নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আনন্দ-পঠন

লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই

মেহেদী হাসান মঞ্জুর

লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই।

মেহেদী হাসান মঞ্জুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমাদের বর্ণবাদঃ

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:২৩



কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামীতে ভরপুর, পুরুষতান্ত্রিক ও পৃথিবীর অন্যান্য সমাজের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকা আমাদের এই জরাজীর্ণ সমাজে বর্ণবাদ আছে কি? প্রকট ভাবে হয়ত নেই, প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু, প্রকাশ্যভাবে হয়ত নেই, গোপনে থাকতে পারে কি, আমাদের মনের সচেতন স্তরে নেই, অবচেতন স্তরে থাকা অসম্ভব কি?



আমি সেই বর্ণবাদের কথা বলছি, যার কারনে যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে আততায়ীর গুলিতে প্রান দিতে হয়েছিল, মূলত সাদা ও কালো রঙয়ের মানুষদের মাঝে যে বৈষম্য শুধু গায়ের রঙকে কেন্দ্র করে।



এই আলোচোনার শুরুতে আমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, গায়ের রঙ সাদা করার ক্রীমের বর্তমান বাজার, এর ব্যাবহারকারীর সংখ্যা এবং এগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষার দিকে--



আমাদের প্রসাধনের বাজার সয়লাব হয়ে গিয়েছে, এই রঙ সাদা করার ক্রীম, লোশন ও ফেস ওয়াসে। এগুলো বাদে প্রসাধনের বাজারকে আজ কল্পনাও করা যায় না। পূর্বে মেয়েদের রঙ ফর্সা করার জন্যই শুধু এগুলো ছিল; যদিও তখনও পুরুষরাও ওগুলো ব্যাবহার করত। এখন আলাদা ভাবে পুরুষদেরও রঙ ফর্সা করার যাবতীয় জিনিসপত্র বের হয়েছে। আর পূর্বে শুধু মেয়েদের মুখের রঙ সাদা করার প্রসাধন ছিল এখন হাতের পায়ের সমস্ত শরীরের রঙ সাদা করার প্রসাধনও বের হয়েছে। কিছুদিন পরে হয়ত পুরুষের সমস্ত শরীরের রঙও সাদা করার প্রসাধন বের হবে। প্রেমিকার যে কালো চুল নিয়ে কত কবিতা কত গান কত শিল্প রচনা করল পুরুষ প্রেমিক সেই কালো চুলকে বাদামী করার জন্য বেরিয়েছে চুলে ব্যাবহারের জন্য বাদামী রঙের কলপ।





এখন দেখা যাক রঙ সাদা করার এইসব প্রসাধনের ভোক্তার সংখ্যা কেমন? পুরো দেশ জুড়ে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানহীন মানুষবাদে এমন একজনকেও (নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে) হয়ত খুজে পাওয়া কষ্টকর হবে, যে রঙ সাদা করার ক্রীম বা এই সকল প্রসাধন ব্যাবহার করেনা। ক্রীম ঘষে অবালবৃদ্ধবনিতা সবাই সাদা হতে চায়, গায়ের রঙ সাদা না হলে সুন্দর দেখাবে না আর সুন্দর না দেখালে চলবেনা কারন সবাই সুন্দর পছন্দ করে। দেখতে সুন্দর না হলে অস্তিত্ব স্বার্থকতা পায় না, সমাজে কোন কাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় না। সুতরাং সাদা তাকে হতেই হবে। এবং এর পাশাপাশি কালো চুল বাদামী করার কলপ ব্যাবহারকারীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে । তারা মনে করছে গায়ের রঙ এর পাশাপাশি তাদের চুলের রঙও সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ানদের চুলের মত বাদামী হতে হবে। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে কালোকে কোনমতেই আর টিকতে দেয়া হবেনা, শরীরের সমস্ত জায়গা থেকে তাকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হবে।



এখন আসি রঙ সাদা করার প্রসাধনগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষার দিকে। টেলিভিশন খুললেই, পত্রিকার পাতা উল্টালেই, রাজপথের বিলবোর্ড গুলোর দিকে তাকালেই রঙ ফর্সা করার প্রসাধনের বিজ্ঞাপন।



সাদা তোমাকে হতেই হবে, কোনমতেই গায়ের রঙ কালো থাকা চলবেনা; তোমার গায়ের রঙ যদি কালোই থেকে যায় সমাজে দাড়ানোর জায়গাটুকুও তোমার থাকবে না। পুরুষ হলে হয়ত কোনমতে বেচে থাকতে পারবে কিন্তু নারী হলে আর রক্ষে নেই! তুমি যতই শিক্ষিত হও, থাকো যতই মেধাবী, হও যতই বুদ্ধিমান, যতই থাক ধনসম্পদ কোন লাভ নেই; এই গায়ের রঙ কালো নিয়ে কোথাও দাড়াতে পারবেনা। তোমার চাকুরী হবেনা, তোমার জন্য হবেনা কেউ মজনু প্রেমে কেউ হবুডুবু খাবেনা, তোমাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না, কোন সন্মান পাবেনা, স্নেহ করবেনা কেহ, পরিবারে কোন জায়গা হবেনা, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তোমাকে ঘিরে, তোমাকে নিয়ে কোন আলোচোনা হবে না। সর্বোপরি সমাজে তোমার কোন ব্যাক্তিত্বই থাকবেনা, এর চেয়ে বরঞ্চ মরনই ভাল। হয় গায়ের রঙ ফর্সা কর, নচেৎ মারা যাও বা বেচে থাকো জীবন্মৃত হয়ে।



আর তোমার গায়ের রঙ যদি ফর্সা থাকে বা কালো রংকে ঘষে মেঝে ক্রীম লাগিয়ে ,উপটান মেখে ফর্সা হতে পার বা ফর্সাকে করতে পারো আরো ফর্সা, গরুর খাটি দুধের মত; তাহলে দেখবে কি হয়! রিসিভশনে চাকরী তোমার কে আটকায়, কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের প্রাইভেট সেক্রেটারীর পদ থাকবে তোমার হাতের মুঠোয়।



চাও কি নৃত্যশিল্পী হতে? গায়ের রঙ অবশ্যই হতে হবে সাদা, নৃত্যের যত মুদ্রাই তুমি জানো না কেন ভারত নাট্যম, ক্লাসিক; লাভের খাতায় শূন্য। তোমার গায়ের রঙ্গটি যদি গাভীর দুধের মত ধবধবে সাদা না হয় তাহলে তোমার নৃত্য জলসা হবে দর্শকহীন।



সঙ্গীতে নাম কামাতে চাও? পূর্বের দিনে হলে গায়ের রঙ কালো হলেও চলত কারন তখনকার দিনে গান ছিল শুধু শোনবার বিষয়, দেখার সুযোগ বা প্রয়োজন ছিল না। এখন গান যেমন দেখার তেমনি শিল্পীকে দেখারও তাই তোমার গায়কী সুন্দর হলেই চলবেনা গায়ের রংটিও হতে হবে সাদা ,তাহলেই কেবল মাত্র তুমি গায়িকা হিসেবে নাম কুড়োতে পারবে নচেত সম্ভবে না।

অভিনয় করতে চাও, বড় অভিনেতা হবে, অভিনয় না জানলেও চলবে শুধু তোমার গায়ের রঙ হতে হবে সাদা। তোমার গায়ের রঙ সাদা না হলে কোন সিনেমা বা নাটকে এমনকি কমেডিয়ানের চরিত্রেই তুমি অভিনয় করতে পারবেনা, নায়ক চরিত্র তো দূরের কথা।



আরেকটা ব্যাপারে তোমাকে হুশিয়ার করে দিচ্ছি, সাবধান কখনো রোদে যাবেনা। রোদে যাওয়া তোমার জন্য হারাম।সূর্য তোমার সাথে প্রতিনিয়ত শত্রুতা করবে। তোমাকে হতে হবে অসূর্যস্পর্শা, কারন এই সূর্য তোমার সকল সাধনাকে দেবে নষ্ট করে, তোমার গায়ের মেনালিনকে জাগ্রত করে, তোমার গায়ের রংকে কালো করে দিবে। ভিটামিন ডি(যেটা সুর্যের আলো থেকে পাওয়া যায়) এর অভাবে তোমার শরীরের হাড় গুড়ো হয়ে যাক, তাতে কোন ক্ষতি নেই, কারন তোমার গায়ের রঙ সাদা হলে তোমাকে তো আর শারীরিক , মানসিক পরিশ্রম সকল ধরনের পরিশ্রমের হাত থেকে বেচে যাবে। গায়ের সাদা রংকে পুজি করে তুমি অনেক কিছুই করতে সক্ষম হবে। রোদে যাওয়ার বিপদ আরো অনেক। তোমার মুখে লুকিয়ে আছে অনেক ডার্কস্পট, সূর্যের আলোতে গেলেই ওরা কালো কোলাহল করতে করতে বেরিয়ে আসবে। আর তাহলেই তুমি গেছ, আর কেউ রক্ষা করতে পারবেনা তোমাকে, ধরনীকে দ্বিধা করে একবারে ভেতরে ঢুকে যেতে হবে। আর নিতান্ত বাধ্য হয়েই যদি বাইরে যেতে হয় তাহলে মুখে লাগিয়ে যাবে আমাদের শক্তিশালী সানস্ক্রীন মুখে লাগাতে কখনোই ভুলবেনা। আর এই সানস্ক্রিন ভেদ করে সূর্যের আলো তোমার সাদা মুখের রঙ কালো করে দিতে পারবেনা, ডার্কস্পট গুলোও পারবেনা আর

জেগে উঠতে।





আর ওহে পুরুষ, তুমি আগে তোমার বৌয়ের, প্রেমিকার, বোনের রঙ ফর্সা করার প্রসাধন ব্যাবহার করতে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে তার আর দরকার হবেনা, আমাদের কোম্পানী, অনেক বছর গবেষণা করে শুধু তোমার জন্য তৈরী করেছে, রঙ ফর্সা করার হরেক রকম প্রসাধনী। মেয়েলোকের প্রসাধনী আর কেন ব্যাবহার করবে বল?আর তুমি পুরুষ, তোমার গায়ের চামড়া, মুখের চামড়া ওদের থেকে ভিন্ন, ওরা অনেক বেশী কোমল আর তুমি শক্ত সামর্থ্য। তাই তোমার জন্যে এনেছি রঙ ফর্সা করার শক্তিশালী ক্রীম । এই ক্রীম ব্যাবহার করার সাথে সাথেই তুমি সাদা এবং হ্যান্ডসাম হয়ে যাবে। চাকুরীর জন্য রাস্তায় রাস্তায় আর ঘুরতে হবে না, বা মাছি মারা কেরানীর চাকুরীকে বিদায় জানাতে পারো। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখবে এখন নারীরা আস্তে আস্তে স্বাধীন হচ্ছে, পূর্বে হয়ত মেয়েরা কালো পুরুষদের মুখ বুঝে সহ্য করে নিত কিন্তু এখনযুগ পাল্টাচ্ছে শহুরে মেয়েরা আর তোমার কালোপনা মুখ সহ্য করবেনা, সুতরাং তোমার গায়ের রঙ যদি কালো হয় তাহলে দেবদাস সেজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে । আমাদের রঙ ফর্সা করার ক্রীম ব্যাবহার করে, নির্দিদ্ধায় হতে পারবে সিনেমার হিরো, বিজ্ঞাপনের মডেল, গায়ক এবং একসাথে পাবে তিনচারটা গার্লফ্রেন্ড।



তুমি জীবনের ঝুকি নিয়ে, কত কষ্ট সহ্য করে, প্রচন্ড রোদের মধ্যে স্ট্যান্টম্যানের কাজ করতে করতে রোদে পুড়ে তোমার গায়ের রঙ কালো হয়ে গিয়েছে। এত গুন থাকা সত্ত্বেও ঐ কালো চামড়ার কারনে আজও তোমাকে স্ট্যান্টম্যানের কাজ করতে হয়, হিরো চরিত্রে অভিনয় করার স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে গেল। আর যে লোক হিরোর চরিত্রে অভিনয় করে তার কোন গুন না থাকা সত্ত্বেও, শুধু মাত্র সাদা চামড়ার আশির্বাদে সে হিরো, তার কত মেয়ে ভক্ত, কতজন অটোগ্রাফ নিতে আসে! কত তার নাম ডাক! তোমার এই কালো চামড়া নিয়ে তুমি শুধু মাত্র বিটকেলে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতে পারবে, পার্শ্ব চরিত্র এমনকি কমেডিয়ানের চরিত্রেও অভিনয়ের সুযোগও কোনদিন হবেনা। তুমি কি পারবে দেখাতে সিনেমার জগতে কালো কোন হিরো আছে, এমন কোন চিত্র মডেল আছে যার গায়ের রঙ কালো? তোমাকে জানাই সাদা আহ্বান, আসো আমাদের প্রসাধন মাখো ফর্সা হও, সিনেমা নাটকে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করে রূপালী পর্দায় তোল ঝড়, গান গেয়ে মাতাও মঞ্চ, আমাদের রঙ ফর্সা করার বিজ্ঞাপনের মডেল হও আর দুনিয়া জোড়া মেয়ে ভক্ত ও খ্যাতি লাভ কর।





রঙ সাদা করার ক্রীমের বিজ্ঞাপনের ভাষা এবং আমাদের সমাজের প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদী ভাষার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে কি করে ,আমাদের সমাজের প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদী ভাষাকেই তো ওরা আরেকটু রাঙ্গিয়ে ওদের বিজ্ঞাপনের ভাষা হিসেবে ব্যাবহার করে। আবার ঐ রঙ্গচঙ্গে ভাষাই আমাদের সমাজ করে নেয় আয়ত্তীকৃত। সুড়সুড়ি দেয়ার মত ঐ বর্ণবাদী অঙ্গটার অস্তিত্ব আছে বলেই তো ওরা সুড়সুড়ি দিয়ে ওদের পন্য বিক্রি করতে চায় এবং ব্যাপকভাবে করেও । মোট কথা আমরা আমাদের গায়ের রঙ ফর্সা করতে চাই আর ওরা চায় রঙ সাদা করার ক্রীম বিক্রী করে মুনাফা লুটতে।



সমাজের যেকোন অসঙ্গতি, বৈষম্য তার ভাষার ব্যাবহারে প্রভাব ফেলে। আমাদের বর্ণবাদী মানসিকতার প্রভাবও ভাষায় দারুন ভাবে লক্ষ্য করা যায়। মানুষের গায়ের রঙের ক্ষেত্রে ফর্সা শব্দটি সুন্দর শব্দের সমার্থক হয়ে দাড়িয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে এ জিনিসটি বেশ ভালভাবে লক্ষ্য করা যায়। যে মেয়েটির গায়ের রঙ ফর্সা কিন্তু দেখতে হয়ত সুশ্রী না, তার সমন্ধে বলা হয়ঃ মেয়েটি সুন্দর কিন্তু দেখতে ভাল না। আবার যে মেয়েটির গায়ের রঙ কালো কিন্তু দেখতে বেশ, তার সমন্ধে বলা হয়, মেয়েটি দেখতে ভাল হলেও সুন্দর না।



আবার যা কিছু ভাল, সুন্দর, সৎ সবকিছুরই সমার্থক শব্দ হয়ে দাড়িয়েছে সাদা এবং যা কিছু খারাপ, কুৎসিত, অসৎ এগুলোর সমার্থক শব্দ কালো। একজন খারাপ মানুষের গায়ের রঙ যদি কালো থাকে তাহলে বলা হয়; ওর বাহিরটাও যেমন কালো, ভিতরটাও আলাদা নয়। আবার একজন ভাল মানুষের গায়ের রঙ যদি কালো হয় তাহলে বলা হয়; ওর বাহিরটা কালো হলেও ভিতরটা সাদা। অন্যায়কারী, অসৎ লোকের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে গিয়ে বলি অমুকের কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও। অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকার রঙ কালো আর যা সৎ উপায়ে অর্জিত টাকা সাদা।



আমাদের সমাজে সাধারণভবে যদি সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার এরকম একটি মানুষের চিত্র আঁকি তাহলে তার চিত্রটি সম্ভবত এরকম পাবোঃ নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি কালো মেয়ে। প্রথমত সে পুজিবাদী সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার, পুরুষতান্ত্রিকতার কারনে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার, এবং তারপর শিকার বর্ণবাদের।

আমাদের বর্ণবাদঃ





কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামীতে ভরপুর, পুরুষতান্ত্রিক ও পৃথিবীর অন্যান্য সমাজের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকা আমাদের এই জরাজীর্ণ সমাজে বর্ণবাদ আছে কি? প্রকট ভাবে হয়ত নেই, প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু, প্রকাশ্যভাবে হয়ত নেই, গোপনে থাকতে পারে কি, আমাদের মনের সচেতন স্তরে নেই, অবচেতন স্তরে থাকা অসম্ভব কি?



আমি সেই বর্ণবাদের কথা বলছি, যার কারনে যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে আততায়ীর গুলিতে প্রান দিতে হয়েছিল, মূলত সাদা ও কালো রঙয়ের মানুষদের মাঝে যে বৈষম্য শুধু গায়ের রঙকে কেন্দ্র করে।



এই আলোচোনার শুরুতে আমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, গায়ের রঙ সাদা করার ক্রীমের বর্তমান বাজার, এর ব্যাবহারকারীর সংখ্যা এবং এগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষার দিকে--



আমাদের প্রসাধনের বাজার সয়লাব হয়ে গিয়েছে, এই রঙ সাদা করার ক্রীম, লোশন ও ফেস ওয়াসে। এগুলো বাদে প্রসাধনের বাজারকে আজ কল্পনাও করা যায় না। পূর্বে মেয়েদের রঙ ফর্সা করার জন্যই শুধু এগুলো ছিল; যদিও তখনও পুরুষরাও ওগুলো ব্যাবহার করত। এখন আলাদা ভাবে পুরুষদেরও রঙ ফর্সা করার যাবতীয় জিনিসপত্র বের হয়েছে। আর পূর্বে শুধু মেয়েদের মুখের রঙ সাদা করার প্রসাধন ছিল এখন হাতের পায়ের সমস্ত শরীরের রঙ সাদা করার প্রসাধনও বের হয়েছে। কিছুদিন পরে হয়ত পুরুষের সমস্ত শরীরের রঙও সাদা করার প্রসাধন বের হবে। প্রেমিকার যে কালো চুল নিয়ে কত কবিতা কত গান কত শিল্প রচনা করল পুরুষ প্রেমিক সেই কালো চুলকে বাদামী করার জন্য বেরিয়েছে চুলে ব্যাবহারের জন্য বাদামী রঙের কলপ।





এখন দেখা যাক রঙ সাদা করার এইসব প্রসাধনের ভোক্তার সংখ্যা কেমন? পুরো দেশ জুড়ে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানহীন মানুষবাদে এমন একজনকেও (নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে) হয়ত খুজে পাওয়া কষ্টকর হবে, যে রঙ সাদা করার ক্রীম বা এই সকল প্রসাধন ব্যাবহার করেনা। ক্রীম ঘষে অবালবৃদ্ধবনিতা সবাই সাদা হতে চায়, গায়ের রঙ সাদা না হলে সুন্দর দেখাবে না আর সুন্দর না দেখালে চলবেনা কারন সবাই সুন্দর পছন্দ করে। দেখতে সুন্দর না হলে অস্তিত্ব স্বার্থকতা পায় না, সমাজে কোন কাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় না। সুতরাং সাদা তাকে হতেই হবে। এবং এর পাশাপাশি কালো চুল বাদামী করার কলপ ব্যাবহারকারীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে । তারা মনে করছে গায়ের রঙ এর পাশাপাশি তাদের চুলের রঙও সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ানদের চুলের মত বাদামী হতে হবে। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে কালোকে কোনমতেই আর টিকতে দেয়া হবেনা, শরীরের সমস্ত জায়গা থেকে তাকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হবে।



এখন আসি রঙ সাদা করার প্রসাধনগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষার দিকে। টেলিভিশন খুললেই, পত্রিকার পাতা উল্টালেই, রাজপথের বিলবোর্ড গুলোর দিকে তাকালেই রঙ ফর্সা করার প্রসাধনের বিজ্ঞাপন।



সাদা তোমাকে হতেই হবে, কোনমতেই গায়ের রঙ কালো থাকা চলবেনা; তোমার গায়ের রঙ যদি কালোই থেকে যায় সমাজে দাড়ানোর জায়গাটুকুও তোমার থাকবে না। পুরুষ হলে হয়ত কোনমতে বেচে থাকতে পারবে কিন্তু নারী হলে আর রক্ষে নেই! তুমি যতই শিক্ষিত হও, থাকো যতই মেধাবী, হও যতই বুদ্ধিমান, যতই থাক ধনসম্পদ কোন লাভ নেই; এই গায়ের রঙ কালো নিয়ে কোথাও দাড়াতে পারবেনা। তোমার চাকুরী হবেনা, তোমার জন্য হবেনা কেউ মজনু প্রেমে কেউ হবুডুবু খাবেনা, তোমাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না, কোন সন্মান পাবেনা, স্নেহ করবেনা কেহ, পরিবারে কোন জায়গা হবেনা, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তোমাকে ঘিরে, তোমাকে নিয়ে কোন আলোচোনা হবে না। সর্বোপরি সমাজে তোমার কোন ব্যাক্তিত্বই থাকবেনা, এর চেয়ে বরঞ্চ মরনই ভাল। হয় গায়ের রঙ ফর্সা কর, নচেৎ মারা যাও বা বেচে থাকো জীবন্মৃত হয়ে।



আর তোমার গায়ের রঙ যদি ফর্সা থাকে বা কালো রংকে ঘষে মেঝে ক্রীম লাগিয়ে ,উপটান মেখে ফর্সা হতে পার বা ফর্সাকে করতে পারো আরো ফর্সা, গরুর খাটি দুধের মত; তাহলে দেখবে কি হয়! রিসিভশনে চাকরী তোমার কে আটকায়, কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের প্রাইভেট সেক্রেটারীর পদ থাকবে তোমার হাতের মুঠোয়।



চাও কি নৃত্যশিল্পী হতে? গায়ের রঙ অবশ্যই হতে হবে সাদা, নৃত্যের যত মুদ্রাই তুমি জানো না কেন ভারত নাট্যম, ক্লাসিক; লাভের খাতায় শূন্য। তোমার গায়ের রঙ্গটি যদি গাভীর দুধের মত ধবধবে সাদা না হয় তাহলে তোমার নৃত্য জলসা হবে দর্শকহীন।



সঙ্গীতে নাম কামাতে চাও? পূর্বের দিনে হলে গায়ের রঙ কালো হলেও চলত কারন তখনকার দিনে গান ছিল শুধু শোনবার বিষয়, দেখার সুযোগ বা প্রয়োজন ছিল না। এখন গান যেমন দেখার তেমনি শিল্পীকে দেখারও তাই তোমার গায়কী সুন্দর হলেই চলবেনা গায়ের রংটিও হতে হবে সাদা ,তাহলেই কেবল মাত্র তুমি গায়িকা হিসেবে নাম কুড়োতে পারবে নচেত সম্ভবে না।

অভিনয় করতে চাও, বড় অভিনেতা হবে, অভিনয় না জানলেও চলবে শুধু তোমার গায়ের রঙ হতে হবে সাদা। তোমার গায়ের রঙ সাদা না হলে কোন সিনেমা বা নাটকে এমনকি কমেডিয়ানের চরিত্রেই তুমি অভিনয় করতে পারবেনা, নায়ক চরিত্র তো দূরের কথা।



আরেকটা ব্যাপারে তোমাকে হুশিয়ার করে দিচ্ছি, সাবধান কখনো রোদে যাবেনা। রোদে যাওয়া তোমার জন্য হারাম।সূর্য তোমার সাথে প্রতিনিয়ত শত্রুতা করবে। তোমাকে হতে হবে অসূর্যস্পর্শা, কারন এই সূর্য তোমার সকল সাধনাকে দেবে নষ্ট করে, তোমার গায়ের মেনালিনকে জাগ্রত করে, তোমার গায়ের রংকে কালো করে দিবে। ভিটামিন ডি(যেটা সুর্যের আলো থেকে পাওয়া যায়) এর অভাবে তোমার শরীরের হাড় গুড়ো হয়ে যাক, তাতে কোন ক্ষতি নেই, কারন তোমার গায়ের রঙ সাদা হলে তোমাকে তো আর শারীরিক , মানসিক পরিশ্রম সকল ধরনের পরিশ্রমের হাত থেকে বেচে যাবে। গায়ের সাদা রংকে পুজি করে তুমি অনেক কিছুই করতে সক্ষম হবে। রোদে যাওয়ার বিপদ আরো অনেক। তোমার মুখে লুকিয়ে আছে অনেক ডার্কস্পট, সূর্যের আলোতে গেলেই ওরা কালো কোলাহল করতে করতে বেরিয়ে আসবে। আর তাহলেই তুমি গেছ, আর কেউ রক্ষা করতে পারবেনা তোমাকে, ধরনীকে দ্বিধা করে একবারে ভেতরে ঢুকে যেতে হবে। আর নিতান্ত বাধ্য হয়েই যদি বাইরে যেতে হয় তাহলে মুখে লাগিয়ে যাবে আমাদের শক্তিশালী সানস্ক্রীন মুখে লাগাতে কখনোই ভুলবেনা। আর এই সানস্ক্রিন ভেদ করে সূর্যের আলো তোমার সাদা মুখের রঙ কালো করে দিতে পারবেনা, ডার্কস্পট গুলোও পারবেনা আর

জেগে উঠতে।





আর ওহে পুরুষ, তুমি আগে তোমার বৌয়ের, প্রেমিকার, বোনের রঙ ফর্সা করার প্রসাধন ব্যাবহার করতে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে তার আর দরকার হবেনা, আমাদের কোম্পানী, অনেক বছর গবেষণা করে শুধু তোমার জন্য তৈরী করেছে, রঙ ফর্সা করার হরেক রকম প্রসাধনী। মেয়েলোকের প্রসাধনী আর কেন ব্যাবহার করবে বল?আর তুমি পুরুষ, তোমার গায়ের চামড়া, মুখের চামড়া ওদের থেকে ভিন্ন, ওরা অনেক বেশী কোমল আর তুমি শক্ত সামর্থ্য। তাই তোমার জন্যে এনেছি রঙ ফর্সা করার শক্তিশালী ক্রীম । এই ক্রীম ব্যাবহার করার সাথে সাথেই তুমি সাদা এবং হ্যান্ডসাম হয়ে যাবে। চাকুরীর জন্য রাস্তায় রাস্তায় আর ঘুরতে হবে না, বা মাছি মারা কেরানীর চাকুরীকে বিদায় জানাতে পারো। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখবে এখন নারীরা আস্তে আস্তে স্বাধীন হচ্ছে, পূর্বে হয়ত মেয়েরা কালো পুরুষদের মুখ বুঝে সহ্য করে নিত কিন্তু এখনযুগ পাল্টাচ্ছে শহুরে মেয়েরা আর তোমার কালোপনা মুখ সহ্য করবেনা, সুতরাং তোমার গায়ের রঙ যদি কালো হয় তাহলে দেবদাস সেজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে । আমাদের রঙ ফর্সা করার ক্রীম ব্যাবহার করে, নির্দিদ্ধায় হতে পারবে সিনেমার হিরো, বিজ্ঞাপনের মডেল, গায়ক এবং একসাথে পাবে তিনচারটা গার্লফ্রেন্ড।



তুমি জীবনের ঝুকি নিয়ে, কত কষ্ট সহ্য করে, প্রচন্ড রোদের মধ্যে স্ট্যান্টম্যানের কাজ করতে করতে রোদে পুড়ে তোমার গায়ের রঙ কালো হয়ে গিয়েছে। এত গুন থাকা সত্ত্বেও ঐ কালো চামড়ার কারনে আজও তোমাকে স্ট্যান্টম্যানের কাজ করতে হয়, হিরো চরিত্রে অভিনয় করার স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে গেল। আর যে লোক হিরোর চরিত্রে অভিনয় করে তার কোন গুন না থাকা সত্ত্বেও, শুধু মাত্র সাদা চামড়ার আশির্বাদে সে হিরো, তার কত মেয়ে ভক্ত, কতজন অটোগ্রাফ নিতে আসে! কত তার নাম ডাক! তোমার এই কালো চামড়া নিয়ে তুমি শুধু মাত্র বিটকেলে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতে পারবে, পার্শ্ব চরিত্র এমনকি কমেডিয়ানের চরিত্রেও অভিনয়ের সুযোগও কোনদিন হবেনা। তুমি কি পারবে দেখাতে সিনেমার জগতে কালো কোন হিরো আছে, এমন কোন চিত্র মডেল আছে যার গায়ের রঙ কালো? তোমাকে জানাই সাদা আহ্বান, আসো আমাদের প্রসাধন মাখো ফর্সা হও, সিনেমা নাটকে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করে রূপালী পর্দায় তোল ঝড়, গান গেয়ে মাতাও মঞ্চ, আমাদের রঙ ফর্সা করার বিজ্ঞাপনের মডেল হও আর দুনিয়া জোড়া মেয়ে ভক্ত ও খ্যাতি লাভ কর।





রঙ সাদা করার ক্রীমের বিজ্ঞাপনের ভাষা এবং আমাদের সমাজের প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদী ভাষার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে কি করে ,আমাদের সমাজের প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদী ভাষাকেই তো ওরা আরেকটু রাঙ্গিয়ে ওদের বিজ্ঞাপনের ভাষা হিসেবে ব্যাবহার করে। আবার ঐ রঙ্গচঙ্গে ভাষাই আমাদের সমাজ করে নেয় আয়ত্তীকৃত। সুড়সুড়ি দেয়ার মত ঐ বর্ণবাদী অঙ্গটার অস্তিত্ব আছে বলেই তো ওরা সুড়সুড়ি দিয়ে ওদের পন্য বিক্রি করতে চায় এবং ব্যাপকভাবে করেও । মোট কথা আমরা আমাদের গায়ের রঙ ফর্সা করতে চাই আর ওরা চায় রঙ সাদা করার ক্রীম বিক্রী করে মুনাফা লুটতে।



সমাজের যেকোন অসঙ্গতি, বৈষম্য তার ভাষার ব্যাবহারে প্রভাব ফেলে। আমাদের বর্ণবাদী মানসিকতার প্রভাবও ভাষায় দারুন ভাবে লক্ষ্য করা যায়। মানুষের গায়ের রঙের ক্ষেত্রে ফর্সা শব্দটি সুন্দর শব্দের সমার্থক হয়ে দাড়িয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে এ জিনিসটি বেশ ভালভাবে লক্ষ্য করা যায়। যে মেয়েটির গায়ের রঙ ফর্সা কিন্তু দেখতে হয়ত সুশ্রী না, তার সমন্ধে বলা হয়ঃ মেয়েটি সুন্দর কিন্তু দেখতে ভাল না। আবার যে মেয়েটির গায়ের রঙ কালো কিন্তু দেখতে বেশ, তার সমন্ধে বলা হয়, মেয়েটি দেখতে ভাল হলেও সুন্দর না।



আবার যা কিছু ভাল, সুন্দর, সৎ সবকিছুরই সমার্থক শব্দ হয়ে দাড়িয়েছে সাদা এবং যা কিছু খারাপ, কুৎসিত, অসৎ এগুলোর সমার্থক শব্দ কালো। একজন খারাপ মানুষের গায়ের রঙ যদি কালো থাকে তাহলে বলা হয়; ওর বাহিরটাও যেমন কালো, ভিতরটাও আলাদা নয়। আবার একজন ভাল মানুষের গায়ের রঙ যদি কালো হয় তাহলে বলা হয়; ওর বাহিরটা কালো হলেও ভিতরটা সাদা। অন্যায়কারী, অসৎ লোকের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে গিয়ে বলি অমুকের কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও। অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকার রঙ কালো আর যা সৎ উপায়ে অর্জিত টাকা সাদা।



আমাদের সমাজে সাধারণভবে যদি সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার এরকম একটি মানুষের চিত্র আঁকি তাহলে তার চিত্রটি সম্ভবত এরকম পাবোঃ নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি কালো মেয়ে। প্রথমত সে পুজিবাদী সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার, পুরুষতান্ত্রিকতার কারনে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার, এবং তারপর শিকার বর্ণবাদের।

আমাদের বর্ণবাদঃ





কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামীতে ভরপুর, পুরুষতান্ত্রিক ও পৃথিবীর অন্যান্য সমাজের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকা আমাদের এই জরাজীর্ণ সমাজে বর্ণবাদ আছে কি? প্রকট ভাবে হয়ত নেই, প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু, প্রকাশ্যভাবে হয়ত নেই, গোপনে থাকতে পারে কি, আমাদের মনের সচেতন স্তরে নেই, অবচেতন স্তরে থাকা অসম্ভব কি?



আমি সেই বর্ণবাদের কথা বলছি, যার কারনে যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে আততায়ীর গুলিতে প্রান দিতে হয়েছিল, মূলত সাদা ও কালো রঙয়ের মানুষদের মাঝে যে বৈষম্য শুধু গায়ের রঙকে কেন্দ্র করে।



এই আলোচোনার শুরুতে আমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, গায়ের রঙ সাদা করার ক্রীমের বর্তমান বাজার, এর ব্যাবহারকারীর সংখ্যা এবং এগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষার দিকে--



আমাদের প্রসাধনের বাজার সয়লাব হয়ে গিয়েছে, এই রঙ সাদা করার ক্রীম, লোশন ও ফেস ওয়াসে। এগুলো বাদে প্রসাধনের বাজারকে আজ কল্পনাও করা যায় না। পূর্বে মেয়েদের রঙ ফর্সা করার জন্যই শুধু এগুলো ছিল; যদিও তখনও পুরুষরাও ওগুলো ব্যাবহার করত। এখন আলাদা ভাবে পুরুষদেরও রঙ ফর্সা করার যাবতীয় জিনিসপত্র বের হয়েছে। আর পূর্বে শুধু মেয়েদের মুখের রঙ সাদা করার প্রসাধন ছিল এখন হাতের পায়ের সমস্ত শরীরের রঙ সাদা করার প্রসাধনও বের হয়েছে। কিছুদিন পরে হয়ত পুরুষের সমস্ত শরীরের রঙও সাদা করার প্রসাধন বের হবে। প্রেমিকার যে কালো চুল নিয়ে কত কবিতা কত গান কত শিল্প রচনা করল পুরুষ প্রেমিক সেই কালো চুলকে বাদামী করার জন্য বেরিয়েছে চুলে ব্যাবহারের জন্য বাদামী রঙের কলপ।





এখন দেখা যাক রঙ সাদা করার এইসব প্রসাধনের ভোক্তার সংখ্যা কেমন? পুরো দেশ জুড়ে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানহীন মানুষবাদে এমন একজনকেও (নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে) হয়ত খুজে পাওয়া কষ্টকর হবে, যে রঙ সাদা করার ক্রীম বা এই সকল প্রসাধন ব্যাবহার করেনা। ক্রীম ঘষে অবালবৃদ্ধবনিতা সবাই সাদা হতে চায়, গায়ের রঙ সাদা না হলে সুন্দর দেখাবে না আর সুন্দর না দেখালে চলবেনা কারন সবাই সুন্দর পছন্দ করে। দেখতে সুন্দর না হলে অস্তিত্ব স্বার্থকতা পায় না, সমাজে কোন কাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় না। সুতরাং সাদা তাকে হতেই হবে। এবং এর পাশাপাশি কালো চুল বাদামী করার কলপ ব্যাবহারকারীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে । তারা মনে করছে গায়ের রঙ এর পাশাপাশি তাদের চুলের রঙও সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ানদের চুলের মত বাদামী হতে হবে। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে কালোকে কোনমতেই আর টিকতে দেয়া হবেনা, শরীরের সমস্ত জায়গা থেকে তাকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হবে।



এখন আসি রঙ সাদা করার প্রসাধনগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষার দিকে। টেলিভিশন খুললেই, পত্রিকার পাতা উল্টালেই, রাজপথের বিলবোর্ড গুলোর দিকে তাকালেই রঙ ফর্সা করার প্রসাধনের বিজ্ঞাপন।



সাদা তোমাকে হতেই হবে, কোনমতেই গায়ের রঙ কালো থাকা চলবেনা; তোমার গায়ের রঙ যদি কালোই থেকে যায় সমাজে দাড়ানোর জায়গাটুকুও তোমার থাকবে না। পুরুষ হলে হয়ত কোনমতে বেচে থাকতে পারবে কিন্তু নারী হলে আর রক্ষে নেই! তুমি যতই শিক্ষিত হও, থাকো যতই মেধাবী, হও যতই বুদ্ধিমান, যতই থাক ধনসম্পদ কোন লাভ নেই; এই গায়ের রঙ কালো নিয়ে কোথাও দাড়াতে পারবেনা। তোমার চাকুরী হবেনা, তোমার জন্য হবেনা কেউ মজনু প্রেমে কেউ হবুডুবু খাবেনা, তোমাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না, কোন সন্মান পাবেনা, স্নেহ করবেনা কেহ, পরিবারে কোন জায়গা হবেনা, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তোমাকে ঘিরে, তোমাকে নিয়ে কোন আলোচোনা হবে না। সর্বোপরি সমাজে তোমার কোন ব্যাক্তিত্বই থাকবেনা, এর চেয়ে বরঞ্চ মরনই ভাল। হয় গায়ের রঙ ফর্সা কর, নচেৎ মারা যাও বা বেচে থাকো জীবন্মৃত হয়ে।



আর তোমার গায়ের রঙ যদি ফর্সা থাকে বা কালো রংকে ঘষে মেঝে ক্রীম লাগিয়ে ,উপটান মেখে ফর্সা হতে পার বা ফর্সাকে করতে পারো আরো ফর্সা, গরুর খাটি দুধের মত; তাহলে দেখবে কি হয়! রিসিভশনে চাকরী তোমার কে আটকায়, কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের প্রাইভেট সেক্রেটারীর পদ থাকবে তোমার হাতের মুঠোয়।



চাও কি নৃত্যশিল্পী হতে? গায়ের রঙ অবশ্যই হতে হবে সাদা, নৃত্যের যত মুদ্রাই তুমি জানো না কেন ভারত নাট্যম, ক্লাসিক; লাভের খাতায় শূন্য। তোমার গায়ের রঙ্গটি যদি গাভীর দুধের মত ধবধবে সাদা না হয় তাহলে তোমার নৃত্য জলসা হবে দর্শকহীন।



সঙ্গীতে নাম কামাতে চাও? পূর্বের দিনে হলে গায়ের রঙ কালো হলেও চলত কারন তখনকার দিনে গান ছিল শুধু শোনবার বিষয়, দেখার সুযোগ বা প্রয়োজন ছিল না। এখন গান যেমন দেখার তেমনি শিল্পীকে দেখারও তাই তোমার গায়কী সুন্দর হলেই চলবেনা গায়ের রংটিও হতে হবে সাদা ,তাহলেই কেবল মাত্র তুমি গায়িকা হিসেবে নাম কুড়োতে পারবে নচেত সম্ভবে না।

অভিনয় করতে চাও, বড় অভিনেতা হবে, অভিনয় না জানলেও চলবে শুধু তোমার গায়ের রঙ হতে হবে সাদা। তোমার গায়ের রঙ সাদা না হলে কোন সিনেমা বা নাটকে এমনকি কমেডিয়ানের চরিত্রেই তুমি অভিনয় করতে পারবেনা, নায়ক চরিত্র তো দূরের কথা।



আরেকটা ব্যাপারে তোমাকে হুশিয়ার করে দিচ্ছি, সাবধান কখনো রোদে যাবেনা। রোদে যাওয়া তোমার জন্য হারাম।সূর্য তোমার সাথে প্রতিনিয়ত শত্রুতা করবে। তোমাকে হতে হবে অসূর্যস্পর্শা, কারন এই সূর্য তোমার সকল সাধনাকে দেবে নষ্ট করে, তোমার গায়ের মেনালিনকে জাগ্রত করে, তোমার গায়ের রংকে কালো করে দিবে। ভিটামিন ডি(যেটা সুর্যের আলো থেকে পাওয়া যায়) এর অভাবে তোমার শরীরের হাড় গুড়ো হয়ে যাক, তাতে কোন ক্ষতি নেই, কারন তোমার গায়ের রঙ সাদা হলে তোমাকে তো আর শারীরিক , মানসিক পরিশ্রম সকল ধরনের পরিশ্রমের হাত থেকে বেচে যাবে। গায়ের সাদা রংকে পুজি করে তুমি অনেক কিছুই করতে সক্ষম হবে। রোদে যাওয়ার বিপদ আরো অনেক। তোমার মুখে লুকিয়ে আছে অনেক ডার্কস্পট, সূর্যের আলোতে গেলেই ওরা কালো কোলাহল করতে করতে বেরিয়ে আসবে। আর তাহলেই তুমি গেছ, আর কেউ রক্ষা করতে পারবেনা তোমাকে, ধরনীকে দ্বিধা করে একবারে ভেতরে ঢুকে যেতে হবে। আর নিতান্ত বাধ্য হয়েই যদি বাইরে যেতে হয় তাহলে মুখে লাগিয়ে যাবে আমাদের শক্তিশালী সানস্ক্রীন মুখে লাগাতে কখনোই ভুলবেনা। আর এই সানস্ক্রিন ভেদ করে সূর্যের আলো তোমার সাদা মুখের রঙ কালো করে দিতে পারবেনা, ডার্কস্পট গুলোও পারবেনা আর

জেগে উঠতে।





আর ওহে পুরুষ, তুমি আগে তোমার বৌয়ের, প্রেমিকার, বোনের রঙ ফর্সা করার প্রসাধন ব্যাবহার করতে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে তার আর দরকার হবেনা, আমাদের কোম্পানী, অনেক বছর গবেষণা করে শুধু তোমার জন্য তৈরী করেছে, রঙ ফর্সা করার হরেক রকম প্রসাধনী। মেয়েলোকের প্রসাধনী আর কেন ব্যাবহার করবে বল?আর তুমি পুরুষ, তোমার গায়ের চামড়া, মুখের চামড়া ওদের থেকে ভিন্ন, ওরা অনেক বেশী কোমল আর তুমি শক্ত সামর্থ্য। তাই তোমার জন্যে এনেছি রঙ ফর্সা করার শক্তিশালী ক্রীম । এই ক্রীম ব্যাবহার করার সাথে সাথেই তুমি সাদা এবং হ্যান্ডসাম হয়ে যাবে। চাকুরীর জন্য রাস্তায় রাস্তায় আর ঘুরতে হবে না, বা মাছি মারা কেরানীর চাকুরীকে বিদায় জানাতে পারো। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখবে এখন নারীরা আস্তে আস্তে স্বাধীন হচ্ছে, পূর্বে হয়ত মেয়েরা কালো পুরুষদের মুখ বুঝে সহ্য করে নিত কিন্তু এখনযুগ পাল্টাচ্ছে শহুরে মেয়েরা আর তোমার কালোপনা মুখ সহ্য করবেনা, সুতরাং তোমার গায়ের রঙ যদি কালো হয় তাহলে দেবদাস সেজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে । আমাদের রঙ ফর্সা করার ক্রীম ব্যাবহার করে, নির্দিদ্ধায় হতে পারবে সিনেমার হিরো, বিজ্ঞাপনের মডেল, গায়ক এবং একসাথে পাবে তিনচারটা গার্লফ্রেন্ড।



তুমি জীবনের ঝুকি নিয়ে, কত কষ্ট সহ্য করে, প্রচন্ড রোদের মধ্যে স্ট্যান্টম্যানের কাজ করতে করতে রোদে পুড়ে তোমার গায়ের রঙ কালো হয়ে গিয়েছে। এত গুন থাকা সত্ত্বেও ঐ কালো চামড়ার কারনে আজও তোমাকে স্ট্যান্টম্যানের কাজ করতে হয়, হিরো চরিত্রে অভিনয় করার স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে গেল। আর যে লোক হিরোর চরিত্রে অভিনয় করে তার কোন গুন না থাকা সত্ত্বেও, শুধু মাত্র সাদা চামড়ার আশির্বাদে সে হিরো, তার কত মেয়ে ভক্ত, কতজন অটোগ্রাফ নিতে আসে! কত তার নাম ডাক! তোমার এই কালো চামড়া নিয়ে তুমি শুধু মাত্র বিটকেলে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতে পারবে, পার্শ্ব চরিত্র এমনকি কমেডিয়ানের চরিত্রেও অভিনয়ের সুযোগও কোনদিন হবেনা। তুমি কি পারবে দেখাতে সিনেমার জগতে কালো কোন হিরো আছে, এমন কোন চিত্র মডেল আছে যার গায়ের রঙ কালো? তোমাকে জানাই সাদা আহ্বান, আসো আমাদের প্রসাধন মাখো ফর্সা হও, সিনেমা নাটকে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করে রূপালী পর্দায় তোল ঝড়, গান গেয়ে মাতাও মঞ্চ, আমাদের রঙ ফর্সা করার বিজ্ঞাপনের মডেল হও আর দুনিয়া জোড়া মেয়ে ভক্ত ও খ্যাতি লাভ কর।





রঙ সাদা করার ক্রীমের বিজ্ঞাপনের ভাষা এবং আমাদের সমাজের প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদী ভাষার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে কি করে ,আমাদের সমাজের প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদী ভাষাকেই তো ওরা আরেকটু রাঙ্গিয়ে ওদের বিজ্ঞাপনের ভাষা হিসেবে ব্যাবহার করে। আবার ঐ রঙ্গচঙ্গে ভাষাই আমাদের সমাজ করে নেয় আয়ত্তীকৃত। সুড়সুড়ি দেয়ার মত ঐ বর্ণবাদী অঙ্গটার অস্তিত্ব আছে বলেই তো ওরা সুড়সুড়ি দিয়ে ওদের পন্য বিক্রি করতে চায় এবং ব্যাপকভাবে করেও । মোট কথা আমরা আমাদের গায়ের রঙ ফর্সা করতে চাই আর ওরা চায় রঙ সাদা করার ক্রীম বিক্রী করে মুনাফা লুটতে।



সমাজের যেকোন অসঙ্গতি, বৈষম্য তার ভাষার ব্যাবহারে প্রভাব ফেলে। আমাদের বর্ণবাদী মানসিকতার প্রভাবও ভাষায় দারুন ভাবে লক্ষ্য করা যায়। মানুষের গায়ের রঙের ক্ষেত্রে ফর্সা শব্দটি সুন্দর শব্দের সমার্থক হয়ে দাড়িয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে এ জিনিসটি বেশ ভালভাবে লক্ষ্য করা যায়। যে মেয়েটির গায়ের রঙ ফর্সা কিন্তু দেখতে হয়ত সুশ্রী না, তার সমন্ধে বলা হয়ঃ মেয়েটি সুন্দর কিন্তু দেখতে ভাল না। আবার যে মেয়েটির গায়ের রঙ কালো কিন্তু দেখতে বেশ, তার সমন্ধে বলা হয়, মেয়েটি দেখতে ভাল হলেও সুন্দর না।



আবার যা কিছু ভাল, সুন্দর, সৎ সবকিছুরই সমার্থক শব্দ হয়ে দাড়িয়েছে সাদা এবং যা কিছু খারাপ, কুৎসিত, অসৎ এগুলোর সমার্থক শব্দ কালো। একজন খারাপ মানুষের গায়ের রঙ যদি কালো থাকে তাহলে বলা হয়; ওর বাহিরটাও যেমন কালো, ভিতরটাও আলাদা নয়। আবার একজন ভাল মানুষের গায়ের রঙ যদি কালো হয় তাহলে বলা হয়; ওর বাহিরটা কালো হলেও ভিতরটা সাদা। অন্যায়কারী, অসৎ লোকের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে গিয়ে বলি অমুকের কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও। অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকার রঙ কালো আর যা সৎ উপায়ে অর্জিত টাকা সাদা।



আমাদের সমাজে সাধারণভবে যদি সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার এরকম একটি মানুষের চিত্র আঁকি তাহলে তার চিত্রটি সম্ভবত এরকম পাবোঃ নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি কালো মেয়ে। প্রথমত সে পুজিবাদী সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার, পুরুষতান্ত্রিকতার কারনে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার, এবং তারপর শিকার বর্ণবাদের।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:২৮

আদনান মাহমুদ বলেছেন: গায়ের রং সাদা/কালো,এই বর্ণবাদের চেয়ে আমাদের দেশের রাজনীতির বর্ণবাদ আরো বেশি ভংকর। আমারা নিজেরাই নিজেদের কে রাজনীতির নামে রাস্তায় কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করছি।

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৪৫

মেহেদী হাসান মঞ্জুর বলেছেন: ধন্যবাদ, আদনান মাহমুদ। হ্যা, রাজনীতির বর্ণবাদ আরো বেশী ভয়ংকর। কিন্তু সাদা/কালোর বর্ণবাদ সমাজের প্রচ্ছন্নে থেকে গোপনে ক্ষতি সাধিত করছে। ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.