![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বছর কয়েক আগে আমার এক আত্মীয়ের ‘নেফ্রাইটিস’ (কিডনী সংক্রান্ত রোগ) এ আক্রান্ত হলে সরকারী হাসপাতালে আশানুরূপ চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হয়ে ঐ হাসপাতালের একজন প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধানের কাছে যাই ‘ভাল চিকিৎসার জন্যে’। তিনি তৎক্ষণাৎ একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তির পরামর্শ দেন ও নিজে অভিজ্ঞ চিকিৎসক হওয়া সত্বেও, ঐ সময়ে কর্মরত বিভাগীয় প্রধানকেও ক্লিনিকে আমন্ত্রণ জানান ১,০০০ টাকা প্রতিটি ভিজিটের পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। ১০/১২ দিনের চিকিৎসায় আমার ক্লিনিকের বিল হয় ২,০০,০০০ টাকারও বেশী, যার অধিকাংশ বিভিন্ন টেস্ট বা পরীক্ষা সংক্রান্ত। নানা কষ্টে ঐ বিল পরিশোধ করে কোলকাতা যাই চিকিৎসার জন্যে। ৩৫-টাকা ভিজিটে কোলকাতার ‘পিয়ারলেস হাসপাতালে’র কিডনী বিশেষজ্ঞ ড. দিপংকর ভট্টাচার্য ঘটনাক্রমে ঢাকার ‘বিভাগীয় প্রধান’কে তার বৃটিশ সহপাঠী বলে সনাক্ত করেন এবং আশ্চর্য হন যে, তিনি বর্ণিত রোগীকে যে সব টেস্ট করিয়েছেন, তার ৮০% তার রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ঢাকার ডাক্তার কেবলমাত্র টেস্টের ‘কমিশনের লোভে’ ও রোগীর টাকা খসানোর অসৎ মানসে ঐ টেস্টগুলো করিয়েছেন একজন মরণাপন্ন রোগীর। পিয়ারলেসে ৩৫-টাকা ভিজিটের কিডনী বিশেষজ্ঞ ভারতীয় ৭০০ টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে কেবল তার ৩-টি টেস্ট করতে বলেন। মোট ৭৩৫ টাকায় তার চিকিৎসা শুরু হয় এবং ভারতীয় ১০০০ টাকার ঔষধ কিনে বাংলাদেশে ফিরে আসি। পরবর্তীতে আরো ৫/৬-বার কোলকাতা যেতে হয় এবং সাকুল্যে ২০-২৫ হাজার টাকার মধ্যে আমার আলোচ্য রোগীর কিডনী চিকিৎসা সম্পন্ন হয় এবং আল্লাহর রহমতে তিনি এখন কিডনী রোগমুক্ত।
ঘটনাটি আমার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ। আমি বাংলাদেশের একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক। কখনোই চাই না যে বাংলাদেশের রোগীরা ভারত বা বিদেশে যাক চিকিৎসা করাতে। কিন্তু দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অপশাসনে আমাদের দেশের অনেক মানুষকে তৈরী করেছে ‘লোভী-নৈতিকতাহীন একেকটা যন্ত্রমানবে’। তাইতো হাসপাতালের একজন ডাক্তার যেমন নিজের বেতন ভাতায় সন্তুষ্ট নন, তেমনি হাসপাতালের একজন এমএলএসএস পর্যন্ত ধান্ধায় থাকেন উপরি কামাইয়ের, একজন সিএনজি ড্রাইভার সন্তুষ্ট নয় তার মিটারে প্রাপ্ত সঠিক হালাল ভাড়ায়। অতিরিক্ত হারাম ভাড়া আদায় না করতে পারলে তার মন ভরে না, মাথা ঠিক থাকে না। বর্তমান নৈতিকতাহীন, অসৎ, লোভী মানস লালনকারী বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু বিশেষ কোন মানুষ যতই অসৎ বা নৈতিকতহীন হোক না কেন, তাতে সাধারণের খুব একটা যায় আসে না কিন্তু একজন ডাক্তার যদি হয় এই অসৎ গুণগুলোর ধারক, তবে দেশের কি অবস্থা হবে? দেশের অধিকাংশ মানুষই এখন জানে যে, বাংলাদেশের ২/১ জন হাতে গোনা সৎ ডাক্তার ছাড়া অধিকাংশ ডাক্তারকে পেয়ে বসেছে নৈতিকতাহীন অসৎ বাণিজ্যিক মানসিকতায়। যে কারণে সরকারী হাসপাতালগুলো সাধারণ মানুষ ‘সেবা’ নামক বস্ত্তটি খুঁজে পান না। ২/৪ জন সৎ ডাক্তারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ডাক্তাররা স্বাস্থ্য বিভাগে চাকুরী করেন অন্যান্য সরকারী চাকুরের মতই কিন্তু একজন জজ যদিও আবদার করতে পারেন না যে, তিনি অফিস আওয়ারের পর আবার বিকেলে বা রাতে ‘প্রাইভেট প্রাকটিস’ করবেন কিন্তু ডাক্তাররা তা করেন। যদি জজ বা জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপার আলাদা কোন ‘প্রাইভেট প্রাকটিসে’ বসেন, তবে চিন্তা করুন, তাদের মূল পেশার কি হবে? এই প্রাইভেট প্রাকটিসই হচ্ছে একজন ডাক্তারের লোভী তথা নৈতিকতাহীন মানসিকতার মূল কারণ।
রোগী ধরার দালাল নেই এমন ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম। কোন কোন ডাক্তারের দালাল তার অফিস আওয়ারের সময় সরকারী হাসপাতালগুলোতে ফাঁদ পাতে, গরিব রোগীকে ভাগিয়ে নিয়ে যায় তার নিকটবর্তী চেম্বারে। মোবাইলে জানিয়ে দেয় ‘বস’কে, ফাঁদে আটকানো রোগীর কথা। সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব চেম্বারে এসে দেখে যান তার প্রাইভেট রোগীদের। আবার লিখে দিয়ে যান বিশেষ ক্লিনিকে বিশেষ বিশেষ টেস্ট করানোর কথা। অফিস সময়ে চেয়ার খালি থাকলেও জবাবদিহিতার অভাবে কার জবাব কে নেবে? কারণ যারা ডাক্তারের এই সময়ের হিসাবটি নেবেন, তাদের তারা ঠিকই সার্ভিস দেন। সরকারী কোন বড় আমলা সরকারী কোন হাসপাতালে ভর্তি হলে, তাকে তারা কেবিনে সুন্দরভাবে ‘দেখভাল’ করেন, যাতে তাদের প্রমোশন কিংবা খাগড়াছড়ি বদলী না হতে হয়। কিংবা ঢাকা শহরে বছরের পর বছর অবস্থান কিংবা অব্যবস্থার প্রশ্ন কর্তারা না তোলেন। মধ্যবিত্তরা অনেকেই ডাক্তারদের এই চালাকী ধরতে পেরে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক নিদেনপক্ষে ভারত চলে যান। কেবল অত্যন্ত গরীব মানুষ, যাদের কোথাও যাওয়ার সঙ্গতি নেই, কিংবা যারা সহজে ধরতে পারে না এই ‘ধুরন্দর ডাক্তারদের কারসাজি, তাদেরকেই মনের মত করে ঠকান এই ডাক্তারগণ। এটি এখন নাকি চন্দ্র সূর্যের মত সত্য যে, প্রায় সব প্রাইভেট ক্লিনিকের সাথে ডাক্তারদের থাকে কমিশন বাণিজ্য।
সরকারী হাসপাতালের সরবরাহকৃত ঔষধের সিকি ভাগও নাকি রোগীরা পায় না, চলে যায় নিকটবর্তী ফার্মেসীতে। অপারেশনে ঔষধ ছাড়াও সুই, সুতা, গজ-ব্যান্ডেজ সবই রোগীকে কিনতে হয়। এই অপকর্মের সাথেও কম বেশী ডাক্তাররা জড়িত থাকেন বলে কথিত আছে। এরপর সবচেয়ে বড় সত্য দেশের বড় বড় ডাক্তারদের সাথে রোগী দেখাতে করতে হয় ‘আগাম এ্যাপয়েন্টমেন্ট’। এই এ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে কখনো ১ সপ্তাহ আবার কখনো ২-মাসও লাগতে পারে। প্রত্যেক বড় ডাক্তারই তার অফিস সময়ে দেখা গোপনীয় প্রাইভেট রোগীর হিসাব বাদ দিলেও বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০/১১ টা পর্যন্ত কমপক্ষে গড়ে ৫০-জন রোগী দেখেন প্রত্যহ। গড়ে ভিজিট ৫০০ টাকা করে নিলেও দৈনিক তার আয় ২৫,০০০ টাকা। সে হিসেবে এই সমস্ত ডাক্তারদের আয়কর হওয়া উচিৎ বার্ষিক লাখ টাকার উপরে। কিন্তু এই ডাক্তারগণই যখন বার্ষিক মাত্র ৪/৫ হাজার টাকা আয়কর দেন, তখন চিন্তা করতে হবে আসলে ডাক্তাররা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। বছর কয়েক আগে যখন দেশের আয়কর সংক্রান্ত ব্যাপারে কড়াকড়ি ও রাঘববোয়ালদের ধরা শুরু হলো, তখন অনেক নামকরা ডাক্তারকেই দেখা গেছে তাদের ব্যাংকে রক্ষিত লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে লাভ লোকশানের চিন্তা ভাবনা না করে কেবল চড়া দামে ‘শেয়ার’ কিনতে। যে কারণে ঐ সময় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় শেয়ারের দাম। তথ্যগুলো বিশ্লেষণে দেখা যাবে, ডাক্তারগণ সরকারী অফিস সময়েও বিশেষ ব্যবস্থায় প্রাইভেট রোগী দেখেন, নিজের সরকারী দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেন না, রোগীদের প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা তথা প্যাথলজি পরীক্ষা করাতে পাঠান, বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানীর ঔষধ তাদের ব্যবস্থাপত্রে লেখার জন্যে ‘উপহার’ নামক বিশেষ ‘কমিশন’ খান, রাতে ওয়ার্ডে ছাত্রদের প্রাকটিক্যাল করানোর কথা থাকলেও, তা না করিয়ে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রাইভেট রোগী দেখেন, আয়কৃত অর্থের সঠিক আয়কর দেন না। এইসব অপ-সিস্টেমের পরিবর্তন হওয়া দরকার দেশের ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই। দেশ ও জনগণের স্বার্থে ডাক্তারদের এই অপকর্ম, দায়িত্ব অবহেলা, লোভ, আয়কর ফাঁকি ইত্যাদি বন্ধের জন্যে নিম্নবর্ণিত কার্যাবলী গ্রহণের জন্যে বর্তমান জনগণের সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই। তবে কোনো পেশাকেই একতরফা সমালোচনা করা যাবে না। আমাদের পলিসি লেভেলে অনেক সমস্যা। টপ ডাউন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, জবাবদিহিতার অভাব, জাতীয় সততা ব্যবস্থার অকার্যকারিতা সব কিছুই সকল পেশাকে দূষিত করেছে। এগুলো ঠিক করার জন্য পলিটিকেল উইল জরুরি।
©somewhere in net ltd.