নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
পড়ন্ত বিকেলে গর্ত থেকে মাথা বাড়ায় সাপটি, জিভ বের করে বার কয়েক শিস দিয়ে চলতে শুরু করে। বিকেলের সোনারোদের প্রভাবে সাপটির গায়ের চামড়ার ঔজ্জ্বল্য আরো বেড়ে যায়। অবিরাম চলতেই থাকে পথের বুকে বুক রেখে। এ রাস্তার মোড়, ও পথের বাঁক পেরিয়ে সাপটির মাথা অনেক দূরে চলে গেলেও লেজ এখনও গর্তের ভেতরে; কী আশ্চর্য সাপ!
আকন্দ গাছের তলায় পিঁপড়াদের মেলা বসেছে। উৎসবে মাতোয়ারা পিঁপড়াকুল! নাচ-গান হচ্ছে, রঙ্গ-তামাসা হচ্ছে, আর খানাপিনা তো আছেই! একটা মরা আঞ্জনি, মরা প্রজাপতি, একটা আধমরা ফড়িং, মরে শুকিয়ে যাওয়া একটা টাকিমাছ, একটা আমসি মাকড়সা, কিছু চানাচুরের টুকরো; এর সঙ্গে সালাদের মতো দু-চারটে মরা মশা, কী নেই খাবারের তালিকায়!
এতোকিছুর পরেও আছে মিষ্টান্ন! এক বালক বামহাতে বাবার আঙুল আর ডান হাতে একটা লাড্ডু ধরে চাটতে চাটতে হাট থেকে বাড়ি ফিরছিলো, এখানটায় এসেই হাত ফসকে লাড্ডুটা পড়ে যায়। বাবা পরের হাটে আবার লাড্ডু কিনে দেবে বলে সান্ত¡না দিতে দিতে দুঃখিত ছেলেকে নিয়ে বাড়ির পথে এগিয়েছে। আর লাড্ডুটা গড়িয়ে গিয়ে পড়েছে পিঁপড়াদের উৎসবে। লাড্ডু পেয়ে পিঁপড়াদের সে কী আনন্দ! আঞ্জনি পেয়েছে, প্রজাপতি, ফড়িং, টাকিমাছ, মাকড়সা, এমনকি মশাও বাকি জুটেছে। বঙ্গদেশের পিঁপড়া, খাবারের শেষে একটু মিষ্টান্ন না হলে কি চলে? লাড্ডুটা গড়িয়ে গিয়ে ওদের ষোলকলা পূর্ণ করেছে!
চলতে চলতে সাপটির চোখে পড়ে রাস্তার ঢালে আকন্দ গাছের তলায় পিঁপড়াদের এই মিলনমেলা। জিভ বের করে কয়েক বার শিস দেয়। মাথাটা ডানে-বায়ে কাত করে। ভয়ানক ফণা তোলে, ছোবল মারে আকন্দ গাছের গোড়ায় পিঁপড়াদের ডিমে, কিছু পিঁপড়াও মুখে পুড়ে নেয়। পিঁপড়াসহ মরা আঞ্জনি আর মাকড়সাটা গলাধঃকরণ করে। তারপর হাঁ করে বিষ ঢেলে দেয় পিঁপড়াদের উৎসবে!
আবার চলতে শুরু করেছে সাপটি। সাপটির গায়ের রঙ এখন আর সেই বাদামি নেই। পথ চলতে চলতে এখন নানান বর্ণ ধারণ করেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রঙ। কোথাও সাদা, কোথাও কালো, কোথাওবা পীত ইত্যাদি বর্ণ!
শূন্যে নাচতে নাচতে দুটো গঙ্গাফড়িং ঘাসের ডগায় বসে। সাপটি মুখ হা করে ফড়িং দুটোর শরীরে বিষ ছোড়ে।
চলতে পথে কদম গাছে একটা হলুদ পাখি পূরবী রাগে গান গায়, ঝিঁঝিপোকা খঞ্জনি বাজায়, বাতাসে গাছের পাতা সঙ্গত দেয়; সাপটি সে-সব কিছুই শোনে না! পৃথিবীর কোল আলো করে চাঁদ ওঠে, সাপটি ফিরেও চায় না চাঁদের দিকে! শন্ শন্ শব্দে হিমেল বাতাস বয়, সাপটি বাতাসের অনুভূতি টেরই পায় না!
একটা বেশ বড় মানকচু গাছের তলায় কয়েকটা শামুক নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করছিল। সাপটিকে দেখে তারা মুখের পর্দা টেনে গুটিয়ে যায়। সাপটি শামুকগুলোর দিকে তাকিয়ে বার দুয়েক শিস দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। তারপর একটি অন্ধকার গর্তে মাথা ঢুকিয়ে দেয়। তখনই দূরের সেই গর্ত থেকে বের হয় সাপটার লেজ!
গভীর রাতে সাপটি আবার বের হয়.....
দুই
একদল মানুষ লম্বা লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। একজনের চোখ আরেকজনের পিঠে, নিতম্বে, পায়ের দিকে। কেউ আশেপাশে তাকাচ্ছে না। সোজা পথে কেবল হাঁটছেই, লাইন ভাঙছে না। অপর দিক থেকে আসছে একটা ছোট মিছিল। আজ স্বাধীনতা দিবস। নারী-পুরুষের সম্মিলিত মিছিলটি ব্যানার নিয়ে শহরের দিকে যাচ্ছে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে। লম্বা লাইনের মানুষগুলো রাস্তার ডানপাশ দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আড়চোখে মিছিলের মুখগুলো দ্যাখে।
সাত থেকে সত্তর, সব বয়সের মানুষই আছে মিছিলে। কারো কারো মুখে আঁকা বাংলাদেশের পতাকা। সামনের সারিতে ব্যানার ধরে আছে শাড়ি পরা একদল তরুণী। দারুণ উচ্ছ্বাসে গলা খুলে গান গাইছে তারা। মিছিলটা পেরিয়ে গেলে লম্বা লাইনের একজন মুখ বিকৃত করে গলার রগ ফুলিয়ে বলে, ‘বেতমিজ জেনানা’!
লম্বা লাইনটা হালিমের দোকানের সামনে দিয়ে চলে যায়।
তিন
বেড়িবাঁধের দক্ষিণে মেহগনি গাছের ঘন ছায়ার হালিমের মুদি দোকান, চা-ও বিক্রি করে। বেড়িবাঁধের ওপাশেই পদ্মা। বর্ষাকাল হলেও এদিকটায় এখনও মেঘের নাকাড়া বাজেনি, বৃষ্টির ফুল ফোটেনি পদ্মা কিংবা পুকুরের জলে। অথচ এরই মধ্যে পদ্মার পেট বাড়তে শুরু করেছে। কোন গহীনে কার সাথে শুয়েছে তা কে জানে! নিত্য মাঝির মা বলে ‘কলঙ্কিনী মাগি’! নিত্য’র বাবা মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।
হালিমের দোকানের বেঞ্চ দুটো আগে খালি হতো না কখনও। মানুষ এক গিয়ে আর এক এসে বসতো। স্থানীয় লোকজনই বেশি থাকতো। তাছাড়া বিকেলের দিকে বাইরের লোকজনের সমাগম হয় এদিকটায়। শহর থেকে, অন্যান্য গ্রাম থেকে সাইকেলে, ভ্যানে-রিক্সায় পদ্মার হাওয়া খেতে আসে মানুষ। এখন হালিমের দোকানে স্থানীয় লোকজনের ভিড় কমে গেছে।
আগে বাড়ির কাজ সেরে মাঝে মাঝে তার বউ তাকে সাহায্য করতে আসতো দোকানে। বসে বসে চা-পান বানাতো। টাকা-পয়সার লেনদেনও করতো। হালিম মালপত্র আনতে গেলে বা কোথাও গেলে বউ-ই চালাতো দোকান। দোকানে একটা চৌদ্দ ইঞ্চি টিভি আছে। সকাল থেকে রাত অব্দি জি বাংলা, স্টার জলসার সিরিয়াল কিংবা বাংলাদেশের কোনো চ্যানেলে সিনেমা চলতো আগে। মানুষ টিভি দেখতো আর নিজেদের মধ্যে গাল গল্প করতো, হাসি-তামাশা করতো। এখনও সকাল থেকে রাত অব্দি টিভি চলে; তবে জি বাংলা- স্টার জলসা নয়, আল-জাজিরা কিংবা সিডি প্লেয়ারের মাধ্যমে ওয়াজ মাহফিল। যদিবা বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল কদাচিৎ চলে, তো নিউজ চ্যানেল; তাও কখনও-সখনও। এখন হালিমের দোকানে তার বউ এসে চা বানানো তো দূরের কথা, গত ছয় মাসে এলাকার কোনো পুরুষ তার বউয়ের ছায়াও বোধ হয় দ্যাখেনি!
লুঙ্গি-জামা ছেড়ে দিয়েছে হালিম। এখন পুরোদস্তুর আরবীয় বেশ তার। মুখে দাড়ি, গোটা পাঁচ-ছয় দাড়িতে পাক ধরেছে, সেগুলো মেহেদি রাঙা। চাল-চলনে, কথাবার্তায় এসেছে বিস্ময়কর পরিবর্তন। দোকানে কোনো খরিদ্দার এলেই লম্বা সালাম দিয়ে বলে, ‘ভাইসাহেব, বসেন দুই মিনিট কথা বলি।’
এরপর শুরু করে বয়ান। একটু শুনে শ্রোতা উশখুশ করে, কেউবা কাজ আছে বলে উঠে যায়। আবার অনেকে মন দিয়ে শোনেও। পরিচিত কেউ কেউ তার বয়ান শোনার ভয়ে দোকানে আসা কমিয়ে দিয়েছে। সে নিজেও প্রায়ই দোকান বন্ধ করে পাঁচ-দশ দিনের জন্য হাওয়া হয়ে যায়। তখন দোকান বন্ধ থাকে। অথচ আগে সে কোথাও গেলে দোকান চালাতো তার বউ। একারণে আয়-রোজগারও কমে গেছে। ‘কমুক, ইহকালের আয়-রোজগার সুখই সব নয়, পরকালই সব, সে তো পরকালের জন্য রোজগার করছে!’ নিজেকে বুঝ দেয়।
আগে হালিমের সঙ্গে যারা হাসি-তামাশা করতো, এখন তারা তাকে সমীহ করে চলে। সে অন্য জগতের মানুষের সাথে চলাফেরা করায় কেউ কেউ তাকে ভয়ও পায়, নিজেও তা বুঝতে পারে। এজন্য অনেকে তার দোকানে আসাই ছেড়ে দিয়েছে। তিন রাস্তার মোড়ে ঐ কাফের মালাউন সুধীরের দোকানে যায়। সুধীর আগের সাদাকালো চৌদ্দ ইঞ্চি বদলে একুশ ইঞ্চি রঙিন টিভি কিনেছে দোকানে জন্য। দিনভর বেপর্দা জেনানাদের ছেনালিপনা-বেলেল্লাপনা চলে টিভিতে। তাই দেখতে মাছির মতো ভিড় জমে। বিক্রিও হয় বেশি। তার বাঁধা খরিদ্দারদের কেউ কেউ ওই মালাউনটার দোকানে গিয়ে ভিড়েছে। এই বেলেল্লাপনা বন্ধ করা দরকার শীঘ্রই!
হালিমের দোকানে এখন খরিদ্দার নেই। আল-জাজিরায় চোখ রেখে নিজের ভেতরের ক্রোধটা ঝালিয়ে নিচ্ছে, ক্রূরাত্মায় শান দিচ্ছে। লম্বা সালাম দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় ইসহাক। দুঃখিত, মোহাম্মদ আবু ইসহাক মোল্লা!
‘জনাব মোহাম্মদ হালিম মিয়া, সব ঠিক তো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর রহমতে সব ঠিক।’
‘তাহারা আজ সন্ধ্যায় আসিবেন। আপনার বাড়িতে রাত্রিযাপন করিবেন। সকালে আল্লাহ্’র নাম নিয়া আপনি তাহারদের সহিত রওনা হইবেন।’
‘ইনশাল্লাহ্।’
‘সর্বদা মনে রাখিবেন, আমরা কোনো মানুষের কাজ করি না, আমরা কোনো মানুষের গোলামী করি না। আমরা মহান আল্লাহ্তায়ালার বান্দা, আমরা তাহার গোলামী করি।’
এই সময় আল-জাজিরা মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত চারজন আইএস জঙ্গির লাশ প্রদর্শন করে।
‘ইন্নালিল্লাহি ও ইন্না ইলাহি রাজিউন। হে আল্লাহ, হে পরওয়ারদিগার, আপনার এই পাক বান্দাদের বেহেশত নসিব করুন। হে তাওহিদ, আপনার এই পরহেজগার বান্দাদের আপনি ফজিলত দান করুন। আর যে জালিমেরা আপনার বান্দাদেরকে এই তকলিফ দান করেছে, আপনি এর চেয়ে শতগুণে-হাজারগুণে তকলিফ দিয়ে তাহাদেরকে এই পৃথিবীর বুক থেকে হজিমত করুন মালিক। দোজখে নিক্ষেপ করুন। আমিন।’
দুইহাত উপরে তুলে এই কথাগুলো বলতে বলতে ইসহাকের গলা ধরে আসে, চোখ ভিজে যায়। হালিমও ইসহাকের দেখাদেখি দুইহাত উপরে তুলে মালিক মালিক বলে কয়েকবার। এরপরই আল-জাজিরা জানায় আইএস ছয়জন জিম্মি খ্রিষ্টানের শিরোচ্ছেদ করেছে। ইসহাক উঠে দাঁড়িয়ে মুষ্টিবন্ধ ডান হাত শূন্যে ছুড়ে দিতে দিতে বলে, ‘আল্লাহুআকবর, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুল্লিাহ, সুবহান আল্লাহ্!’
হালিম যথারীতি তাকে অনুসরণ করলো।
চার
শরতের মাঝামাঝি। তবু যেন বর্ষার ঘোর এখনও ভাল মতো কাটেনি। ভাদ্রের প্রথম দশ দিন তো বর্ষণে শ্রাবণকেও হার মানিয়েছে। তারপর থেকে সারা মাস জুড়েই ছেঁড়া ছেঁড়া বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি বন্ধ হলেই ভ্যাপসা গরম। ক’দিন ধরে চলছে বঙ্গপোসাগরে লঘু নিন্মচাপ। বিকেলের দিকে বাতাসের বেগ বাড়ে, পদ্মা জটাধারী পাগলীর মতো হাত-পা ছুড়ে আছাড়ি-পিছাড়ি করে। আঁচল ছুড়ে দেয় বেড়িবাঁধের গায়ে!
উত্তরের জানালায় বসে পদ্মার দিকে তাকিয়ে আছে বছর নয়েকের নূর ইসলাম। মাথায় টুপি, পরনে পাঞ্জাবী-পাজামা। বিকেলের আলোয় পদ্মার বুকের রঙ বদলে যাচ্ছে। সোনালী আভা খেলা করছে পদ্মার সারা বুকে। পদ্মার ঐ পারটা এখান থেকে দেখা যায়, তবে ঝাপসা। ঐ পারেই নূর ইসলামের বাড়ি, পাবনায়। বলতে গেলে পদ্মার পারেই তাদের বাড়ি। বাবা-মা, বোন সেলিনা আর ভাই নিয়াজ থাকে সেখানে। বাবা ঘাটের কুলি। বাড়িতে খাওয়া-পরার বড় কষ্ট, তাইতো তার মাদ্রাসায় আসা। বোন আর ভাইটার জন্যে বড় পরান পোড়ে। নিয়াজ কেবল হাঁটা শিখেছে। শিখেছে আধো আধো বোল। টাল খাওয়া পায়ে ‘বাই’ বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। ঐ পারের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। ঈদের আরো পনের দিন দেরি। ঈদের তিনদিন আগে আব্বা তাকে নিতে আসবে। সে পদ্মার বড় বড় ঢেউ গোনে, দিনও গোনে। ঢেউগুলো নিমেষেই শেষ হয়ে যায়, দিনগুলো শেষ হতেই চায় না!
কিচির-মিচির শুনে পুবের জানালায় ছুটে যায় নূর ইসলাম। শালিকটা বাঁশ থেকে নিচে নেমে এসেছে অথবা পড়ে গেছে। বাচ্চা একটা শালিক। এখনও ভাল মতো উড়তে শেখেনি। মাঝে মাঝে নিচে নেমে আসে, ডানা ঝাপটে কঞ্চির সাহায্যে উঠা-নামা করতে ওর খুব কষ্ট হয়। ওর মা মাঝে মাঝে মুখে করে খাবার এনে ওকে খাওয়ায়। তখন কেন যেন খুশিতে ভরে ওঠে তার মন। শালিকটা আবার কসরত করে বাঁশে উঠতে থাকে।
মাদ্রাসার পূর্ব দিকটায় বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ে অনেক শালিক আর বক আছে। পাশেই বিরাটাকার একটা অর্জুনবৃক্ষের গাছ। এই গাছেও বক আছে, অন্যান্য পাখিও। শীতের সময় অবকাশ যাপনে আসে কিছু অতিথি পাখি, অর্জুনবৃক্ষে অস্থায়ী সংসার পাতে তারা।
মাঝে মাঝে রাতের বেলা পাখিরা তীব্রভাবে ডানা ঝাপটা-ঝাপটি আর ভীষণ তীক্ষèস্বরে কিচির-মিচির করে। তখন নূর ইসলামের মনে হয় ওরা আসলে কাঁদে। এক বড় ভাই বলেছে, রাতেরবেলা বাঁশ বেয়ে ভয়ংকর সাপ উপরে ওঠে পাখির বাচ্চা আর ডিমের লোভে। তখন ভয় পেয়ে ডিম আর বাচ্চার মায়ায় পাখিগুলো কাঁদে! ভয়ে ছুটোছুটি করে।
নূর ইসলাম ঘর থেকে বের হয়। মাদ্রাসার ছেলেরা খেলছে। তার রোজ খেলতে ভাল লাগে না, যেদিন বাড়ির কথা মনে পড়ে সেদিন সে হাঁটে। বেড়িবাঁধ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। পদ্মার ঐপারে তাকিয়ে থাকে।
পদ্মাপারে নৌকা নিয়ে পিকনিক করতে আসে অনেক মানুষ। স্পিকারে জোরে জোরে গান বাজে। নৌকার ওপর মানুষগুলো গানের তালে তালে নাচে। আনমানা হয়ে মাঝে মাঝে নিজেও দু-এক কলি গেয়ে ওঠে নূর ইসলাম। তারপরই জিভ বের করে তওবা কাটে।
বেড়িবাঁধ দিয়ে হাঁটছে নূর ইসলাম। তিন রাস্তার মোড়টা পার হলেই রাস্তার পাশে বটগাছ। বটগাছের নিচে মন্দির। ক’দিন বাদেই দূর্গাপূজা। মূর্তির দো-মেটের কাজ প্রায় শেষের পথে।
মন্দির এখন ফাঁকা। প্রতিমার দো-মেটের কাজ শেষ হয়েছে। কোথাও কোথাও এখনো কাঁচা, শুকোয়নি ভাল মতো। শুকোলেই রঙের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে প্রতিমাশিল্পী। নূর ইসলাম হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের কাছে যায়, কি মনে করে খোলা মন্দিরের বারান্দায় ওঠে। আগে দিনেশ-শংকরদের সাথে কতো উঠেছে মন্দিরে! দূর্গা, অসুর, লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক- গণেশকে নিয়ে নিজেদের মতো করে গল্প বুনেছে তারা।
নূর ইসলামদের বাড়ির পাশেই দূর্গামন্দির। ওখানে দূর্গাপূজা হয়, কালীপূজাও হয়। তাদের গ্রামে মুসলমানের চেয়ে হিন্দুই বেশি। তার অনেক হিন্দু বন্ধু আছে। দিনেশ, শংকর, দেবু, গোবিন্দ। বাড়িতে থাকতে পূজার দিনগুলো তো ওদের সাথেই কাটতো তার। পূজোর সময় ওদের বাড়িতে ভাল ভাল খাবার বানাতো। ওরা তাকে ডেকে নিয়ে খেতে দিত। তখনই সে জেনেছে এই ডাকাতের মতো দেখতে অসুর লোকটা মোটেই সুবিধের নয়, ভীষণ খারাপ! আর দূর্গা ভাল, তাইতো দূর্গা অসুরটাকে মেরেছে।
নূর ইসলাম পায়ে পায়ে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে। একটা একটা করে মূর্তি খুঁটিয়ে দ্যাখে। কার্তিকের বাহন ময়ূরের মাথাটা স্পর্শ করে। ‘ইস! যদি সত্যি ময়ূর হতো!’ আফসোস হয় তার। সে কখনও জীবন্ত ময়ূর দ্যাখেনি।
অসুরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সে। অসুরের দিকে তাকিয়ে দাঁতমুখ খিঁচায়। তারপর মুখ দিয়ে ঢিসুম-ঢিসুম শব্দ করে কোনো স্পর্শ ছাড়াই অসুরকে ঘুষি মারার অভিনয় করে কিছুক্ষণ; শেষে আলতো করে অসুরের মাথায় একটা চাটি মারার পর বাঘের মুখোমুখি হয়। দুই হাত থাবার মতো করে, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বাঘের মতো হুঙ্কার ছাড়ে। অপর দিক থেকে কোনো পাল্টা আক্রমণ না হওয়ায় অবশেষে ক্ষান্ত দেয় সে। বাঘের দাঁত স্পর্শ করে। মুখের ভিতর তর্জনী ঢুকিয়ে বলে, ‘খাও, আমার আঙুল খাও। খাও দেহি কেমন পারো। পারে না....।’
এরপর নূর ইসলামের চোখ পড়ে সাপের ওপর। সাপটা অসুরের দিকে ফণা তুলে আছে, লেজটা দূর্গার হাতের মুঠোয় ধরা। প্রথমে নিজের ডান হাতটা ফণার মতো বানিয়ে মুখ দিয়ে হুস হুস করলো সে। নিজেও ভয় পাওয়ার ভান করে। তারপর কি খেয়ালে ডান হাতের বুড়ো আঙুল মুখে পুড়ে হাতদুটো বীণের মতো করে সাপের মুখের সামনে নাচায় আর বীণ বাজানোর অনুকরণে মুখ দিয়ে শব্দ করে! হঠাৎ-ই এই খেলা সাঙ্গ হয় পিছন থেকে কেউ একজন এসে সজোরে তার কান ধরায়!
মাদ্রাসার আঙিনার মাঝখানে দুই হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নূর ইসলাম। দুই পা দড়ি দিয়ে বাঁধা, যাতে দৌড়ে পালাতে না পারে। ডান হাতের তালুতে মাঝারি স্বাস্থ্যের বেতের প্রথম ঘা পড়তেই ব্যথায় ‘উহ্’ শব্দ বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে। দ্বিতীয় ঘা দেবার সময় বাম হাত কিছুটা পিছিয়ে আনায় হাতে পড়ার বদলে শূন্যে বেতের বাতাস কাটার শব্দ হয়। কিন্তু পরক্ষণেই দ্বিগুণ ক্রোধে নূর ইসলামের বাম কাঁধে কয়েক ঘা বেত্রঘাত কষে বড় হুজুর। নির্দেশ মতো আবার দুই হাত বাড়ায় সে। একবার তার ডান হাতে আবার বাম হাতে একের পর এক বেতের ঘা পড়ে। চিৎকার করে কাঁদে সে, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে জলের ধারা।
মাদ্রাসার অন্যান্য ছেলেরা কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কেউবা ঘরের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে দ্যাখে এই প্রহার দৃশ্য। আঙিনার একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষীপ্র চোখে তাকিয়ে দ্যাখে তরুণ মাদ্রাসা শিক্ষক মোহাম্মদ আবু ইসহাক মোল্লা। বিধর্মী কাফেরদের মন্দির থেকে সে-ই নূর ইসলামকে কান ধরে টেনে এনেছে।
প্রহারের প্রবলতায় মাটিতে পড়ে যায় নূর ইসলাম। বড় হুজুর এবার তার পিঠে শেষ বারের মতো কয়েক ঘা বেত্রাঘাত করে অন্য ছাত্রদের উদ্দেশে বলে, ‘দেইখে রাইখো তোমরা, দেইখে রাইখো, ফের যদি কেউ ভুল করেও কাফেরগের মন্দিরের দিকে পা বাড়াও, তার শাস্তি হইবে এর চেয়েও ভয়ানক। একজন এসে এই বেতমিজটার পায়ের বান্দনডা খুলে দাও।’
রাতে নূর ইসলামের জ্বও আসে। জ¦র ছাড়ে তিনদিনের মাথায়।
পাঁচ
কয়েক মাস যাবৎ হালিমের কোনো খোঁজ নেই। হালিম আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকতো। কোথায় যেতো তা পাড়ার কেউ জানতো না। এমনকি তার বউ আয়েশাও না। দোকানে বেচাকেনা কমে গেলেও অভাব ছিল না সংসারে, বরং আগের চেয়ে ভাল চলছিল। আয়েশা নানান রকম প্রশ্ন করেও হালিমের কাছ থেকে অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো উত্তর পায়নি। হালিম শুধু বলেছে, ‘রিজিকের মালিক আল্লাহ্পাক। আমি আল্লাহ্পাকের কাজ করি। আল্লাহ্পাকই রিজিকের ব্যবস্থা করেন।’
বেশি পীড়াপীড়ি করলে ধমক খেয়েছে আয়েশা।
কয়েক মাস আগে একদিন ভোরবেলায় বোঁচকা নিয়ে বেরিয়ে যায় হালিম। আয়েশাকে বলে যায়, ‘সপ্তাহ খানেক পর ফিরবো।’ কিন্তু সপ্তাহ ঘুরে পক্ষ যায়, পক্ষ ঘুরে মাস, তারপর আরো মাস যায়, তবু হালিমের দেখা নেই! হালিমের বউ আয়েশা ক’দিন পর পর ইসহাকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে হালিমের ব্যাপারে। ইসহাক তাকে সান্ত¡না দেয়, ‘চিন্তা করিয়েন না ভাবীসাহেবা। ভাইসাহেব আল্লাহ্পাকের পরহেজগার বান্দা। তিনি যেখানেই থাকুন, আল্লাহ্ পাক তাহাকে ভাল রেখেছেন। আল্লাহ্পাকের ইচ্ছায় ভাইসাহেব নিশ্চয় তাড়াতাড়ি ফিরিয়া আসিবেন।’
মুখের কথায় মনের সান্ত¡না জুটলেও, পেটের অন্ন জোটে না। হালিমের রেখে যাওয়া টাকা কবেই শেষ হয়ে গেছে। তারপর পাড়া-পড়শির কাছ থেকে ধারদেনা করতে হয়েছে আয়েশাকে। ধারদেনা করে আর ক’দিন চলে? অথচ ইসহাকের কাছে গেলে ঐ এক উত্তর, ‘চিন্তা করিয়েন না ভাবীসাহেবা...!’
ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুসতে থাকে আয়েশা। কিন্তু মুখে কিছু বলে না ইসহাককে। যখন একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, ধারদেনা পাওয়াও বন্ধ হয়, তখন ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে দোকানের ঝাঁপ খুলে বসে সে। প্রায় বছরখানেক পরে আয়েশার মুখ দেখে পরপুরুষ। পাড়া-পড়শির চোখেও বিস্ময় আর মনে কৌতুহলী প্রশ্ন! হঠাৎ হালিম কোথায় গিয়ে নিরুদ্দেশ হলো যে আয়েশা বোরকা ছেড়ে আবার আগের মতো দোকানে বসতে হলো? কেউ কেউ হালিমের কথা জিজ্ঞাসা করে। আয়েশা কোনো সদুত্তর দিতে পারে না।
ধুলো-বালি ঝেড়ে মুছে স্টোভে গরম পানির কেতলি চড়ায় আয়েশা। গরম পানির ভাপ উঠতে না উঠতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে লম্বা সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়ায় ইসহাক। গরম জলের কেতলির মৃদু ধোঁয়া ওঠা নলের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এ আপনি কী গুনাহ’র কাজ করছেন ভাবীসাহেবা! বেপর্দা হয়ে দোকান খুলে বসেছেন। দোকান চালানো আপনার কাজ নয়।’
আয়েশা কোনো কথা না বলে আপন মনে সুপারী কাটতে থাকে। তারপর রিমোর্ট চেপে টিভিটা চালায়। নায়কের বুকে মুখ গুঁজে নায়িকা কাঁদছে। কেঁদেই চলেছে...
‘ভাবীসাহেবা, টিভিটা বন্ধ করেন। এসব গুনাহ’র কাজ। আপনি দোকান বন্ধ করে ঘরে যান।’
আয়েশা নীরব।
‘কথা বলেন ভাবীসাহেবা।’
‘আমার স্বামীরে আনে দ্যান।’
‘বলেছি তো ভাইসাহেব আল্লাহ্পাকের পরহেজগার বান্দা। তিনি যেখানেই থাকুন, আল্লাহ্ পাক তাকে ভাল রেখেছেন। ভাই সাহেব যদি ফিরে এসে দ্যাখেন যে আপনি বেপর্দা হয়ে দোকানে বসেছেন, তাহলে তিনি কষ্ট পাবেন। আর মৃত্যুর পর আপনার জায়গা হবে হাবিয়া দোজখ।’
দপ করে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে আয়েশার। হাতের জাঁতিতে প্রয়োজনের অধিক চাপ দিয়ে দু’ভাগ করে সুপারি। ইসহাকের মুখে দৃষ্টি ছুড়ে ক্ষুব্ধ গলায় বলে, ‘হোক। কাম করে খালি যদি দোজখে যাতি হয় তো যাব। আপনি আমার সামনের তে যান।’
অভিমান ভুলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার পর মিলনের আনন্দে নায়ক-নায়িকা এখন নাচে-গানে মত্ত!
‘আস্তাকফিরুল্লাহ! হে আল্লাহ্ আপনার এই অবুঝ বান্দাকে সুমতি দিন। ভাবীসাহেবা, দোকান খুললে ভাইসাহেব ফিরে এসে কিন্তু আপনাকে তালাকও দিতে পারেন!’
‘ফিরে আসে সে যদি আপনের বুদ্ধি শুনে ভেগ ধরে থাহে, তালি আমার আর তার তালাক দেওয়া লাগবেন না, আমি-ই তারে তালাক দিবানে।’
‘আস্তাকফিরুল্লাহ...এইকথার জন্য মৃত্যুর পর আপনাকে দোজখের আগুনে পোড়ায়ে মারা হইবে।’
‘এই খানকির পুত, তোরে যাইতে কই নাই আমার সামনের তে! কতায় কতায় পরকালের ডর দ্যাহাস!’
‘ভুল করতেছেন ভাবীসাহেবা।’
গলার ওপর এট্টা কোপ দিয়ে তোরে পরকালে পাঠায়া দিবানে খানকির বাচ্চা। দূর হ আমার সামনের তে হারামির বাচ্চা!
ইসহাক আর দাঁড়ায় না। বেঞ্চে ডান পায়ের লাথি ছুড়ে মাটিকে জানান দিয়ে হাঁটা শুরু করে।
‘আমার সহজ-সরল স্বামীডারে ভুলায়ে-ভালায়ে নিরুদ্দেশ করছে। আল্লায় জানে মানুষটা বাঁচে আছে না মরে গেছে। তোরে আমি পুলিশে ধরাবো। হারামীর বাচ্চা আমার সংসারডারে শ্যাষ করছিস!’
হাতের জাঁতি দোকানের মধ্যে আছড়ে ফেলে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে আয়েশা।
সাত
ষষ্টীর সকালেই মন্দিরের ঢাকে কাঠি পড়েছে। নূর ইসলামের ভেতরটা নেচে ওঠে ঢাকের আওয়াজে। গ্রামের স্মৃতি মনে পড়ে। গ্রামে থাকতে এই সময়টায় কতো মজা হতো! মন্দিরের সামনের মাঠে মেলা বসে। বন্ধুরা মিলে মেলায় ঘুরে বেড়াতো রাত অব্দি, কতো কি কিনে খেতো! স্মৃতির ঘোরে নূর ইসলাম পৌঁছে যায় মেলাখোলায়। দিনেশ, শংকরদের সাথে মেলার মাঠে ছুটোছুটি করে। লুকোচুরিও খেলে মেলার মাঠে। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে আশপাশে তাকায়। মনে মনে তওবা করে হুজুরের কথা ভেবে। হুজুর বলেছে, ‘ওসব কাফেরদের বেলেল্লাপনা!’
নিমের মিসওয়াক মুখে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাদ্রাসায় ফিরছে ইসহাক। মন্দিরের সামনে মানুষের ভিড়। ঢাক-কাঁসর বাজছে। ইসহাক থমকে দাঁড়ায়। সুসজ্জিত দূর্গার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দূর্গার উন্নত বুক বেয়ে দৃষ্টি নেমে আসে লালচে নাভিতে। নিমের মিসওয়াক মাড়িতে ফেলে জোরে জোরে পেষে। সিরসির করে এক ঝাপটা বাতাস বয়ে যায়। বটের পাতার আবছা অন্ধকারে একটা কাক ডানা ঝাপটায়, উড়ে যেতে চায়!
মাদ্রাসার গেট দিয়ে ঢুকে থমকে দাঁড়ায় ইসহাক। ওজুখানা থেকে বের হয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে ঢাকের তালে বার কয়েক নেচে উঠে হঠাৎ-ই নূর ইসলাম ইসহাকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে। ভীত অপরাধীর মতো একবার ইসহাকের মুখের দিকে তাকায়, আবার মাটির দিকে তাকায়। ইসহাক নূর ইসলামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলে, ‘তুমি যাহা করিছ, তাহার অনেক বড় শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু আমি তোমরে বাঁচাইতে পারি। আমার একটা কাজ করিয়া দিতে হইবে। পারিবা?’
‘পারবো।’ ঘাড় নেড়ে জানায় নূর ইসলাম।
‘রাতে খাবার পর আমার সাথে দেখা করিবা। যাও আবার ওজু করিয়া আসো।’
নূর ইসলাম পুনরায় ওজুখানায় যায়। ইসহাক গিয়ে ঢোকে টয়লেটে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আতাগাছের ডালে বসে একটা কাক ডানে-বায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকছে।
রাতে খাওয়ার পর ইসহাক যখন বারান্দায় পায়চারি করছে তখন তার সামনে এসে দাঁড়ায় নূর ইসলাম। নূর ইসলামের হাত ধরে টেনে নিয়ে বারান্দার নিচে নামে ইসহাক। নিচু স্বরে বলে, ‘কালকের দিন পর মালাউনরা মূর্তি পানিতে ডোবাইবে । ডোবানোর সময় পদ্মার পারে অনেক মূর্তি আনে তারা। তখন ওরা নাচ-গানে ব্যস্ত থাকে। তুমি লোকের ভিড়ে মিশে গিয়ে মূর্তির পরনে কাপড় ছিঁড়ে আনতে পারিবা? বেশি না এক-দেড়হাত হইলেই হইবে।’
‘পারবো।’
তারপর প্রশ্ন করে নূর ইসলাম, ‘হুজুর কাপড় দিয়ে কী করবেন?’
‘কাফের মারিবো। এমন জাদু করিবো, দুনিয়ার ব্যাবাক কাফের মরিয় শ্যাষ হইয়া যাইবে। তহন খালি সাচ্চা মুসলমান থাকিবে দুনিয়ার বুকে। তয় কাউরে কওন যাইবে না এই কথা। কইলে কাফের মরিবে না। আর আল্লাহ্পাক তোমারে দোজখের আগুনে পোড়াইয়া মারিবে। আমিও বড় শাস্তি দিব।’
নূর ইসলাম ঘাড় নাড়ে।
‘এখন যাও।’
চলে যায় নূর ইসলাম। অন্ধকারে দাঁড়িয়েই থাকে ইসহাক। মন্দির থেকে ভেসে আসছে ঢাক আর কাঁসরের বাদ্য।
ঈদের আর তিনদিন বাকি। সবাই যার যার বাড়ি চলে গেছে। নূর ইসলামের আব্বার আজ সকালের দিকেই আসার কথা ছিল। আসেনি। এখন বিকেল। বোধ হয় আজ আর আসবে না। মাদ্রাসা খা খা করছে। কেবল বড় হুজুর আর ইসহাক হুজুর আছে। শাহাবুদ্দিন হুজুরও বাড়ি চলে গেছে। মন খারাপ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে নূর ইসলাম। শালিকের বাচ্চাটাকে খুঁজছে। দেখা যাচ্ছে না। বাচ্চাটা আগের চেয়ে বড় হয়েছে।
একটু পরই শালিকের বাচ্চাটাকে দেখতে পায় সে। বাঁশের নিচের দিকের একটা কঞ্চিতে চুপটি করে বসে আছে। থেকে থেকে ঠোঁটের ডগা দিয়ে ডানা চুলকাচ্ছে! নূর ইসলাম শালিকটার দিকে তাকায়, মৃদু হাসে। আব্বা না আসার দুঃখ ক্ষণিকের জন্য ভুলে যায় শালিকটাকে পেয়ে!
রাতে নূর ইসলাম শাহাবুদ্দিন হুজুরের বিছানায় শোয়। মাদ্রাসায় তিনজন হুজুর। বড় হুজুর মোহাম্মদ নায়েব আলী। তারপর মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন। এরপর মোহাম্মদ আবু ইসহাক মোল্লা। বড় হুজুর একা একঘরে থাকে। শাহাবুদ্দিন আর ইসহাক হুজুর থাকে একই ঘরে। ঘরের দু’পাশে দুটো চকি। মাঝখানে চলাফেরার জায়গা। অন্য ছাত্ররা না থাকায়, একা একা শুতে ভয় করবে বলে বড় হুজুর তাকে এ ঘরেই শুতে বলেছে। আশেপাশে নাকি গায়েবি জ্বীন আছে!
নূর ইসলাম ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের মধ্যে একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখছে সে। জ্বীনের স্বপ্ন। গায়েবি জ্বীনটা ক্রমশই দৃশ্যমান হচ্ছে, মুখটা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, ভীষণ আবছা!
ইসহাক শুয়ে এপাশ ওপাশ করে। তারপর ডান হাতটা ঢুকিয়ে দেয় বালিশের তলায়। খয়েরি রঙের এক খ- কাপড় হাতে নিয়ে নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ শুকতে থাকে। মুখে, গলায় ঘষে কাপড়ের টুকরোটা, দাঁতে কামড়ে ধরে। তারপর ফুলে ওঠা কম্পমান তলপেটের দিকে ধাবিত হয় কাপড়ের টুকরোসহ হাত।
বিছানা থেকে ওঠে ইসহাক। মোবাইলের লাইটটা জ্বালায়। পা টিপে টিপে নূর ইসলামের বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। লাইটের আলোয় দ্যাখে নূর ইসলামের মুখম-ল। নিমীলিত চোখ, ঘুমে কাদা হয়ে আছে। ইসহাক হাতের কাপড়টা পুনরায় নাকের কাছে ধরে ঘ্রাণ নেয়। তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় কাপড়ের ঘ্রাণের ভেতর অন্য কোনো ঘ্রাণ খোঁজে! তারপর বিছানায় বসে, নূর ইসলামের বুকের ওপর মেলে রাখে কাপড়টা। খয়েরি রঙের আঁচলের দিকের হাত দেড়েক লম্বা-চওড়া কাপড়। সবুজ জরির সুতোয় কাজ করা পাড়। কাপড়ে লাইটের আলো পড়ে নূর ইসলামের মুখটা ঈষৎ লালচে দেখায়! ইসহাক সামনে ঝুঁকে নূর ইসলামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চৈতন্যে ঢাক বেজে ওঠে, নিশ্বাসে কানড়ের শিসের মতো শব্দ আর ধুনচির উত্তাপ; চোখে ভাসে- নূর ইসলাম দশ হাত মেলে শুয়ে আছে, উন্নত স্তন, অবগুণ্ঠনহীন মাথায় ঘন কোঁকড়া লম্বা চুল, গোলাপের পাপড়ির মতো গাল, লাল টুকটুকে দুটো ঠোঁট!
বাঁশঝাড়ে শালিকের ঝাঁক কিচির-মিচির করে ডেকে ওঠে, ডানা ঝাপটায়। ভীষণ আর্ত শোনায় শালিকের ডাক। সাপটা বোধহয় আজ আবার উপরে উঠেছে পাখির ডিম কিংবা বাচ্চার লোভে!
ঢাকা।
নভেম্বর, ২০১৪
২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩১
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ প্রিয় বাঙালি পাশে থাকার জন্য।
গল্পটা মাস তিনেক আগে লিখলেও প্রকাশ করিনি। একটু দ্বিধায় ছিলাম এখনই প্রকাশ করবো কিনা, কেনা পাঁচশো টাকার জন্যও এখন মানুষ মানুষকে খুন করছে। কিন্তু অভিজিৎ রায়ের রক্ত ভেতরে আগুন জ্বালিয় দিল।
"আমরা অনেকে ধার্মিক আর মৌলবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে ব্যর্থ হই। এই গল্প তাদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয়।"
চরম সত্য বলেছেন। এদেশে অধিকাংশ লোকের এই অবস্থা। এটা মৌলবাদকে এক ধরণের প্রশ্রয় দেওয়া। যার ফলশ্রুতিতেই মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ আজ মহীরুহের আকার ধারণ করেছে। দেশ হারাচ্ছে তার মেধাবী সন্তান।
ভাল থাকুন। শুভকামনা নিরন্তর..........
২| ০৩ রা মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৫:০৪
মৌসুমী মালা বলেছেন: ভীষন রকমের ভালো লেগেছে আপনার লেখা মিশুভাই। অনেক দিন আগে আপনার একটা কবিতা পড়ে খুব মুগ্ধ হয়ে আপনাকে ফেসবুকে সম্ভবত ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট পাঠিয়ে ছিলাম।
০৪ ঠা মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৬
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাইনি তো। আপনি কী এই নামেই আছেন ফেসবুকে? আমি দেখছি, অথবা আপনি কাইন্ডলি আবার রিকোয়েস্ট পাঠান।
ভাল থাকুন। শুভকামনা নিরন্তর............
©somewhere in net ltd.
১| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০১
বিদ্রোহী বাঙালি বলেছেন: মেটাফোরের সাথে বাস্তবের মিশেল গল্পটাকে অনবদ্য করে তুলেছে। মূলত ইসহাক চরিত্রদের মাধ্যমেই মৌলবাদের স্বরূপটা তুলে ধরেছেন। বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে। আমরা অনেকে ধার্মিক আর মৌলবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে ব্যর্থ হই। এই গল্প তাদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয়।
কাহিনী বিন্যাসে চরম বাস্তবতার ছাপ। অস্বীকার করার কোন উপায় নাই।
আমি মাদ্রাসা শিক্ষার বিরোধিতা করছি না। কিন্তু সেখানে কী ধরণের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কিংবা কী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে সেগুলোর সুষ্ঠু তদারকি দরকার। তা না হলে অভিজিতের মতো মুক্তমনা মানুষগুলোকে এভাবেই নির্মমতার শিকার হতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা দিন দিন বেড়ে যাবে। ধর্মের নামে হবে অধর্ম। সমাজ তলিয়ে যাবে কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামির অন্ধকারে।
গল্পের সাহসী বক্তব্য নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। অনেক ভালো লিখেছেন মিশু। এভাবেই কলমের আঘাতে মৌলবাদীদের নির্মূল করতে হবে। শুভ কামনা রইলো মিশু।