নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুর চৌধুরী

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!

মঞ্জুর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আইসিস

০৮ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ৯:৫৩

তামিমের সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটা মনে নেই। পঁচিশ ছাব্বিশ বছর আগের ঘটনা, ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ি তখন। কত ঘটনা ঘটে গেল এর মাঝে! স্থায়ী ঠিকানার শহর বদলালো, একসময়ে জন্মভূমির শেকড়টাও ছিঁড়তে হলো। বহু মানুষ আসলেন জীবনে, অনেকে হারিয়েও গেলেন; এতজনের ভিড়ে এখনও যে তামিমের নামটা মনে আছে, সেটাও কম না। অবশ্য ভুলবোই বা কি করে? শৈশবের উজ্জ্বলতম কিছু অধ্যায়ের সাথে সে সরাসরি জড়িত ছিল, ওকে ভুলতে গেলে যে শৈশব সাদাকালো হয়ে যাবে!

আমরা তখন মাত্রই সিলেট শহরে নিজেদের বাড়িতে থাকতে শুরু করেছি। তিন তলা বাড়ির দোতলায় আমরা থাকি। নিচতলায় প্রথম ভাড়াটে হিসেবে আসে মামুনরা (ছদ্মনাম ব্যবহার করছি। সংগত কারনে তামিম ছাড়া আর কারোরই আসল নাম ব্যবহার করবো না।)। বয়সে আমার চেয়ে এক দুই বছরের ছোট ছিল সে, তাই খেলার সঙ্গী পেয়ে আমরাও খুবই আনন্দিত।
মামুনের বাবা বহু আগেই মারা গেছেন। বিধবা মায়ের সে একমাত্র জীবিত সন্তান। আন্টির সাথে তাঁর ফ্ল্যাটে থেকে পড়াশোনা করেন মামুনের খালাতো ভাই বোনেরা, আর একজন মামাও থাকেন ঘরে।
আমরা শীতের বিকালে ক্রিকেট খেলি, বর্ষায় খেলি ফুটবল। মামুনের এক খালাতো ভাই সালমানও (এটিও ছদ্মনাম) আমাদের খেলার সঙ্গী। বয়সে সালমান ভাই আমার চেয়ে এক বছরের বড়।
আনন্দের পরিমান কয়েকগুন বাড়িয়ে দিতেই কয়েক মাসের মধ্যে জানতে পারলাম ওদের এক আত্মীয় চিটাগং থেকে সিলেট চলে আসছে। থাকবে যদিও পাশের পাড়ায়, তবে হাঁটা পথে সেটা মাত্র পাঁচ মিনিট দূরত্বে। তামিম ঐ পরিবারেরই ছেলে, বয়সে মামুনের সমান। আরেকজন খেলার সঙ্গী যুক্ত হচ্ছে!
তাছাড়া আমরা নিজেরাও চিটাগং থেকে কয়েক বছর হলো মাত্র এসেছি। চিটাগং ছিল আমাদের জন্মভূমি, আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের ভালবাসার শহর। তামিমের প্রতি তাই একটা বাড়তি টান অনুভব করলাম।
এরপরে একদিন তামিমের সাথে পরিচয়। দিন ক্ষণ মনে নেই। তবে মনে আছে সে খুব ভাল স্পিন বল করতে পারতো।
সেযুগে আমরা সবাই ফাস্ট বোলার হতে চাই। দশ বছর বয়সের শরীরে তেমন জোর নেই, তবু প্রতিটা বল ছোড়ার সময়ে জীবন উজাড় করে দেই। তামিমই আমার জীবনে দেখা প্রথম স্পিনার। যে কিনা বল ছোড়ে খুবই আস্তে, কিন্তু পড়ার পরে পলক না ফেলতেই সেটা স্প্রিংয়ের মতন লাফিয়ে অন্যদিকে মোড় নিয়ে নেয়। ওভারের পর ওভার বল করে যায়, ক্লান্ত হয়না। ব্যাটসম্যান সহজে খেলতেও পারে না, বেশিরভাগ সময়েই আউট হয়। দারুন ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!
এতটাই ক্রিকেট খেলার প্রেমে পড়লাম যে ফুটবল বাদ দিয়ে বর্ষাতেও ব্যাট বল নিয়ে লড়াইয়ে মেতে উঠতাম।
মনে আছে একদিন সে আমাকে বুদ্ধি দেয় কেননা আমরা একটা খেলার ক্লাব খুলে বসি। যেহেতু ভাল খেলোয়াড়ের অভাব নেই, আমরা চাইলেই নিজেরা একটা দল গড়ে অন্যান্য দলের বিরুদ্ধে খেলতে পারি।
বুদ্ধিটা খুবই ভাল লাগলো। জন্ম হলো "শিশু ক্লাবের।" আমরা ক্রিকেট দল গড়ে ফেললাম। আমি ক্যাপ্টেন (তখন আমি ব্যাটিং বোলিং দুইই ভাল খেলতাম, তাই দলের সবাই আমাকেই ক্যাপ্টেন বানালো), তামিম সহ অধিনায়ক (সেও দুর্দান্ত বোলার, এবং মোটামুটি কাজ চলে এমন ব্যাটসম্যান ছিল এবং সবাই তাঁকেও মান্য করতো)। প্রথম ম্যাচের আয়োজকও সে ছিল। নিজের পাড়ার ছেলেদের সাথে কথা বলে একটি ম্যাচ ঠিক করে ফেলে। খেলা হবে ওদেরই মাঠে।
ম্যাচের দিন আমরা বিপুল উৎসাহে ওদের মাঠে খেলতে গেলাম। আমাদের জীবনের প্রথম কোন ফ্রেন্ডলি ম্যাচ! তাও ভিন্ন পাড়ায়, ভিন্ন মাঠে। তখন পিচ টিচ ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতাম না। বাইশ ব্যাট সাইজের একটা জায়গাকেই পিচ বানিয়ে খেলা চালিয়ে নিতাম। কোদাল দিয়ে ঘাস ছেঁচে ন্যাড়া করা হয়েছে নাকি সবুজ ঘাসের উপরই খেলা হচ্ছে এই নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করতাম না। বলার বল করবে, ব্যাটসম্যান ব্যাট চালাবে, এই ছিল সহজ সরল পরিকল্পনা।
দুর্দান্ত দাপটের সাথে সেই ম্যাচ জয় করে এলাম।
আমি হয়েছিলাম ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান এবং বোলিং করে দুইটি উইকেট নিয়েছিলাম সেদিন। গলায় দুইটি মেডেল এবং ট্রফি হাতে সে আমাদের কি আনন্দ! পাড়ায় বিজয় মিছিলও করেছিলাম মনে আছে।
সে ম্যাচে তামিম খুব ভাল বল করেছিল। উইকেট নিয়েছিল এবং ব্যাটিংয়েও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ওর ব্যাট থেকেই এসেছিল। আমার এবং ওর পার্টনারশিপের উপরই আমরা মোটামুটি একটা স্কোর দাঁড়া করাতে পেরেছিলাম।
তামিম খুব ভাল ছাত্রও ছিল। স্কুলে ফার্স্ট সেকেন্ড হতো। অগা মগা কোন স্কুলে সে পড়তো না, সিলেট পাইলট স্কুলের ছাত্র ছিল সে। তখন সিলেটের সেরা দুই তিনটা স্কুলের একটি ছিল সেটি। যতদূর মনে আছে, বৃত্তি পরীক্ষাতেও সে টপ রেজাল্ট করেছিল।
খুব কম সময়ে পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সাথেও ওর ভাল সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। প্রধান কারন ছিল ওর সুন্দর আচার আচরণ ও ব্যবহার। সুন্দর করে কথা বলতো, ধৈর্য্য ধরে কথা শুনতো, কোন ঝগড়াঝাটিতে যেত না। ওর আত্মীয়, যার মাধ্যমে ওর সাথে সবার পরিচয়, মামুনের সাথে যেমন সবার ঝগড়া লেগে যেত। আমার সাথেই কতবার ঝগড়া হয়ে কথা বলাবলি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল! কিন্তু তামিমের সাথে কখনই এমনটা হয়নি।
তাই যখন তামিম ওর পরিবারের সাথে কানাডা চলে গেল, খুবই মন খারাপ হয়েছিল সেদিন। আশা ছিল পাঁচ ছয় বছর পরপর ও দেশে বেড়াতে আসবে। আমার চাচাওতো আমেরিকা থাকেন, তাঁরা এইরকম সময় ব্যবধানেই দেশে আসেন। তামিমের সাথেও নিশ্চই দেখা হবে।
তাই তামিম যখন শেষবারের মতন হাত নেড়ে বলেছিল "খোদা হাফেজ!" তখনও মনের ভিতর একটা আশা ছিল। পৃথিবীটা খুবই ছোট এবং জীবনটা অনেক বড়। নিশ্চই দেখা হবে।
যদিও ফেসবুক পূর্ববর্তী যুগ ছিল তখন। একবার কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আর সহজে খুঁজে পাওয়া যেত না।
তামিমরা এরপরে দেশে এসেছিল কিনা জানিনা। মামুনরা আমাদের বাসা ছেড়ে ভিন্ন পাড়ায় চলে যায় এর বছর দুয়েকের মধ্যেই। ধীরে ধীরে ওদের সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
"শিশুক্লাব' একদিন বন্ধ হয়ে গেল।
আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি পড়ালেখা ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধব নিয়ে। এসএসসি গেল, এইচএসসিও গেল। চলে এলাম ঢাকা। নতুন শহর, নতুন বন্ধুবান্ধব, নতুন জীবন। কিন্তু সেটা গুছিয়ে বসার আগেই আবারও ঠিকানা বদল। এইবার পৃথিবী নামক গোলকটার ঠিক উল্টো দিকের দেশ, আমেরিকা!
ফেসবুক ততদিনে অনেক কাজে লাগাচ্ছি। ক্যানভাস নিয়ে মারাত্মক ব্যস্ত। মাঝে মাঝেই পুরানো বন্ধুবান্ধব খুঁজে পাই, যাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তাঁদের সাথে গল্প করতে পেরে ভালই লাগে। শৈশবের বন্ধু জিফরান-জেরিফ-মিনহাজ ভাইয়া (এদের নামগুলো আসল); যাদের সাথে সেই ১৯৯২ সালে চিটাগং ছাড়ার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম, তাঁদেরও খুঁজে পেলাম। তেমনই একবার কৌতূহল বশতই মামুনের নাম লিখে ফেসবুকে সার্চ দিলাম। এবং তাঁকে খুঁজেও পেলাম। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম। দেখি এড করে না। ম্যাসেজ পাঠালাম, হয়তো পুরো নামে চিনতে পারেনি, হয়তো ডাক নামে চিনবে। কোন সাড়া নেই। ম্যাসেজ দেখেওনি। ওর ফেসবুক খানিকটা ঘাটলাম। দেখি সে দুর্দান্ত কার্টুনিস্ট হয়েছে। ভাবলাম হয়তো সে এখন সেলিব্রেটি হয়ে গেছে। অসংখ্য নোটিফিকেশনের ভিড়ে আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এবং ম্যাসেজ দুইটাই হারিয়ে গেছে।
একই দোষে আমি নিজেও দুষ্ট। ফেসবুকের অন্যতম বৃহত্তম গ্রূপের অ্যাডমিন হওয়ায় প্রতি মিনিটে দশের বেশি নোটিফিকেশন জমা হয়। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও আসে প্রচুর। এত ভিড়ে অনেক সময়েই জরুরি নোটিফিকেশনগুলো হারিয়ে যায়।
সেদিন আমার ছোটভাই জানালো মামুনের কাজিন সালমান ভাই (ছদ্মনাম) থাকে নিউ ইয়র্কে। ওর সাথে নাকি নিয়মিতই যোগাযোগ হয়।
সালমান ভাইর কথা উপরে বলেছি। তাঁর বাবা ছিলেন প্রবাসী, তিনি মামুনদের ফ্ল্যাটে থেকে সিলেটে পড়াশোনা করতেন। আমাদের শিশু ক্লাবের একজন তারকা ব্যাটসম্যান ছিলেন। ভিন্ন পাড়ার দলের বিরুদ্ধে এক ম্যাচে আমি করেছিলাম তিপ্পান্ন রান, সেই ইনিংসেই তিনি করলেন ৮৮ নট আউট। অবিশ্বাস্য এক ইনিংস ছিল! শিশু ক্লাবের হয়ে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। আমার সবসময়ে জেদ থাকতো দলের হয়ে প্রতি ম্যাচে সর্বোচ্চ রান আমিই করবো। কিন্তু সেই রেকর্ডের ধারে কাছেও যেতে পারিনি।
প্রায় দুই যুগ পরে কথা হলো। এ কেমন আছে, ও কেমন আছে সব জানা হলো। জানলাম মামুনের অবস্থা ভাল না। এক মেয়েকে ভালবেসেছিল, পরিবার মেনে নেয়নি, মেয়েটির অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এখন সে কারোর সাথেই কথাবার্তা বলেনা। চুল দাড়ি কাটেনা, চেহারার যত্ন নেয়না। জীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে গেছে।
আমার ম্যাসেজের রিপ্লাই কেন দেয় না, সে উত্তর বুঝে নিলাম।
জানতে পারলাম মাহিন ভাই (ছদ্মনাম) এখন দারুন সফল ব্যবসায়ী। সিলেট শহরে তিনি বেশ প্রতিষ্ঠিত। তাঁর বোন সোমা (ছদ্মনাম) আপুও এখন সিলেটে প্রতিষ্ঠিত। এরাই থাকতো মামুনদের বাসায়, পড়াশোনা করতো সিলেটের কলেজে।
খোঁজ নিলাম তাঁদের অন্যান্য খালাতো চাচাতো ভাই বোনদেরও। সে সময়ে সবার সাথে পরিচয়, কথাবার্তা ছিল। ওদের আত্মীয় যেন আমাদেরও আত্মীয় ছিল। বৰ্ণা আপু (ছদ্মনাম), যে ছিল আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দরতম মেয়েদের একজন, সে শুনলাম নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকে। স্বামী সন্তান নিয়ে বিরাট সংসার তাঁর।
সবাই সুখে আছে, সবাই ভাল আছে। জেনে ভাল লাগলো।
কথা প্রসঙ্গেই তামিমের কথা জিজ্ঞেস করলাম।
"আচ্ছা, তামিম কেমন আছে? ওর সাথে যোগাযোগ আছে তোমার? আমি ওর ভাল নাম ভুলে গেছি, তাই ফেসবুকে সার্চ দিয়ে খুঁজে পাচ্ছি না।"
সালমান ভাই যেন বিরাট ধাক্কা খেলেন। একটু থমকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি জানোনা তামিম সম্পর্কে?"
আমার ধারণা ছিল তামিম ডক্টরেট পোস্ট ডক ইত্যাদি করে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হয়ে রিসার্চ টিসার্চ টিম লিড করছে হয়তো। কিংবা বড় কোন কোম্পানির ভিপি, বা একজিকিউটিভ ম্যানেজমেন্টে চলে গেছে নিশ্চই। কিন্তু সালমান ভাইর কথা ও কণ্ঠস্বরেই বুঝতে পারলাম বিরাট কোন দুঃসংবাদ আমি শুনতে যাচ্ছি। হয়তো সে মারা গেছে। ইকবাল যেমন পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল, ঠিক সেভাবে। কিংবা হয়তো অসুস্থতায় মারা গিয়ে থাকবে। এই যুগে অনেক অল্প বয়সী ছেলেকেও দেখেছি হার্ট এটাকে মারা যেতে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় সহপাঠী ইফরাজতো এই সেদিন মারা গেল। এছাড়াও অনেক সহপাঠী, জুনিয়র বা এক দুই বছর সিনিয়রদেরও হারিয়েছি। তামিমও কি ওদের দলে নাম লিখিয়েছে? মন আফসোস করে উঠলো। আহারে!
"না। আমি কিছু শুনিনি ওর ব্যাপারে। কি হয়েছে?"
সালমান ভাই প্রথমে একটু ইতস্তত করলেন। তারপরে বললেন, "তোমাকে খুব বেশি ডিটেইলে বলতে পারবো না, শুধু জেনে রাখো, বাংলাদেশে হোলি আর্টিসানে যে হামলা হয়েছিল...."
আমার মাথায় সাথে সাথে এলো, তবে কি তামিম ভিকটিম তালিকায় ছিল? ইশ!
সালমান ভাই বলে চললেন, "যারা হামলা করেছিল, তাদের মূল পরিকল্পকের নাম মনে আছে?"
আমি নাম মনে করার চেষ্টা করলাম। জবাবটা নিজেই দিল সালমান ভাই।
"তামিম চৌধুরী।"
মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমার মাথায় শুধু আকাশ না, ওতে বিরাজমান গ্রহ তারা নক্ষত্র সব যেন আছড়ে পড়লো।
"বলো কি! Are you serious?"
সালমান ভাই বললেন, "ইয়েস। ওর পরিবার ছিল, বৌ ছিল, বাচ্চা ছিল - সবাইকে ফেলে সে এই কাজ করেছে।"
দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। আর দাঁড়াতে পারলামনা। বসে পড়লাম।
"মানে কি? কিভাবে? কেন?"
"সেটাইতো জানিনা। আমি যখন পত্রিকায় ওর ছবি দেখি, তখন বৌকে বলছিলাম এই ছেলেটাকে চেনা চেনা লাগছে। বৌ বলেছিল, 'তুমিতো পারলে দুনিয়ার সবাইকেই চিন।' এর কিছুদিনের মধ্যেই আম্মা ফোনে জানালো এই তামিমই সেই তামিম।"
আমার মাথায় তখনও কিছুই ঢুকছে না। কি করে সম্ভব? শৈশবে অনেক ধরনের, অনেক জাতের ছেলের সাথেই আমি মিশেছি। কোন অবস্থাতেই আমি কল্পনা করতে পারিনা আমাদের তামিম ঠান্ডা মাথায় মানুষ হত্যার পরিকল্পনা করতে পারে। এত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট! যার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ছিল নিশ্চিত। যাকে দেখিয়ে আমাদের সবার বাবা মায়েরা বলতেন কেন ওর মতন রেজাল্ট করতে পারিনা!
হোলি আর্টিসানের ঘটনার পরে একটি ভিডিও বের করেছিল আইসিস, যেখানে বাংলাদেশী কিছু যুবক জিহাদের (!?) ডাক দিয়েছিল। তাদের একজনকে আমি চিনতাম। আমাদের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির আইকোনিক স্টুডেন্ট, তাহমিদ ভাই। যে একই সাথে পড়ালেখা, ড্রামা ক্লাব, গান বাজনা ইত্যাদি সবকিছুতেই দুর্দান্ত এক্টিভ ছেলে ছিল। ব্র্যাকে তখনকার সময়ে এমন কেউ বোধয় ছিল না যে তাকে চিনতো না। একদিন হঠাৎ করে সে ধর্মের নামে মানুষ হত্যার আহবান করলো! অবিশ্বাস্য! তারচেয়ে অবিশ্বাস্য তামিমের ঘটনা।
বাংলাদেশের ইতিহাসের কলঙ্কতম অধ্যায় সেই জঙ্গি হামলা চালানো জঙ্গিদের কাউকে কাউকে চিনে এমন কারোর কারোর সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার। ওরাও অবাক, ওরাও বিস্মিত। সাধারণ স্বাভাবিক যুবক, শিক্ষিত, স্বচ্ছল পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসা যুবকেরা কিভাবে কয়েক দিনেই এইভাবে একশো আশি ডিগ্রি পাল্টে গেল? কোন বিষে ওদের মন বিষাক্ত করা হয়? কিভাবে করা হয়? জাদুটোনা? হিপনোসিজম? ড্রাগস? নাহলে ঘর পরিবার আত্মীয় ক্যারিয়ার সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ইত্যাদি সব ছেড়ে কিসের মোহে ওরা আল্লাহর বিরুদ্ধে গিয়ে আল্লাহর রাস্তায় থাকার দাবি করে?
ফোনে কথা বেশিদূর জমলো না। বারবার ঘুরে ফিরে তামিম প্রসঙ্গ উঠলো। ফোন রেখে দিলাম। তখনই গুগল করলাম হোলি আর্টিসান লিখে। একটি লিংক বের করে দেখি মূল পরিকল্পক হিসেবে তামিমের ছবি সেখানে। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি রেখেছে। তবু ওর ঠোঁট থেকে ছোটবেলার চেহারা বুঝা যায়। নির্ভুল। এই সেই তামিম যে একদিন বিকালে মাঠে হাঁটতে হাঁটতে আমাকে বলেছিল, "আমরা যখন ভাল খেলতেই পারি, তখন কেননা আমরা একটা ক্লাব খুলে অন্যান্য পাড়ার ছেলেদের বিরুদ্ধে খেলতে শুরু করি? এতে বুঝা যাবে আমরা আসলেই কত ভাল খেলি।"
নারায়ণগঞ্জে এক অভিযানে সে নিহত হয়েছে।
দেশের শত্রু, ইসলামের শত্রু, মানবতার শত্রু - ওর প্রতি মমতা দেখানো উচিৎ না। সে যত আপনই হোক, যত কাছেরই হোক। মাথার ভিতর থেকে কেউ বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল পবিত্র কুরআনের সেই নির্দেশ যা সামনে রেখে পথ চলার চেষ্টা করি, "ন্যায় বিচারের জন্য নিজের বাবা মা আত্মীয় এমনকি বিরুদ্ধে হলেও যাও!"
সাধারণ মানুষ হত্যা করা জঙ্গিদের চিরজীবন ঘৃণা করে এসেছি, তামিম ওদের একজন ছিল জেনেও এই অনুভূতির কোন পরিবর্তন হয়নি।
ওর ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষন। মন থেকে কেবল একটি প্রশ্নই আসছিল, "কেন তামিম? তুমিও কেন?"
তামিমের হবার কথা ছিল একজন আদর্শ কমিউনিটি লিডার। ওর হওয়া উচিত ছিল মানুষের সৃষ্টির কারিগর। ও যতটা না মানুষকে ভালবাসতো, মানুষের কথা ছিল এরচেয়ে বহুগুন ভালবাসা ওকে ফেরত দেয়ার। ওর একটি সুন্দর পরিবার থাকার কথা ছিল। আরও সবকিছু যা একজন সুখী মানুষ সুখের জন্য স্বপ্ন দেখেন, সবই ছিল জীবনের কাছে তার প্রাপ্য। আফসোসের বিষয়, এর সবই ওর ছিলও। অথচ সে নিজেই কিনা স্বেচ্ছায় সব ছুঁড়ে ফেলে দিল!
যে মেধা উপওয়ালা তাকে দিয়েছিলেন মানব কল্যানে ব্যয় করতে, সেটাই সে প্ৰয়োগ করলে ইবলিসের কাজে!
তাহমিদ ভাই ও তামিমের ঘটনাই প্রমান করে আইসিস এবং এইরকম জঙ্গি সংগঠনগুলো কত শক্তিশালী, কত বিষাক্ত ও বিপজ্জনক! ওদের মতন চৌকস ও মেধাবী ছেলেদের যদি ওরা এত দ্রুত এত ভয়াবহ জঙ্গিতে রূপান্তরিত করতে পারে, তাহলে ওদের দ্বারা সবই সম্ভব।
নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে যত সম্ভাবনাময় যুবকদের, তাদের পরিবারদের স্বপ্নকে চূর্ণ বিচূর্ণ করার পাশাপাশি অসংখ্য নির্দোষের রক্তে যারা হাত রাঙিয়েছে, মানব সম্প্রদায় কি পারবে তাদের ক্ষমা করতে?
পরম করুনাময় কি এত মানুষের অভিশাপ বৃথা যেতে দিবেন?

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ১০:১৩

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: দুঃখজনক ও ভংঙ্কর।

২| ০৮ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ১২:৪৩

রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.