![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাইরে নাঈম কথা বলছে আসাদের সাথে। তার বাবার দুঃসাহসিক বিয়ের কথাই আলোচনার বিষয়। দুঃসাহসিক বলার কারণ হলো, তার বাবার প্রথম বিয়ের পর ১৭ বছর কেটে গেলেও কোন সন্তানাদি হয়নি। ফলস্বরূপ তার বউ তাকে বারেক বিয়ে করতে রাজি করান। আমার বন্ধুবর তার বাবার ১৭ বছর পরের এই বিয়েকে নিয়ে প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে গল্প শুনিয়েই যায়, যেন দ্বিতীয় বিয়ে তার বাবার কোন মহা কীর্তি। অবশ্য মহাকাজ হওয়ারই কথা, তার বাবার এই সিদ্ধান্তই তার দুনিয়ায় আসাটাকে সুগম করে দেয়। আমিও বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসে গেলাম। আসাদকে দেখে মনে হচ্ছে আসাদ কথাগুলো শুনতে চাচ্ছে না। ভালো শ্রোতা না থাকলে ভালো বলা যায় না, কিন্তু নাঈমের সমস্যা হচ্ছে না। আমি মনোযোগ দিয়েই শোনার চেষ্টা করছি কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না, হারিয়ে যাচ্ছি অভিশপ্ত সেই রাতের মাঝে।
হলের দোকানগুলো সাধারণত ১২টার পর বন্ধ করে ফেলে। সেদিন দেড়টার দিকে নিচে নেমে দোকান খোলা দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। অন্তত হলের দেয়াল টপকিয়ে পলাশিতে যেতে হবে না। যদিও তখন চা খেতে ইচ্ছে করছিলো, আপাদত সিগারেট খেয়েই ঘুমিয়ে পড়া যাবে। ঘুমানোর আগে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাসটা গতবছর থেকেই। দোকান খোলা দেখে মনে যতটা উৎফুল্লতা কাজ করেছিলো, রকেটের গতিতে তা বদলে ততটাই খারাপ হয়ে গেল। নীলক্ষেতের পাশদিয়ে দেয়াল টপকানো যায়। সাধারণত লুঙ্গি পরা অবস্থায় হলের বাইরে কেও বের হয় না। লুঙ্গি পরেই দেয়াল টপকিয়ে যাবো বলে মনস্থির করলাম। রাস্তার দু'পাশে রিকসা সারি-সারি দাড়িয়ে আছে। সিটের উপর কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে রিকসাওয়ালারা। পা সোজা করে শুয়ার জায়গাটুকু পাচ্ছে না তারা, তাছাড়া রাস্তার মশাগুলোর অমানবিক নির্যাতনের পরও ঘুমাতো হচ্ছে। আল্লাহ একদিন কষ্ট ঘুচিয়ে দিবে, এই আশায় কষ্ট করেই যাচ্ছে। কেউ অবশ্য আরামেই ঘুমাতে পারছে, রিকসার নিচে কয়েল বেঁধে ঘুমাচ্ছে। আমার সাথে রাস্তার এই কবিদের পার্থক্য খুঁজে পেলাম। আমার বেঁকে ঘুমানোর সুযোগ নেই, আর ওদের সোজা হয়ে। পলাশি মোড়ে সারারাত চা-সিগারেট পাওয়া যায়। এখানকার লোকগুলোকে দেখে মনে হলো, সবাই আমার মতো, "আর্জেন্টিনা আজ ব্রাজিলের সাথে জিতলে সিগারেট খাবো না " বলা লোকজন। যারা আর্জেন্টিনার জয় সহ্য করতে না পেরে টেনশনে সিগারেট খেতে আসছে। আমার মতো ব্রাজিল রোগে আক্রান্ত বন্ধু হৃদয়ও এখানেই সিগারেট টানছে। সিগারেট টেনে এবার ফেরার পালা। হলের মাঠের পাশের আন্ডার কন্সট্রাকশন এরিয়া দেখে নিজেকে বোকাচোদা মনে হলো। ওয়াল না টপকিয়ে এদিক দিয়েই আসতে পারতাম, অথচ এই সাধারণ জিনিসটা আমার মনে ছিলো না।
যাইহোক, এদিক দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে হলে যাওয়া যাবে, তাই এদিক দিয়েই রওনা হলাম। আকাশে সুন্দর চাঁদ দেখে মন ভালো হয়ে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে চাঁদ। চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চাঁদে কাউকে দেখা যায় নাকি। একসময় চাঁদে তাকালে বঙ্গবন্ধুকে দেখতাম, যেন মৃত্যুত্তর তিনি তার নেতৃত্বে স্বাধীন করা এই ভূমিটাকে দেখছেন। চাঁদে যেদিন ওলামারা সাঈদীকে দেখলেন, তার পর থেকে চাঁদে আর কাউকে দেখিনি। পাহাড়ের উচ্চতা যদিও অনেক বেশি, আন্ডার-কন্সট্রাকশন এরিয়ার ছোট বালু, মাটি, পাথরের স্তুপ গুলোকে একেকটা পাহাড় মনে হচ্ছিলো, যেন বিধাতা শ্রী মিশিয়ে এগুলো তৈরি করেছে। শরের মধ্যে পাহাড়গুলো কেউ এখনো আবিষ্কার করেনি, যদিও একদল পাহাড়ি পিঁপড়ে এখানে বসবাস শুরু করেছে। চাঁদে যদিও কাউকে দেখছি না, চাঁদটাকে আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে। এই চাঁদের নিচেই বুঝি কবি সাহিত্যিকেরা সারারাত কাঁটিয়ে দিয়েছেন। মরুভূমির পাশে যেমন ছোট ছোট পাহাড় আছে, চোরাবালি থাকাও অতি স্বাভাবিক। কাজের সুবিধার জন্য এক কোণায় ছোট্ট পুকুর খনন করা হয়েছে, যেখানে পিলার করার সময় ভূ-গর্ভ থেকে উঠে আসা কাদা-বালি রাখা হয়েছে। বালির কারণে পুকুর ভরে গিয়েছে, যেদিক দিয়ে খুব সহজেই হলের মাঠে পৌছানো যাবে। যেমন সন্দেহ করেছিলাম, কাদাবালির আস্তরণ শক্ত হওয়ায় খুব সহজেই পার হওয়া যাচ্ছে। দু'কদম এগিয়ে যতক্ষণে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো, ততক্ষণে আমার পা'দুটো হাটু পর্যন্ত মাটির নিচে। পা উঠাতে গিয়ে বুঝতে দেরি হলো না, কতটা বিপদে পড়েছি। উঠার চেষ্টা করাতে শরীর এতক্ষণে কোমর পর্যন্ত মাটির নিচে। লুঙ্গির যেহেতু পকেট নেই, তাই হাতে করে মুঠোফোন নিয়ে আসিনি। নিজের উপর বড্ড রাগ উঠছে, মোবাইলটা নিয়ে আসলে কী এমন কষ্ট হতো! বন্ধুদেরকে ফোন দিয়ে অন্তত নিজেকে উদ্ধার করতে পারতাম। পাশেই ফায়ার সার্ভিসের অফিস, অথচ জানানোর মতো সামর্থ্য নেই। সিনেমায় দেখা, চোরাবালিতে আটকে গেলে উঠার চেষ্টা করতে হয় না। চেষ্টা করলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ছাড়া উপায় নেই। মুক্তি পাওয়ার জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। শরীরে দু'দিন যাবত জ্বর, তাছাড়া গায়ে পাতলা একটা টিশার্ট পরা। আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদের পাহাড়গুলোকে দেখতে থাকলাম। যদি চাঁদের বুড়ির দেখা মিলতো এখন, তার সাহায্যে অন্তত উদ্ধার হওয়া যেত। চাঁদের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। আমার কষ্টের কথা, নিঃসঙ্গতার কথা বলতে লাগলাম। প্রতি উত্তরে চাঁদ বললো, 'নিঃসঙ্গতা কষ্টের? হাহাহা। কষ্টতো সঙ্গী থাকলে। ঝগড়া, বিবাদ, হিংসে লেগেই আছে তোমাদের তথাকথিত সঙ্গতায়।" নিঃসঙ্গ চাঁদ কোনদিন সঙ্গ পায়নি, নিঃসঙ্গতার কষ্ট তার বোঝার কথাও না। পাশদিয়ে সারি-সারি পিঁপড়ে চলছে। পিঁপড়েদেরকে প্রশ্ন করলাম, শীত লাগছে না? তাদের মধ্যে একজন তিরষ্কার করে বললো, "কেন জ্যাকেট বানিয়ে দিবেন? পাহাড়গুলোকে দেখে তাদেরকেও একাই লাগছে, গাছা পালা নেই শরীরে একটাও। কল্পনার পাহাড়ে অনেক গাছপালা, ছোট ছোট ঘরবাড়ি থাকে স্বপ্নে, কিন্তু বাস্তবে থাকবে কিভাবে! মীমকে একদিন স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম পাহাড়ে বাড়ি বানাবো, যা লোকালয় থেকে বহুদূরে থাকবে। কোন কোলাহল নেই। রাতের আকাশের চাঁদ দেখবো দুজনে সারারাত আর হারিয়ে যাবো প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে। বড্ড শীত লাগছে শরীরে। অবশ্য এতটা শীত শহরে নেই। শরীরে জ্বর খুব বেশি দেখেই বোধয় এরকম লাগছে। ঠান্ডায় বাঁচার আশাটাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যদি বেঁচে থাকি তবে মোবাইল ছাড়া কোথাও যাবো না।
এতো ঠান্ডার পরও চোখ কিভাবে লেগে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি। হঠাৎ পায়ের শব্দে পিছনে তাকিয়ে দেখি কেউ একজন এগিয়ে আসছে এদিকে। প্রহরী হতে পারে, আবার হলের কোন ছাত্রও হতে পারে। একটু না এগোলে ডাক দেয়া ঠিক হবে না, ভূত ভেবে ভয় পেতে পারে। লোকটি এগিয়ে একেবারে আমার কাছে চলে আসলো। আমাকে দেখেনি এখনো, দেখলে হয়তো ভূত ভেবে দৌড়ে পালাতো। এটা তো হৃদয়। চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার বদনখানি। আড্ডা দিয়ে রুমে ফিরছে। আমার ডাক শুনে একটু ভয়ই পেলো বোধকরি। কি ভেবে দৌড়াতে গিয়েও দৌড় দেয়নি। আমাকে তুলার জন্য এগিয়ে আসলো। আমাকে তুলতে গিয়ে হাটু পর্যন্ত তাকেও মাটির নিচে যেতে হলো। বহু কষ্টে মুক্তি স্বাদ পেয়ে ভালোই লাগছে। কিন্তু আরেকটা সমস্যা বেধে গেলো, হৃদয় উঠতে পারছে না সেখান থেকে। খুঁজে খুঁজে একটা টিনশেট ম্যানেজ করলাম। তার উপর দাড়িয়ে কোনমতে হৃদয়কে উপরে তুলতে সক্ষম হলাম। তখনও চাঁদটা আকাশথেকে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে গান গেয়ে উঠলাম, "বাঞ্চুদ, চাঁদ উঠেছিলো গগণে।"
©somewhere in net ltd.