নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
শৈশবে আমি ও আমার বড় বোন দাদির সাথে ঘুমাতাম।
দাদি আমাদের রূপকথার গল্প শোনাতেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম।
সেসব রূপকথা আমার মনে গভীর দাগ ফেলতো।
আমি আমার বাবাকে বলতাম যে, "আমি পাতালপূরীর রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চাই। ডালিম কুমার যেন আমার আগে তাকে বিয়ে করে ফেলতে না পারে, সেজন্য তোমরা তাড়াতাড়ি আমার বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠাও!
কিছুদিন পরে দাদি চলে গেলেন, তবু ঘুমানোর আগে গল্প শোনার অভ্যাস আমার রয়ে গেল। আমার বড় বোন আমাকে গল্প শোনাবার দায়িত্ব নিল।
সে আমাকে "ঠাকুর মার ঝুঁলি," কিংবা "আলাউদ্দিনের আশ্চর্য্য প্রদীপ" গল্পের বইগুলো পড়ে শোনাতো। আমি তখন একজন আদর্শ শ্রোতা। গল্প-উপন্যাস শুনে যাই। কল্পনায় প্রতিটা চরিত্র চোখের সামনে দেখতে পাই। তখনও আমার পাঠক হয়ে ওঠা হয়নি।
আমার স্কুলে (ক্লাস থ্রীতে পড়ি তখন) বাংলা পিরিয়ডে মুন্নি মিস্ আমাদের মাঝে মাঝে পাঠ্য পুস্তকের বাইরের বইও পড়ে শোনাতেন। বিভূতিভূষণের "চাঁদের পাহার" আমার মুন্নি মিসের কন্ঠেই শোনা।
তখন মুন্নি মিস আমাদের আরও একটি লেখকের লেখা বই পড়ে শোনালেন। বইটির নাম "পিপলি বেগম।" লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
একটা বাচ্চা পিপড়ার গল্প। আমি মুগ্ধ হলাম লেখকের গল্প বলার ক্ষমতায়।
তার কয়েকদিন পরে মিস পড়ে শোনালেন "একি কান্ড!" উপন্যাস। লেখক, সেই হুমায়ূন আহমেদ। মাথায় ঢুকে গেল নামটি। তখনও খেয়াল করিনি টিভিতে প্রচারিত সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটকগুলোর (বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই) রচয়িতারও একই নাম।
এক মেলায় আমাদের বাসায় "বোতল ভূতে"র আগমন ঘটলো। পাঠক তখনও আমার বোন, আমি মুগ্ধ শ্রোতা। লেখকটির যাদুকরি লেখনির ভাষায় আমি অভিভূত!
সেই ঈদে আমার এক ফুপুর বাসায় বেড়াতে গেলাম। সেখানে সবাই মিলে একটি নাটক দেখে খুবই হাসলাম। নাটকটির নাম "হিমু।" অভিনেতা বাংলাদেশের শীর্ষ অভিনেতা, আমাদের বাকের ভাই, আসাদুজ্জামান নূর। লেখক, এখনও হুমায়ূন আহমেদ।
সেই বছরই আব্বু আমাদের বই মেলায় নিয়ে গেলেন। একটি স্টলে নিয়ে গিয়ে বললেন, "কোন বই কিনতে চাও?"
আব্বুর ইচ্ছে ছিল, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর লেখা জমকালো ছবিওয়ালা প্রচ্ছদের একটি বই। আমার হাতে সেটা তুলেও দিলেন।
কিন্তু আমার চোখ তখন আটকে আছে একটি বইয়েই। বইটির নাম "হিমু।" লেখক, হুমায়ূন আহমেদ।
আব্বু বললেন, "হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে কি হবে? সেতো একজন উন্মাদ! দরকার হলে শরৎচন্দ্রের বই পড়ো।"
আমি অনড়। আমি "হিমু"ই কিনবো। নাটকটি তখন আমার এতই ভাল লেগেছিল।
আমার চয়েসে আব্বু একটু হতাস হলেন বলে মনে হলো, কিন্তু আমাদের বাসায় হিমুর প্রবেশ ঠিকই ঘটলো।
আমি প্রথম কোন উপন্যাস পড়া শুরু করলাম।
মাকড়শা যেমন জাল বুনে শিকার ধরে, লেখকরাও গল্পের জাল বুনে পাঠক ধরেন। আমি হুমায়ূন আহমেদের লেখনি জালে পেঁচিয়ে একদম ধরাশায়ী হয়ে গেলাম। শুরু করলাম গল্পের বই পড়া। প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। যেখানেই তাঁর বই পাচ্ছি, পড়ে ফেলছি।
মিসির আলীর চরম ভক্ত হয়ে গেলাম। ছোট বাচ্চাদের একজন করে সুপার হিরো থাকে। আমার সুপার হিরো ছিলেন, এবং এখনও আছেন, মিসির আলি।
তাঁর উপন্যাস পড়তে পড়তে আমার মনে হতো যেন আমি বই পড়ছি না, তিনি আমার সামনে বসে গল্প বলছেন। আমার দাদী যেন আবার ফিরে এসেছেন। আমার বোন আবার ফিরে এসেছে। এখানে হুমায়ূন আহমেদ গল্প বলে যাচ্ছেন, আর আমি শুনতে শুনতে কল্পনায় হারিয়ে যাচ্ছি। আমি যেন তাঁর সাথে আড্ডা দিচ্ছি! তিনি এখানে দেশ বরেণ্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ না, তিনি যেন আমার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছেন!
এই আড্ডাতেই পরিচয় হলো আনিস, হাসান, তিথী, নীলু, শুভ্র, তিতলি, আতাহার, সাজ্জাদ, মাওলানা ইরতাজুদ্দিন, মৃন্ময়ী প্রমুখদের সাথে। এই আড্ডাতেই আমি আসমানির (চিত্রের দ্বিতীয় দিবস) প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম!
একটা সময়ে এই আড্ডাই আমার নেশা হয়ে গেল। সময় বের করতে লাগলাম ঘনঘন প্রিয় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য। প্রতি বইমেলায় একগাদা গল্প নিয়ে তিনি আমার দরজায় কড়া নেড়ে বলতেন, "আরে এই যে বন্ধু! এসো, এসো! তোমার জন্য যে কত গল্প জমিয়ে রেখেছি! কার গল্প আগে শুনতে চাও?"
"আপনিই বলুন, কারটা আগে শোনাবেন?"
"কুটু মিঞার গল্প শুনবে?"
"সে আবার কে?"
"সে তেমন বিশিষ্ট কেউ না। তবে খুব ভাল রাঁধতে জানে।"
"একজন বাবুর্চির আবার কিসের গল্প?"
"তাও ঠিক। তবে একটু শুনে দেখতে পারো, ইন্টারেস্টিং লাগতেও পারে।"
এক সময়ে আমাদের আড্ডার আসরে সুনীল এলেন, শীর্ষেন্দু এলেন, সমরেশ এলেন, কিছু বিদেশী লেখকও এলেন। সবাই সবার গল্প শোনাবেন। আমি মুগ্ধ শ্রোতা। কিন্তু আড্ডার মধ্যমণি ঠিকই থেকে গেলেন সেই একজন, হুমায়ূন আহমেদ!
গল্প পড়তে পড়তেই একসময় কলম তুললাম। অতি দূর্বল কিছু লেখা লিখলাম। আমি এখনও যা লিখি, তার চারা গাছটি সেই হুমায়ূন আহমেদরই রোপণ করা।
হুমায়ুন আহমেদ সেই লেখক যিনি পাঠ বিমুখ বাংলাদেশীদের বই পড়া শিখিয়েছেন।
রাস্তাঘাট ফাঁকা করে মানুষ একমাত্র তাঁরই নাটক দেখতো।
হলবিমুখ দর্শকরা আবারও সিনেমা হলে ফিরিয়ে এসেছিলেন এই হুমায়ূন আহমেদেরই কারনে।
তাঁর লেখা পড়তে পড়তে অনেকেই লেখক হয়েছেন।
তাঁর ঋণ শোধ করার ক্ষমতা বাংলা সাহিত্যের নেই।
দুই বছর আগের এই দিনটিতেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমার এত খারাপ লেগেছিল! ঠিক যেন ইকবালকে হারানোর কষ্টটাই আবার ফিরে এসেছিল।
প্রথমেই মনে হয়েছিল আমাদের আড্ডার কি হবে?
তিনি না এলে যে মিসির আলী, শুভ্র, হিমু, আসমানি, রূপা কেউই আসবে না! কে আমাকে গল্প শোনাবে? আড্ডা ছাড়া আমার চলবে কিভাবে?
আমি যে তাঁর লেখনী জাল ছিড়ে বেরোতে চাইনা!
আসমানি, রূপা, তিতলি, লীলাবতী - এদের সাথে কি আর কোনদিন দেখা হবেনা?
একদিন আবারও আমার দরজায় টোকা পড়লো।
দরজা খুলে দেখি হুমায়ূন আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন। সেই পরিচিত উত্ফুল্ল ভঙ্গিতে কাঁধ চাপড়ে বলে উঠলেন, "আরে এসো এসো! তোমাকে একটা নতুন গল্প শোনাই!"
"নতুন গল্প! বলেন কি!"
"হ্যা! শেখ সাহেবের গল্প। শেখ সাহেব কে চিনেছোতো? শেখ মুজিবুর রহমান!"
তারপর স্বভাবসুলভ নাটকীয় ভঙ্গিতে কথায় বিরতি দিলেন। তারপর ভুরু নাচিয়ে জানতে চাইলেন, "শুনতে চাও?"
আমি "দেয়াল" উপন্যাসের মলাট উলটালাম।
এখনও তিনি প্রায়ই ডাক দেন। পুরনো গল্পই শোনাতে চান। আমি বাঁধা দেই না। বহুবার শোনা গল্পই বারবার মুগ্ধ হয়ে শুনি। আড্ডার মাঝখানে কারেন্ট চলে গেলে হিমু তার সাথের শান্তিনিকেতনি ব্যাগ থেকে মোমবাতি বের করে এনে আমাদের চমকে দেয়ার চেষ্টা করে।
গল্পের মাঝখানে মিসির আলী সাহেব যুক্তির প্যাচে ফেলে স্যারের সাথে তর্ক জুড়ে দেন। একসময়ে দুজন দুইদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকেন।
শুভ্র কিছুক্ষণ পরপর চমশার কাঁচ পরিষ্কার করে আবার ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।
আমি আড়চোখে আসমানির দিকে তাকিয়ে ভাবি, একজন নারী এতটা রূপবতী কি করে হতে পারে!
আমাদের আড্ডার আসর চলতেই থাকে। আমাদের আড্ডার আসর কখনই ভাঙ্গার নয়।
২| ১৯ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৪৩
লিখেছেন বলেছেন: উপরের মন্তব্যের ফালতু লিঙ্ক তা পরে কেউ সময় নষ্ট ক্রেন না। অনেক পুরনো আর ঈর্ষা কাতর এক অপদার্থের ফালতু প্যাঁচাল
©somewhere in net ltd.
১| ১৯ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৩৯
পরাজিত মধ্যবিত্তের একজন বলেছেন: হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর 'সাহিত্যিকের মৃত্যু এবং আমাদের গদগদে আবেগ' শিরোনামে একটি গদ্য রচনা করেছিলাম। আজ গদ্যটি স্মরণ করছি। যারা পড়েননি তাদের পড়ার আহবান জানাই।
Click This Link