মানুষের হাত কয়টা, দুইটা না তিনটা?

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৪:১২

মানুষের সাধারণত হাত থাকে দুইটা। দুই হাত, দুই পা, দুই চোখ এইভাবে যার যা থাকার তাই থাকে। তবে এক দু’টা যে দেখা যায় না- তা নয়। দুই হাতের জায়গায় সমান সমান তিনটা হাত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই অস্বাভাবিক। কিন্তু আমি সেই অস্বাভাবিক ব্যাপারটাকেই বড় করে দেখেছি। কেননা আজকাল যেখানে সেখানে কারণ-অকারণে দুই হাতের চেয়ে তৃতীয় হাতটিকেই বেশি বড় মনে হয়। বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এমনকি বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে আমাদের চারপাশে যারা চলাচল করে, বসবসা করে, আমাদের সঙ্গে যাদের নিত্য সম্পর্কের গাঁটছড়া বাঁধা তাদের ডান হাত বাঁ হাতের সঙ্গে বাড়তি একটা হাত আাছে যেই হাতটার নাম ‘অজুহাত’। এই অজুহাত এখন জাতীয় কিংবদন্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, ক্রেতা-বিক্রেতা, যাত্রী-চালক, মালিক-কর্মচারী যার কাছে যাবেন দেখবেন শুধুই অজুহাতের ছড়াছড়ি। বাবা ছেলেকে জিজ্ঞেস করবে- পরীা রেজাল্ট খারাপ হোল কেন, ছেলে বলবে বিদ্যুৎ ছিল না, ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারিনি। বড় কর্তা কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করবেন- আসতে এতো দেরি হোল কেন? কর্মচারী বলবে, রাস্তায় ভীষণ যানজট। যাত্রী সিএনজিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করবে, অমুক জায়গায় যাবে? সিএনজিওয়ালা বলবে-যাবো না। কেন যাবে না? গ্যাস নেই। এইভাবে ব্যবসায়ীর কাছে জানতে চাইবেন- জিনিসপত্রের দাম বেশি কেন? বলবে, বিদেশ থেকে ঠিকমতো আমদানি হচ্ছে না। আপনি জিজ্ঞেস করবেন-যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয় তার সঙ্গে আমদানির কি সম্পর্ক? সুন্দরভাবে জবাব দেবে - কি করবো স্যার, যাদের কাছ থেকে সদাই আনি তারা যা বলে আমাদেরকে তো তাই মেনে চলতে হবে। এইভাবে ঘরে-বাইরে সবখানে সবসময় দেখবেন এই তৃতীয় হাতের আধিপত্য। স্ত্রীকে বলবেন- পুরনো তরকারি টেবিলে কেন? নতুন তারকারি কেন রান্না হয়নি? সে জবাব দেবেÑ গ্যাসের চুলায় ঠিকমতো গ্যাস আসেনি। কাজের বুয়ার কাছে জানতে চাইবেনÑ দুদিন কেন আসেনি? সে বলবে-মাথায় খুব ব্যথা ছিল। হোটেলে খেতে গিয়ে দেখবেন মাছ অথবা মাংস পুরনো। ফ্রিজে থেকে হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে। সে বলবে-নষ্ট হয়নি। ফ্রিজে ছিল বলে একটা ভিন্ন রকমের ফেবার পাওয়া যাচ্ছে। যে কোনো দোকানে রুটি, বিস্কিট, আটা, ময়দা, তেল-চিনি যাই কিনতে যাবেন দেখবেন দাম আকাশছোঁয়া। জানতে চাইবেন, জবাব দেবেÑ সরকার দেশ চালাতে ব্যর্থ, সময়মতো সমন্বয় করতে পারেনি। মাছ দেখলেই বোঝা যাবে- এর মধ্যে ফরমালিন মেশানো। যদি জানতে চান, আইনে শাস্তির কথা বলা আচে, তারপরও এগুলো বিক্রি করছেন কেন? হয়তো হেসে হেসেই বলবে-কি করবো, বাঁচতে হবে তো। সবাই যদি কেনে তাহলে আমরা বিক্রি করবো না কেন? ছেলেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন, প্রথমেই শুনবেন লাখ লাখ টাকার হিসাব। জানতে চাইবেন, বলবে-বাড়ি ভাড়া, ঘরভাড়া, মিটার, সেমিস্টার সব মিলিয়ে আমাদের বাঁচতে হবে তো। আপনার কথা এক কান দিয়ে শুনে আর একদ কান দিয়ে বের করে দেবে। বলবে- কি করবো, জিনিসপত্রের যেই দাম। বাঁচতে হবে তো।

এমনি করে যেখানে যা চোখে পড়বে, সমস্যা সৃষ্টি হলেই যদি প্রতিবাদ করেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে জবাব পেয়ে যাবেন- বিভিন্ন অজুহাতে। ‘অজুহাত’ আমাদের একটা অতি সরল এবং গুরুত্বপূর্ণ হাত। এই হাতটিকে আমরা এখানে সেখানে যখন তখন ব্যবহার করছি। আর ব্যবহার করার আগে ভেবেও দেখছি না, আল্লাহ আমাদের হাত দিয়েছেন, এই হাতকে আমরা হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাবো। হাতের ব্যবহার হবে অস্ত্রের মতো। বুলেটের মতো। কলমের মতো। তরবারির মতো। এই হাতকে ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি সর্বেেত্র আমরা আমাদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে চাই। কিন্তু আসল দুটি হাত বাদ দিয়ে আমরা যদি নকল একটি হাত নিয়ে চলাচল করি এবং নকল হাত কিংবা অভিশপ্ত হাত, যার নাম ‘অজুহাত’। এই অজুহাতকে সঙ্গে নিয়ে যদি আমরা চলি, চলতে চাই এবং চলতে অভ্যস্ত হয়ে যাই তাহলে আমাদের দুর্ভোগ ও দুরবস্থা অবধারিত। ১৫ কোটি মানুষের দেশে আমাদের শক্তির হাত সাহসের হাত, সমৃদ্ধির হাত ৩০ কোটি হলেই যথেষ্ট। ৪৫ কোটি হওয়ার প্রয়োজন নেই। আসুন সবাই মিলে আমাদের জীবন থেকে, কর্ম থেকে, সকল প্রয়োজন থেকে এই ‘অজুহাত’ নামের বাড়তি হাতটিকে বিসর্জন দেই।

০ টি +০/-০