![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সফল মানুষের দিন শুরু হয় খুব সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু আমার শুরু হয় বকুনি খেয়ে। মায়ের বকুনি না খেলে আমার ঘুম ভাঙ্গে না। অথচ আজ হয়েছে উল্টো। আমি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। উঠে রান্নাঘরে গেলাম। চুলা জ্বালিয়ে এক কাপ চা বানালাম। এমনিতে আমি ভাল চা বানাতে পারি না। আজও তাই হল। চায়ে চুমুক দিয়ে দেখলাম তিতা লাগছে। বাড়তি চিনি দিলাম। আমি চায়ে চিনি কম খাই। ডায়েট করি। ডায়েট না করলে আমার ওয়েট বাড়ে। মেয়েদের ওয়েট বাড়লে দেখতে বিশ্রী লাগে। আমি চাইতাম না আমাকে দেখতে বিশ্রী লাগুক। আমি কেন? জগতের কেউ চায় না তাকে দেখতে বিশ্রী লাগুক।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমি ছাদে গেলাম। ছাদে ঝিরিঝিরি ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। আমার ভাল লাগতে শুরু করলো।
গতকাল বিকেল থেকে আমার মন খারাপ। শুধু খারাপ নয়, সাংঘাতিক রকম খারাপ।
এত খারাপ যে সারারাত এক মিনিটের জন্য ঘুমোতে পারি নি।
চা খেতে খেতে আমি ছাদে হাটতে লাগলাম। এর আগে এত সকালে কখনও ছাদে আসেনি। তাই আজকের ছাদটাকে আমার কাছে অন্যরকম মনে হল। কিন্তু হঠাৎ করেই মনে হল কে যেন ধপাশ ধপাশ করে পা ফেলে সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে আসছে। এত সকালে কে ছাদে আসে আমার জানা নাই। আমরা ভাড়া বাসায় থাকি। এ বাসায় মোট পাঁচটা ফ্যামিলি। তাদের কাউকেই আমি চিনি না।
এমনিতে মন খারাপ, তার উপর এই সাত সকালে কোনো অপরিচিত লোকের মুখ দেখতে ভাল লাগবে না। আমি একটা যুবতী মেয়ে। যুবতী মেয়েদের পদে পদে বিপদ। একটা অপরিচিত ছেলের সাথে সাত সকালে ছাদে থাকলে কত কথা না শুনতে হতে পারে।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ছাদে উঠলো মা। আমি অবাক হয়ে বললাম, মা তুমি?
মা বললো, তোকে সকালে রান্না ঘরে দেখে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে দেখি তুই নেই। ভাবলাম ছাদে যেতে পারিস।
আমি কিছু বলার আগেই মা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, সে কিরে! তোর চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। শরীর খারাপ করে নি তো?
আমি বললাম, না মা। একটু মন খারাপ। আর অনেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠি না। তাই মনটা চাঙ্গা করতে আজ সকালে উঠলাম।
মা আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ছাদে কিছুক্ষন হেটে চলে গেল।
মা জানে আমার সহজেই মন খারাপ হয়। এর জন্য সাংঘাতিক কোন কারণের দরকার হয় না। কিন্তু আমার এবারের মন খারাপের কারণটা আমার কাছে সাংঘাতিক কিছু।
মাস দুয়েক থেকে আমি একটা ছেলেকে পড়াই। আমার ছাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কিছু ছাত্র আছে তুখোড় মেধাবী। কিন্তু পড়াশুনায় কোন মনযোগ নেই। আমার ছাত্রটিও সেরকম। পড়তে চায় না। পড়ার চেয়ে গল্প করতেই তার বেশি পছন্দ। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে তার গালে ঠাঁস করে এক থাপ্পড় লাগাই কিন্তু পারি না। মায়া লাগে। বাচ্চা ছেলের কান্না একদম সইতে পারি না।
আমার ছাত্রের নাম জুমান। চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার এলাকায় তাদের পাঁচতলা বাড়ি। গতকাল তাকে পড়ানো ছেড়ে দিয়েছি। আমার ছাত্রের একজন চাচা আছে। নাম জজো। ফটোগ্রাফার। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। সে আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিবে ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবিনি।
একদিনের কথা বলি। জুমানকে পড়ানো শেষে বাসায় ফিরছিলাম। রাস্তায় একটা নীল রঙের মাইক্রোবাস আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমি পাশ ফিরে দেখি জজো।
জজো বললো, খেয়া আসুন, আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমি বললাম, ধন্যবাদ। আমার একা যেতেই ভাল লাগবে।
সে না হয় রোজ গেলেন, আজ আসুন। রোজ রোজ তো আর আপনাকে গাড়িতে উঠতে বলব না।
আমি রসিকতা করে বললাম, রোজ উঠালে সমস্যা কোথায়? নাকি উঠাতে চাইছেন জন্য বলছেন?
দেখুন এতকিছু ভেবে বলেনি। এপথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। আপনাকে দেখে ভাবলাম এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমি বললাম, কিছু কিছু কথা ভেবে বলতে হয়। যেমন ধরুন, আজ গাড়িতে উঠালে দুটো কথা হবে। তারপর আরেকদিন বলবেন খেয়া আসেন গল্প করি।
আপনি বেশ রসিক তো। এত কথা না বলে আসুন।
আমি গাড়িতে গিয়ে বসলাম। সেদিন জজো আমাকে গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দিল।
এর দু'দিন পর, আমি শাড়ি পড়ে আমার এক বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্টানে যাচ্ছিলাম। পথে জজোর সাথে দেখা হল। জজো আমাকে গাড়িতে উঠালো।
গাড়িতে উঠে আমি লক্ষী মেয়ের মত চুপ করে বসে আছি। জজো আমার নীরবতা ভাঙ্গিয়ে বললো, এমন সেজে গুজে কোথায় ঘুরতে যাচ্ছেন?
আমি রসিকতা করে বললাম, ঘুরতে নয়, প্রেম করতে যাচ্ছি।
একা একা?
সেকি! একা একা কেউ প্রেম করে নাকি?
আমাকে অবাক করে জজো বললো, হ্যাঁ, আমি করি। সারাদিন প্রকৃতির দ্বারে দ্বারে ঘুরি। প্রকৃতির ছবি উঠাই। প্রকৃতির সাথে আমার প্রেম। যেন একটা আত্মার সম্পর্ক। প্রকৃতির দ্বারে দ্বারে ঘুরতেই এবেলা কেটে গেল।
আমি বললাম, বিয়েটা করছেন না কেন?
কখনো একা অনুভূত হয় না তাই।
আমি প্রশ্ন করলাম, একাকীত্বতার সাথেই কি বিয়েটা জড়িত?
জজো উত্তর দিয়ে বললো, পারিবারিক জীবনে কেউ একা নয়, ব্যক্তিগত জীবনে একা। আর এটার সাথেই বিয়েটা জড়িত।
দারুন বললেন।
আপনার ভালো লাগলো?
হ্যাঁ, তবে আমার কাছে সেরকম নয়। বিয়েটা মহাজাগতিক, জগতের খেলা। আর আমরা সবাই তার খেলোয়ার। জগতকে জয়ী বানাতেই আমরা মাঠে নামি।
তার মানে জয়টা আমাদের জন্য নয়?
আমি বললাম, তা কেন? জয়টা আমাদের ও। স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালবাসা সবকিছু মিলেই সংসার জীবন। আর এই সংসারেই আমাদের আনন্দ, আমাদের বেদনা। এর বাইরে কেউ নই। কিন্তু জগতের উদ্দেশ্য আলাদা। স্নেহ, ভালবাসা, প্রেম এগুলো দিয়েই জগৎ তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
জজো বললো, আপনি ভাবুক ব্যক্তি। এমন ভবঘুড়ে ফটোগ্রাফারের সাথে আপনার ভাবের মিল পাওয়া দুস্কর।
আমি বললাম, আপনি যে প্রকৃতির ছবি উঠান, সেই প্রকৃতিই কিন্তু এটার শিক্ষা দেয়।
হয়ত এটা বোঝার মত মন আমার নেই। এ মন শুধু ছবিটাই খোঁজে, ভেতরের রহস্য খোঁজে না।
আমি বললাম- আজ থেকে সেটাও খূঁজুন।
এর ঠিক এক সপ্তাহ পরের কথা।
সেদিন জুমানকে পড়ানো শেষে আমি গেটের বাইরে এসেছি। এমন সময় বাগান থেকে জজো আমাকে ডেকে বললো, খেয়া।
আমি বললাম, কিছু বলবেন জজো?
সে বাগানের ফুলগুলো আমাকে দেখিয়ে বললো, এই ফুলগুলোর একটা ভাষা আছে। ছবি উঠাতে গিয়ে খুঁজে পেলাম।
জজোর কথায় আমার শরীরটা কেঁপে উঠলো। বাগানে শুধু গোলাপ ফুটেছে।
আমি বললাম, জজো বাগানে তো শুধু গোলাপ ফুটেছে।
আমি গোলাপের কথাই বলছি।
আপনার ভেবে বলা উচিত জজো।
আমি ভেবে দেখেছি খেয়া।
এটা ভাবনা নয়, আপনি আবেগে আচ্ছন্ন।
না খেয়া, আমি আবেগী নই।
আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে পছন্দ করি। অন্যকে নিয়ে নয়।
জগতের সবাই তা করে। এটা চিরন্তন খেয়া।
সে চিরন্তনের দাবিদার আমি আপাতত নিজে। অংশীদারিত্বে আমার সামান্যই উৎকর্ষতা জাগে, পুরোপুরি নয় জজো।
আজ নয় কাল আপনার সাথে কথা হবে।
আপনি একটু ভাবুন খেয়া।
কিন্তু কাল আমাকে একথা জানাবেন না। আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না। বলে আমি হন হন করে চলে আসলাম।
(চলবে)
©somewhere in net ltd.