![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পকেটে মাত্র পাঁচ টাকা আছে। গন্তব্য বরিশাল লঞ্চ ঘাট। রফিক বরিশাল লঞ্চ ঘাটে নেমেই হাঁটতে থাকে পাবলিক টয়লেটটার দিকে। দীর্ঘ সময় নিয়ে উদর শুন্য করে এবার হাত ঢোকায় পকেটে। তা থেকে বেরিয়ে আসে দশ, বি্ পঞ্চাশ, একশ আর পাঁচশ টাকার এতগুলো নোট।
আজকের রোজগার মন্দ হয়নি। এক লঞ্চঘাট থেকে অন্য লঞ্চঘাটে এসেছে রফিক; এরই মাঝে পচিশ'শ পঁয়তাল্লিশ টাকা রোজগার, বেশ ভালই। সদরঘাটে আজকাল বেশ ভালই ইনকাম হচ্ছে। ঈদের মৌসুমটাতে বড্ড ব্যস্ত থাকতে হয়। সবসময় চোখ খোলা রাখতে হয়। কে টাকা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে- আসছে, বুঝে নিতে হয়। রফিক এ ব্যাপারে এক্সপার্ট বলা যেতে পারে। পকেট দেখেই সে বলে দিতে পারে কত টাকা আছে তাতে। কোন লোককে চটপটির দোকানীকে পয়সা মিটিয়ে দেবার ধরন দেখেই বলে দিতে পারে তার কোন টাকার কতটা নোট আছে। শুধু যারা প্রাইভেট গাড়ি চড়ে ঘোড়া ফেরা করে – তাদের ব্যাপারেই সে কেবল অজ্ঞ। একবার এক কোট-টাই পড়া ভদ্র লোককে গাড়ি থেকে নামতে দেখে তার পিছু নেয় সে। চকচকে চেহারার ভদ্র লোকটা মাত্র জেল দেয়া চকচকে চুলের ভাঁজ ঠিক করতে পকেট থেকে হাত বের করেছে, এর মাঝেই রফিক তার মানি ব্যাগ সাফা করে দিয়েছে। কিন্তু সেদিনকের মত অপমান তাকে আর কোনোদিন হতে হয়নি। মানিব্যাগ পোস্টমর্টেম করে সে দেখে তাতে কেবল ১৪টা ভিজিটিং কার্ড আর শক্তমত কয়েকটা অপরিচিত প্ল্যাস্টিকের কার্ড। রাগে অপমানে সে ওগুলো ফেরত দিয়ে আসে লোকটাকে। লোকটা সেগুলো পেয়ে সে কি খুশি! খুশি হয়ে লোকটা তাকে পঞ্চাশ টাকা বকশিস দিয়েছিল প্লাস্টিকের কার্ড গুলোর জন্য। রফিক ক্রেডিট কার্ডগুলোকে তখন চিনতে পারেনি, পেরেছিল আরো অনেক পরে। সে সব অনেক কথা। তারপর থেকে প্রাইভেট গাড়ি চড়া লোক দেখলে একদমই টার্গেট করে না। জানে, ওরা সব টাকা মাটির নিচে- ব্যাঙ্কে পুতে রাখে। প্রয়োজন হলেই কেবল সেটা ঠাস করে ভেঙ্গে ফেলে।
ঈদের মৌসুমটাতে ব্যাপক ইনকাম। বছরের সারাটা সময়জুড়ে যতটা না হয় তার বেশি হয় এই ঈদ মৌসুম এ। তাই খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। ওভারটাইম করতে হয় সকাল- রাত। দিনে আট টা ট্রিপ চলে ফেরিতে। কিন্তু সবকটাতেই ব্যবসা খুলে বসতে পারেনা সে। তাকে নিয়ম মেনে চলতে হয়। আফছার মিয়াকে ট্রিপ প্রতি পঞ্চাশ টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। তাছাড়া পকেট কাটার পারমিশন পাওয়া যায়না। একবার তাকে টাকা না দিয়ে পকেট কাটতে গিয়ে ভারি বিপদে পড়তে হয়েছিল টেম্পু আবুলের। ৫ দিন জেলে থাকতে হয়েছিল- তাও আবার ঈদের রমরমা মৌসুমটাতে। অবশ্য এর সুবাদে রফিক ওভার টাইম করে বাড়তি কিছু টু পাইস কামিয়ে নিয়েছিল সেবার।
ফিরতিপথে আরো সতের'শ টাকা রোজগার হয় তার। হাসিমুখে বাড়ির পথে পা বাড়ায় রফিক। রাস্তার মোড় থেকে পাঁচ টাকার বাদাম কিনে নেয়, তার ঘড়ে অপেক্ষারত হামিদাবানুর জন্য। পাঁচ বছর হয় বিয়ে হয়েছে ওদের। কিন্তু ভালবাসা ফিকে হয়ে যায়নি এতটুকুও। সংসারের হাজারো ঝামেলার মাঝেও সে বাড়ী ফেরার সময় ঠিক মনে করে স্ত্রীর প্রিয় জিনিস গুলো আনতে ভোলেনা।
সংসারের শত টানাপড়েন এর মাঝেও সে স্ত্রীকে কখনো মুখ কাল করে থাকতে দেখেনি। বছরে একটা নতুন কাপড়ও তাকে কিনে দিতে পারে না রফিক, তবু এ নিয়ে কখনো কোন অভিযোগ করতে দেখা যায়নি তাকে। বলতেগেলে এ বিষয়ে রফিক একজন সুখি মানুষ। তবে তার পেশা নিয়ে সারাক্ষণই দুশ্চিন্তায় থাকে সে। হামিদাবানু জানেনা ঠিক কি তার স্বামীর পেশা। যতবারই সে জিজ্ঞেস করেছে ততবারই রফিক এড়িয়ে গেছে। বিষয়টা ভাল ঠেকেনি তার। তার সারাক্ষণই মনে হয়- ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সবসময় তাই সে দুশ্চিন্তায় থাকে। রফিক বাড়িতে না আসা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। আর কদিন বাদেই ওদের ঘর আলো করতে আসছে ওদের ভালবাসার ফসল, নিজের সন্তান। ভাবতেই হামিদাবানুর চোখে পানি চলে আসে।
বাচ্চার নামও ঠিক হয়েছে। ছেলে হলে নাম কি হবে আর মেয়ে হলে কি, সব একদম রেডি। রফিক দায়িত্ববান পুরুষ; সে সবরকম ব্যবস্থা ঠিক করে রেখেছে। তবু যেন হামিদার মনে কিসের এক ভয় কাজ করে সারাক্ষণ। রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন দেখে চমকে ওঠে।
শুক্রবার দুপুর। রফিক তার ব্যবসার খাতা এখনো খুলে বসেনি। তবে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবেনা তাকে। বলাকা-২ এক্ষুনি লঞ্চঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশে রওনা দেবে। লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে সে। লক্ষ্য রাখছে সম্ভাব্য শিকারের দিকে। ভিড়ের ভেতর কিছু একটা চকচক করে ওঠে। রফিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকটায় তাকায়। চকচকে টাক ওয়ালা এক ভদ্রলোক। হাতে কেতাদুরস্ত হ্যান্ড ব্যাগ। চোখ দুটো চকচক করে ওঠে রফিকের। সে নিশ্চিত ওর ভেতর কম করেও লাখখানেক টাকা আছে। চকচকে টাকাগুলোর ঘ্রাণও সে এরিমদ্ধে পেতে শুরু করেছে।
লোকটির নাম বদরআলি আকন্দ। বয়স ৫৫। পেশায় একজন কেরানি। বাড়ী বরিশাল। সদর উপজেলার ডিগ্রি কলেজটার পাশে যে কাঁচাবাজার, তার উল্টোদিকের ৩ নম্বর বাড়িটা তার। বাড়ির নাম 'নিলুফা মঞ্জিল'- তার মেয়ের নামে নাম। বাড়ির অবস্থা বেশি ভাল না। তবে বড় শখ করে বদরআলি বাড়ির নাম দিয়েছেন ' নিলুফা মঞ্জিল' ; হাজার হলেও শখের দাম লাখ টাকা। তার বড় মেয়ে নিলুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পাত্র অতি বিনয়ী, ভদ্র , শিক্ষিত পরিবার, পেশায় কন্ট্রাক্টর। বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানার বড় রাস্তাটা তারই তৈরি। বরিশালে রাস্তার কন্ট্রাক্ট পেয়ে প্রথম বরিশাল আসা। কলেজে যাবার পথেই মেয়েকে দেখে পছন্দ। পরদিনই ছেলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় বাড়িতে। মেয়ের ভাগ্য খুবি ভাল।
বড় লক্ষি মেয়ে নিলু। বাবার জন্য গোসলের পানি দেয়া, মায়ের কাজে সাহায্য করা, ঘরদোর পরিস্কার রাখা থেকে শুরু করে মোটামুটি সব কাজেই সে পারদর্শী। বদরআলির অভ্যাস অফিস থেকে এসে হাতমুখ পরিস্কার করে এক কাপ আগুন গরম চা খাওয়া। নিলুফা সেই কাজটি করে নিখুঁতভাবে। অফিস থেকে এসে মেয়ের হাতের এক কাপ চা না খেতে পারলে তার শান্তি লাগে না। ওর বিয়ে হয়ে গেলে... চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসে বদরআলির। এ হয়েছে এক সমস্যা, একটুতেই চোখে পানি চলে আসে। বয়স টা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।
লঞ্চে প্রচণ্ড ভিড়। এর মাঝে কোনরকমে জায়গা করে নেয় সে। হাতের ব্যাগ খুব যত্ন করে বুকেটেনে নেয়। বদরআলি ঢাকা গিয়েছিলেন টাকা জোগাড় করতে। বরিশালে একমাত্র সম্বল ২ বিঘা জমি বিক্রি করে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকার বাবস্থা করেছিলেন , সেই টাকা আনতেই ঢাকা যাওয়া। ব্যাগে সেই টাকা । তার হবু জামাই বড় ভদ্র আর অমায়িক। বিয়েতে একটা পয়সাও যৌতুক দাবি করে নি। আজকাল যৌতুক ছাড়া বিয়ে শাদি ! তবে তার জামাই হঠাৎই একটু বিপদে পড়ে গেছে। বদরআলির কাছে গিয়ে কাচুমাচু করে জানায়, "আব্বা, একটা টেন্ডার পাইছি, কিন্তু মাত্র কয়ডা ট্যেকার জন্য টেন্ডার ডা বোধয় হাতছাড়া হয়া যায়, টেন্ডার ডা পাইলে ব্যাপক লাভ হইত, আপনের মাইয়ারে নিয়া ব্যাংকক ঘুড়তে যাইতে পারতাম। শুনছি দেশটা নাকি বড়ই সুন্দর।" সামান্য কিছু টাকার জন্য সেটা হাতছাড়া হতে বসেছে। কিন্তু কারো কাছেই সে হাত পাতবে না। কিছুতেই না। বদরআলি জানতে চান, "কত টাকা?" ছেলে তো কিছুতেই বলবে না, লজ্জায় সে একদম লাল। তবুও বারবার জোরাজুরিতে সে জানায়, " আব্বা, মাত্র আড়াই লক্ষ টাকা।" সেই টাকার জোগাড় করতেই মুলত ঢাকা যাওয়া। সঙ্গে বিয়ের আয়জনের জন্য আরো বাড়তি কিছু, সব মিলিয়ে তিন লক্ষ পঁচিশ হাজার।
বিয়ের পর মেয়ের সুখের জন্যই এসব করা। কখনো যেন তার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন খোটা না দিতে পারে, মেয়ের বাবা জামাইয়ের বিপদে দু পয়সা সাহায্য করেনি। মেয়ের সুখের জন্য বদরআলি সব কিছু ত্যাগ করতেও প্রস্তুত।
লঞ্চ ছেড়ে দেয়। বদরআলি ভাবতে থাকেন তার মেয়ের কথা, বাড়ির কথা। হঠাৎ তার পায়ে ধাক্কা লাগে। লাল শার্ট পড়া হাসিখুশি চেহারার লোকটা পায়ে সালাম করে বলে, " চাচা, বেয়াদবি নিবেন না, ভুল কইরা লাইগা গেছেগা।" লোকটাকে দেখে নিতান্তই সাদামাটা আর ভদ্র বলেই মনে হয় বদর আলির। তিনি বলেন, " ঠিক আছে বাবা, সমস্যা নাই।" লোকটা কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে তার দিকে মুখ করে বসে পড়ে। ঈদে সবারই কষ্ট করে বাড়ী যাওয়া। আপনজনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবার জন্য কতনা কষ্ট করে সবাই বাড়ী যাচ্ছে। "কিন্তু লোকটির কথা শুনে তো মনে হয় না তার বাড়ী বরিশাল"। যা হোক এতো কিছু ভাববার সময় কোথায়? লঞ্চের মৃদু দোলায় ঘুম ঘুম ভাব হয়। চোখ বুজে আসতে চায়। কিন্তু কনোক্রমেই ঘুমিয়ে পড়া চলবেনা তার। খানিকপরে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েন বদরআলি। দু হাতে বুকের কাছে জরিয়ে রাখা টাকা ভর্তি ব্যাগ। ঘুমের ভেতর তার চোখের মনি নড়াচড়া করে।, স্বপ্ন দেখেন বদরআলি। - তার মেয়ের বিয়ে। কনে সেজে বসে আছে সে। ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। পাশে বর বসে আছে, কিন্তু বরকে একদম অচেনা লাগে তার। ভালভাবে দেখার আগেই আরেকটা স্বপ্ন দেখা শুরু করেন তিনি। ছোট্ট একটা ছেলে , দাদুর পিঠে চড়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলছে। বদরআলি চার হাত পায়ে হাটছেন আর মাঝে মাঝে ঘোড়ার ডাক নকল করে চিঁ হি হি করছেন। বাচ্চাটার সেকী খুশি ! বাচ্চাটা দেখতে হয়েছে ওর নানির মত। বদরআলি আবার দেখেন, বাচ্চাটা তার হাত ধরে টানছে। কিছু একটা নিতে চাইছে হাত থেকে। বদর আলি ঢিল দেন হাতে; দেখেন ছেলেটার হাতে সেই কাল ব্যাগ। এক মুহূর্ত ইতস্তত করেন তিনি। এ টাকা দিয়েই তো মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। পরক্ষনেই ভাবেন, তার মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগেই। তার বাচ্চাটা সাথেই তো খেলছেন এতক্ষণ ধরে। ব্যাগ পেয়ে বাচ্চাটার সেকী আনন্দ, কী হাসি ! এমন হাসি দেখার জন্য বদর আলি একশ'টা ব্যাগ হারাতেও প্রস্তুত। টাকার ব্যাগ হাতে পেয়ে বচ্চাটা বড়দের মত গম্ভির হয়ে যায়। আস্তে আস্তে বড়দের মত হয়ে যায় ছেলেটা। তাকে দেখে বড্ড চেনা চেনা লাগে তার। বাচ্চাটার গায়ে কোন জামা ছিলনা, এখন দেখা যাচ্ছে একটা লাল শার্ট পড়া অবস্থায়। মুখ গম্ভির। হঠাৎ সে পিছ ফিরে দৌড়িয়ে কোথায় যেন চলে যায়। বদরআলি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
লঞ্চ ঘাটের টয়লেটটাতে নিয়ম মাফিক ঢুকে পড়ে রফিক। তার হাতে কাল একটা ব্যাগ। আস্তে আস্তে ব্যাগের চেইন খুলতে থাকে। উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছে সে। ভেতরে তাকাতেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে ওঠে ওর। ব্যাগের ভেতর কম করে হলেও তিন লক্ষ টাকা!!
মনে মনে চমকে ওঠে রফিক। এতগুলো টাকা পেয়ে একধরনের নির্ভার স্বস্তির অনুভূতি হয় তার। বার কয়েক প্রচণ্ড খুশিতে চোখ জোড়া চকচক করে ওঠে।
অনেকদিন ধরেই তার স্ত্রী তার পেশা কি তা জানতে উদগ্রীব। রফিক এদ্দিন এড়িয়ে গেছে। আর নয়, এবার সে বলার মত একটা পেশা বেছে নেবে, আর লুকচুরি নয়। এ টাকা গুলো দিয়ে একটা মুদি দোকান দেবে সে। বউকে ঈদে এবার একটা ভাল শাড়ি কিনে দেবে। বস্তির বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে একটা ভাল বাসা ভাড়া নেবে। কদিন বাদেই তার সংসার আলো করতে আসছে নতুন অতিথি। তার জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ উপহার দিতে পারবে রফিক। সে ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে। সে চায় না বস্তির পরিবেশে বড় হয়ে তার সন্তান তার মতই একজন পকেটমার হোক। অনেক বড় মানুষ বানাবে তাকে রফিক। পরিশ্রম করে সৎ পথে উপার্জন করবে এখন থেকে। এর থেকে প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট অংশ জমাবে সে। তিনলক্ষ পঁচিশ হাজার টকা জমলে নিজে গিয়ে টাকাটা ফেরত দিয়ে আসবে সেই লোকটাকে। টাকা ফেরত দিয়ে হাত ধরে মাফ চেয়ে আসবে ; লোকটা ঠিক মাফ করবে তাকে।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সদরঘাট থেকে বাড়ির পথে রওনা দেয় রফিক। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, জীবনটা তার এমন ভাবে পাল্টে যাবে কখনো ভাবেনি সে। সত্যিই সে অতি ভাগ্যবান। নইলে হামিদা বানুর মত স্ত্রী মেলে ? এতগুলো টাকা মেলে? কালই সে হামিদাবানুকে নিয়ে শিশুপার্ক আর চিড়িয়াখানা বেড়াতে যাবে। ডাক্তার বলেছেন এ সময় তাকে হাসিখুশি রাখতে হবে। রফিকের জীবনের এই মুহূর্তের একমাত্র লক্ষ্য হামিদাবানুকে সুখি করা।
বস্তির প্রবেশ পথের মোড়টাতে হইচই শোনা যায়। সবাই এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। হাতে করে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। " নাহ, দ্যাশের অবস্থা খুবি খারাপ, সকাল বেলা নল্কায় পানি নাই, দুপুরে গ্যাসে চাপ নাই, বিকালে জ্যাম ছাড়া রাস্তা নাই, সন্ধ্যায় কারেন্ট নাই তারমদ্ধে রাতে ওয়াজের চোটে ঘুম নাই" নাহ ছেলেটাকে বোধহয় এ দেশে রাখা ঠিক হবে না, বিদেশে পাঠিয়ে দিতে হবে, তবেই তো মানুষের মত মানুষ হবে! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। এগিয়ে যায় সে গলির রাস্তা ধরে। যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই অস্থিরতা বাড়তে থাকে রফিকের, কিছু একটা হয়েছে বস্তিতে। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় তুলেছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে রফিক জানতে পারে , ঘণ্টা তিনেক আগে ঘটে যাওয়া সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা।
বস্তির তিন নম্বর গলির চার নম্বর ঘড়ে হঠাৎই আগুন লাগে। মুহূর্তেই সেটা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের ঘর গুলোতে। ফায়ার ব্রিগেডকে খবর দেয়া হয়। রাস্তার জ্যাম ঠেলে আসতে আসতে আধাঘণ্টা লেগে যায়। এরই মধ্যে আগুন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। আড়াই ঘণ্টা চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত আগুন নিওন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।
খবরটা শোনা মাত্র ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে রফিক। বস্তির চার নম্বর বাড়িটা তার নিজের। চোখে ভেসে ওঠে হামিদাবানুর আগুনে পোড়া লাশের ছবি। আর্তনাদ করে ওঠে সে। রুদ্ধ শ্বাসে ছুটে চলে বস্তির তিন নম্বর গলির দিকে।
***
কথায় বলে, 'দুনিয়াতে করা পাপের সাজা দুনিয়াতেই ভোগ করতে হয়'। রফিকও ভোগকরছে।সন্তানসম্ভবাস্ত্রীকেআগুনেরলেলিহানশিখায়চিরতরেহারিয়েমানসিকভারসাম্যহারিয়েফেলেসে।তাকেএখনমাঝেমাঝেসদরঘাটেদেখাযায়- কাল একটা ব্যাগ হাতে। শত শত মানুষের মাঝে সে খুঁজে বেড়ায় সেই লোকটিকে। তার দৃঢ় বিশ্বাস লোকটিকে তার ব্যাগ ফিরিয়ে দিলেই তার স্ত্রী ফিরে আসবে। তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে উঠনে মাদুর বিছিয় বসাবে। শাড়ির আচল দিয়ে ঘাম মুছে দিয়ে বলবে , "চেহারাডার কি হাল হইছে দেখছেন? বসেন, আপনেরে শরবত বানায়ে দিতেছি"।
কিন্তু সেই লোকটির দেখা মেলে না।, মিলবেও না কখনো। রফিক কখনো জানবে না, টাকা ভর্তি ব্যাগ হারিয়ে পাগলপ্রায় লোকটি বাড়ী পৌঁছানোর আগেই ঢলে পরেছিল মৃত্যুর কোলে। রফিক কখনো জানবে না, তার স্ত্রীও ঠিক সেই মুহূর্তে রফিককে চিরতরে একা করে চলে গিয়েছিলো পৃথিবীর মায়া ছেড়ে বহু দূরে।
=সমাপ্ত=
লিখেছেন .....shahriar shaikat
©somewhere in net ltd.