নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুর চৌধুরী

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!

মঞ্জুর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভিসুভিয়াস - একটি ছোট গল্প

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:০৯

দরজা খোলাই ছিল।

বাতাসে লম্বা পর্দা তিরতির করে কাঁপছে। লোকজন আজকাল দরজায় পর্দা টাঙ্গায় না। তবু এ বাড়িতে কিছু পুরনো প্রথা ধরে রাখা হয়েছে।

কলিংবেল নেই। সোহেল দরজায় হালকা করে টোকা দিল। ভিতরে শুনতে পেয়েছে কিনা নিশ্চিত হতে পারলো না, তাই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জোরে কাশলোও।

সোহেল এ বাড়ির গ্যারেজের লাগোয়া একটি এক কামড়ার ঘরে ভাড়া থাকে। তার মূল বাড়ি যশোর। ঢাকায় থেকে সে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং।

ভিতর থেকে লিপি বেরিয়ে এলো।

"ভাবি, আমাকে ডেকেছেন?"

লিপির বয়স বেশি না। খুব বেশি হলে ঊনিশ কুড়ি হবে। রোগা পাতলা বলে দেখতে আরও কম মনে হয়। সোহেলের চেয়ে বয়সে অবশ্যই ছোট। তবু সোহেল তাকে আপনি আপনি বলে সম্বোধন করে। 'পরস্ত্রী' বলে কথা! এর উপর আবার এক বাচ্চার মা!

"হ্যা ভাইয়া, একটা উপকার করতে পারবেন? খুব বেশি কষ্ট হলে অবশ্য লাগবে না।"

লিপি ভাবির এই এক যন্ত্রণা, খালি ফর্মালিটি। একটা কথা বলার আগেই ক্ষমা চাইবে, অনুমতি চাইবে, ইতস্তত করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সহজভাবে বলে দিলেই পারে!

"আরে ছিঃ ছিঃ! আপনার জন্য কি করতে হবে বলুন, আমার সাধ্যে থাকলে অবশ্যই করে দিব।"

লিপি ইতস্তত করে বলল, "বাসায় একদম চিনি নেই। উনার আবার অফিস থেকে ফিরেই চা খাবার অভ্যাস। তিন চামচ চিনি লাগে। আপনি একটু কষ্ট করে রুবেলের দোকান থেকে আধ পোয়া চিনি এনে দিতে পারবেন?"

সোহেল কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, "এইটাকে আপনি বলছেন কষ্টকর কাজ? এখুনি নিয়ে আসছি।"

লিপি আবারও ইতস্তত করে বলল, "ইয়ে, মানে....আমার কাছে খুচরা টাকা নেই। আপনি যদি একটু কষ্ট করে দোকানে উনার নাম করে বাকিতে আনতে পারেন...."

"হাহাহা।"

সোহেল কথা শেষ করতে দিল না। মাঝেই হেসে দিল।

"নিজাম ভাইয়ের নামে বাকি দিবে নিশ্চিততো? রুবেইল্যা কিন্তু আমাকে মোটেও বাকি দেয় না।"

লিপির মুখ ফর্সা হয়ে গেল।

"তাহলে উপায়?"

সোহেলের মজা লাগছে। এত দ্রুত নার্ভাস হয়ে যায় মেয়েটা!

"তিন চামচ চিনি হলেই আপনার হবেতো? আপনি বরং আমার কাছ থেকেই পাঁচ চামচ চিনি ধার নিন। যখন বাড়িতে চিনি আসবে, তখন নাহয় ফেরত দিয়ে দিবেন?"

লিপি হেসে দিল। টেনশন মুক্তির হাসি।

"উফ! বাঁচালেন। আপনার এই উপকার আমি কোনদিন ভুলবো না!"

সোহেল মনে মনে আবার বিরক্ত হলো। এই মেয়ে এত ফরমাল কেন?

"বেশি ভদ্রতাও যে গাত্র দাহের কারণ হতে পারে" এই কথা যদি কেউ বিশ্বাস না করে থাকে তবে তার সাথে লিপি ভাবির পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।

সোহেল বাসা থেকে চিনির বয়াম নিয়ে এলো।

"নিন, আপনার যত খুশি চিনি নিন।"

লিপি গুনে গুনে চায়ের চামচের পাঁচ চামচ চিনি নিল।

হাসতে হাসতে বলল, "আমার আপাতত এটাতেই চলবে। আপনি অনেক উপকার করলেন ভাই। আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিব!"

আবারও গা জ্বালা ধরা কথাবার্তা।

সোহেল বলেই ফেলল, "আপাতত কিছু না বললেই উপকৃত হবো।"

লিপি বোধয় মর্ম বুঝলো না। সে হেসে দিল।

মেয়েটা সুন্দরী বলতে যা বুঝায় তা না। কেবল গায়ের রংটাই একটু ফর্সা। রোগা বলে গালের হনু একটু উঁচু হয়ে থাকে। লম্বা চুল সবসময়েই বেণী করে রাখে। ভাসা ভাসা চোখ দেখলে প্রায়ই ক্লান্ত বলে মনে হয়। কিন্তু হাসলে মেয়েটিকে ভালই দেখায়।

"বাবু কি করছে ভাবি?"

"ঘুমাচ্ছে। সারাদিন ভীষণ দুষ্টুমি করে এখন টায়ার্ড হয়ে ঘুমাচ্ছে।"

"দুষ্টুমি করলেতো ভালই। দুষ্টু বাচ্চারা মেধাবী হয়। সায়েন্স বলে এই কথা।"

লিপি এতে দারুন উৎসাহ পায়।

"আর বলবেন না। এই বয়সেই যা বুদ্ধিমান হয়েছে! এই বয়সেই সব বুঝতে পারে মাশাল্লাহ!"

সোহেল মনে মনে হেসে দিল। সে আজ পর্যন্ত কোন মা পায়নি যে বলে, "আমার বাচ্চা একদম হাবাগোবা হয়েছে, কিছুই বুঝে না।"

সবার বাচ্চাই ছোটবেলা থেকেই সব বুঝে। পারলে দোলনাতে থাকা অবস্থাতেই পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে নেয়, এমন অবস্থা!

তখুনি একটা কাশির শব্দ হলো। সোহেল পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে নিজাম ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। কাশিটা ইচ্ছাকৃতই, সোহেল যাতে সরে গিয়ে তাঁকে রাস্তা দেয়।

সোহেল দরজা থেকে সরতে সরতে বেশ আন্তরিক গলায় বলল, "স্লামালিকুম নিজাম ভাই! কেমন আছেন?"

নিজাম ভাইর বয়স পয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে, দেখতে আরও বয়ষ্ক দেখায়। গালে সবসময়েই কাঁচাপাকা দাড়ি খোচাখুচি করে। মাথার চুলের পরিমানও অনেক কমে গেছে। সবসময়ে মাথা নিচু করে হাঁটেন। যে কারনে তাঁকে কুঁজো দেখায়। কখনই মানুষের চোখে চোখ রেখে তাকাননা। সোহেলের ধারনা অফিসে ছোটখাট চাকরি করেন বলেই এমন স্বভাব হয়েছে। অথবা এই স্বভাবের কারনেই হয়তো তিনি ছোট খাটো চাকরি করেন।

তিনি স্বভাবসুলভ অন্যদিকে তাকিয়েই বিড়বিড় করে বললেন, "ওয়ালাইকুম।"

কেমন আছেন সেটার আর জবাব দিলেন না।

তিনি নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলেন।

লিপি ভাবি বললেন, "চিনির জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই। এখন আমাকে ক্ষমা করবেন, উনার জন্য চা বানাতে হবে।"

সোহেল হাসিমুখে বলল, "অবশ্যই।"

মনে মনে বলল, "হায়রে ফর্মালিটিজ!"



সোহেল ঠিকঠাকমত চলে যাবার আগেই লিপি দরজা লাগিয়ে দিল। রান্নাঘরে যাবার আগে স্বামীর খোঁজ নিতে বেডরুমে গেল।

নিজাম তখন মাত্রই শার্ট খুলে ফ্যানে শুকাবার জন্য দেয়ালে ঝুলানো হ্যাঙ্গারে টাঙ্গিয়ে দিল। শরীরের ঘাম শরীরেই শুকাতে ফ্যানের নিচে বসলো।

লিপি এসে আহ্লাদী স্বরে বলল, "আজকে অফিস কেমন গেল?"

নিজাম রসহীন কন্ঠে বলল, "যেমন প্রতিদিন যায়।"

লিপি বলল, "দাঁড়াও, তোমার জন্য চা বানিয়ে আনছি।"

নিজাম কিছু বলল না। চোখমুখ শক্ত করে বিছানায় বসে রইলো।

আজকে তার দিন ভাল যায়নি। কোনদিনই তার ভাল যায়না। সকাল শুরু হয় লোকাল বাসে ভিড় ঠেলে উঠার প্রতিযোগিতা দিয়ে। জ্যামের কারনে প্রতিদিন অফিসে যেতে দেরী হয়। খুব বেশি না, মাত্র পাঁচ দশ মিনিট, কিন্তু সবাই এমন আচরণ করে যেন সে বিরাট ফাঁকিবাজ! কিই এমন ঘোড়ার আন্ডা ক্ষতি হয়ে যায় অফিসের?

কিন্তু না, তার বস মাহীন সাহেব এমন সব কথা শুনাবেন যে ইচ্ছে করবে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিতে। নিজের না, ঐ হারামজাদার। ব্যাটাকে মাছ কাটার চাপাতি দিয়ে কুচি কুচি করে কাটলেও যদি মনে একটু শান্তি আসতো!

এই মাহীন একটা আস্ত শুয়োরের বাচ্চা। 'শুয়োরের বাচ্চা' গালি দিলে নাকি চল্লিশ দিন নাপাক হয়ে যায়। সে নাপাক থাকতে রাজি আছে, তবু মাহীনকে সে শুয়োরের বাচ্চা বলবেই। হারামজাদা বদটা তার নিচের লেভেলের কর্মচারীদের মানুষ বলেই গ্রাহ্য করেনা। ইচ্ছে মতন অপমান করে। ফাইলে ছোটখাট ভুল পেলেই মুখের উপর ফাইল ছুড়ে ফেলে। চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে, "যত্তসব গরু গাধাকে বেতন দিয়ে পোষা হচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই পারেনা! শুধুশুধু গদি গরম করছে।"

সেদিন অফিসের পিওন মজনু কেঁদেই ফেলেছিল। চায়ে পিপড়া পাওয়া যাওয়ায় তার চৌদ্দ গুষ্ঠির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তুই শালা কোন নবাবের নাতি যে চা থেকে সামান্য পিপড়া সরায়ে খেতে পারবি না? চা ছুড়ে মজনুর শার্টটা ভিজিয়ে দিয়েছে। গালাগালি করে হুলুস্থূল!

মজনু ফোঁপাতে ফোঁপাতে নায়লা ম্যাডামকে বলছিল, "আমি গরীব বইলা আমার লগে এমন করেন? পেটের দায়ে চাকরি করি। চুরিতো করিনা।"

মাহীনের এই তেজ যদি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতো, তাহলে কোন অসুবিধা ছিল না। মেয়েদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েদের সাথে তার গলা আশ্চর্য রকমের মধুর। প্রতিটা মেয়ের সাথেই সে লাঞ্চে যেতে চায়। অফিস শেষে ঘুরতে যেতে চায়। সুন্দরী ম্যাডামদের কাছে মাঝে মাঝে ফুলের তোড়া উপহার পাঠায়। ব্যাটা কিন্তু বিবাহিত। এক বাচ্চার বাপ! তার উপরের লেভেলের কর্মচারীদের সাথেও তেল না মেরে কথা বলতে পারেনা। অথচ জুনিয়রদের সাথে গালাগালি না দিলে যেন চলেই না।

আজকে সামান্য একটা ভুল নিয়ে তাকে এত অপমান করলো যে তার ইচ্ছা করছিল অফিস থেকে ফেরার পথে হারামজাদাকে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত বাসের নিচে ফেলে দেয়।

ভুলটা কি ছিল? হারামজাদা চেয়েছিল আজিজ এন্ড কংয়ের ফাইল, সে এনে দিয়েছিল কাজী এন্ড কংয়ের ফাইল।

ফাইল খুলে হারামজাদা থমথমে গলায় বলল, "নিজাম সাহেব, আপনার বিবাহের কয়বছর পার হয়েছে?"

নিজাম বলল, "স্যার তিন বছর।"

"এখনও প্রতিরাতে স্ত্রীর সাথে সহবাস করেন?"

নিজাম অবাক হয়ে বলল, "জ্বী স্যার?"

মহিনের গলা শান্ত এবং নির্বিকার, "না মানে, অতৃপ্ত যৌন বাসনায় আপনার স্ত্রী হয়তো অন্য কারও সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে গেছে, এবং আপনি আপনার অক্ষমতা হেতু নিজের '….' গোনা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেন না।"

নিজাম আশপাশে তাকিয়ে দেখে অফিসের সবাই এদিকেই তাকিয়ে আছেন। সে অত্যন্ত বিব্রত স্বরে বলল, "স্যার এসব কি বলছেন? একটু ভদ্রতা রক্ষা...."

"ভদ্রতা?"

মাহিনের গলা চড়ে গেল।

"চামচিকার বাচ্চা! তুই আমাকে ভদ্রতা শিখাস? হারামজাদা! কাম করতে পারিস না, অফিসে বসে বসে '…' ছিড়িস, আর মাস শেষে বেতন নিস! তুই আমাকে ভদ্রভাবে কথা বলতে বলিস?"

মাহীনের পাশের ডেস্কের জামান সাহেব বললেন, "মাহীন সাহেব, কি হয়েছে?"

"হারামজাদাকে বললাম এক কোম্পানির ফাইল এনে দিতে, হারামজাদা আমাকে এনে দিয়েছে আরেক কোম্পানির ফাইল। ফাইজলামি পেয়েছে? আমার সময়ের দাম নাই? তাদের মত worthless কর্মচারী ভেবেছে?"

তারপর তার দিকে ফাইল ছুড়ে মেরে বলেছে, "যা শালা! এখুনি ঠিক ফাইল নিয়ে আয়।"

নিজাম মেঝে থেকে ফাইল কুড়িয়ে নিল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। করুনার চোখে। কেউ কিছু বলছে না। কী অপমান! কী অপমান!



লিপি অতি সাবধানে চুলায় পানি চাপালো। তার হাত কাঁপছে। বুক ধরফর করে লাফাচ্ছে। একটা ভীষণ ভয় তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। আজকে উনার ভাব গতিক সুবিধার ঠেকছে না। লিপি উনার এই রূপকেই ভীষণ ভয় করে।

লিপির জন্ম একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। খুব বেশি অর্থকড়ি তার বাবার কখনই ছিল না। কিন্তু তাদের দুইবোনকেই মা বাবা রাজকন্যার যত্নে বড় করেছেন। লিপি মনে করতে পারেনা বাবা কখনও তাদের দুই বোনের একজনেরও গায়ে হাত তুলেছিলেন কিনা। অনেক ছোটবেলায় মা একবার চড় দিয়েছিলেন, সেটাও তার নিজের দোষে। পরীক্ষায় ফেল করেছিল, টিচার বলেছিলেন অভিভাবকের সই নিয়ে আসতে, সে সেই খাতা ছিড়ে ফেলে দিয়েছিল। মা জানতে পেরে তাকে চড় মেরেছিলেন।

এক চড়েই তার জ্বর উঠে গিয়েছিল। সে কি উথাল পাথাল জ্বর! যেই মা চড় দিয়ে জ্বর তুলেছিলেন, সেই মা সারারাত মাথায় পানি ঢেলে জ্বর নামিয়েছিলেন।

লিপির ধারনা মাথায় ঢালা পানিতে নয়, তার জ্বর কমেছিল আসলে মায়ের চোখের জলে।

সে জ্বরে কাতরাতে কাতরাতেই বারবার মায়ের চোখ মুছতে মুছতে বলছিল, "কেঁদো না মা, আমি মোটেও রাগ করিনি।"

মা ততই হাউমাউ করে কাঁদেন।

লিপির মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।

মাকে যদি সে চিরদিন পাশে পেত!

মা বাবার পছন্দেই নিজামের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। তার নিজের পছন্দ ছিল নাসির নামের তার এক সহপাঠি ছেলে। ভীষণ রুপবান ছিল ছেলেটা। ঠিক যেন সালমান শাহর ফটোকপি! খুব শখ ছিল তার সাথে প্রেম করার। হলোনা। রূপবান ছেলেদের যে সমস্যা থাকে আর কি। আজকে এই মেয়ে তো কালকে সেই মেয়ের সাথে প্রেম করে বেড়াতো। শেষ পর্যন্ত রূপবান ছেলেদের প্রতিই তার বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল।

তার ধারনা ছিল নিজামের সাথে বিয়ে হওয়ায় সে সুখী হবে। তার বান্ধবীরা বলতো, যেসব পুরুষেরা জানে যে তারা দেখতে সুন্দর না, তারা তাদের স্ত্রীদের ভীষণ ভালবাসে।

অন্যান্য ছেলেদের ক্ষেত্রে কথাটা সত্যি হলেও হতে পারে, নিজামের ক্ষেত্রে তা হয়নি।

বাসর রাতেই সে এমনভাবে কথা শুরু করেছিল, যেন তাকে বিয়ে করে নয়, চাকরি দিয়ে এ বাড়িতে এনেছে।

"সকাল ছয়টার আগে ঘুম থেইকে উঠবা। সাড়ে ছয়টার মইধ্যে যেন আমি আমার নাস্তা রেডি পাই। নাস্তায় আমি তিনটা আটার রুটি আর একটা ডিম পোজ খাই। তুমি রুটি বানাইতে পারো? গোল হয়?"

লিপি প্রায় ফিসফিসিয়ে বলেছিল, "জ্বী, হয়।"

"খুব ভাল। রুটি গোল না হইলেও সমস্যা নাই। আটার রুটি ছিইড়্যা পেটেইতো যাইবো, গোল হইলেই কি, চারকোণা হইলেই কি? কিন্তু টেস্টে যেন কোন সমস্যা না হয়। তরকারী কি কি বানাইতে পারো?"

"অনেক কিছুই পারি।"

"দেখা যাইবোনে কি কি পারো। একটা কথা ইস্পষ্ট কইয়া দেই, লবণের যেন হেরফের না হয়। তাইলে তোমার মুখের মইধ্যে লবণের বাটি ঠেইশ্যা দিমু কইলাম। এখন শাড়ি-ব্লাউজ খুইল্যা একটু কাছে আস, বাসর রাত শুরু করি।"

একদিন অফিস শেষে তিনি থমথমে চেহারায় ফিরে এসেছিলেন।

লিপি এক কাপ চা নিয়ে দিল তার হাতে। মুখে চুমুক দিয়েই থু করে ফেলে দিয়ে বললেন, "এত গরম ক্যান! জিব্বা জ্বালায় দিল মাগী!"

নিজের স্বামীর মুখে এমন ভয়াবহ গালি শুনে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। সেটা দেখে তিনি আরও ক্ষেপে গেলেন, "চায়া চায়া দ্যাখতাছোস কি খানকি? যা ভাগ এইখান থেইকা!"

লিপি আহত গলায় বলল, "আমাকে আপনি গালি দিবেন না।"

এতেই তিনি তার উপর ঝাপিয়ে পড়লেন।

"তুই কোনখানকার কোন মহারানী আইছস যে তোরে সালাম ঠ্যাকায়া চলতে হইবো? পিটায়া আইজকা তোর তেল বাইর করতাছি, খারা!"

সেই যে শুরু, ব্যস, প্রায়ই বিভিন্ন বাহানায় লিপির গায়ে হাত উঠতে লাগলো।

প্রতিবাদ যে করবে সেটারও উপায় নেই। স্বামী ঘর থেকে বের করে দিলে সে যাবে কোথায়?

উনার এই লক্ষণ দেখলে সে তাই খুব সাবধান হয়ে যায়। গায়ে হাত তোলার কোন বাহানা দিতে চায়না।

চুলায় ফুটন্ত পানিতে চা পাতা সিদ্ধ করে দুধ চিনি মিশিয়ে একটু ঠান্ডা করে সে পাঁচটা সল্টেড বিস্কিটের সাথে নিজামের হাতে এনে দিল।

নিজাম থমথমে মুখেই কাপে চুমুক দিল।

লিপি কাচুমাচু গলায় জানতে চাইলো, "চা ঠিক আছে?"

নিজাম গম্ভীর স্বরে বলল, "হুম।"

লিপি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। যাক! বাঁচা গেল। আর ভয় নেই। এখন ফ্যানের বাতাসে ঠান্ডা হোক। মেজাজ খারাপ থাকলে কিছুক্ষণ টিভি দেখলে আপনাতেই ভাল হয়ে যাবে।

সে রান্নাঘরের দিকে রউনা হলো। রাতের খাবার রান্না করতে হবে। ইচা মাছ ভুনা। বাছতে সময় লাগবে।

"ঐ পোলাটা আইছিল ক্যান?"

লিপি অবাক হয়ে জানতে চায়, "কোন পোলা?"

"ন্যাকা সাজোস? এখন জানোস না কোন পোলা? নিচতলার ঐ হারামজাদা পোলাটা দরজার সামনে কি করতাছিল?"

কয়েক মুহূর্তের জন্য লিপি সোহেলের কথা ভুলেই গিয়েছিল।

"ও আচ্ছা। সে আসছিল চিনি দিতে। ঘরে চিনি ছিল না।"

"ক্যান? ওর কি চিনির কল আছে যে চিনি লইয়া তারেই আসতে হইলো? আর তুইও ব্লাউজের বোতাম খুইল্যা তার সামনে ঢলাঢলি করতেছিলি?"

লিপি সাথে সাথে তার ব্লাউজের বোতাম লক্ষ্য করলো। বোতামতো ঠিকই আছে। শুধু শুধু বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে কেন?

"আমারে দিয়া এখন আর মন ভরে না, না? ইয়ং পোলা লাগে? অ্যা?"

নিজামের গলার জোর বাড়ছেই।

লিপি এসে চাপা গলায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, "চুপ করেন! প্লিজ চুপ করেন!"

নিজামের রাগ আরও বেড়ে গেল। চায়ের কাপ ছুড়ে ফেলে এসে লিপির চুলের মুঠি ধরে তাকে প্রায় শুন্যে তুলে ধরলো।

"নটি মাগী! তুই বেশ্যামি কইরা বেড়াবি, আর আমি কথাও কইতে পারুম না?"

তারপর তাকে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল।

লিপি ছিটকে এসে আছড়ে পড়লো। উঠতে গিয়ে দেখে তার হাত কেটে গেছে।

কিছুক্ষণ আগে ছোড়া কাপ ভেঙ্গে মেঝেময় ছড়িয়ে গেছে। সেটারই কোন এক ভাঙ্গা টুকরায় তার হাত কেটেছে। বোধয় কোন রগ টগ কেটেছে, রক্ত গলগলিয়ে পড়ছে।

এত রক্ত দেখে লিপি ভয় পেয়ে গেল। নিজামের কোনই বিকার নেই। সে তার নিতম্বে জোরে লাথি মেরে বলল, "বেশ্যারে নিয়া আমি সংসার করতে পারুম না। তুই এখনই বিদায় হবি!"

লিপি বলল, "আপনার পায়ে পড়ি, আপনি চুপ করেন!"

চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে বাবুর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সে তাড় স্বরে কাঁদছে।

নিজামের মাথায় বোধয় গন্ডগোল হয়ে গেছে। সে উন্মাদের মত আচরণ করছে।

"কিসের লাইগা চুপ করুম? কাউরে ডরাই নাকি আমি? কাউরে পুছি? অ্যা?"

বলে সে সদর দরজা খুলে দিল। উৎসুক প্রতিবেশীরা আগে থেকেই দরজার ওপাশে কান পেতে উপস্থিত ছিল। এখন ভিতরের কর্মকান্ড স্পষ্ট দেখতে পারছে।

লিপি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে চাইল।

তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেও কেউ এগিয়ে এলো না নিজামকে থামাতে।

নিজাম এসে তার চুলের মুঠি ধরে তুলে প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যে বলল, "এই যে আমার বউ, নটিগিরি করে। আমি এই নটিরে ঘরে রাখুম না। বিদায় দিয়ে দিব।"

লিপি বাচ্চাকে সামলাতে ওদিকে যাবার চেষ্টা করতেই নিজাম সজোরে আরেকটা চড় দিল তার গালে। চড়ের জোর এত বেশি ছিল যে সে ছিটকে গিয়ে পড়লো বাবুর উপর। বাবু সমানে কেঁদে যাচ্ছে। মায়ের রক্ত দেখে সে কি বুঝলো সেই জানে। তার চেহারায় ভয় ফুটে উঠলো।

বাবুকে দেখে হঠাৎ লিপিরও মাথা এলোমেলো হয়ে গেল।

বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হলো যেসব শিশুরা মাকে বাবার হাতে মার খেতে দেখে, তাদের মানসিক বিকাশ ঠিক মতন ঘটে না। বড় হলে এরা ভাল মানুষ হতে পারেনা। হয় তারা বাইরে সন্ত্রাসী হয়, নাহয় ঘরে বউ পেটায়।

নিজাম যখন তাকে মারার জন্য আবার চুলের মুঠি ধরলো, তখন সে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নিজামের গালে একটা থাপ্পড় মারলো। নিজামের কোনই প্রস্তুতি ছিল না। সে স্তম্ভিত হয়ে গেল।

লিপি এবার আরেকটা থাপ্পড় মারলো। এবারেরটা আগেরটার চেয়েও জোরে। নিজাম ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেল। সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তার সব প্রতিবেশী তাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

মুহূর্তে তীব্র অপমানবোধ তাকে গ্রাস করে ফেলল।

সে ঘুরে দাঁড়ালো লিপিকে মারার জন্য। কিন্তু লিপির উপর যেন কোন দেবী ভর করেছে। সে সজোরে লাথি বসালো নিজামের কোমর বরাবর। নিজাম আবার মেঝেতে আছড়ে পড়লো।

প্রতিবেশীরা হায় হায় করে এগিয়ে এলো লিপিকে বাঁধা দিতে। লিপি হাতে ফুলদানি তুলে নিয়েছে। পিতলের ফুলদানি, আঘাত লাগলে খবরই আছে। ভয়ে কেউ কাছাকাছি এলো না।

লিপি এবার মুখ খুলল, "হারামির বাচ্চা! কি মনে করছিলি, যত খুশি মারবি, আমি চুপচাপ হজম করে যাব? এখন কেমন লাগে মার খেতে? আমারও তেমন কষ্ট হয়।"

নিজাম বিষ্ফোরিত চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে তার স্ত্রী না। এই মেয়ে অন্য কেউ! জ্বিনে ধরেনিতো?

একজন প্রতিবেশী (বরকত সাহেব) বললেন, "ভাবি, শান্ত হোন। শান্ত হোন। উনি আপনার স্বামী।"

লিপি লোকটার উপর গর্জে উঠলো, "তুই চুপ থাক শালা ‘স্বামীর দালাল!’ যখন আমাকে মারতেছিল, তখন তারে থামাইতে পারোস নাই? এই হারামজাদাকে আমি মেরে বিধবা হবো।"

নিজাম ল্যাংচিয়ে ল্যাংচিয়ে দরজার বাইরে চলে গেল। সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। বউর হাতে মার খেয়ে সে প্রাণ হারাতে চায়না।

লিপি এক হাতে ফুলদানি সহ আরেক হাতে বাবুকে কোলে তুলে নিল। তারপর বরকত সাহেবকে বলল, "আমার জন্য একটা সিএনজি নিয়ে আসেন। মধ্য বাড্ডা, গুদারা ঘাটের সামনে যাব। মিটারে যেতে না চাইলে একটা থাপ্পড় দিবেন। আমি এই জানোয়ারের সাথে আর এক দিনও থাকবো না।"

মধ্যবাড্ডা গুদারা ঘাট লিপির মায়ের বাসা। আপাতত সেখানেই যাবে সে। যদি মা বাবা ফিরিয়ে দেন, তাহলে কোন কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল, অথবা অন্য কোথাও উঠার ব্যবস্থা করবে সে। কোটি মানুষের ঢাকা শহরে তার নিজের এবং বাবুর থাকার জন্য কোন না কোন আশ্রয় সে ঠিকই খুঁজে বের করতে পারবে।

তবে কোন অবস্থাতেই এই বাড়িতে ফেরা যাবেনা। এখন নিজাম বাটে পড়েছে, কিন্তু একটু গুছিয়ে উঠতে পারলেই সে প্রতিশোধ নিবে। তাকে যদি মেরেও ফেলে অবাক হবার কিছু নেই। এরচেয়ে বাইরের পৃথিবীতে কষ্ট করে বেঁচে থাকা অনেক ভাল।

কুকুর একবার পাগল হয়ে গেলে যেমন তাকে মেরে ফেলতে হয়, স্বামীও একবার গায়ে হাত তুললে তাকে ছেড়ে দিতে হয়। সে অনেক সুযোগ দিয়েছে। নারী নির্যাতনের এই অপরাধে সে নিজেই আসলে সবচেয়ে বড় অপরাধী। সে প্রতিবাদ করেনি বলেই এতদিন মার খেয়েছে।

বরকত সাহেবের স্ত্রী এসে বুঝাতে চাইলেন, "ভাবি, সংসারে টুকিটাকি এইসব হয়ই, মাথা গরম করলে...."

লিপি সোজাসাপ্টা জবাব দেয়, "আপনার যদি মার খেয়ে সংসার চালাতে হয়, তাহলে আপনি এই হারামজাদাকে বিয়ে করেন। আমি চললাম। একা থাকবো, তবু এর সাথে এক মিনিটও না।"

বরকত সাহেব নিজামের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালেন। নিজাম ভীত। ভীষণ ভীত। সে এই অগ্নিমূর্তির সামনে দাঁড়াবার সাহস করছে না।

লিপি তাকে হুকুম দিল, "একটা ব্যাগে আমার কাপড় গুছিয়ে দে! এখুনি!"

নিজাম সুরসুর করে স্ত্রীর হুকুম তালিম করলো।





সিএনজি ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে সোহেলের সাথে দেখা।

ব্যান্ডেজ, ওরনা, পট্টি প্যাচানো রক্তাক্ত লিপির দিকে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

উপরের এতসব ঘটনার সে কিছুই জানেনা। হঠাৎ কি হলো যে মেয়েটার মুখ ফুলে উঠেছে? হাতে, জামায় এত রক্তের ছোপ?

সে ঘটনা আন্দাজ করে নিল।

লিপি স্বভাবসুলভ অতি অমায়িক হাসি হেসে বলল, "আপনার পাঁচ চামচ চিনি ধার রইলো, মনে করে নিজামের কাছ থেকে নিয়ে যাবেন কিন্তু! আপনার সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিকভাবেই দুঃখিত! আসি, কেমন?"

সোহেল চোখ বড় বড় করে বিড়বিড় করে বলল, "হায়রে ফর্মালিটিজ!"

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৫:১৩

কুচ্ছিত হাঁসের ছানা বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন। ভাল লেগেছে গল্পটা।

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৭:২৭

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ! :)

২| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১৫

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: অসাধারণ +++++++ কিছু কিছু সময় গল্প সত্য হয়ে ওঠা খুবই জরুরী ।

ভালো থাকবেন :)

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:১৫

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: থ্যাংকস! :)

৩| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৩৭

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
ভাল লিখেছেন ৷ তবে শেষের দিকটা কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক বা অভূতপূর্ব লাগছে ৷ ভেবে দেখতে পারেন ৷

মঙ্গলার্থে.......

৪| ০১ লা অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১১:৪৬

ব্লগার রানা বলেছেন: পুরাই '...........' হয়া গেলাম

৫| ০১ লা অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১১:৪৭

ব্লগার রানা বলেছেন: ভাইজান প্লিজ পার্ট ২ দিয়েন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.