![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুহাম্মদ হুসাইন বিল্লাহ
হুসাইন বিলল্াহ
ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষে আসে তখন সারা পৃথিবীর মধ্যে ধনে জনেসর্বশ্রেষ্ঠ ছিল ভারত উপমহাদেশ। তার সঙ্গে তুলনা করা যেত মোসলেমদেরই আরেক সাম্রাজ্য তুর্কী অটোমানদের। নিছক বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংরেজরা এই এলাকায় পাড়ি জমায়, ভারত বিজয়ের কথা ব্রিটিশদের কল্পনারও বাইরে ছিল। মোসলেমরাও তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে নি, নিজেদের স্বভাবজাত উদারতাবশত খ্রিস্টানদেরকে তারা অতিথি হিসাবেই গ্রহণ কোরে নেয়, সন্দেহ না করার কারণ শক্তির বিচারে তখনও ব্রিটিশরা মোঘলদের তুলনায় সামান্য ছিল। কিন্তু পরে নিজেদের বাণিজ্যের নিরাপত্তার অজুহাতে ব্রিটিশরা ভারতে কুঠিবাড়ি স্থাপনের অনুমতি নিয়ে নেয় এবং সেখানে অস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশ কোরতে থাকে। এক সময় তাদের ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচিত হোয়ে পড়ে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হোয়ে গেছে। তারা তখন এতটাই শক্তিশালী যে মোঘল বাদশাহরা তাদের পরাভব মেনে নিতে বাধ্য হয়। ব্যাপক ও নির্বিচার গণহত্যার মাধ্যমে সূচনা হয় ভারতীয়দের প্রায় তিন শতাব্দীর গোলামির যুগ।
আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়াতেও ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা তাদের উপনিবেশ স্থাপন কোরেছে কিন্তু সেখানে তারা মুখোমুখি হোয়েছে জংলী রেড ইন্ডিয়ান আর অ্যাবোরিজিনদের। জংলীদের উপর প্রভুত্ব করা আর ভারতের সুশিক্ষিত, বহুগুণ অগ্রসর জাতি মোসলেমদের উপরে প্রভুত্ব করা এক কথা নয়। তারা দিল্লীর পতন ঘোটিয়ে এতদঞ্চলীয় হিন্দু-মোসলেম জনসংখ্যাটিকে সামরিক শক্তিবলে তাদের গোলামে পরিণত কোরল, তখন তারা এই জাতির উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ কোরল। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হোল শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে জাতির মধ্যে গোলামি মানসিকতা প্রবেশ কোরিয়ে দেওয়া। গোলামি মানসিকতা হোচ্ছে নিজেকে সর্বদিকে প্রভুর তুলনায় তুচ্ছ, নগণ্য ও জঘন্য মনে করা অর্থাৎ হীনমন্যতা। তখন ভারতবর্ষের প্রধান শক্তি ছিল মোসলেমরা। তাই খ্রিস্টানদের প্রধান লক্ষ্য ছিল পূর্বতন শাসক জাতির মনমগজকে ভালো কোরে ধোলাই করা। এটা কোরতে হোলে মোসলেমদের ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অবধারিতভাবে তাদের প্রেরণার উৎস কোর’আন ও রসুলাল্লাহর জীবন ইতিহাস সম্পর্কে খ্রিস্টানদের ব্যাপক গবেষণা কোরতে হয়। এটা তারা করে শাসনকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই। এজন্য তারা ফার্সি, উর্দু, আরবী, সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রাচ্যদেশীয় ভাষায় অবিশ্বাস্য পাণ্ডিত্য অর্জন কোরল। এই পণ্ডিতদেরকে বোঝানোর জন্য ইংরেজী ভাষায় একটি শব্দই সৃষ্টি হোল- Orientalist বা প্রাচ্যবিদ। ইংরেজ শাসকরা যেন মোসলেমদের ইতিহাস ও শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে সহজে জ্ঞানলাভ কোরতে পারে এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ কোরতে পারে সেজন্য মোসলেমদের লেখা প্রায় প্রতিটি বই তা যে ভাষাতেই হোক না কেন, সেগুলির অনুবাদ কোরে ফেলল। নিজেরাও লিখল রসুলাল্লাহর জীবন ইতিহাস, কোর’আনের তাফসির, এসলামের ইতিহাস। ইংরেজরা এই কয়েক শতাব্দীতে কয়েক হাজার মৌলিক গ্রন্থ রচনা কোরেছেন যেগুলিতে তারা প্রাচ্যদেশীয় মানুষের অনুসৃত ধর্ম, ইতিহাস ও সংস্কৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ সন্নিবেশ কোরেছেন। স্বভাবতই এগুলি তারা লিখেছিল প্রধানত রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য, তাই এগুলিতে ইতিহাসের ব্যাপকভাবে বিকৃতি-সাধন করা হোয়েছে, নিজেদের এসলাম বিদ্বেষ সেগুলিতে প্রতিফলিত হোয়েছে।
ভারত উপমহাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য মোসলেম অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে মোসলেম জাতিকে দাসে পরিণত করার পরও খ্রিস্টান জাতিগুলির মনে ঐ দাস জাতির সম্বন্ধে ভয় সম্পূর্ণ দূর হোল না, কারণ তখনও তাদের মন থেকে সেই ইতিহাস সম্পূর্ণ মুছে যায় নি যে, অতীতে ঐ জাতির হাতে কতবার তারা সামরিকভাবে পরাজিত হোয়েছিল। তারা জানতো, যে জাতিকে তারা এখন পরাজিত ও পদানত কোরেছে সে জাতির প্রচণ্ড শক্তির উৎস হোচ্ছে তাদের কোর’আন ও হাদিস। তাই এই জাতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নিশ্চিত হবার জন্য, এই জাতিটিকে সম্পূর্ণ পঙ্গু কোরে দেবার জন্য তারা এক শয়তানি ফন্দি আট্লো। সে ফন্দি হোল এই যে, সমস্ত মোসলেম দুনিয়ায় খ্রিস্টানেরা যার যার অধিকৃত অংশে মোসলেমদের “এসলাম” শিক্ষা দেবার জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা কোরল। ইংরাজরা এই উপমহাদেশে, মালয়েশিয়ায়, মিশরে ইত্যাদিতে; ফরাসিরা আলজেরিয়া এবং অন্যান্য যে সব মোসলেম এলাকা দখল কোরেছিল সেখানে; ডাচ অর্থাৎ ওলন্দাজরা ইন্দোনেশিয়ায় ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা স্থাপন কোরল। ইংরেজ অধিকৃত এই উপমহাদেশের ভাইসরয় লর্ড ওয়ারেন হেসটিংস ১৭৮০ সনে কোলকাতায় Mohammedan College of Calcutta বা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা কোরলেন। এই মাদ্রাসায় “এসলাম” শিক্ষা দেবার পূর্বোক্ত খ্রিস্টানরা, পণ্ডিতরা সম্মিলিতভাবে বহু গবেষণা কোরে একটি নুতন “এসলাম” দাঁড় করালেন, যে “এসলামের” বাহ্যিক দৃশ্য এসলামের মতই কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যেটার আকিদা এবং চলার পথ অর্থাৎ সেরাত, আল্লাহর রসুলের এসলামের, সেরাতাল মুস্তাকিমের ঠিক বিপরীত। ঐ বিপরীতমুখী এসলাম শিক্ষা দিতে কি কি বিষয় শিক্ষা দিতে হবে, কি কি বিষয়বস্তু বাদ দিতে হবে, কেমন কোরে শিক্ষা দিতে হবে অর্থাৎ এক কথায় Syllabus এবং Carricullam নির্ধারণ ও স্থির কোরলেন ঐ খ্রিস্টানরা পণ্ডিতরা। আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা কোরে তাদের সৃষ্ট “এসলাম” শিক্ষা দিতে কোথাও কোন বাধা না আসতে পারে সে জন্য মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য পূর্ণ ক্ষমতাসহ অধ্যক্ষ পদটি তারা নিজেদের হাতেই রাখলো। প্রথম অধ্যক্ষপদে নিয়োজিত হোলেন এসলাম বিদ্বেষী প্রাচ্যবিদ Dr. A. Springer M.A । ১৭৮০ থেকে ১৯২৬ সন পর্যন্ত এই ১৪৬ বছর একাধিক্রমে ২৬ জন খ্রিস্টান পণ্ডিতরা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষপদে থেকে এই জাতিকে “এসলাম” শিখিয়েছেন। তারা কোন্ “এসলাম” শিখিয়েছেন? অবশ্যই তারা আল্লাহ রসুলের সেই প্রকৃত এসলাম সেখান নাই। তারা শিখিয়েছেন তাদের তৈরি করা এমন একটি এসলাম যেটা তৈরি করে মৃত্যুভয়ে ভীত কাপুরুষ, যারা দাড়ি, মোচ, টুপি, পাগড়ি, মেসওয়াক, কুলুখ, হায়েয-নেফাস, যিকির আসকার আর বিবি তালাককেই এসলাম মনে কোরে তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে বাহাস আর মারামারি কোরতে থাকে যাতে খ্রিস্টানরা নিশ্চিন্ত মোনে তাদের দাসদের ওপরে রাজত্ব কোরতে পারে। ১৪৬ বছর ধোরে নিজেদের তৈরি “এসলাম” শেখাবার পর ২৬ নং খ্রিস্টান অধ্যক্ষ Mr. Alexander Hamilton Harty ১৯২৭ সনে অধ্যক্ষপদ তাদেরই ছাত্র শামসুল ওলামা, কামাল উদ্দিন আহমদ এম.এ.আই.আই.এস এর হাতে ছেড়ে দেন।
পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা নাম দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ একটি শিক্ষাব্যবস্থা তারা চালু কোরল স্কুল কলেজের মাধ্যমে। কারণ এ বিরাট এলাকা শাসন কোরতে যে জনশক্তি প্রয়োজন তা এদেশের মানুষ ছাড়া সম্ভব ছিল না; সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের কেরানীর কাজে অংশ নিতে যে শিক্ষা প্রয়োজন তা দেওয়ার জন্য তারা এতে ইংরেজী ভাষা, সুদভিত্তিক অংক, বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক, ইতিহাস, প্রধানতঃ ইংল্যান্ড ও ইউরোপের রাজারাণীদের ইতিহাস, ভূগোল, প্রযুক্তিবিদ্যা অর্থাৎ পার্থিব জীবনে যা যা প্রয়োজন হয় তা শেখানোর বন্দোবস্ত রাখলো; সেখানে আল্লাহ, রসুল, আখেরাত অর্থাৎ হাদিস কোর’আন সম্বন্ধে প্রায় কিছুই রাখা হলো না, সেই সঙ্গে নৈতিকতা, মানবতা, আদর্শ, দেশপ্রেম ইত্যাদি শিক্ষাও সম্পূর্ণ বাদ রাখা হোল। তাদেরকে এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হোল, যাতে তারা সব সময় শাসকদেরকে প্রভু জ্ঞান করে আর নিজেদেরকে মনে করে বর্বর, পশ্চাৎপদ একটি জাতি। অন্যদিকে তাদের মধ্যে জন্ম নিল এসলামের প্রতি অনীহা এবং বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। লর্ড ডালহৌসির আমলে ১৮১৭ সনে রাজা রামমোহন রায় কোলকাতায় খ্রিস্টানদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ। এই কলেজের প্রথম থেকে ১৯৩০ সন পর্যন্ত প্রথম ৫৬ জন প্রিন্সিপালের মধ্যে ৫৫ জনই ছিলেন খ্রিস্টান। এর মধ্যে প্রসন্ন কুমার রায় নামে একজন ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন, অবশ্য তিনিও ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজেরই এক বিলেত ফেরত ছাত্র। এইভাবে স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার মাধ্যমে খ্রিস্টানরা তাদের তৈরি করা বিকৃত ইতিহাস এ জাতিটিকে শিক্ষা দিয়েছে।
মোসলেমদেরকে পদানত রাখার জন্য এই প্রাচ্যবিদ পণ্ডিতরা কী সাংঘাতিক পরিশ্রম ও ষড়যন্ত্র কোরেছিলেন তা বর্তমানে ইতিহাসের এক গোপন করা অধ্যায়। আমাদের দেশে বিকৃত ইতিহাস পরিবেশনের জন্য ইংরেজরা বহুলাংশে দায়ী হোলেও তাঁদের কূটনৈতিক জ্ঞান ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারার প্রশংসা কোরতেই হয়। তারা তস্কর হোলেও প্রতিভাবান তস্কর একথা নিরপেক্ষ বিচারে না বোলে উপায় নেই। তাঁরা বুঝেছেন, ইতিহাসে ভেজাল দিয়েই ভারতবাসীকে অন্ধকারে রাখা সম্ভব এবং এ ইতিহাসের মাধ্যমেই হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে। সে উদ্দেশ্যেই ইতিহাস-স্রষ্টা মোসলেম জাতির অক্লান্ত পরিশ্রমের রচনা-সম্ভার আরবি, ফার্সী ও উর্দু ইতিহাসগুলোর প্রায় প্রত্যেকটি অধ্যয়ন, গবেষণা ও অনুবাদ কোরতে তাঁরা যে অধ্যবসায় ও পরিশ্রমশীলতার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অনস্বীকার্য এবং উল্লেখযোগ্য।
উদাহরণ দিয়ে বলা যায়-
(১) আব্বাস শেরওয়ানির লেখা তোহফায়ে আকবর শাহী, জিয়াউদ্দিন বারনীর লেখা তারিখে ফিরোজশাহী, আবদুর হামিদ খানের বাদশাহনামা এবং মুহাম্মদ আলীর লেখা চাচানামা, ফাতাহনামা ও মিনহাজুল মাসালিকের অনুবাদ কোরেছেন যুগ্মভাবে মি: ইলিয়ট ও মি: ডওসন।
(২) মিনজাউদ্দিন সিরাজের তাবাকাতে নাসিরির অনুবাদক এইচ.জি. রেভার্টি।
(৩) আলী হাসানের সিয়াসাতনামার অনুবাদক মি: শেফার।
(৪) ইউসুফের কিতাবুল খারাজের অনুবাদ কোরেছেন মি: ই. ফাগনন।
(৫) আবু তালেব লিখিত মালফুজাতে তাইমুরির অনুবাদ মি: মেজর ডাভি।
(৬) বায়হাকির তারিখে সুবুক্তগীনের অনুবাদক মি: ডব্লু এইচ. মোরাবি।
(৭) আবুল ফজলের আকবরনামার তৃতীয় খণ্ডের অনুবাদ কোরেছেন মি: হেনরী বেভারিজ।
(৮) আইন-ই-আকবরীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের অনুবাদ কোরেছেন মি: এইচ এস, জারেট এবং প্রথম খণ্ডের অনুবাদ কোরেছেন মি: এইচ, লো এবং স্যার ডব্লু হেইগ।
(৯) মাওয়ার্দির আল-আহকামে সুলতানিয়ার অনুবাদ কোরেছেন যুগ্মভাবে মি: স্ট্ররগ ও মি: আঘনিডস।
(১০) বালাজুরির ফাতহুল বুলদানের তরজমা কোরেছেন মি: ডি. কোজে।
(১১) আল বিরুনীর কিতাবুল হিন্দের অনুবাদ কোরেছেন মি: ই.সি.সাচান।
(১২) ইবনুল আসির লিখিত তারিখুল কামিলের অনুবাদক হোচ্ছেন মি: টর্নবার্গ।
(১৩) মোসলেম মহিলা ঐতিহাসিক গুলবদন বেগম লিখিত হুমায়ুুননামার ইংরেজী অনুবাদ কোরেছেন মিসেস বেভারিজ।
(১৪) বাদশা জাহাঙ্গীরের লেখা তুজুকে জাহাঙ্গীরীর অনুবাদক যুগ্মভাবে মি: রজার ও মি: বেভারিজ।
(১৫) মির্জা হায়দারের লেখা তারিখে রশীদীর ইংরেজী কোরেছে মি: ই. ডি. রস।
(১৬) কাফি খানের মুনতাখাবুল লুবাবের অনুবাদ কোরেছেন স্যার ডব্লু হেইগ।
(১৭) হেদায়া’র মতো গ্রন্থের অনুবাদ কোরেছেন চার্লস হ্যামিল্টন।
(১৮) পর্যটক ইবনে বতুতার পর্যটনের কাহিনী লিখিত গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ কোরেছেন মি: এইচ. এ. আর গিবন প্রমুখ।
এগুলি সামান্য কয়েকটি উদাহরণ মাত্র, পাঠকের ধৈর্যচ্যুতির আশঙ্কায় এখানেই থামলাম। এই অনুবাদ গ্রন্থগুলিতে মূল তথ্যের সাথে কোন্ কায়দায় কোন্ ভেজাল কিভাবে সংমিশ্রণ কোরতে হয় এ বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুবাদকগণ ‘নিপুণ শিল্পী’র পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হোচ্ছে, ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতীয় জনগোষ্ঠী তাদের পূর্বতন সরকারি ভাষা ফার্সিসহ আরবি ও উর্দুর সঙ্গে সম্পর্কহীন হোয়ে পড়ায় মূল গ্রন্থগুলি পাঠ কোরে এর নির্যাস গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। তখন তাদের ভরসা ইংরেজদের করা উপরোক্ত বইয়ের অনুবাদগুলি। সেগুলির সহায়তা নিয়েই এ অঞ্চলের ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস রচনা কোরেছেন এবং এখনও কোরে যাচ্ছেন। তাদের কেবল এসলামের ইতিহাস ও শিক্ষাই নয়, সনাতন ধর্মগ্রন্থ এবং বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের মধ্যেও তারা বিকৃতি ও ভেজাল মিশিয়ে গেছেন, কারণ এ ধর্মের অনুসারীরাই এতদঅঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
‘বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস’ বইয়ে শ্রী ধনঞ্জয় দাস মজুমদার লিখেছেন: “ইংরেজগণ তখন শাসকজাতি ছিলেন। ভারতের আর্যগোষ্ঠীর বহির্ভূত পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকগণের মধ্যে বাংলার ইংরেজের সংস্কৃতিতে অভিজাত ও বেতনভুক্ত ঐতিহাসিক ও শাস্ত্রকারগণ তাঁদের ইচ্ছামত শাস্ত্রগ্রন্থের বহু তালপত্র বদলিয়ে তাঁদের ইচ্ছামত শ্লোক প্রক্ষিপ্ত করেন। আবার বহু তালপত্র ধ্বংস করিয়াছেন। এই শাসক গোষ্ঠীর ভারত শাসনের সুবিধার জন্য তাঁরা হিন্দুশাস্ত্রের বহু তথ্য গোপন, বহু তথ্য বিকৃত এবং বহু মিথ্যা প্রক্ষিপ্ত করিয়া যে মিথ্যা ইতিহাস প্রস্তুত কোরেছেন তাহার বহু প্রমাণ দেওয়া হোয়েছে। বিভেদের সুযোগে ইংরেজ রাজত্ব চিরস্থায়ী কোরতে চেষ্টা করেন। এইজন্য তারা তাদের অনুগত হিন্দুদেরকে এইরূপ মিথ্যা ইতিহাস লিখতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।” (পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭)
ভারতের বিখ্যাত নেতা স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: “অনেক বৌদ্ধ গ্রন্থের দু’ একটি স্থল ঈষৎ পরিবর্তনপূর্বক কোথাও বা প্রমাণসূত্রটিকে বদলিয়ে সমগ্র গ্রন্থখানিকে ‘হিন্দু’ কোরে তোলা হোয়েছে। পরবর্তীকালে ভাষার পরিমার্জনের সাথে সাথে বাঙ্গলার আদি কবি কৃত্তিবাসও ‘পরিমার্জিত’ হোয়েছেন। কবির কাব্য পরি®কৃত কোরতে যেয়ে সংশোধকগণ আবর্জনা রাশির দ্বারা কৃত্তিবাসকে আচ্ছন্ন কোরে ফেলেছেন। এটা ছাড়া অন্যান্য পুরাণ, উপপুরাণ হোতে মনোরম অংশও লিপিকারগণ বেছে এনে কৃত্তিবাসে জুড়ে দিয়েছেন।” (সমালোচনা সংগ্রহ-কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ২৮৩-২৮৪)
তাহোলে ইতিহাস, সাহিত্য, প্রবন্ধ ইত্যাদিতে ভেজাল দেয়ার কথা প্রমাণিত হোচ্ছে। এছাড়া আর একটি দিক হোচ্ছেÑ ব্রিটিশ আমলে এবং তার পরবর্তীতে রচিত সরকারি ইতিহাসের সাথে বেসরকারি ইতিহাসের পার্থক্য কতটুকু। এ সম্বন্ধে রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায় বোলছি: “এটা কিছুতেই ভুললে চোলবে না যে, সরকারি ইতিহাস এবং পণ্ডিতসুলভ ইতিহাসের মধ্যে আদর্শ উদ্দেশ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য থাকবেই। সেইজন্য বেসরকারি ইতিহাসের একটি বিশেষ দায়িত্ব হোল সরকারি ইতিহাসের প্রকৃতির উপর দৃষ্টি রাখা। ভারতের জাতীয়তাবাদী ইতিহাস, স্বধীনতা সংগ্রামের ইতিবৃত্তও নিরপেক্ষ গবেষণার কষ্টিপাথরে যাচাই হওয়া উচিত। হয়তো তার ফলে, প্রচলিত কিছু অলীক ধারণা ধূলিসাৎ হবে। ব্যক্তি বিশেষের প্রতিষ্ঠার বুনিয়াদ ভেঙ্গে পোড়বে। তার ফলেই প্রমাণ হবে প্রকৃত ইতিহাস রচনার স্বার্থকতা।”
এ প্রসঙ্গে ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের অন্যতম দিকপাল শ্রীমতী রোমিলা থাপার বলেন: -“স্কুল-কলেজের পাঠ্য ইতহাসের বই সত্যিই সেকেলে এবং অজস্র ভুল তত্ত্ব ও তথ্যে ভরা। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের অনুমোদন সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার কিংবা শিক্ষা পর্ষদের এখতিয়ার। অথচ ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইতিহাসের লোক ননÑহয় আমলা, নয় রাজনীতিবিদ, যাঁরা কখনও ইতিহাস পড়েন নি অথবা ৬০/৭০ বছর আগেকার দু’একটা বই মনে কোরে পড়ছেন। রাজনীতিবিদদের ইতিহাস চেতনার কথা আর নাই বা বললাম, ইতিহাসের মধ্যে নিজের দল গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের স্বার্থ খোঁজাই এদের কাজ”
আর রবীন্দ্রনাথ বোলেছেন, “ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্ত কোরে পরীক্ষা দেই তা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক দুঃস্বপ্নের কাহিনী মাত্র।”
ভারত উপমহাদেশে ক্যান্সারের মতো সবচেয়ে বড় ব্যাধি হোচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। এটাকে নির্মূল কোরতে হোলে, আমাদের ধারণায় সর্বাগ্রে সঠিক ইতিহাস পরিবেশন অবশ্য কর্তব্য।
©somewhere in net ltd.