নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অন্যের চোখে পৃথিবী দেখি

এম এ হানিফ

ভালোবাসি দেশ, এ মাটি ও মানুষ।

এম এ হানিফ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোট গল্প- পরীর নীল স্বপ্ন

২০ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১:৩৬


ছবি- ইন্টারনেট।


জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে পরী। তার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তার চোখের জল গড়িয়ে পড়তে দেখলো অনু। দেখে সে থমকে গেল।

পরী কাঁদবে কেন? তার তো কাঁদার কোন কারন নাই। তার তো এখন আকাশে উড়বাব কথা। তাকে ঘিরে চারপাশে আনন্দের জোয়ার বইছে। একদল নাচনেওয়ালী মহিলা ডাকা হয়েছে। গায়ে হলুদের দিন তারা আসবে।তাদের তেমন কোন কাজ নেই। শুধু নাচবে আর গাইবে এই তাদের কাজ। বাড়ি শুদ্ধ সবাইকে তারা নাচাবে। যদি না পারে তাহলে তাদের মাইনে কাটা। কিন্তু হচ্ছেটা কি?
যাকে ঘিরে এমন আয়োজন সে গাধার মত নি:শব্দে কাঁদছে কেন?

এসব ভেবে অনু পরীকে ডাকলো।
-আপু তুমি কাঁদছো কেন? আজ তো তোমার বিয়ে নয়। বিয়ের আগে মেয়েরা কাঁদে না। তুমি কেন বোকা মেয়ের মত কাঁদছো?
পরী চোখের জল মুছে বললো- খুব তো পেঁকেছিস।
- কই পাঁকি নি তো। পাঁকার চেষ্টা করছি। এখন বলো তোমার কেস টা কি? তুমি কেন কাঁদছো?

পরী কিছু বলবে এমন সময় পরীর মা লাইলী বেগম ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলো।
-পরী, এবেলা ওঠ। তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক আসতেছে। তাড়াতাড়ি সব গোছগাছ কর। আর শোন তোর বাবাকে এককাপ চা দিয়ে আয়। তার তো আবার চা খাবার সময় হয়েছে। কাজের মেয়েটা যে গেল কই। ফুলি ও ফুলি।
বারান্দা থেকে ফুলি বললো: ডাকনের কাম নাই, এই আমি হাজির। এখন কন কি করতে হবে।
- তোমার কিছু করতে হবে না, পুঁইশাক দিয়ে মাছ রেধেছি, খেয়ে আমায় উদ্ধার কর।
- আফায় যে কি কয়। এখন কি খাওনের সময়, এখন হলো কামের সময়। কামের সময় খাওন ঠিক না।
-অতো লেকচার শোনোনের কাম নাই, নতুন আত্মীয় আসতেছে, ঘর দুয়োর সব পরিষ্কার করা দরকার। যা করার জলদি কর, হাতে একদম সময় নাই।

ফুলি চলে যাবার পর পরী গেল চা বানাতে। আজকাল চা বানাতে তার ভাল লাগে না। তবু পরিবারের কিছু কাজ না করলেই নয়। এর মধ্যে চা বানানো একটি কাজ। রোজ সময় গুনে গুনে তাকে চা বানাতে হয়। তার বাবা আকবর আলী একজন চা খোর মানুষ। চা ছাড়া বেহেস্তে গেলেও তার চলবে না।
তিনি এখন মহাব্যস্ত, সারাদিন একের পর এক কাজ করে যাচ্ছেন। আয়োজনের কোন ত্রুটি রাখছেন না। তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
তিনি এখন কথা বলছেন তার পুরনো বন্ধু রহমতের সাথে।
-তোর মাথায় কলা ভাংগি, রামছাগল।
-তোর মাথায় বেল।
-হারামজাদা।
-পরের টাও বল।
-হ্যাঁ সেটাও বলবো, ইডিয়েট।
- আমি কিন্তু আসছি না।
-তোর বাপ আসবে, তোর চৌদ্দগুষ্টি আসবে। ভয় দেখাচ্ছে।
রহমত ফোনের লাইন কেটে দিল। আকবর আলী তাতে বেজায় ক্ষেপলো। দু'বার হ্যালো হ্যালো বলার পর জোড়ে ফোনটা রেখে দিল।

পরী বুঝলো বাবা ক্ষেপেছে। সে কথা না বলে চা হাতে দাড়িয়ে থাকলো।
আকবর আলী বললো: কলা গাছের মত খারায় রইলি কেন। সামন থেকে যা।
টেবিলের উপর চা রেখে পরী ঘর থেকে বের হল।

সকাল থেকেই বাড়িতে হৈ হুল্লুর। গেট সাজানো হয়েছে, বাড়ির চারপাশে লাল নীল মরিচ বাতি জ্বলছে। পরীর মন ভালো নেই। মরিচ বাতির আলো তার কাছে এখন অসহ্য। তার মনে হচ্ছে বাড়িটা একটা ভূতের বাড়ি। একদল ভূত চারপাশে নাচানাচি করছে। সবকটা ভূতের চোখে মরিচ বাতির আলো। ভূতগুলো দৌঁড়ে আসছে তাকে ধরতে। তারা তাকে জাপটে ধরার চেষ্টা করছে। পরীর দম বন্ধ হয়ে আসলো। সে দৌঁড়ে ঘরে ঢুকলো। ঢুকেই দেখে অনু তার সামনে।
অনু বললো:ব্যাপার কি?
পরী বললো: জ্বালাস না, এখন বাইরে যা।
- বর কি তোর পছন্দ নয়?
- সেটা শুনে তোর কোন কাম নেই, এখন সামন থেকে যা।
- মনের মধ্যে গিট্টা লেগেছে, আগে সেটা সরানো দরকার।
- আমি কোন ডাক্তার নই। মেডিকেলে যা নইলে ধাপ। ধাপে ডাক্তারের অভাব নেই।
-সে বুঝলাম, কিন্তু বল কাল থেকে কাঁদছিস কেন? কার জন্য চোখে জল?
- তোর জন্য, এখন যা।
- মিথ্যা বলার দরকার নাই।
- সত্য মিথ্যা দিয়ে তোর কোন কাম নাই, দয়া করে সামন থেকে ভাগ।
অনু চলে গেল। বিছানায় শুয়ে পরী ছটপট করতে লাগলো।

যার সাথে পরীর বিয়ে তার নাম অনীল। অনীল নামটা তার পছন্দ নয়। সে ভাবছে বরের নাম হবে নীল। বিয়ে বাড়ির সবখানেই থাকবে নীল রঙ। সে পড়বে নীল শাড়ি।বরের পাঞ্জাবীর রঙও হবে নীল। বরের গাড়িও হবে নীল রঙের। সারাটা পথজুড়ে থাকবে নীল রঙের বাতি। বাসর ঘর সাজানো হবে নীল রঙ দিয়ে। বরের বাড়ির সামনে থাকবে মস্ত বড় একটা পুকুর। পুকুরের পানির রঙ হবে নীল। তারা সারারাত পুকুর পাড়ে বসে গল্প করবে। আর আলো ফোটার সাথে সাথে তারা ঘরে গিয়ে ঘুমাবে।
কিন্তু তা হচ্ছে না। ছেলেপক্ষ নাম পরিবর্তন করতে নারাজ। চারটা খাসি আর দুটো গরু কোরবানী দিয়ে অনীলের বাবা ছেলের নাম রেখেছিলেন। এখন কনের ইচ্ছায় তা বদলানোর কোন দরকার তিনি মনে করছেন না। বিয়ের কার্ডে ছেলের নাম অনীল ছাপা হয়েছে। সুতারাং বিয়ে হবে অনীল আর পরীর।

আকবর আলী গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে সিগারেট। সকাল বেলা তিনি একটা সিগারেট খান। না খেলে তার হজমের সমস্যা হয়। তবে এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। জগতের সব কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে এটা তিনি মনে করেন না। তাই ছেলের নাম অনীল হোক আর নীল হোক এটা নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। অনীলের বাবা অগাধ সম্পত্তি
র মালিক। অনীলই তার একমাত্র সন্তান।
সুতরাং পরী যে রাজরানী হয়ে থাকবে, এ বিষয়ে তার কোন সন্দেহ নেই।

সিগারেটে টান দিতেই তার চোখ কপালে উঠলো। রহমত বাড়ির সকলকে নিয়ে সাত সকালে হাজির। রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তিনি দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলেন। সিগারেট ফেলে আকবর আলী তাকে জড়িয়ে ধরলো। নাচনেওয়ালী মহিলারা গীতের তালে তালে নাচতে শুরু করলো।

পরীকে সাজানো হলো লাল শাড়ীতে। টসটসে লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে সে বসে আছে। কিন্তু তার ভাল লাগছে না। বিয়েতে সে নীল শাড়ি পড়বে এটা ছিল তার এতদিনের শখ। আজ তা জলাঞ্জলি দিতে হল। নীল শাড়ি অনীলের পছন্দ নয়, তার পছন্দ লাল। পরী বাধ্য হয়ে লাল শাড়িই পড়লো। এটা ছাড়াও লাল শাড়ি পড়ার আরও কারন আছে। দিন সাতেক আগে পরী মামার বাড়ি গিয়েছিল। সেখানে এক নামকরা ফকির কে তার হাত দেখালো। হাত দেখে ফকির বললো: এক মস্ত বড় ঘরে খুব শীঘ্রই তোমার বিয়ে হবে। কিন্তু ছেলে হবে তোমার ঠিক বিপরীত। তুমি ডান বললে সে বলবে বাম। উত্তরে যেতে চাইলে সে বলবে দক্ষিন ভাল। তবে এ ছেলের সাথে তোমাকে সংসার করতে হবে না, কারন বাসর রাতেই দম বন্ধ হয়ে সে মারা যাবে।

সেই থেকে পরীর মন ভালো নেই, সে একটানা কেঁদেই চলছে।

মৃতগামী ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরন করতে হয়। হতে পারে এটাই অনীলের শেষ ইচ্ছা। সুতারাং লাল বেনারশি শাড়িতে সাজানো বউ দেখেই তার মৃত্যু হোউক।
কিন্তু পরীর ইচ্ছে করছে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে। কারন বিয়ে ভাংলেই একটা ছেলের জীবন বাঁঁচবে।

কিন্তু তা হল না।
রাত দশটা ত্রিশ মিনিটে পরী শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছলো। বাড়ির একেবারে দক্ষিনের ঘরটাতে বাসর সাজানো হয়েছে।
ঘরে একজোড়া কাঠের চেয়ার। তার একটাতে অনীল বসা। পরী বসেছে বিছানার এক কোনে। অনীল বললো: তোমার কি মাথা ধরা রোগ আছে?
পরী মাথা নেড়ে বললো: না।
এটা হল বাসর ঘরে তাদের প্রথম কথা।

তারপর অনেক্ষন দুজন চুপ করে বসে থাকলো। কিন্তু পরীর ভালো লাগছে না। তার ইচ্ছে করছে অনীলের বুকে মাথা রাখতে। তার বারবার মনে হচ্ছে খুব অল্প সময়ের জন্য তাদের বিয়ে হল। সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথেই অনীল নামের মানুষটা আর পৃথিবীতে থাকবে না। পরীর মন খারাপ হয়ে গেল।
ঘড়ির কাটায় তখন রাত পৌনে একটা। অনীল পরীর পাশে এসে বসলো। তারপর বললো: আমার নামটা তোমার পছন্দ নয়, তাই না?
পরী কিছু বললো না। অনীল বললো: তুমি আমায় নীল ডাকতে পারো।
পরী মাথা নেড়ে বললো: আচ্ছা।
কিছুক্ষন চুপ থাকার পর পরী ডাকলো: নীল।
অনীল বললো: কিছু বলবে?
- তুমি মৃত্যু বিশ্বাস কর?
- হ্যাঁ করি। তবে মৃত্যু হয় শরীরের, আত্মার নয়। আত্মার মৃত্যু নেই।
পরী আর কিছু বললো না। তার মনে হল এই লোকটাকে সে মেরে ফেলতে যাচ্ছে। আর কয়েকটা ঘন্টা সে বেচে আছে। তারপর তার জগতের আলো নিভে যাবে। পরীর চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। মাথা ঘুড়তে লাগল। মনে হল পুরো ঘরটা লাঠিমের মত ঘুরছে। তার চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। সে চোখ বন্ধ করে অনীলের বুকে ঢলে পড়লো।

আঙ্গিনায় একটা নীল রঙের ছামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছে।তার এক কোনায় একটা নীল রঙের চৌকি। অনীলকে সেখানে শোয়ানো হলো। পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া। অনীল মারা গেছে। পুকুর পাড়ে তার জন্য কবর খোড়া হয়েছে। তাকে একটু পরে কবরে নেয়া হবে। কবরের রঙ নীল। কবরের আসে পাশে অসংখ্য নীল বাতি জ্বলছে।
কয়েকজন মহিলা পরীকে ধরে টানাটানি করছে। কিন্তু কেউ তাকে আটকাতে পারছে না। সে অনীলের কাছে যাবার জন্য দৌঁড়াচ্ছে, কিন্তু তার পথ শেষ হচ্ছে না।

হঠাৎ জোড়ে শব্দ হলো। শব্দ শুনে পরীর ঘুম ভাংলো। সে চোখ মেলে দেখলো পূর্ব দিকের জানালাটা খোলা। জানালা দিয়ে সূর্য্যের আলো ঘরে ঢুকছে।
তার স্বপ্নের কথা মনে পড়লো। সে বিছানায় অনীলকে খুঁজলো। অনীল বিছানায় নেই। পরীর বুকের ভেতরটা সাৎ করে উঠলো।সে দ্রুত বিছানা থেকে নামলো। নেমে দেখলো অনীল মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে অনেকগুলো নীল ফুল|


সমাপ্ত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.