নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
"রাজীব ভাই, এই বোলারটারে সাবধানে খেইলেন, দারুন বল করে!"
আমি ওয়ান ডাউনে নামবো। তখন ভালই ব্যাটিং করতাম। বড় বড় ভাইদেরও পাত্তা না দিয়ে অনায়াসে ব্যাট চালাতাম। মনের ভিতরে একটা অহংকারী ভাবতো ছিলই।
দলের একটা ছেলের(নাফিস না নাদিম, কী যেন নাম ছিল, ভুলে গেছি) কাছে এ ধরনের কথা শুনে তাই একবার ভাল করে দেখে নিলাম বোলারটাকে। পাতলা টিংটিংয়ে একটা ছেলে। বয়স বারো তের হবে।
"এর নাম শালোম।"
শালোম। হয়তো নামটা শাহ আলম, মানুষের মুখে মুখে শালোম হয়ে গেছে।
শুনেছি এর নাম আগে। এই টুর্নামেন্টের আবিষ্কার। দারুন নাকি বল করে। গত ম্যাচে কাইয়ুমের দলকে একেবারে একাই নাকি হারিয়ে দিয়েছে। সেরকম এক ম্যাচে হিরোতো অনেকেই হয়। আমার কথাই ধরা যাক। আমি কি ভাল বোলার? মোটেই না। অথচ মাঝে মাঝে কিভাবে কিভাবে যেন আমি হাত ঘুরলেই উইকেট আপনাতেই পড়া শুরু করে। এই ছেলেও হয়তো সেরকম।
আমাদের টার্গেট মাত্র বিশ রান। ওদের ঊনিশ রানেই বেঁধে ফেলেছি। হাসতে খেলতে জিততে পারবো আমরা।
আমাদের দলে আমি ছাড়াও নওশাদ, শুভ ভাই আর সুব্রত আছে, যাদের ব্যাটে ইদানিং ভাল রান আসছে। টিপু ভাই, নুরু ভাইদেরই সেদিন হেসে খেলে পার পেয়ে গেলাম, এতো নতুন ছোকরা!
ওপেন করছে নওশাদ। দুর্দান্ত মারকুটে ব্যাটসম্যান। ওর জীবনের লক্ষ্যই হলো বলকে পেটানো। যদিও ওর টুর্নামেন্ট রেকর্ড খুব খারাপ। বেশির ভাগ সময়েই অল্প রানে আউট হয়।ওপার থেকে বল করবে শালোম। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখার অপেক্ষায় রইলাম কি হয়।
প্রথম বলে নওশাদ তার স্বভাবসুলভ স্টাইলে ব্যাট ঘুরালো, বল অল্পের জন্য ছক্কা হলো না।
আমি নাদিমের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্লের হাসি হাসলাম। প্রথম বলেই বাউন্ডারী খায়, এই বোলারের কাছ থেকে সাবধান হবার কী আছে?
দ্বিতীয় বলেও আরেকটা চার। নওশাদ আজকে ফাটাচ্ছে!
আমরা চিৎকার শুরু করলাম, "এই ওভারেই খেলা শেষ কর!"
নওশাদ হাত উঁচিয়ে আমাদের ইশারা করলো। সে আমাদের দাবী মেটাবে।
তৃতীয় বলে সর্বনাশ! শালোম বল ছুড়লো, নওশাদ ব্যাট চালালো, ব্যাটে বলে হলো না, বল স্ট্যাম্প থেকে একটা বেল ফেলে দিয়ে উইকেট কিপারের হাতে ধরা দিল।
নওশাদকে আমরা আফ্রিদি বলতাম। ওর থেকে রান পাওয়াটা আমরা বোনাস হিসেবে ধরতাম। আজকে বিশ রান টার্গেটে আট রান বোনাস পাওয়া কম কিসের?
প্যাভিলিয়নে (বাউন্ডারির বাইরে একটা কাঠের বেঞ্চি পাতা, সেটাই আমাদের প্যাভিলিয়ন) ফেরার পথে নওশাদ বলল, "খুব ভাল বল ছিল, আমার দোষ নাই।"
মনে মনে বললাম, "তোমাকে আউট করতে ভাল বল লাগেনা বাবাজি। সবসময়েই একই বাহানা দাও!"
মুখে শুধু একটা হাসি দিয়ে বললাম, "ব্যাপার না।"
আমি খুব ভাব নিয়ে ব্যাটিংয়ে আসলাম। ভাল মত ফিল্ড পজিশন দেখে নিলাম। বোলারের চোখে চোখ রেখে জানালাম আমি প্রস্তুত।
শালোম বল ছুড়ল। অফস্ট্যাম্পের একফুট বাইরে হবে নিশ্চিত। ফুল পিচ ডেলিভারি। আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটায় পড়েছে। এখুনি স্কয়ার ড্রাইভ করে বলটাকে থার্ড ম্যান দিয়ে সীমানার ওপারে পাঠাচ্ছি। বেকুবরা পয়েন্টে একটা পুঁচকে ছোরাকে রেখেছে। ওর সাধ্যি নেই এই বলকে ঠেকানোর।
আমি ফ্রন্ট ফুটে খেললাম। ব্যাটও সময় মতই চালালাম। কিসের থেকে কি হয়ে গেল, আমি দেখলাম বলটা আমার ব্যাটে লাগলই না।বরং ফিল্ডিং দল আনন্দে হৈ হুল্লোড় করে উঠলো।
আমি পেছনে ফিরে দেখি আমার মিডল স্ট্যাম্প নড়ে গেছে! এ কি করে সম্ভব? একটা পেস বোলারের বল এত বড় টার্ন করে কি করে? একদম বেকুব বনে গেলাম! অনেক অনেক দিন পর আমার প্রথম শুন্য রানে আউট হওয়া।
আমি বোকার মত প্যাভিলিয়নে এসে নওশাদের মতই বললাম, "আসলেই ভাল বল ছিল।"
শুভ ভাই আমার দিকে ঠিক তেমনটাই হাসি দিল যেমনটা আমি নওশাদের দিকে দিয়েছিলাম। হয়তো মনে মনেও একই কথা বলল। দলের সেরা ব্যাটসম্যান কে, সেটা নিয়ে তার আমার মধ্যে অনেকদিনের ঠান্ডা লড়াই চলছে।
নাদিম আমার কাছে এসে বলল, "কইছিলাম না ভাল বোলার?"
আমি ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকালাম। এখনও মাথায় ঢুকছে না বল এত বড় টার্ন করলো কি করে!
শালোম হ্যাট্রিকের জন্য বল করতে যাচ্ছে। শুভ ভাই আছে, ভাল ব্যাটসম্যান। তবে আমাকে যে বল করেছে, সেরকম একটা করলে শুভর সাধ্য নাই হ্যাট্রিক ঠেকানো!
শালোমের হ্যাট্রিক বল শুভ ভাই আরামসেই ঠেকিয়ে দিল। আমরা হাঁফ ছাড়লাম। যাক। ঐ দুইটা উইকেট বোধহয় ঝরে মরা বক ছিল, এখন আর ভয় নেই। মাত্রইতো বারো রান লাগবে জিততে। শুভ ভাই ছক্কা পেটানোয় ওস্তাদ! দুইটা মাত্র বল লাগবে ওর।
শালোমের শেষ বলটা শুভর স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলে দিল। সর্বনাশ! আমাদের দলের মূল তিন ব্যাটসম্যান এক ওভারেই খতম! এক সুব্রত আছে। সে কি পারবে বাকিদের নিয়ে বারো রান তুলতে?শুভ প্যাভিলিয়নে এসে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষনা করলো, "আমি সেকেন্ড বলে আউট হয়েছি, রাজীব প্রথম বলে।"আমি তর্কে গেলাম না। তর্কের পরিস্থিতিতে আমরা নেই।
সেই ম্যাচ আমরা এক উইকেটে জিতি। শালোম সুব্রতকেও বোল্ড করেছিল। আমাদের দলের আরো দুই ব্যাটসম্যান তার শিকার হয়েছিল। অন্য প্রান্তের বলারটা খুব দূর্বল না হলে সেই ম্যাচ আমরা জিততে পারতাম না।শালমের দল পরে একটা ম্যাচও জিততে পারেনি। তাদের একটাও ভাল ব্যাটসম্যান ছিল না(পাকিস্তানের এখন যে সমস্যা)।
অথচ টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার সে। দ্বিতীয়জন চ্যাম্পিয়ন দলের টিপু ভাই, শালোমের অর্ধেক সংখ্যক উইকেটও তিনি পাননি।
আমরা ছিলাম ছোট দল। আমাদের একটা ভাল বোলারের প্রয়োজন ছিল। আমরা যোগাযোগ করলাম শালোমের সাথে।
ছেলেটা গরীব, বাবা রিক্সা চালায়। ময়লা প্যান্ট, ময়লা জামা পড়ে ঘুরে বেড়ায়। ক্রিকেট থেকেও বেশি ভালবাসে ঘুড়ি ওড়াতে।
ছেলেটার ন্যাচারাল ট্যালেন্ট ছিল ইনসুইং বল করার। আমাদের পিচ ছিল ভারতীয় পিচের মতই, মরা। কোদাল দিয়ে ঘাস চেছে ফেলে প্রাণহীন ন্যাড়া উইকেটে খেলা হত ক্রিকেট। স্পিনাররাও জোর করে খুব একটা টার্ন আদায় করতে পারতো না। সেই উইকেটেও এই ছেলে পেস বোলিংয়ে সুইং আদায় করে নিত। উইকেট থেকে এক দুইফুট বাইরে থেকে টার্ন করিয়ে কিভাবে মিডল স্ট্যাম্প ভেঙ্গে ফেলতো, সেটা একটা রহস্য।আমরা অনেক স্বপ্ন দেখে ফেললাম দলকে নিয়ে। আমরা নিয়মিত ভাল ব্যাটিং করছি, শুধু মাত্র ভাল বোলারের অভাবে ম্যাচ হারি(ইন্ডিয়ার মত।)
এবার শালোম দায়িত্ব নিবে আমাদের বোলিং আক্রমনের। ও উইকেট ফেলবে, আমি, নওশাদ, মাজেদ, নাদিমরা রান আটকে ফেলতে পারবো। হীমেল, তুষার, শিশির ভাইদের বড় দলকেও ইনশাল্লাহ আমরা খুব শীঘ্রই একহাত দেখে নিব।
একদিন একটা ম্যাচে শালোম এলো না। ওর জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে আধা ঘন্টা খেলা পেছানো হয়েছিল। কিন্তু ও এলোই না। ম্যাচটা আমরা কোন রকমে জিতি। শালোম আসলে এই কষ্টটা করতে হতো না। ও ধামাধাম উইকেট ফেলে দিত।
মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছিল, তাই আর গেলাম না তার খোজে।
কিন্তু পরের দিনও রাগটা ছিল তার উপর।বিকালে গেলাম তার বস্তিতে। কোন বস্তিতে সেই প্রথম আমার প্রবেশ।
আহারে! মানুষ গুলি কি কষ্টেই না থাকে! দুর্গন্ধময় পরিবেশ, একটা ঘুপচি ঘরে সাত আটজন পারিবারিক সদস্য নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়! শুধু মাত্র অন্ন বস্ত্রের যোগান দিতে দিতেই জীবন শেষ হয়ে যায়!
শালোমের বাড়ি খুঁজে বের করতে খুব একটা কষ্ট হলো না। কোন আলাদা বিশেষত্ব নেই। একটা মাটির ঘরে অনেক মানুষের কৌতুহলী চোখ উঁকি দিয়ে ভদ্রলোকের সন্তানদের দেখছে। কয়জন থাকে এই ঘরে, কে জানে!
একজন মহিলা, যার কোলে একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু, জানালেন শালোম এখন বন্দর বাজারে একটা পানের দোকানে বসে।
আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। এই টুকুন ছেলে, এখন নেমেছে সংসারের আয় রোজগারে! ওর খেলাধুলার কী হবে? ওর বোলিং প্রতিভার? আমাদের কিছু বলার অধিকারও ছিল না। ওদের অভাবের সংসারে আমরা কথা বলার কেউ না।
আমাদের দল বেশিদিন থাকেনি। আমরা পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমাদের ঈশ্বর প্রদত্ত তেমন প্রতিভা ছিল না, কঠোর পরিশ্রম করার ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু শালমের প্রতিভা ছিল। একজন ভাল কোচের হাতে পড়লে আজকে হয়তো সে দেশের সেরা পেসার হত। শেবাগ, সিধু, ইউনুস খানরা আমাদের নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারতো না। বিরাট কোহলির মিডল স্ট্যাম্প আমাদের শালোম নিয়মিতই উপড়ে ফেলত। আমি নিশ্চিত।
ইন্ডিয়ার নতুন বোলিং সেনসেশন মোহাম্মদ শামির জীবনকাহিনী পড়ে হঠাৎ শালোমের কথা মনে পরে গেল। পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইরফানও অনেকটা সেরকমই গরীব ঘর থেকে উঠে এসেছে। বিতর্কিত কিন্তু দুর্দান্ত প্রতিভাবান মোহাম্মদ আমিরও তাই। হঠাৎ মনে হলো, কেমন আছে শালোম এখন? বন্দর বাজারে তার পানের ছোট দোকানটা কি এতদিনে একটু বড় হয়েছে? যে হাত যাদুকরী স্যুইং বল করার ক্ষমতা রাখে, সেই হাতে পান সাজাতে এখন কেমন লাগে তার?
১০ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৫৮
মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ!
২| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:৪৯
কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
ভালো লিখেছেন।
২৩ শে নভেম্বর, ২০১৩ ভোর ৫:২১
মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ
৩| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:১০
মোহাম্মদ মজিবর রহমান বলেছেন: এরকম শালম আমাদের চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,গল্পে আপনি তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।লেখায় +
২৩ শে নভেম্বর, ২০১৩ ভোর ৫:২২
মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:৫১
সোহেল রনি বলেছেন: দারুন লিখেছেন । কত প্রতিভা যে এভাবে নষ্ট হচ্ছে।