![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষের জীবনটা অনেক বৈচিত্রময়। কারণ, জীবনটা বহু ঘটনার সমন্বয়ে সৃষ্ট একটা শাশ্বত, বাস্তব গল্প। যেখানে কোন কাল্পনিক ঘটনার অনুপ্রবেশ নেই। জীবনটা বৈচিত্রময় হয়ে ওঠে তখনি যখন এমন কোন ঘটনা বাস্তবে ঘটে যায় যেটা কল্পনার জীবনে ঘটাও সম্ভবপর বলে মনে হয় না। যা জীবনে কখনও কল্পনাও করিনি তা আজ দু’চোখের সামনে ঘটে গেল, কেবল নির্বাক, নিশ্চল মূর্তির মত চেয়ে দেখলাম। তখন বাস করতাম সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানায়। একেবারে উপকূল অঞ্চলের চর ঘেঁষে। আমার বাবা তার এক ছেলে বেলার বন্ধুর সাথে সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে চিংড়ি মাছের ব্যবসা করতেন। সেই খাতিরে তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ছিল অনেক গভীর।আর এই সম্পর্কটাকে আরও বেশী অটুট করার প্রয়াসে বাবা তার বন্ধুর মেয়ের সাথে সাধারণভাবে বিয়ে দিয়ে রেখেছিলেন সেই ছোট বেলাতে। কথা ছিল, ছেলে যখন কর্মক্ষেত্রে নামবে তখন আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়েকে তার শ্বশুর বাড়ীতে আনা হবে। স্বচ্ছলতার দিক দিয়ে আমাদের অবস্থ ছিল অনেক ভাল। কিন্তু মাঝ পর্যায়ে তিনটি মাছ ধরা ট্রলার জলদস্যুদের কবলে পড়ায় অবস্থা আর আগের মত ছিল না।
মেয়েটির নাম ছিল ফুলজান। তখন সে ছিল দশম শ্রেণীর ছাত্রী। তবে চিন্তা-চেতনায় অনেক বড় ছিল সে। অনেক স্বপ্ন ছিল তার মনে। গ্রামে একটি স্কুল খুলবে, সেখানে গ্রামের ছেলে-মেয়ে এমনকি বয়স্ক লোকদেরকেও শিক্ষার আলোয় আলোকিত করবে। আর একটা ইচ্ছা ছিল- ঢাকায় এক মাস মত থেকে লোক মুখে শোনা সেখানকার সব আজব জিনিস দেখবে।
সেই প্রথম ঢাকায় আসার পূর্বের কথা- সেদিন স্কুলের পেছনে কদম গাছটির তলায় কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল ওর সাথে। বললাম- মা-বাবা বলছিল এ বছরের শেষের দিকে তোমাকে আমাদের বাড়ীতে তুলে নেবে। এত বড় সংসারে মা আর একা পারছে না। কিন্তু সাথে সাথে সে না বলে দিল। বলল- বিয়ের পর খাওয়াবা কি শুনি? বললাম, আমাদের কি কম আছে? এখনো যা কিছু আছে তা নাড়াচাড়া করলেও চলে যাবে। তখন সে বলল- আমাদের আছে বলছ কেন, আমার আছে বলত! এখন যা কিছু আছে তা তো তোমার আব্বার, কিন্তু আামি যার কাছে যাব তার তো কিছু থাকা দরকার। তা না হলে বলা যায় না কখন কি ঘটে যায়! কারণ মেয়েরা চায় স্থায়ী স্বচ্ছলতার নিরাপত্তা। তুমি তো আর লেখাপড়া করলে না। সেই একবার এস.এস.সি পরীক্ষায় ফেল করে আর পরীক্ষা দিলে না। বললাম- আমার দ্বারা যততুকু হয়েছে এর বেশী আর হবে না। যা জানি তা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব অনায়াসে চালিয়ে যেতে পারব। হঠাৎ ফুলজান বলল- আচ্ছা, তুমি একটা কাজ কর, ঢাকায় যাও। সেখানে তো অনেক কাজ পাওয়া যায়। দেখনা , গ্রামের কত লোক ঢাকায় যেয়ে কত কি না করছে। তুমি যতক্ষণ না নিজে কিছু করবা ততক্ষণ আমি তোমাদের বাড়ীতে আসছি না। এটাই আমার মনের কথা।
এর কিছুদিন পর সত্যিই ঢাকা চলে আসলাম। কিন্তু ওর সাথে দেখা করিনি। ভাবলাম ওকে কিছু না জানিয়ে আগে একটা ভলো কাজ যোগাড় করে কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে ওর সামনে হাজির হব, এর আগে নয়। কারণ, জেদ কেবল যে শুধু মেয়েদের বেলাতে নয় বরং ছেলেদের বেলাতেও আছে তা প্রমাণ করে আমার অন্য কাজ। অবশ্য আমার ঢাকায় আসার খবর পেয়ে ও খুব মন খারাপ করেছিল। আমাকে বাড়ী ফিরিয়ে আনার জন্য আব্বাকে অনেক বার বলেছিল। আসলে মানুষ কাছে থাকলে তার অনুপস্থিতির বিরহ-বেদনা আগে বোঝা যায় না। প্রায় সে বাড়ীতে এসে আমার খোঁজ-খবর নিত আর ইচ্ছেমত বকাবকি করত আর আঁড়ালে চোখের পানি ফেলত।
ওর নানার বাড়ী ছিল পাশের গ্রামে। প্রায় সে ওখানে যেত। যাওয়ার আগের দিন ও আমাকে বলে রাখত। ওদের ছোট নৌকা নিয়ে দু’জনে যেতাম। রাতে থাকত না কখনো। ও শুধু যেত আমলকি আর তেঁতুলের জন্য। এগুলো নাকি ওর খুব প্রিয়। আমাকে অবশ্য ওর নানার বাড়ীতে নিয়ে যেত না, ওর নাকি লজ্জা লাগে সবাই আমাকে নিয়ে খেপায় বলে। তাই একলা নদীর পাড়ে নৌকায় অপেক্ষা করতাম। আর আসার সময় বকবকানিতে অস্থির করে তুলত সারাটা পথ। কে আমলকি দিয়েছিল, কে চুল বেঁধে দিয়েছিলকে আসতে দিচ্ছিল না ইত্যাদি শুনতে শুনতে অস্থির হয়ে যেতাম। তবু বলার কিছুই নেই, কেবল সমর্থন দিয়ে যেতাম। ওর অল্পতেই অনেক রাগ। একবার রাগ করে বসলে সহজে ফেরানো দায়। আর সেই দিনটিই মাটি ,কারও সাথে কথা নেই, খাওয়া নেই আরও কত কি তার চেয়ে চোখ কান বন্ধ করে ওর বকবকানি শোনাই অধিকতর শ্রেয়।
মাঝে মাঝে ঢাকায় ওর জন্য খুব মন খারাপ হত। আসলে ওর হাসিতে, অভিমানে কোন অপবিত্রতা ছিল না; কেবল ছিল জীবন্ত, স্নিগ্ধ, পবিত্র সর্বকালে। প্রথম দিকে শহরের কোলাহলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। শুধুই প্রতিদিনকার ঘটনাগুলো মনে পড়ছিল বারবার। এখানকার যান্ত্রিক জীবন আমাকে খুব বিষন্ন করে তুলেছিল। কিন্তু করা কি, কিছু তো একটা করতেই হবে আমাকে, তা না হলে ও যে আমাকে অকর্মণ্য ভাববে। তাই শত কষ্টেও হাল ছাড়িনি।
প্রায় ওকে স্বপ্নে দেখতাম। ওর সাথে ধানের ক্ষেতে, মাছের ঘেরে, তালতলায় মাটির জিনিস কিনতে, নৌকায় চড়ে ওকে পৌঁছে দিচ্ছি নানার বাড়ীতে ইত্যাদি। আসলে ওকে প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করতাম আমি। একদিন তালতলায় গিয়েছিলাম ওকে একটি মাটির ব্যাংক কিনে দিতে। অনেক বাছাবাছির পর ও একটি পছন্দ করল। বিশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম সেটা। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে ফিরে আসার সময এবড়ো-থেবড়ো পথে সেটি ভেঙ্গে গিয়েছিল। আমি হেসে খুন আর ও শুরু করে দিল কান্না। পরে বুঝলাম ব্যথার জন্য নয়, কেবল ওই মাটির জিনিসটার জন্য ও কাঁদছিল। আসলে আমি ওকে যে জিনিসটা দিতাম তা সে স্বযত্নে তুলে রাখত। আজ কি যেন শূন্যতা বিরাজ কেরছে আমার চারদিকে, আমি ক্রমে হারিযে যাচ্ছি অজানায়।সেখানে আলো নেই, আশা নেই, কোন ঠাঁই নেই।
ও প্রায় আমাকে বলত আমাকে নিয়ে ওর নাকি খুব ভয় হয়। যদি আমি হারিয়ে যায় কোন দিন , চলে যায় কোন এক অজানায় ওর সীমানার বহু দূরে! আসলে সত্য বলতে ও আমাকে অনেক বেশী ভালবাসত, যার কারণে আমাকে ঘিরে ওর ছিল এতসব চিন্তা। সেদিন রেডিওতে শুনলাম দেশের উপকূল অঞ্চলগুলোতে নয় নম্বর বিপদ সংকেত দেওয়া হয়েছে। যে কোন মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে অতি শক্তিশালী সামুদ্রিক বিপর্যয়, যার নাম ”সিডর”।এর ফলে সৃষ্টি হবে বড় ধরণের ঝড় ও সেই সাথে জলোচ্ছ্বাস। আমি তখন অফিসে কাজ করছিলাম। পরের কাজ তাই যখন তখন বাইরে আসা যায় না। কাজ হতে বাসায় ফিরলাম রাত দশটায়। ওভার টাইম বাধ্যতামূলক ছিল, কারণ কম্পানীর অনেক কাজ পড়েছিল। ইতোমধ্যে ঢাকায় খুব জোরে বাতাস বহা শুরু করেছে। আকাশে কোন তারা নেই। সমস্ত আকাশ আজ ভয়ংকার এক কালো রূপ ধারণ করেছে। মনে হয় প্রকৃততে আজ অস্বভাবিক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এলাকার খবর জানার জন্য ছুটে গেলাম মোবাইল ঘরের দিকে, কিন্তু কোন দোকান খোলা পেলাম না। কেবল আমার মত কয়েকজন হতভাগা লোক এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করছে। সারা রাত ঘুম হল না। কেবল বাড়ীর চিন্তায় অস্থির হয়ে খাটের এপাশ-ওপাশ করে কেবল প্রহর গুনছি কখন ভোর হবে। শুধু ভয় হতে লাগল, যদি ঢাকাতে এমনটা হয় তবে না জানি উপকূল অঞ্চলের দিকে কি ঘটছে। সারা রাত প্রচন্ড ঝড় আর বৃষ্টি হল। ঢাকার অনেক জায়গাতে পানি জমে অস্থায়ী বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় ঘর-বাড়ী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু মন আমার কেবলই বাড়ীর দিকে। বাবা-মা কেমন আছে, ফুলজানেরা কেমন আছে, কেমন আছেন এলাকার অন্য লোকেরা। এসব চিন্তা মনকে কেবল উতলা করে তুলছে। শুধু ভয় হচ্ছে না জানি কোন বিপদ ঘটে গেল। ভোর না হতেই কিছু রান্না করে খেয়ে তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম বাড়ীর উদ্দেশ্যে। ওর জন্য প্রথম বেতনের টাকা পেয়ে একটা নীল রঙের শাড়ী আর সেই ভেঙ্গে যাওয়া ব্যাংকের মত একটি ব্যাংকও কিনেছিলাম। এগুলোও সাথে নিয়ে চললাম। যাওয়ার পথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম কিন্তু তা বন্ধ পেলাম।
বিকাল বেলা গাড়ী থেকে নেমে সোজা রওনা দিলাম গ্রামের দিকে। পৌঁছে দেখি এ যেন এক অচেনা জায়গা। কোথাও কোন ঘর-বাড়ী নেই, আর যে কয়টি রয়েছে তার ছাউনি নেই। লোক-জনের কোলাহল নেই, নেই গরু-ছাগল ও পাখীর ডাক। গাছগুলো উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। খানিক দূরে গিয়ে দেখি কিছু লোক মিলে পানিতে কি যেন খুঁজছে। তাদের কাছে জানতে পারলাম জলোচ্ছ্বাসে লোকজন গরু-ছাগল সব কিছুই ভেসে গেছে। আর জীবিতরা আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিকে যেন
কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। ক্রমে আমি যেন নিজেকে ভুলে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি কোন এক কল্পলোকে। অন্য সময় যখন বাইরের কোন স্থান থেকে আসি তখন কত লোক আমার জন্য অপেক্ষা করে, কিন্তু আজ আমি এ কোথায় এসেছি! এ যেন আত্না বিবর্জিত কোন এক অলৌকিক গ্রহে প্রাণীর সন্ধানে বের হয়েছি। কেউ নেই আজ আমাকে স্বাগত জানাবার। কেবল দেখি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ গর্জে আমাকে আহ্বান জানাচ্ছে তার সাথে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার। নীরব দর্শকের ভূমিকায় দাড়িয়ে রইলাম সাগরের তীরে। এমন সময় দেখি ফুলজানের বাবা সেই নৌকাখানি বেয়ে আমার দিকে আসছে। আমাকে বললেন- তোমার বাবা-মা সবাই বেঁচে আছে, তারা এখন তোমার নানার বাড়ীতে আছে। কিন্তু ফুলজানকে এখনও পেলাম না। কাল আমি ব্যবসার কাজে বাইরে ছিলাম। এসে দেখি এই অবস্থা। আশ্রয় কেন্দ্র সহ বিভিন্ন আত্নীয়দের বাড়ীতে খোঁজ নিয়েছি।কিন্তু কোথাও নেই। তাই অবশেষে এই শেষ ঠিকানায় খুঁজে বেড়াচ্ছি।
বাকরুদ্ধ এই পরিস্থিতিতে নিজেকে আর কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছি না। যার জন্য আমি বাড়ী ছাড়া আজ সেই কিনা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল কাউকে কিছু না বলে! এ যেন তাকে না জানিয়ে দূরে চলে যাওয়ায় আমার উপর তার অব্যক্ত অভিমানের নীরব প্রতিবাদ! তাই বলে আমার এই ক্ষুদ্র সীমানা পেরিয়ে অসীমে কেন! কেন দু’জনের আজ দুই পৃথিবী! তার কাছে যে আর কি জানতে চাইব তা ঠিক করে পারলাম না। শব্দগুলো কিছুতেই বাক্যের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলায়িত হতে চাচ্ছে না। তিনি আমাকে নানার বাড়ীর দিকে যেতে বলে আবার নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য উদ্যত হলেন। আমি বললাম- কোথায় যাচ্ছেন? বললেন-ফুলজানকে আনতে! তখন বললাম- আমিও যাব।
মেহেদী হাছান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ফার্মেসী বিভাগ
e-mail: [email protected]
©somewhere in net ltd.