নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মেঘদূত

মনের জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবনাগুলোর মিলিয়ে যাওয়া দেখি। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ হয়ে, ঐ দূর দিগন্ত পানে...

মে ঘ দূ ত

হে অপরিচিতা, গ্রহণ করো আমার এই অর্পণা আজিকের এই প্রভাতের প্রথম কিরণ মেঘময় আকাশ- দখিনা হাওয়ার শীতল পরশ দাবমান মেঘরথে হে অপরিচিতা শুধু তোমার 'পরে

মে ঘ দূ ত › বিস্তারিত পোস্টঃ

নক্সী-কাঁথার মাঠ - পল্লীকবি জসীমউদ্‌দীন (শেষ পর্ব)

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১১:৫৯

আগের পর্ব



"এই শেষ কথা!" সাজু কহে কেঁদে, "বলিবে না আর কিছু?"

খানিক চলিয়া থামিল রুপাই, কহিল চাহিয়া পিছু,

"মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যদি কোন ব্যথা লাগে,

দুটি কালো চোখ সাজাইয়া নিও কাল কাজলের রাগে।

সিন্দুরখানি পরিও ললাটে-মোরে যদি পড়ে মনে,

রাঙা শাড়ীখানি পরিয়া সজনি চাহিও আরশী-কোণে।

মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যতনে বাঁধিও চুল,

আলসে হেলিয়া খোঁপায় বাঁধিও মাঠের কলমী ফুল।

যদি একা রাতে ঘুম নাহি আসে-না শুনি আমার বাঁশী,

বাহুখানি তুমি এলাইও সখি মুখে মেখে রাঙা হাসি।

চেয়ো মাঠ পানে-গলায় গলায় দুলিবে নতুন ধান;

কান পেতে থেকো, যদি শোন কভু সেথায় আমার গান।

আর যদি সখি, মোরে ভালবাস মোর তরে লাগে মায়া,

মোর তরে কেঁদে ক্ষয় করিও না অমন সোনার কায়া!"



ঘরের খোপেতে মোরগ ডাকিল, কোকিল ডাকিল ডালে,

দিনের তরণী পূর্ব সাগরে দুলে উঠে রাঙা পালে।

রুপা কহে, "তবে যাই যাই সখি, যেটুকু আঁধার বাকি,

তারি মাঝে আমি গহন বনেতে নিজেরে ফেলিব ঢাকি।"

পায়ে পায়ে পায় কতদূর যায়, তবু ফিরে ফিরে চায়;

সাজুর ঘরেতে দীপ নিবু নিবু ভোরের উতলা বায়।



তেরো

******



বিদ্যাশেতে রইলা মোর বন্ধুরে।

বিধি যদি দিত পাখা,

উইড়া যায়া দিতাম দেখা;

আমি উইড়া পড়তাম সোনা বন্ধুর দেশেরে।

আমরা ত অবলা নারী,

তরুতলে বাসা বান্ধিরে;

আমর বদন চুয়ায়া পড়ে ঘামরে।

বন্ধুর বাড়ি গঙ্গার পার

গেলে না আসিবা আর;

আমার না-জান বন্ধু, না জানে সাঁতাররে।

বন্ধু যদি আমার হও

উইড়া আইসা দেখা দাও

তুমি দাও দেখা জুড়াক পরাণরে।

- রাখালী গান



একটি বছর হইয়াছে সেই রুপাই গিয়াছে চলি,

দিনে দিনে দিন নব আশা লয়ে সাজুরে গিয়াছে ছলি।

কাইজায় যারা গিয়াছিল গাঁর, তারা ফিরিয়াছে বাড়ি,

শহরের জজ, মামলা হইতে সবারে দিয়াছে ছাড়ি।

স্বামীর বাড়িতে একা মেয়ে সাজু কি করে থাকিতে পারে,

তাহার মায়ের নিকটে সকলে আনিয়া রাখিল তারে।

একটি বছর কেটেছে সাজুর একটি যুগের মত,

প্রতিদিন আসি, বুকখানি তার করিয়াছে শুধু ক্ষত।

ও-গাঁয়ে রুপার ভাঙা ঘরখানি মেঘ ও বাতাসে হায়,

খুঁটি ভেঙে আজ হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছে পথেয় গায়।

প্রতি পলে পলে খসিয়া পড়িছে তাহার চালের ছানি,

তারও চেয়ে আজি জীর্ণ শীর্ণ সাজুর হৃদয়খানি।

দুখের রজনী যদিও বা কাটে-আসে যে দুখের দিন,

রাত দিন দুটি ভাই বোন যেন দুখেরই বাজায় বীণ।

কৃষাণীর মেয়ে, এতটুকু বুক, এতটুকু তার প্রাণ,

কি করিয়া সহে দুনিয়া জুড়িয়া অসহ দুখের দান!

কেন বিধি তারে এত দুখ দিল, কেন, কেন, হায় কেন,

মনের-মতন কাঁদায় তাহারে 'পথের কাঙালী' হেন?



সোঁতের শেহলা ভাসে সোঁতে সোঁতে, সোঁতে সোঁতে ভাসে পানা,

দুখের সাগরে ভাসিছে তেমনি সাজুর হৃদয়খানা।

কোন্‌ জালুয়ার* মাছ সে খেয়েছে নাহি দিয়ে তার কড়ি,

তারি অভিশাপ ফিরিছে কি তার সকল পরাণ ভরি!

কাহার গাছের জালি কুমড়া সে ছিঁড়েছিল নিজ হাতে,

তাহারই ছোঁয়া কি লাগিয়াছে আজ তার জীবনের পাতে!

তোর দেশে বুঝি দয়া মায়া নাই, হা-রে নিদারুণ বিধি

কোন্‌ প্রাণে তুই কেড়ে নিয়ে গেলি তার আঁচলের নিধি।

নয়ন হইতে উড়ে গেছে হায় তার নয়নের তোতা,

যে ব্যথারে সাজু বহিতে পারে না, আজ তা রাখিবে কোথা?



*জালুয়া - জেলে



এমনি করিয়া কাঁদিয়া সাজুর সারাটি দিবস কাটে,

আনমনে কভু একা চেয়ে রয় দীঘল গাঁয়ের বাটে।

কাঁদিয়া কাঁদিয়া সকাল যে কাটে-দুপুর কাটিয়া যায়,

সন্ধ্যার কোলে দীপ নিবু-নিবু সোনালী মেঘের নায়।

তবু ত আসে না। বুকখানি সাজু নখে নখে আজ ধরে,

পারে যদি তবে ছিঁড়িয়া ফেলার সন্ধ্যার কাল গোরে।



মেয়ের এমন দশা দেখে মার সুখ নাই কোন মনে,

রুপারে তোমরা দেখেছো কি কেউ, শুধায় সে জনে জনে।

গাঁয়ের সবাই অন্ধ হয়েছে, এত লোক হাটে যায়,

কোন দিন কিগো রুপাই তাদের চক্ষে পড়েনি হায়!

খুব ভাল করে খোঁজে যেন তারে, বুড়ী ভাবে মনে মনে,

রুপাই কোথাও পালাইয়া আছে হয়ত হাটের কোণে।

ভাদ্র মাসেতে পাটের বেপারে কেউ কেউ যায় গাঁয়,

নানা দেশে তারা নাও বেয়ে যায় পদ্মানদীর পার।

জনে জনে বুড়ী বলে দেয়, "দেখ, যখন যেখানে যাও,

রুপার তোমরা তালাস লইও, খোদার কছম খাও।"

বর্ষার শেষে আনন্দে তারা ফিরে আসে নায়ে নায়ে,

বুড়ী ডেকে কয়, "রুপারে তোমরা দেখ নাই কোন গাঁয়ে!"

বুড়ীর কথার উত্তর দিতে তারা নাহি পায় ভাষা,

কি করিয়া কহে, আর আসিবে না যে পাখি ছেড়েছে বাসা।



চৈত্র মাসেতে পশ্চিম হতে জন খাটিবার তরে,

মাথাল মাথায় বিদেশী চাষীরা সারা গাঁও ফেলে ভরে।

সাজুর মায়ে যে ডাকিয়া তাদের বসায় বাড়ির কাছে,

তামাকে খাইতে হুঁকো এনে দ্যায়, জিজ্ঞাসা করে পাছে;

"তোমরা কি কেউ রুপাই বলিয়া দেখেছ কোথাও কারে,

নিটল তাহার গাঠন, কথা কয় ভারে ভারে।"

এমনি করিয়া বলে বুড়ী কথা, তাহারা চাহিয়া রয়,-

রুপারে যে তারা দেখে নাই কোথা, কেমন করিয়া কয়!

যে গাছ ভেঙেছে ঝড়িয়া বাতাসে কেমন করিয়া হায়,

তারি ডালগুলো ভেঙে যাবে তারা কঠোর কুঠার-ঘায়?



কেউ কেউ বলে, "তাহারি মতন দেখেছিনু একজনে,

আমাদের সেই ছোট গাঁর পথে চলে যেতে আন্‌মনে।"

"আচ্ছা, তাহারে শুধাও নি কেহ, কখন আসিবে বাড়ী,

পরদেশে সে যে কোন্‌ প্রাণে রয় আমার সাজুরে ছাড়ি?"

গাঙে-পড়া-লোক যেমন করিয়া তৃণটি আঁকড়ি ধরে,

তেমনি করিয়া চেয়ে রয় বুড়ী তাদের মুখের পরে।

মিথ্যা করেই তারা বলে, "সে যে আসিবে ভাদ্র মাসে,

খবর দিয়েছে, বুড়ী যেন আর কাঁদে না তাহার আশে!"

এত যে বেদনা তবু তারি মাঝে একটু আশার কথা,

মুহূর্তে যেন মুছাইয়া দেয় কত বরষের ব্যথা।

মেয়েরে ডাকিয়া বার বার কহে "ভাবিস না মাগো আর,

বিদেশী চাষীরা কয়ে গেল মোরে-খবর পেয়েছে তার।"

মেয়ে শুধু দুটি ভাষা-ভরা আখিঁ ফিরাল মায়ের পানে;

কত ব্যথা তার কমিল ইহাতে সেই তাহা আজ জানে।

গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,

বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস।



আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা,

ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেড়ে যায় বাসা।

আজকে কতনা কথা লয়ে যেন বাজিছে বুকের বীণে,

সেই যে প্রথম দেখিল রুপারে বদনা-বিয়ের দিনে।

তারপর, সেই হাট ফেরা পথে তারে দেখিবার তরে,

ছল করে সাজু দাঁড়ায়ে থাকিত গাঁয়ের পথের পরে।

নানা ছুতো ধরি কত উপহার তারে সে যে দিত আনি,

সেই সব কথা আজ তার মনে করিতেছে কানাকানি।

সারা নদী ভরি জাল ফেলে জেলে যেমনি করিয়া টানে,

কখন উঠায়, কখন নামায়, যত লয় তার প্রাণে;

তেমনি সে তার অতীতেরে আজি জালে জড়াইয়া টানে,

যদি কোন কথা আজিকার দিনে কয়ে যায় নব-মানে।



আর যেন তার কোন কাজ নাই, অতীত আধাঁর গাঙে,

ডুবারুর মত ডুবিয়া ডুবিয়া মানিক মুকুতা মাঙে।

এতটুকু মান, এতটুকু স্নেহ এতটুকু হাসি খেলা,

তারি সাথে সাজু ভাসাইতে চায় কত না সুখের ভেলা!

হায় অভাগিনী! সে ত নাহি জানে আগে যারা ছিল ফুল,

তারাই আজিকে ভূজঙ্গ হয়ে দহিছে প্রাণের মূল।

যে বাশীঁ শুনিয়া ঘুমাইত রাজু, আজি তার কথা স্মরি,

দহন নাগের গলা জড়াইয়া একা জাগে বিভাবরী।



মনে পড়ে আজ সেই শেষ দিনে রুপার বিদায় বাণী-

"মোর কথা যদি মনে পড়ে তবে পরিও সিঁদুরখানি।"

আরও মনে পড়ে, "দীন দুঃখীর যে ছাড়া ভরসা নাই,

সেই আল্লার চরণে আজিকে তোমারে সঁপিয়া যাই।"

হায় হায় পতি, তুমি ত জান না কি নিঠুর তার মন;

সাজুর বেদনা সকলেই শোনে, শোনে না সে একজন।

গাছের পাতারা ঝরে পড়ে পথে, পশুপাখি কাঁদে বনে,

পাড়া প্রতিবেশী নিতি নিতি এসে কেঁদে যায় তারি সনে।

হায়রে বধির, তোর কানে আজ যায় না সাজুর কথা;

কোথা গেলে সাজু জুড়াইবে এই এক বুক-ভরা ব্যথা।

হায় হায় পতি, তুমি ত ছাড়িয়া রয়েছ দূরের দেশে,

আমার জীবন কি করে কাটিবে কয়ে যাও কাছে এসে।

দেখে যাও তুমি দেখে যাও পতি তোমার লাউ-এর লতা,

পাতাগুলি তার উনিয়া পড়েছে লয়ে কি দারুণ ব্যথা।

হালের খেতেতে মন টিকিত না আধা কাজ ফেলে বাকি,

আমারে দেখিতে বাড়ি যে আসিতে করি কতরুপ ফাঁকি।

সেই মোরে ছেড়ে কি করে কাটাও দীর্ঘ বরষ মাস,

বলি বলি ব্যথার দহনে থেমে আসে যেন শ্বাস।







নক্সী-কাথাঁটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আকেঁ ছবি,

ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি।

অনেক সুখের দুঃখের স্মৃতি ওরি বুকে আছে লেখা,

তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা।

এই কাঁথা যবে আরম্ভ করে তখন সে একদিন,

কৃষাণীর ঘরে আদরিণী মেয়ে সারা গায়ে সুখ-চিন।

স্বামী বসে তার বাশীঁ বাজায়েছে, সিলাই করেছে সে যে;

গুন্‌গুন করে গান কভু রাঙা ঠোঁটেতে উঠেছে বেজে।



সেই কাঁথা আজো মেলিয়াছে সাজু যদিও সেদিন নাই,

সোনার স্বপন আজিকে তাহার পুড়িয়া হয়েছে ছাই।

খুব ধরে ধরে আঁকিল যে সাজু রুপার বিদায় ছবি,

খানিক যাইয়া ফিরে ফিরে আসা, আঁকিল সে তার সবি।

আঁকিল কাঁথায়-আলু থালি বেশে চাহিয়া কৃষাণ নারী,

দেখিছে-তাহার স্বামী তারে যায় জনেমের মত ছাড়ি!

আঁকিতে আঁকিতে চোখে জল আসে, চাহনি যে যায় ধুয়ে,

বুকে কর হানি, কাঁথার উপরে পড়িল যে সাজু শুয়ে!

এমনি করিয়া বহুদিন যায়, মানুষে যত না সহে,

তার চেয়ে সাজু অসহ্য ব্যথা আপনার বুকে বহে!

তারপর শেষে এমনি হইল, বেদনার ঘায়ে ঘায়ে,

এমন সোনার তনুখানি তার ভাঙিল ঝড়িয়া-বায়ে।

কি যেন দারুণ রোগেতে ধরিল, উঠিতে পারে না আর;

শিয়রে বসিয়া দুঃখিনী জননী মুছিল নয়ন-ধার।

হায় অভাগীর একটি মানিক! খোদা, তুমি ফিরে চাও,

এরে যদি নিবে তার আগে তুমি মায়েরে লইয়া যাও!

ফিরে চাও তুমি আল্লা রসুল! রহমান তব নাম,

দুনিয়ায় আর কহিবে না কেহ তারে যদি হও বাম!



মেয়ে কয়, "মাগো! তোমার বেদনা জানি আমি সব জানি

তার চেয়ে যেগো অসহ্য ব্যথা ভাঙে মোর বুকখানি!

সোনা মা আমার! চক্ষু মুছিয়া কথা শোন, খাও মাথা,

ঘরের মেঝে মেলে ধর দেখি আমার নক্সী-কাঁথা!

একটু আমারে ধর দেখি মাগো, সূঁচ সুতা দাও হাতে,

শেষ ছবিখানা এঁকে দেখি যদি কোন সুখ হয় তাতে।"

পাণ্ডুর হাতে সূঁচ লয়ে সাজু আঁকে খুব ধীরে ধীরে,

আঁকিয়া আঁকিয়া আঁখি জল মুছে দেখে কত ফিরে ফিরে।

কাঁথার উপরে আঁকিল যে সাজু তাহার কবরখানি,

তারি কাছে এক গেঁয়ো রাখালের ছবিখানি দিল টানি;

রাত আন্ধার, কবরের পাশে বসি বিরহীর বেশে,

অঝোর বাজায় বাঁশের বাঁশীটি, বুক যায় জলে ভেসে।



মনের মতন আঁকি এই ছবি দেখে বারবার করি,

দুটি পোড়া চোখ বারবার শুধু অশ্রুতে উঠে ভরি।

দেখিয়া দেখিয়া ক্লান্ত হইয়া কহিল মায়েরে ডাকি,

"সোনা মা আমার! সত্যিই যদি তোরে দিয়ে যাই ফাঁকি;

এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার কবর পরে,

ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরি বুকে যাবে ঝরে!

সে যদি গো আর ফিরে আসে কভু, তার নয়নের জল,

জানি জানি মোর কবরের মাটি ভিজাইবে অবিরল।

হয়তো আমার কবরের ঘুম ভেঙে যাবে মাগো তাতে,

হয়ত তাহারে কাঁদাইতে আমি জাগিব অনেক রাতে।

এ ব্যথা সে মাগো কেমনে সহিবে, বোলো তারে ভালো করে,

তার আঁখি জল ফেলে যেন এই নক্সী-কাঁথার পরে,

মোর যত ব্যথা, মোর যত কাঁদা এরি বুকে লিখে যাই,

আমি গেলে মোর কবরের গায় এরে মেলে দিও তাই!

মোর ব্যথা সাথে তার ব্যথাখানি দেখে যেন মিল করে,

জনমের মত সব কাঁদা আমি লিখে গেনু কাঁথা ভরে।"

বলিতে বলিতে আর যে পারে না, জড়াইয়া আসে কথা,

অচেতন হয়ে পড়িল যে সাজু লয়ে কি দারুণ ব্যথা!



কানের কাছেতে মুখ লয়ে মাতা ডাক ছাড়ি কেঁদে কয়,

"সাজু সাজু! তুই মোরে ছেড়ে যাবি এই তোর মনে লয়?"

"আল্লা রসুল! আল্লা রসুল!" বুড়ী বলে হাত তুলে,

"দীন দুঃখীর শেষ কান্না এ আজিকে যেয়ো না ভুলে!"

দুই হাতে বুড়ী জড়াইতে যায় আঁধার রাতের কালি,

উতলা বাতাস ধীরে বয়ে যায়, সব খালি! সব খালি!!

"সোনার সাজুরে, মুখ তুলে চাও, বলে যাও আজ মোরে,

তোমারে ছাড়িয়া কি করে যে দিন কাটিবে একেলা ঘরে।"



দুখিনী মায়ের কান্নায় আজি খোদার আরশ কাঁপে,

রাতের আঁধার জড়াজড়ি করে উতল হাওয়ায় দাপে।



চৌদ্দ

*****



উইড়া যায়রে হংস পঙ্খি পইড়া রয়রে ছায়া;

দেশের মানুষ দেশে যাইব-কে করিবে মায়া।

- মুর্শিদা গান



আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,

নীরবে বসিয়া কোন্‌ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।

মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি;

ফাগুনের রোদে শুখাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি!

নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি,

কোন্‌ সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি!



বাতাসের পায়ে বাজে না আজিকে ঝল মল মল গান,

মাঠের ধুলায় পাক খেয়ে পড়ে কত যেন হয়ে ম্লান!

সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথ পরে,

মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে!

মাঠে মাঠে কাঁদে কলমীর লতা, কাঁদে মটরের ফুল,

এই একা মাঠে কি করিয়া তারা রাখিবেগো জাতি-কুল।

লাঙল আজিকে হয়েছে পাগল, কঠিন মাটিরে চিরে,

বুকখানি তার নাড়িয়া নাড়িয়া ঢেলারে ভাঙিবে শিরে।



তবু এই গাঁও রহিয়াছে চেয়ে, ওই গাঁওটির পানে,

কত দিন তারা এমনি কাটাবে কেবা তাহা আজ জানে।

মধ্যে লুটায় দিগন্ত-জোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ;

সারা বুক ভরি কি কথা সে লিখি, নীরবে করিছে পাঠ!

এমন নাম ত শুনিনি মাঠের? যদি লাগে কারো ধাঁধা,

যারে তারে তুমি শুধাইয়া নিও, নাই কোন এর বাধা।



সকলেই জানে, সেই কোন্‌ কালে রুপা বলে এক চাষী,

ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমেতে গলায় পড়িল ফাঁসি।

বিয়েও তাদের হয়েছিল ভাই, কিন্তু কপাল-লেখা,

খণ্ডাবে কেবা? দারুণ দুঃখ ভালে এঁকে গেল রেখা।

রুপা এক দিন ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দূর দেশে,

তারি আশা-পথে চাহিয়া বউটি মরিল শেষে

মরিবার কালে বলে গিয়েছিল-তাহার নক্সী-কাঁথা,

কবরের গায় মেলে দেয় যেন বিরহিণী তার মাতা!







বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে,

শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশী বেদনার তালে তালে।

প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়,

রোগ পাণ্ডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়!

শিয়রের কাছে পড়ে আছে তার কখানা রঙিন শাড়ী,

রাঙা মেঘ বেয়ে দিবসের রবি যেন চলে গেছে বাড়ি!

সারা গায় তার জড়ায়ে রয়েছে সেই যে নক্সী-কাঁথা,

আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা।



কেহ কেহ নাহি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে,-

মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নক্সী-কাঁথাটি ধরে;

হাতে তার সেই বাঁশের বাশীঁটি বাজায় করুণ সুরে,

তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ওগাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে।

সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নক্সী-কাঁথার মাঠ

ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ।



*সমাপ্ত*

মন্তব্য ২১ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (২১) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা মার্চ, ২০১০ রাত ১২:৩৫

কানিজ বলেছেন: চমৎকার ! সংগ্রহে ছিল-এক ছোট ভাই নিয়ে হাওয়া ।
এখন হাতের কাছে পেয়ে গেলাম-আপনাকে অ-নে-ক ধণ্যবাদ ।

০১ লা মার্চ, ২০১০ রাত ১:৪০

মে ঘ দূ ত বলেছেন: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।

২| ০১ লা মার্চ, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৭

দীপান্বিতা বলেছেন: আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,
নীরবে বসিয়া কোন্‌ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।
মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি;
ফাগুনের রোদে শুখাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি!
নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি,
কোন্‌ সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি!

বাতাসের পায়ে বাজে না আজিকে ঝল মল মল গান,
মাঠের ধুলায় পাক খেয়ে পড়ে কত যেন হয়ে ম্লান!
সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথ পরে,
মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে!
মাঠে মাঠে কাঁদে কলমীর লতা, কাঁদে মটরের ফুল,
এই একা মাঠে কি করিয়া তারা রাখিবেগো জাতি-কুল।
লাঙল আজিকে হয়েছে পাগল, কঠিন মাটিরে চিরে,
বুকখানি তার নাড়িয়া নাড়িয়া ঢেলারে ভাঙিবে শিরে।

তবু এই গাঁও রহিয়াছে চেয়ে, ওই গাঁওটির পানে,
কত দিন তারা এমনি কাটাবে কেবা তাহা আজ জানে।
মধ্যে লুটায় দিগন্ত-জোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ;
সারা বুক ভরি কি কথা সে লিখি, নীরবে করিছে পাঠ!
এমন নাম ত শুনিনি মাঠের? যদি লাগে কারো ধাঁধা,
যারে তারে তুমি শুধাইয়া নিও, নাই কোন এর বাধা।

সকলেই জানে, সেই কোন্‌ কালে রুপা বলে এক চাষী,
ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমেতে গলায় পড়িল ফাঁসি।
বিয়েও তাদের হয়েছিল ভাই, কিন্তু কপাল-লেখা,
খণ্ডাবে কেবা? দারুণ দুঃখ ভালে এঁকে গেল রেখা।
রুপা এক দিন ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দূর দেশে,
তারি আশা-পথে চাহিয়া বউটি মরিল শেষে
মরিবার কালে বলে গিয়েছিল-তাহার নক্সী-কাঁথা,
কবরের গায় মেলে দেয় যেন বিরহিণী তার মাতা!

বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে,
শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশী বেদনার তালে তালে।
প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়,
রোগ পাণ্ডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়!
শিয়রের কাছে পড়ে আছে তার কখানা রঙিন শাড়ী,
রাঙা মেঘ বেয়ে দিবসের রবি যেন চলে গেছে বাড়ি!
সারা গায় তার জড়ায়ে রয়েছে সেই যে নক্সী-কাঁথা,
আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা।

কেহ কেহ নাহি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে,-
মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নক্সী-কাঁথাটি ধরে;
হাতে তার সেই বাঁশের বাশীঁটি বাজায় করুণ সুরে,
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ওগাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে।
সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নক্সী-কাঁথার মাঠ
ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ।

০৩ রা মার্চ, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৫

মে ঘ দূ ত বলেছেন: ভুল টুল হল নাকি কোথাও? নাকি এই লাইন কটাই মনে ধরেছে? :)

৩| ০২ রা মার্চ, ২০১০ রাত ১২:১৪

বিষন্ন নীল বলেছেন:
সংগ্রহে রাখলাম।
ভাল থাকুন সবসময়........... :)

০৩ রা মার্চ, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৭

মে ঘ দূ ত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ নীল।

আপনিও ভালো থাকুন নিরন্তর।

৪| ০৩ রা মার্চ, ২০১০ রাত ১১:২২

দীপান্বিতা বলেছেন: ভিষণ প্রিয় এই লাইনগুলো!...পড়তে পড়তে কি যে অদ্ভুত কষ্ট হয়!!!

০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ সকাল ৮:৫৮

মে ঘ দূ ত বলেছেন: আসলেই। আমার চোখে পানি চলে এসেছিল।

৫| ০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ সকাল ৯:০২

হ্যামেলিন এর বাঁশিওয়ালা বলেছেন: জসীমউদদীন যেন কলম নয়, হৃদয় দিয়ে লিখতেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!

০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২৫

মে ঘ দূ ত বলেছেন: ধন্যবাদ বাশিঁওয়ালা :)

আছো কেমন?

৬| ০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৪১

অপ্‌সরা বলেছেন: গীতিকাব্যনৃত্য করেছিলাম একবার।

০৫ ই মার্চ, ২০১০ সকাল ৮:২৫

মে ঘ দূ ত বলেছেন: বাহ্‌ :) আর আপনি নিশ্চই সাজু সেজেছিলেন?

৭| ১১ ই মার্চ, ২০১০ রাত ১০:৫৪

তারার হাসি বলেছেন:
খুব ভাল লাগল পড়তে গিয়ে, যেন হারিয়ে গিয়েছি সেই কালে।
ধন্যবাদ।

১২ ই মার্চ, ২০১০ সকাল ৭:৩৩

মে ঘ দূ ত বলেছেন: অনেকদিন বাদে হাসিকে মেঘরাজ্যে দেখে ভালো লাগছে অনেক।

অনেক ধন্যবাদ পাঠের জন্য।

৮| ০২ রা এপ্রিল, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২৭

জুন বলেছেন: নকশী কাঁথার মাঠ আমার কাছে একটা মাস্টার পীস ।
সব সময়ের ভাল লাগার একটা করূন উপাখ্যান ।
অনেক দিন পর আবার পড়লাম
আবার কাঁদলাম ।

০২ রা এপ্রিল, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৫৭

মে ঘ দূ ত বলেছেন: "সব সময়ের ভাল লাগার একটা করূন উপাখ্যান ।" - ভালো বলেছেন।

পাঠ করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

৯| ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১০ রাত ৯:২২

আকাশ অম্বর বলেছেন:

সেই কাঁথা আজো মেলিয়াছে সাজু যদিও সেদিন নাই,
সোনার স্বপন আজিকে তাহার পুড়িয়া হয়েছে ছাই।


শেষ করার জন্য ধন্যবাদ, মেঘদূত।
আজ মন্তব্য করছি।
শুভেচ্ছা, অনেক।

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১০ রাত ৯:২৫

মে ঘ দূ ত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ হে আকাশ।

উপহারস্বরুপ মেঘদূতের তরফ থেকে আকাশের জন্য শুভেচ্ছা কাঁথা প্রেরণ করা হইলো :)

১০| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২০

মাহী ফ্লোরা বলেছেন: চমৎকার ।অনেকদিন পর শেষটুকু পড়লাম।অনেক ধন্যবাদ আবারো আপনাকে,কাব্যটি পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

১১| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২৬

মাহী ফ্লোরা বলেছেন: চমৎকার ।অনেকদিন পর শেষটুকু পড়লাম।অনেক ধন্যবাদ আবারো আপনাকে,কাব্যটি পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

২৮ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ১২:০৯

মে ঘ দূ ত বলেছেন: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.