আমার বইমেলা ২০১২

০৪ ঠা মার্চ, ২০১২ বিকাল ৪:৪১

আমাকে একজন একবার একটা মেসেজ এ বলেছিল আমি যেন সবসময় মুখে বাবু বাবু হাসি ফুটিয়ে রাখি। বাস্তব জীবনে তা কখনোই সম্ভব হয় নি। এমনকি সেই হাসি মুখে বেজার করবার জন্য সেও অনেক সময় দায়ী ছিল। তবে বইমেলা তে এই প্রথম বারের মত দোকানদারী করবার সুযোগ পেয়ে আমি অনেক খুশি।সারাক্ষন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকবার অভিনয় করে বইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের যে কত অনুভুতি দেখবার সুযোগ হয় তার কয়েকটি বলবার জন্যই আজ লিখতে বসা।

আমাদের বগুড়া বইমেলা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ২১ তারিখ। একদিনের বিক্রিই বাকী ৪ দিনের সমান থাকে। তবে যেহেতু আমরা বন্ধুরা মিলে স্টল দিয়েছিলাম, তাই দোকান ভাড়া উঠবার পর-আমরা বেশ মজাতেই ছিলাম। বিশেষত আমার এই চান্সে নামকরা লেখকদের সব বই পড়া হয়ে গেছে। বইমেলাতে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলেন ডোরেমন আহমেদ বা ডোরেমন ইকবাল। বাচ্চা গুলা রঙ্গিন এই বইটি ধরে এমন ভাবে কাদবে-মনে হবে যে এই বাচ্চা বড় হয়ে বিশাল বড় বই পাগলা হবে। হয়তোবা হত, কিন্তু ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে যেহেতু কালার বইয়ের দাম বেড়ে গিয়েছে-সাথে সাথে ১০০ টাকার উপরে দাম উঠলেই তা নাকী অনেক বেশি। তাই বেশিরভাগ বাচ্চারই গাই গুই ব্যর্থ। বাবাদের কথা থাকে এরকম-বাবু চল আমরা আরেকটা স্টল দেখে আসি-মেলা শেষে কিনে নিয়ে যাব। টাকার জন্য বই কিনতে পারছেন না- অথচ হিন্দী চ্যানেল দেখছেন আবার বাচ্চাকে বই কিনে দিবেন না। জানিনা-আমার ধারনা ভুল হয়ে থাকতে পারে। ১০ শতাংশ ডোরেমন বিক্রির সফলতাতেই আমাদের প্রথম দিনে ডোরেমনের সব কপি বিক্রি। অনেকে হয়তো আমাকে দেশ ও সংস্কৃতি এর বিরোধী বলবেন। বলেন। বাচ্চাদের বই পাবার আনন্দ দেখবার মত। কেমন করে জানি বইটা বুকে জড়িয়ে ধরে।

বড়দের বই কিনবার প্রধান ক্রেতা হলেন-তরুণ /তরুণী এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা কিংবা মা। তরুণী বলবেন যে আমার পুরা সেট দরকার সাথে সাথেই হয়ে যাবে। তবে অন্য দৃশ্যই বেশি। শিক্ষক শিক্ষক ভাবের বাবা, তার পাশে তার মেয়ে। মেয়ে প্রথমে হাত দিবে হুমায়ুন আহমেদ এর বইয়ে, বাবা হাত দিবেন রোল নং এক/ কিংবা কিভাবে সফল হবেন এই বইতে। বাবা যখনি বলতে যাবেন বইটি দিন-তখনি মেয়ের আকুল আবেদন, বাবা হিমুর এই বইটা ভালো। বাবা তখন রাগী চোখে তাকাবেন, মেয়েটি আকুল চোখে তার উত্তর দিবেন। সেই ভাষা আমাদের তখন বুঝবার ক্ষমতা নেই। হয় বাবা কড়া চোখে মানা করছেন, নয়তো বলছেন ‘মা আজ আমার এই স্বপ্ন পুরাবার সাধ্য নেই। আমি এরকম ৪-৫ টা নাটক দেখেছি। লাস্ট দুইবারে যেই দামে কেনা সেই দামেই দিতে চেয়েছি-তাও পারিনি। আসলে হুমায়ুন আহমেদ এর বইয়ের দাম একটু বেশি। তবে চ্যাংড়া পোলাপান –উফফ বইমেলাতে বসে তাদের যে ডাউনলোড জ্ঞান পেয়েছি। যাই হোক আমরা তো আর প্রকাশক না, বই পড়লেই হল।

সবচেয়ে মজা লাগে স্কুল ছাত্র ছাত্রীদের বই বুক করা দেখে। জিলা স্কুলের একজন দুই দিন বই বুক রেখে ১৫ টাকা দামের বই কিনেছে। মনে হয় তিন দিনের টিফিনের টাকা। তবে তার সেই বই পাবার পরের অনুভুতি আমার দেখা হয় নি। মনে হয় বেশ আনন্দের হবে। নিজে বই পড়ে মানুষকে তা পড়ানোর অসাধারন আনন্দ আছে। আমি বই পড়ে যে আনন্দ পেলাম, যে আত্মার সাথে নিজেকে মেলালাম- তা যদি অপরকে নাই বললাম তবে আমি বৃথা। যেমন হুমায়ুন আহমেদ এর মেঘের উপর বাড়ি পড়ে একজন বললো এই বইটা পড়ে আমার মরে গিয়ে পরে কী হয় তা দেখতে ইচ্ছা করছিল। ব্যস আশেপাশের অন্তত ৩ জন সাথে সাথে বইটা কিনে। মানুষের মন এতটাই মানবীয়। এবারের বইমেলাতে আমার সবচেয়ে মজার লেগেছে ফালতু কবির ডাবল স্টার।সেখান থেকেই কিছু বলি। আচ্ছা বলুন তো চা ভালো হয়েছে কখন বোঝা যায়? যখন চায়ে মাছি পড়ে থাকে। মাছি চা খেতে খেতে পেট ফুলে মারা যায়। এরকম কিছু মন ভালো করা লাইন আমি এই বইতে পেয়েছি।

শেষে আমার একটা অর্থ সঙ্কটের গল্প বলে শেষ করি। সেবারে বাবা টাকা পাঠালেন কুরিয়ারে-মানিব্যাগে কিছু টাকা ছিল। কুরিয়ার তুলতে যেয়ে দেখি টাকা আসেনি। পুরাই দরিদ্র জীবন। রাস্তার পাশে একটা দোকানে ক্রিম রোল চোখে পড়ল-বললাম দেন একটা। ক্রিম রোল হাতে নিয়েছি তখন মনে পড়ল দেখি মানিব্যাগে কত আছে? চেয়ে দেখি আমার হোস্টেলে ফিরবার পর আর মাত্র ৬ টাকা থাকে। যা দিয়ে রাতে খেতে হবে। সেই দিন ক্রিম রোল হাতে নিয়েও আমাকে ফেরত দিতে হয়েছিল। বড় বড় লেখকরা তাদের ছাত্র জীবনের অনেক অভাবের কথা বলেন। ল্যাপটপ কোলে নিয়ে সেই ধরনের কথা বলা মানায় না। তবে এই ঘটনা আমার মনে থাকবে। অনেক কে শুধুমাত্র ১০-২০ টাকার জন্য বই না দিতে পারায় আমি দুঃখিত। আমি এখন প্রতিবার যখন মাসের টাকা পাই- মনে থাকলে ক্রিম রোল খাই। সেবার ৫ টা খেয়েছিলাম। আশা রাখি সেই বই প্রেমিক রা আমার মতোই যখন সুবিধা পাবেন অনেক অনেক বই পড়বেন।

আরেকটা কথা বলে শেষ করি। সেই রাতে আমার তরকারী কিনবার মত সম্বল টাকা ছিল না। এক বান্ধবীর রান্না করা সবজিই ছিল শেষ ভরসা। আল্লাহ তার উপর রহমত নাজিল করুক। জানিনা এখন সে কোথায় আছে। তার জন্য আমার দোয়া থাকলো।

১৪ টি +৩/-০