! ওদের বাসায় যখন সে আদিলকে পড়াতে আসে, পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে আদিলের সাথে খেলাও খেলে। অংক বিষয়ক মজার মজার খেলা। এগুলোকেই বোধহয় প্যারাডক্স বলে। আদিল একসময়ে অংক কষতে ভয় পেত। সিয়াম ভাইয়ার কাছ থেকে এইসব প্যারাডক্স শেখার পরে আদিলের মনের ভিতর থেকে অংকভীতি পালিয়েছে।
আফরিনের বাবার সাথেও সিয়াম ভাইয়ার যেন বন্ধুর মতই সম্পর্ক। আফরিনের বাবা সরফরাজ সাহেব পিডিবির একজন কর্মকর্তা। যিনি প্রচুর কথা বলতে ভালবাসেন, কিন্তু বাড়ীর কেউই তাঁর কথা শোনায় তেমন আগ্রহী নয়। সিয়াম ভাইয়াকে পেলে তাই তিনি প্রাণ খুলে কথা বলেন। সিয়াম ভাইয়ার সবচেয়ে বড় গুণ হলো, তিনি একজন মনোযোগী শ্রোতা, এবং সময়ে ঠিকই নিজের "সুচিন্তিত" মতামত প্রকাশ করেন। এতে সরফরাজ সাহেব দ্বীগুণ উৎসাহে নিজের কথার বান ছোটান।
আফরিনের মায়ের সাথেও সিয়ামের সম্পর্ক অনেক সহজ। ঘরের অতি আপনজনের মতই সিয়াম ভাইয়া তাদের রান্না ঘরে ঢুকে গিয়ে বলে, "আজ কি রান্না করছেন আন্টি?"
আফরিনের মা আফরোজা বেগম হয়তোবা তখন বললেন, "কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ।"
সিয়াম ভাইয়া তখন এমন মুখ ভঙ্গি করবেন, যেন আফরোজা লুকিয়ে লুকিয়ে বেহেস্তের কোন খাবার রান্না করে ফেলছেন।
"আমাকে একবারও বললেন না! গড়ম ভাতের সাথে কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ, সাথে দুটা শুকনা মরিচ ভেজে গন্ধ নিতে নিতে খাওয়া, উফ্ অসাধারণ! এমন খাবার কি আর দ্বিতীয়টি আছে পৃথিবীতে? কতক্ষণে রান্না শেষ হবে আন্টি?"
"এইতো রান্না প্রায় শেষ হয়ে আসলো। ঝোলটা আরেকটু টানলেই চুলা নিভিয়ে দিব। একটা প্লেট নিয়ে বসে যাও না বাবা।"
মজার ব্যপার হলো সিয়াম ভাইয়া কখনই খেতে বসবেন না। কোন না কোন কাজের বাহানায় তিনি এড়িয়ে যাবেন। পরে একদিন খাবেন ওয়াদাও করে যান। কিন্তু সেই “পরদিনটা” আর কোন দিনই আসেনা।
আফরিনের বাড়ীর প্রতিটা সদস্যের সাথেই সিয়াম ভাইয়া মিলেমিশে গেলেও তার সামনেই যেন সিয়াম ভাইয়া সহজ
ভাবে কথা বলতে পারেননা। কেমন যেন কথা সংক্ষেপ করে পালিয়ে গেলেই বাঁচেন। আফরিনের তখন খুবই খারাপ লাগে মনে মনে। এ যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যে তুমি সুন্দর না, তাই তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই!
প্রথম প্রথম খুব অভিমান হয়। মনে হয় জোড়ে জোড়ে আছড়ে যদি সবকিছু ভাংচুর করা যেত, তাহলে বুঝি মনটা শান্ত হতো। তারপরই আবার মন শান্ত হয়ে আসে। আবারও সিয়াম ভাইয়ার সামনে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। তার রসিকতায় হেসে গড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। নিজের মনের সব কথা তাকে খুলে বলতে ইচ্ছে করে। তার হাতে হাত রেখে তাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তে ঝাঁক বাঁধা পাখির নিড়ে ফেরা দেখতে ইচ্ছে করে।
আফরিন চতুর্থ বারের মত কাজলটা মুছে ফেলল চোখ থেকে। থাক। চোখে কাজল দিলে মায়ের চোখে ধরা পড়ে যাবে সে। এরচেয়ে বরং সুন্দর করে চুল বেঁধে ভাল কামিজ পড়লেই হবে।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। আফরিনের মনে হলো যেন বুক থেকে হৃদপিন্ড লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে। ও কি এসে পড়েছে? সে ছুঁটে গিয়ে দরজা খুলতে চাইলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো দরজার দিকে। প্রতি পদক্ষেপেই তার বুকের স্পন্দনের হার যেন বেড়ে চলেছে। সে বুঝতে পারছে তার গালে রক্ত জমতে শুরু করছে। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে। অনেক কষ্ট হচ্ছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে। সিয়াম ভাইয়ার সামনে কিছুতেই দূর্বল হওয়া যাবে না। কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না তার মনের ভিতর কি চলছে। উনি বুঝে গেলে যে অনেক লজ্জার ব্যপার হবে!
এইবার আরেকবার কলিং বেল বাজলো। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ছুটে গেল দরজায়। দুরুদুরু বুকে দরজা খুলল। তার চোখ মেঝেতেই স্থির। চোখ নাকি মনের জানালা। সিয়াম ভাইয়া যদি তার চোখের দিকে তাকিয়েই তার মনের খবর জেনে যান?
"আফা! এই মাসের বিলডা!"
যেন প্রচন্ড ঝাকুনিতে আফরিনের ঘোর কাটলো। সে চোখ তুলে তাকালো। এ সিয়াম নয়, ময়লা ওয়ালা এসেছে। বাড়ানো হাতে একটা কাগজ ধরা আছে। এমাসের বিল হবে। প্রচন্ড অভিমানে আফরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ময়লাওয়ালা এমনিতেও কুৎসিত দেখতে। এখন যেন তাকে আরও অনেক বেশি কুৎসিত লাগছে। যার মুখের অবশিষ্ট দাঁতের সংক্ষ্যা নিজেরই হাতের মোট আঙ্গুলের তুলনায় কম, তাকে তো কুৎসিত লাগবেই!
"আফা! এই মাসের বিল!"
ময়লাওয়ালা তার দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হাসি হেসে হাতে ধরা কাগজটা আরেকটু এগিয়ে দিল।
আফরিন কড়া গলায় ধমকে উঠলো।
"একবারতো বলেছেনই। শুনেওছি। অস্থির হওয়ার তো কিছু নেই। আমরাতো আপনার পয়সা মেরে দিব না!"
বলে ছোঁ মেরে সে বিলটা কেড়ে নিল ময়লাওয়ালার হাত থেকে। বেচারা ময়লাওয়ালা অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো। বুঝতে পারছে না হঠাৎ আপা এত রেগে গেলেন কেন!
আফরিন বিলের রসিদটা নিয়ে রান্না ঘরের দিকে গেল। আফরোজা সেখানে কাজ করছেন। তিনিই এইসব বিষয় দেখাশোনা করেন।
আফরোজা মেয়ের হাতে বিল দেখে বললেন, "ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে একটা হলুদ খামে দেখবি লেখা আছে 'ময়লা', ওটা নিয়ে আয়। ওখানেই টাকা রাখা আছে।"
আফরিন হনহন করে চলে গেল মায়ের শোবার ঘরে। হঠাৎ প্রচন্ড রাগে তার শরীর কাঁপছে। ইচ্ছে করছে কিছু ভাংচুর করতে। টেবিল থেকে একটা কাঁচের গ্লাস প্রচন্ড জোরে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে ভাংতে পারলে ভাল লাগতো খুব!
ড্রয়ার থেকে ময়লাওয়ালার টাকা নিয়ে এসে দেখে সিয়াম ভাইয়া দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকছেন। তাকে দেখে বললেন, "কি ব্যপার! মেজাজ গড়ম নাকি?"
আফরিনের মনে হলো মুহুর্তেই সে কোন ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। সে আর তার মাঝে নেই। শুধু "হু" জাতীয় একটি শব্দ বেরোলো তার মুখ থেকে।
সিয়াম ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন, "আদিল বাসায় আছে? ওকে বলো যে আমি এসেছি।"
আফরিন আবারও "হু" বলল। সিয়াম ভাইয়া তাকে পাশ কাটিয়ে আদিলের ঘরে চলে গেল। আফরিন কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার কোন বোধ শক্তি কাজ করছে না। তার সময় যেন অনন্তকালের পথ শেষে এখানেই এসে থমকে দাঁড়িয়েছে! তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়ে সিয়াম ভাইয়ের গা ছুঁয়ে খানিকটা বাতাস এসে তার গায়ে এসে লেগেছে। তখনই যেন তার নিজের মানব জনম ধন্য মনে হলো।
"আফা আমার বিল!"
আবারও ময়লাওয়ালার ডাকে আফরিনের ঘোর কাটলো। তাকিয়ে দেখে ময়লাওয়ালা অতি কুৎসিত ভাবে তার হাতে ধরা টাকার দিকে তাকিয়ে আছে। আবারও প্রচন্ড রাগে তার মেজাজ খারাপ হলো। সে প্রায় চিৎকার করেই ধমকে উঠলো, "দেখছেনই তো টাকা নিয়ে এসেছি। এত অস্থির হচ্ছেন কেন? নাকি আপনার ধারণা আপনার টাকা আমি মেরে দিবো?"
ময়লাওয়ালা লজ্জিত হেসে বলল, "কি যে কন আফা!"
আফরিন ময়লাওয়ালার বাড়ানো হাতে টাকা প্রায় ঠেসে দিয়েই প্রচন্ড শব্দে দরজা লাগিয়ে দিল। দারুন অভিমানে তার মনটা বীষিয়ে গেছে। কি সুন্দর একটা দৃশ্য সে কল্পনা করে রেখেছিল! সিয়াম ভাইয়া আসবেন, সে দরজা খুলে দিবে। তিনি কিছু কথা জিজ্ঞেস করবেন, সে লাজুক ভাবে উত্তর দিবে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি বলবেন, "আজকে তো তোমাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে! আমি বুঝতে পারছিনা, দিনে দিনে তুমি এত সুন্দর কি করে হচ্ছো? রহস্য কি?"
সে লাজুক ভাবে হাসবে। কি সুন্দর রোমান্টিক একটি দৃশ্য! অথচ বাস্তবে যখন কিনা তিনি এলেন, তখন একটা কুৎসিত ফোকলা দাঁতের ময়লাওয়ালা পাশ থেকে বলছে, "আফা! এই মাসের বিল!"
অসহ্য!
এবার ঘড়ির কাটায় দশ মিনিট পিছিয়ে যাওয়া যাক। স্থান আফরিনদের প্রতিবেশি সিয়ামদের বাড়ি। যেখানে সিয়াম আরেকবার আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চুলটা ঠিক করে নিল। তার খুব ইচ্ছা জেল দিয়ে চুলটা একটু স্পাইক করে নিতে। কিন্তু বাবা দেখলে খবর আছে। একবার সে এক বন্ধুর জন্মদিনে যাবার সময়ে চুলে জেল দিয়ে স্পাইক করে বেরোচ্ছিল। বাবা তাকে দেখে শুধু বললেন তাঁর সাথে একটু আসতে। বিশ মিনিটের কাজ। সিয়ামের হাতে সময় ছিল। সে বাবার সাথে গেল। তার বাবা ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী তাকে নিয়ে একটি সেলুনে ঢুকে পড়লেন। নাপিতকে ডেকে বললেন তার ছেলের মাথা পুরোপুরি কামিয়ে দিতে। সিয়াম হতভম্ভ! সে কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজেকে সেলুনের চেয়ারে বসা অবস্থায় আবিষ্কার করলো। ততক্ষণে নাপিতের তীক্ষ্ণ ক্ষুর তার চুলের উপর চলা শুরু হয়ে গেছে। পুরো মাথা কামাতে দশ মিনিটও লাগলো না। কাজ শেষে ইমতিয়াজ আহমেদ পুত্রের দিকে তাকিয়ে বেশ স্বাভাবিক গলায় বললেন, "এখন মানুষের বাচ্চার মত লাগছে। এতক্ষণ খাঁচায় বন্দি কলা খাওয়া জানোয়ারের মত দেখাচ্ছিল!"
সিয়ামের সবসময়েই ইচ্ছে করে আজকালকার ছেলেদের মত স্মার্ট হয়ে চলতে। তার বাবার জন্য সেটা সম্ভব হয় না। তিনি যদি দেখেন ছেলে শার্টের উপরের দিকের একটি বোতাম খুলে রেখেছে, যা আজকের দিনের চালু ফ্যাশন, তিনি এসে পারলে কলারের বোতাম পর্যন্ত লাগিয়ে দিয়ে বলবেন, "সীনা ঢেকে রাখার জন্যে, দেখিয়ে বেড়াবার জন্যে না!" আর চুল স্পাইক করলে কি করেন সে ঘটনাতো বলেই দিলাম।
সিয়ামের নিজেকে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে শুধু মাত্র একটি মেয়ের জন্যই। তাঁদের প্রতিবেশি কন্যা আফরিন। শ্যামলা গায়ের রংয়ের এই মেয়েটির চেয়ে মায়াবতী চেহারার অধিকারী আর কোন মেয়ে সিয়াম তার জীবনে অন্য কোথাও দেখে নি। মেয়েটির ভীরু ভীরু চোখে এসে যেন সিয়ামের জীবনের সব অপূর্ণতাই পূর্ণতা পায়। খুব ইচ্ছে করে দুহাত দিয়ে মেয়েটির মুখ কিছুক্ষণ ছুঁয়ে থাকতে। সে জানে তার এধরনের চিন্তা করাটা অন্যায়। মেয়েটি তার স্টুডেন্টের বড় বোন। তাকে "ভাইয়া" বলে ডাকে। কোন মনিষী যেন বলেছিলেন মরুভূমির তপ্ত বালুর মধ্যে ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখাও সহজ, কিন্তু মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য! মনিষী বোধহয় ঠিক ‘মন’ নয়, মানুষের ‘জিহ্বা’ সামলানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু জিহ্বা সামলানোর চেয়েও মন সামলানো আরও অনেক বেশি জটিল!
সিয়াম নিজের সবচেয়ে প্রিয় টিশার্ট গায়ে চড়িয়ে হালকা সেন্ট মেখে ফিটফাট হয়ে আদিলদের বাসার দিকে রওনা দিল। ওদের বাসা পাশাপাশি। হেটে গেলে বিশ কদমও না। কিন্তু প্রতিটা পদক্ষেপেই যেন সিয়ামের শরীর ভারী হয়ে আসতে লাগলো। মনের ভিতর উত্তাল ঝড় বইছে। আর কিছুক্ষণ পরেই তার স্বপ্নকন্যার সাথে দেখা হবে। মেয়েটি তার সাথে তেমন কথা বলেনা। কেমন জানি আড়ষ্ট হয়ে থাকে। কখনই তার সামনে তাকে হাসতে দেখেনি। সিয়ামের ধারণা মেয়েটি তার মনের অবস্থা সম্পর্কে জানে। মেয়েরা নাকি এইসব জিনিষ সহজে টের পায়। তাই আফরিনের সামনে সিয়াম সহজ হতে পারেনা। মনের মাঝে লজ্জাবোধটা বড় বেশি খচখচ করে।
আফরিনদের বাসার নিচে কেউ একজন মোটরসাইকেল পার্ক করে রেখেছে। সেটার আয়নায় সিয়াম শেষবারের মত নিজের চুলটা গুছিয়ে নিল। তারপর ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। শুধু এইবাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই সিয়ামের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। মনে হয় এত দীর্ঘ্য সিড়ি পৃথিবীর আর কোন দালানে নেই।
আফরিনদের বাসার দরজা খোলা। বাইরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। ও আচ্ছা, ময়লাওয়ালা। সিয়ামের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। সে আসা করেছিল দরজা বন্ধ থাকবে। সে কলিংবেল চাপলে আফরিন এসে দরজা খুলবে। সেই সময়টুকুতেই তাদের দুজনের যা দেখাদেখি! এরপরে তো আশেপাশে কেউ না কেউ থাকেই, তখন তো আর প্রাণ ভরে দেখা যায় না!
ময়লাওয়ালাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকতেই সিয়াম থমকে দাঁড়ালো। তার সামনে আফরিন দাঁড়িয়ে। সবুজ রংয়ের কামিজে তাকে পৌরাণিক কোন দেবীর মত লাগছে। হাতে কিছু একটা ধরা। তার সুন্দর দুটি চোখের উপরের একজোড়া ভ্রু কুঁচকে আছে। তাকে দেখেই কি? মেয়েটি তার মনের অবস্থা জানে বলেই কি তাকে দেখে বিরক্তিতে তার এই ভ্রু কুঁচকানো? সিয়ামের মনটা খারাপ হয়ে যায়।
চোখাচোখি হতে সিয়াম হরবর করে বলে, "কি ব্যপার? মেজাজ গড়ম নাকি?"
আফরিন জবাব দিল, "হু!"
সিয়াম যেন কথা বাড়াতেই বলল, "আদিল বাসায় আছে? ওকে বলো যে আমি এসেছি।"
জবাবে আবারও "হু"ই শুনলো। সিয়াম চুপসে গেল। আফরিন কথাই বলতে আগ্রহী নয় তার সাথে। তাই দায়সারা জবাব দিচ্ছে। এখনতো কথা বলারও আর কিছু নেই। শুধুই ক্যাবলার মত দাঁড়িয়ে থাকাও যায় না। সে ধীরে ধীরে ওকে পাশ কাটিয়ে আদিলের ঘরের দিকে চলে গেল। আফরিনের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে সে অতি সাবধানে শ্বাস টেনে বুক ভরিয়ে নিল এই আশায় যদি তার চুলের মৃদু সুবাস তাতে ভেসে আসে। কাজটা খুবই খারাপ হয়েছে, একদমই করা উচিৎ হয়নি। আফরিন টের পেলে তো লজ্জার সীমা থাকবে না। তবু এটাই যেন তার পরম সুখ।
আদিলের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সে শুনলো আফরিন ময়লাওয়ালকে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলছে। তারপর বিকট শব্দে দরজা লাগিয়ে দিল। ওর উপরে করা রাগ ময়লাওয়ালা আর দরজার উপর ঝাড়লো? সিয়ামের নিজেকে খুব অপরাধি মনে হলো। হঠাৎ একটি চিন্তা তার মাথায় আসলো। একদিনতো আফরিনের বিয়ে হবেই। সম্ভাবনা শতকরা শতভাগ যে তার মত নগণ্যের ভাগ্যে এই মেয়ে নেই। তখন কি হবে? কেমন লাগবে তার? কি করবে সে সেদিন? এই বাড়িতে আসতে পারবে সে? মনকে সে কি করে বুঝাবে সেদিন যে এ সব কিছুই যার কারণে অর্থবহ, সে মানুষটিই এখন অন্যের!
সিয়ামের বুক থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরোতে যাচ্ছিল। সে সেটাকে বেরোতে দিল না। আফরিন না হয় আরও কিছুক্ষণ থাকুক তার বুকের মাঝেই!
২| ২৮ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:৩৬
অর্থনীতিবিদ বলেছেন: গল্পটি কোথা দিয়ে শেষ হয়ে গেল টেরই পেলাম না। অবশ্যই সুখপাঠ্য। তবে দুটি ছেলে মেয়ে পরস্পরকে গভীর ভাবে ভালবাসে অথচ দু’জনের কেউই সেটা টের পাচ্ছে না এটা কেমন জানি মিলাতে পারছি না। আপনি সিয়াম আর আফরিনকে নিয়ে নাহয় আরেকটি গল্প লিখুন যেখানে কোন চমকের মাধ্যমে উভয়ের ভালবাসা প্রকাশিত হবে এবং দুটি হৃদয়ের মধ্যে পূর্ণতা পাবে। গল্পটির জন্য ভাললাগা জানিয়ে গেলাম।
৩| ২৯ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:৪২
মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: ভাল লাগার জন্য অনেক ধন্যবাদ!
আসলে গল্পটা অযত্নেই লেখা হয়েছে। ফাইন্যান্স ক্লাস করছিলাম। স্যার লেকচার দিচ্ছিলেন। অতিরিক্ত রকমের একঘেয়ে লেকচার। নোট নিতে নিতেই হঠাৎ গল্পটা মাথায় এলো। নোট ফেলে আমি লিখতে শুরু করলাম। একটা সময় ক্লাস শেষ হলো, গল্পটাও তাই সেখানেই শেষ করলাম।
আমি শুধু চাচ্ছিলাম দুটি মানব মানবীর মনের অনুভূতি ফুটিয়ে তুলতে। ওদের মিলন বা বিচ্ছেদ সম্পর্কে লিখতে ইচ্ছে করেনি। সেটা পড়ে অন্য কোন এক গল্পে লেখা যাবে। সাথে থাকার আমন্ত্রণ রইলো।
©somewhere in net ltd.
১| ২৮ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:১০
চেনা মুখ, অচেনা ছায়া বলেছেন: কিশোরবেলার ভালো লাগার অনুভূতি গল্পে বেশ চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
'ভালো লাগা'- বাটনটা ইদানিং কাজ করছে না ঠিক মত। তাই শুধু মন্তব্যের মাধ্যমেই ভালো লাগা জানাতে হলো।