নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুর চৌধুরী

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!

মঞ্জুর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইকবাল ফারুক। আমার বন্ধু। আমার ভাই।

০৭ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:৪৫

আমি ছোটবেলা থেকেই খুব একটা মিশুক স্বভাবের নই। কেউ না মিশলে সহজে কারোর সাথে আগবাড়িয়ে বন্ধুত্ব করতে পারিনা। বেশিরভাগই মনে করেন আলগা ভাব নিয়ে থাকি হয়তো। বাস্তবে আমি খুবই লাজুক স্বভাবের। চিনি না, জানিনা, আগবাড়িয়ে এমন কিছু না বলে ফেলি যার ফলে সে কিছু না কিছু মনে করে বসতে পারে। কী দরকার?
অতি মিশুক স্বভাবের বিড়ম্বনার একটি উদাহরণ দেয়া যাক। আমার অফিসের এক সাবেক সহকর্মী ছিল এই স্বভাবের। খুবই মিশুক প্রকৃতির। এমনভাবে কথাবার্তা শুরু করে যেন কারোর বহুদিনের চেনা।
একদিন লিফটে সে এক মহিলাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, "তোমার সুসংবাদের ডিউ ডেট কবে?"
মহিলার পেট ছিল বিশাল, সে ধরেই নিয়েছে মহিলা গর্ভবতী এবং তাই বেচারা জানতে চাইলো মহিলার বাচ্চা কয় তারিখে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে।
সাধারণত এই প্রশ্নের উত্তর গর্ভবতী নারীরা অতি আনন্দের সাথেই দেন।
এক্ষেত্রে মহিলা কিড়মিড় করে জবাব দিলেন, "I'm not pregnant!"
বেচারার তখন ইচ্ছা করলো লিফটের দরজা খুলে যাক, এবং সে সেখান থেকেই নিচে ঝাঁপিয়ে পরে!
তো যা বলছিলাম।
আমার এই অতি অমিশুক স্বভাবের কারণেই আমার বন্ধু তালিকাটা তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট। মিশতাম ঠিকই সবার সাথে, বিরোধ ছিল না কারোর সাথেই - কিন্তু ইয়ার দোস্ত পর্যায়ের বন্ধু আমার খুব একটা ছিল না। এক বেঞ্চিতে যতজনের জায়গা হতো, এবং তার পেছনের বেঞ্চিতে যারা বসতো - তারাই ছিল আমার বন্ধু।
কলেজে উঠে বন্ধু তালিকা আরেকটু ছোট হলো। এক কলেজে পড়া হলো না, কেউ চলে গেল সিলেটের বাইরে। আমি, ইকবাল এবং সামি রয়ে গেলাম এমসি কলেজের একই শাখার ছাত্র।
আমরা তিনজন সাইকেলে চড়ে কলেজে যেতাম। একসময়ে উপলব্ধি করলাম আমাদের কলেজে যাওয়া না যাওয়ায় প্রফেসরদের কিছুই আসে যায় না। একেক শাখায় দেড়শোর বেশি ছাত্র, কয়জনের প্রতি লক্ষ্য রাখা যায়?
আমরা ক্লাস কামাই দিতে শুরু করলাম। প্রাইভেট কোচিংয়ে যা পড়াশোনা হয় - সেটাই আমাদের পুঁজি।
চোখের পলকেই এইচএসসি চলে এলো - কলেজ জীবন শেষও হয়ে গেল। আমি এবং ইকবাল ঢাকায় চলে এলাম। বাকিরা থেকে গেল সিলেট।
দুইজন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আমি থাকতাম ফুপুর বাসায়, পরে নানুর বাসায় - ইকবাল থাকতো শান্তিবাগের একটি মেসে।
প্রতি উইকেন্ডে আমি চলে যেতাম ওর মেসে। সারারাত গল্প হতো, সিনেমা দেখা হতো, সকালে ভাগিনার হোটেল নামের একটা সস্তা রেস্তোরায় নাস্তা করা হতো। পরোটা, ডাল, এবং ডিম পোজ এখনও আমার সবচেয়ে প্রিয় সকালের নাস্তা। দেশে গেলে সবার আগে আমি যেটা করি তা হচ্ছে রাস্তার ধারের কোন সস্তা হোটেলে গিয়ে এই নাস্তা করি। প্রতিবার আমার সঙ্গী হয়েছিল ইকবাল। এমনকি বিয়ের সময়ে গুলশানের বিলাসবহুল হোটেলে সকালের বিদেশী, হেলদি, নিউট্রিশাস নাস্তা বাদ দিয়ে আমি যখন ছাপড়া হোটেলের ডাল, ডিম পোজ খেতে গিয়েছি - ইকবাল ছিল আমার সঙ্গী।
আমার স্ত্রীর সাথে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন আমরা "জাস্ট ফ্রেন্ডস।" মানে ওর তরফ থেকে আমরা কেবলই বন্ধু, আমার তরফ থেকে আমি ১০০% প্রেমিক। ও কিছুতেই ওর মা বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করবেনা। এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের এক সহপাঠী ছাত্রের সাথে কেন কোন বাবা মা নিজের মেয়েকে তুলে দিবেন?
প্রতি সপ্তাহে ওর বিয়ের প্রস্তাব আসে। আমি উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনায় বসে যাই। এবং একমাত্র ইকবালের সাথে খোলাখুলি সেসব দুঃসহ অনুভূতিগুলো শেয়ার করি। ইকবাল ছিল আমার অতি দুঃসময়ের পরম বন্ধু।
চলে এলাম অ্যামেরিকা। লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ ধরে রাখা অতি দুঃসাধ্য কর্ম। আমার সাহায্যে এগিয়ে এলো ইকবাল।
ওর কাছে টাকা দিয়ে বলি ওর জন্মদিনে অমুক জিনিস কিনে, তমুকভাবে ওর দরজার বাইরে রেখে আমাকে মিস কল দিতে। আমি দেশে ফোন করে ওকে দরজা খুলতে বলতাম। তিন্নি যখন সারপ্রাইজড হতো ইকবাল তখন ওদেরই সিঁড়ির অন্ধকার কোণে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে কনফার্মেশন দিচ্ছে!
আমার বিয়ের পর সামি এলো লন্ডন থেকে। বহুদিন পর আমরা সব বন্ধুরা এক হলাম। ইকবালের বাবা ততদিনে ঢাকায় বাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। ও আর মেসে থাকে না। সে বাড়িতে রীতিমতন যুদ্ধ করে সিলেটে এলো আমাদের সবার সাথে সময় কাটাতে। ও চায় আমরা সবাই মিলে লালাখাল যাই। এরচেয়ে সুন্দর স্থান নাকি বাংলাদেশেই নেই।
আমরা গেলাম। আসলেই তাই। কেরোসিনের মতন নীল পানি। এত স্বচ্ছ পানির নদী দেশে আর কোথাও আছে বলে আমার ধারণা নেই। আরামসে বিশ পঁচিশ ফিট নিচের বালি স্পষ্ট দেখা যায়।
এবং তাঁর অতি প্রিয় সেই স্থানের সেই অতি স্বচ্ছ পানিতে গোসল করতে গিয়েই সে আমাদের চোখের সামনেই হারিয়ে গেল।
আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, পেলাম না। সে ডুবেছিল দুপুরে, রাত পর্যন্ত আমরা সেখানে ছিলাম। জাল ফেলা হলো। ইকবাল উঠে এলো না।
পরেরদিন ডুবুরি নামানো হলো। তার পরের দিনও। এবং তার পরের দিনও না।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডুবুরিরা পানির নিচে খুঁজতে লাগলো। ইকবালের কোন খোঁজ নেই।
অমন একটি জংলী জায়গায় সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটিকে ওভাবে একা ছেড়ে আসার অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই!
আমি জানি ও আর বেঁচে নেই। তবু ওর লাশ খুঁজে না পাওয়া কেন যেন একটা আশার আলো দিচ্ছিল - হয়তো সে বেঁচে আছে। স্রোতহীন নদীতে হয়তো কোথাও ভেসে গেছে - আমরা অবশ্যই তাঁর সন্ধান পাবো।
অবশেষে সাত তারিখ সকালে আমরা ফোন পেলাম। লাশ পাওয়া গেছে।
আমরা চিকেন পক্স তখন তুঙ্গে। বুক পিঠ ছেয়ে গেছে গুটিতে। জ্বরে বিছানা ছাড়া দায়। তবু আমি জেদ ধরলাম, আমি যাব।
এবং এক ঘন্টা পর আমার বন্ধু আমাদের সামনে শুয়ে ছিল।
নিথর।
মুখ ঈষৎ খোলা। চোখ ফোলা।
চোখ দিয়ে পানি আসছে না। কাঁদতে ইচ্ছা করছিল। পারছিলাম না।
সামিরও একই অবস্থা। আশফাকেরও। তারেক - রুবেলও তাই।
কয়েকঘন্টা চাটিতে শুয়ে থাকার পর অবশেষে ওকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এম্বুলেন্স এলো। ও বেঁচে থাকার সময়ে কতবার চেয়েছিল আমরা যেন ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে একবার ঘুরে আসি। যাব যাব করেও কখনই যাওয়া হয়নি। এইবার আমরা ঠিকই যাচ্ছি। শুধু ও থাকবে না।
আবারও একদিন আমি রাস্তার হোটেলের পরোটা ডাল এবং ডিম পোজ দিয়ে নাস্তা করবো - ও আমার সঙ্গী হবেনা।
দুঃসময়ে আমার মন হালকা করার সাথীটি থাকবে না।
একটা সময়ে আমি সামিকে জড়িয়ে ধরলাম। আমি সামি এবং ইকবাল ছিলাম তিন ভিন্ন মায়ের পেটের সন্তান। আমরা ছিলাম ভাইয়ের চেয়েও আপন। আমরা ছিলাম বন্ধুর চেয়েও পরম বন্ধু।
হাউমাউ করে কান্না ছুটলো একেকজনের। বুক নিংড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো সব কষ্ট।
আমাদের অন্যান্য বন্ধুরাও একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রওনা হলো এম্বুলেন্স। কাঁদছি আমরা।
আমাদের বন্ধু চলে গেল আমাদের ছেড়ে। আমরা কেউই তাঁকে ধরে রাখতে পারলাম না।
অতিব্যক্তিগত এক অনুভূতি। প্রতি তিন থেকে সাতই মার্চ মনে পরে যায় ঘটনাটি। পরম সুখের দিনেও মনটা উদাস থাকে এই দিনগুলোতে। ইকবাল ছিল খুবই মিশুক স্বভাবের। আমার এবং সামির সম্পূর্ণ বিপরীত। ওর কোন শত্রুর দেখা আমি পাইনি আজ পর্যন্ত। তাঁর মৃত্যুতে এত মানুষের ভালবাসা পেতে দেখে হিংসে হচ্ছিল খুব। সেই সাথে গর্বও। এত কম সময়ে ও যত মানুষের ভালবাসা পেয়েছে, আমি আশি নব্বই বছর বাঁচলেও পাবো কিনা সন্দেহ। এক জীবনে আর কী লাগে?
পরকালেও ভাল থাকুক ইকবাল ফারুক। আমার বন্ধু। আমার ভাই।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:৫৭

ওমেরা বলেছেন: আল্লাহ উনাকে জান্নাত দান করুন । আমীন

০৭ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১:০৩

মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: আমীন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.