নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-নয়)

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৩৪

কখনো কখনো সুসময়ের জোয়ার আসে, যখন সুসময় আসে তখন জীবনের প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয় নতুন নতুন প্রাপ্তি, এমনকি না চাইলেও অপ্রত্যাশিতভাবে যোগ হয়। তখন মনে হয় আহা, পৃথিবী কতো মায়াময়, জীবন কতো সুন্দর; হাজার বছর বাঁচার সাধ জাগে! আবার কখনো কখনো এমন দুঃসময় আসে যে একের পর এক খারাপ ঘটনা ঘটতে থাকে, দুঃসময়ের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে জীবন খাবি খায়। তখন মনে হয় পৃথিবী খুব নিষ্ঠুর, জীবন বড় যন্ত্রণাময়; মরে যেতে ইচ্ছে করে। নীলুর জীবনেও শুরু হয়েছে দুঃসময়ের ঘূর্ণাবর্ত! নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি, এর মধ্যেই ভারত থেকে আসার তেরো দিনের মাথায় তার মা মারা গেছে। মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তি বেরিয়ে গেলে বাড়ির অন্য সকলে শোক কিছুটা কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করেছে। নিখিল সাইকেলের পিছনে কাপড়ের গাট্টি বেঁধে গাওয়াল করতে শুরু করেছে, সুবোধও ছাতা আর গাট্টি নিয়ে গাওয়ালে বেরিয়েছে, মেনকা রান্না-বান্না সংসারের কাজকর্ম করছে। কেবল নীলুই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। যাকে কেন্দ্র করে গত কয়েকটা বছর তার জীবন অতিবাহিত হয়েছে, সেই নবদ্বীপ গোঁসাই নেই। ফলে তার কোনো কাজকর্ম নেই। দিনভর ঘরের মধ্যে, নয়তো নদের পারের হিজলতলায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে, কারো সাথে কথাও তেমন বলে না। কেবল নীরবে চোখের জল ফেলে। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছে নীলু, কিছুতেই তার ঘোর কাটছে না। কেবলই তার মনে হচ্ছে এমনটা হতে পারে না। এ তার দুঃস্বপ্ন! এই দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে আবার সে আগের সেই সুখের দিনগুলোতে ফিরে যাবে। মা-বাবাকে প্রণাম করে বাড়ি থেকে বের হবে, নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সাথে বিভিন্ন জায়গায় পালা গাইতে যাবে; সবকিছু আবার আগের মতোই চলতে থাকবে। কিন্তু দুঃস্বপ্নের প্রহর আর কিছুতেই শেষ হচ্ছে না! মাঝে মাঝে সে নিজের গায়ে চিমটি কাটে। না সে জেগেই আছে। বাস্তব জগতেই আছে। তার মা আর আগের মতো নিখিলের ছেলে কোলে নিয়ে বারান্দার এক কোনায় বসে পান চিবোয় না, ডালা-কুলা বানায় না, উঠোনে হাঁটে না, বাবার সাথে ঝগড়া করে না। মা নেই, কোথাও নেই। বাবা গোঁসাইও নেই, তার সাথে আর কোনোদিন পালা গাইতে যাওয়া হবে না। মা যেমন নেই, তেমনি তার বাবা গোঁসাইও নেই, এটাই বাস্তব সত্য। যে দু’জনের জন্যে সে সুখ নামক অমৃত পান করতে পেরেছে, সেই দু’জন মানুষই আজ নেই। চোখে অন্ধকার দ্যাখে সে, মনে হয় পৃথিবীতে আলো নেই বহুকাল! নিশ্বাস নিয়ে স্বস্তি পায় না, মনে হয় পৃথিবীর বাতাসে বিষের তিক্ত দুর্গন্ধ! তার অকৃত্রিম বন্ধু হিজলগাছ আর কুমার নদও তাকে শান্ত করতে পারে না। পৃথিবীটাকে তার নিষ্ঠুর আর প্রতারক মনে হয়; মনে হয় বর্ষাকালের জোলো বাতাসে মায়া নেই, নদীর জলে মায়া নেই, গাছপালায় মায়া নেই, আর মানুষের মধ্যে তো নেই-ই! শূন্য শূন্য লাগে! মনে হয় এক দৌড়ে যদি পৃথিবীটা অতিক্রম করে অন্য কোথাও, অন্য কোনো গ্রহে সে চলে যেতে পারতো! ভারতে যাওয়ার আগে হিজলগাছের পাখির বাসায় দুটো ডিম দেখে গিয়েছিল, ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়েছে। বাচ্চা দুটো নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করে। মাঝে মাঝে মা পাখিটা মুখে করে খাবার নিয়ে এসে বাচ্চাদুটোর মুখে তুলে দেয়, ওরা কাড়াকাড়ি করে মায়ের মুখের খাবার খায়। মা আর সন্তানের অকৃত্রিম এই ভালবাসা দেখে নীলুর চোখ দিয়ে অবিরাম জল ঝরে।

মাঝে মাঝে কণিকা আসে, তার পাশে বসে থাকে। কথা বলতে বলতে ওর নিজের চোখও ভিজে যায়। সাদা থানে চোখ মুছে নীলুর ক্ষতস্থানে সান্ত্বনার মলম লাগানোর চেষ্টা করে, ঝরাপাতার মতো ছড়ানো মনটাকে গোছানোর চেষ্টা করে। তারপর এক সময় চলে যায়, আবার আসে।

কণিকার সঙ্গ নীলুর ভাল লাগলেও মনের অশান্তি দূর হয় না। শান্তি পাবার আশায় সে বেশিক্ষণ ঘুমায়। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দ্যাখে। দু-দিন নবদ্বীপ গোঁসাইকে স্বপ্নে দেখেছে, আর তিনদিন মাকে। নবদ্বীপ গোঁসাই তার নাম ধরে ডাকছিল, ‘নীলু ওঠ, পালা গাইতে যাবিনে! তাড়াতাড়ি ওঠ!’

নীলুর ঘুম ভেঙে গেলে দেখলো সে একা বিছানায় শুয়ে আছে। আর তখনই মনে পড়লো যে তার বাবা গোঁসাই তো নেই। তার বাবা গোঁসাই তাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে!

গত পরশু রাতে মাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, মা ভাত বেড়ে তাকে ডাকছে আর সে গিয়ে খেতে বসেছে। সে খাচ্ছে আর মা পাশে বসে আছে। নীলুর ঠাকুমা বলতো, ‘মরা মানুষ স্বপ্নে আসে কাছে ডাকলি যাতি নাই, কিছু খাবার দিলিউ খাতি নাই। স্বপ্নে মরা মানষির কাছে গিলি আর মরা মানষির হাতে খালি অমঙ্গল হয়! মরা মানষির আত্মা দোসর খোঁজে! ঘুম ভেঙে গেলি কতি অয় দূর হও, দূর হও লক্ষ্মীছাড়া, তুমার মুহি ছাই। শলা-বারুনের ঝাটা মারি তুমার মুহি!’

ঘুম ভেঙে গেলে নীলু তা বলেনি। নিজের গর্ভধারিনী মা আর নিজের গুরুদেবের মুখে সে কী করে ছাই দেবার কথা বা ঝাটা মারার কথা বলবে! বরং এমন স্বপ্ন সে রোজ দেখতে চায়, তার অমঙ্গল হয় হোক, সে মরে যায় তো যাক!

অশান্ত হৃদয়ের নীলু শান্তির খোঁজে হাতে তুলে নিলো নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের উপহার দেওয়া রামায়ণ। তার দুঃখ-যন্ত্রণাময় সময় থেকে মনটাকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করলো রামায়ণের কালে। দিন-রাত পড়তে লাগলো। এক অধ্যায় থেকে আরেক অধ্যায়ে এগিয়ে গেল-বালকাণ্ড থেকে অযোধ্যাকাণ্ড, অযোধ্যাকাণ্ড থেকে অরণ্যকাণ্ড। পড়তে পড়তে কখনো রাম-সীতা আর লক্ষ্মণের দুঃখে তার চোখের জল ঝরলো, কখনো ওদের আনন্দে সে-ও পুলক বোধ করলো, আবার কখনোবা রাম-লক্ষ্মণের প্রেমপিয়াসী রাক্ষসী শূর্পণখাকে নিয়ে দুই ভাইয়ের কৌতুক এবং রামের আদেশে লক্ষ্মণ কর্তৃক শূর্পণখার নাক ও কান কেটে দেওয়ার দৃশ্য কল্পনা করে আপন মনেই হেসে উঠলো।
একদিন কণিকা বললো, ‘নীলুদা এই দুনিয়ার থেকে একদিন সবাই চলে যাবি, আমরাও চলে যাব। যারা চলে গেছে তারা তো আর ফিরে আসপেন না কোনোদিন। তোমার সারা জীবন সামনে পড়ে আছে। তোমারে তো উঠে দাঁড়াতি অবি।’

নীলু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমার জীবনের সব শ্যাষ রে কণিকা! উঠে দাঁড়াবার শক্তিও নাই।’
‘অবুঝ হ’য়ো না নীলুদা। আমারে দ্যাহো, আমি বাঁচে আছি না? কষ্ট হয়, কিন্তু কারো জীবন কারো অবর্তমানে থামে থাহে না। যারা চলে গেছে তারা তো তোমার ভাল চাইতো। তাগের মান রাখতি তুমি আবার সবাইরে নিয়ে পালা আরম্ভ করো।’

নীলু কণিকার মুখের দিকে তাকালো। কণিকা কী সুন্দরভাবে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, তার ভবিষ্যতের পথ বাতলে দিচ্ছে। অথচ ওর নিজের ভবিষ্যত অন্ধকার! কেউ না জানুক নীলু তো জানে, ওর ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! অথচ তা সে নীলুকে বুঝতেও দিচ্ছে না। এই বুঝি চিরন্তন বাঙালি নারীর মমতাময় রূপ!

কণিকা দিনের পর দিন নীলুর কানের কাছে একই কথা বলতে লাগলো। শেষে শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে নীলু একদিন নরেনের কাছে গেল। নরেন তখন পানের বরজ থেকে পান তুলছে। বললো, ‘নরেনদা, বাবা গোঁসাই তো আমাগের চোখের জলে ভাসায়ে চলে গেলেন। তার নাম রাখতি, আসো আমরা দলটা আবার দাঁড় করি।’

নীলুর কথা শুনে নরেন ওর চোখের দিকে তাকালো, ‘দল দাঁড় করাবো মানে! গান গাবি কিডা?’
নীলু দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, ‘আমি গাবো।’
নরেনের যেন বিস্ময়ের শেষ নেই। বললো, ‘তুই কী আমার সাথে মশকরা করিস নাকি!’

‘তোমার সাথে আমি মশকরা করবো ক্যান নরেনদা? আমি আমার মনের কথা ক’তেছি।’
নরেন ব্যঙ্গ করে বললো, ‘তুই পালা গাবি? হ তা তুই পারবি। তুই তো বিরাট গায়েন! তা রাত জাগে কিডা শুনবি তোর পালা? আসরে তো তোরে দেখতি অলি মানষির গাছে উঠা লাগবেনে!’

নরেনের কথা শুনে খুবই মর্মাহত হলো নীলু। তবু সে বললো, ‘তুমি যতো ঠাট্টাই করো না ক্যান নরেনদা, আমার বিশ্বাস, আমি ঠিক পারবো। একবার আমারে সুযোগ দিয়ে দ্যাহো।’

এবার ধমক দিলো নরেন, ‘এই যা তো। বাজে বকবক করিস নে। উনি পালা গাইবেন, আর সেই সঙের পালা মানুষ রাত জাগে শুনবেন। ফাজলেমি পাইছিস?’
নীলু শেষ চেষ্টা করলো, ‘নরেনদা তুমি...’

তার কথা শেষ করতে দিলো না নরেন, ‘এই, সামনের তে যা তো বাল, কানের কাছে বকবক চুদাসনে! নেহাত বাবা গোঁসাইয়ের দয়ায় দলের সাথে কয়ডা বছর ঘুরছিস, এই তোর চৌদ্দপুরুষের কপাল! নইলে তোরে......। সাধ কতো এহন নিজেরে গায়েন ভাবতি শুরু করছে!’

ব্যথিত হয়ে ফিরে এলো নীলু। শম্ভু-যতীনদের কাছে গেলে ওরাও আগ্রহ দেখালো না। ওরা ওদের পানের বরজ, চাষাবাদে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেছে এরই মধ্যে। আস্তে আস্তে তার স্বপ্ন ফিকে হতে লাগলো। আয়-রোজগারহীন হয়ে পড়লো। গান-বাজনা ছাড়া অন্য কাজ করার মতো মানসিক প্রস্তুতি তার নেই। আবার আগের সেই দুঃসহ বেকার জীবনে ফিরে গেল সে। যেন মাঝখানের পালা গাওয়ার দিনগুলো তার কাছে ছিল সুন্দর একটা স্বপ্ন, যেমন স্বপ্ন সে আগে রাত্রে ঘুমের মধ্যে দেখতো, জেগে জেগেও দেখতো!

নরেনদের প্রত্যাখানের কথা শুনে কণিকা নীলুকে পরামর্শ দিলো নতুন দোহার খুঁজে নতুন করে দল গড়ার। কণিকার কথাটা সে ভাবে, ভাবে আর রামায়ণ পড়ে; সীতাকে হারিয়ে উদ্ভ্রান্ত রাম-লক্ষ্মণের সাথে সে-ও ছুটে বেড়ায় দণ্ডকারণ্য থেকে ক্রৌঞ্চবন, পম্পা সরোবর থেকে ঋষ্যমূক পর্বত, কিষ্কিন্ধ্যা থেকে লঙ্কা। মনে মনে সেও হাতে তুলে নেয় ধনুক, বানরসেনার বেষ্টনে থেকে অবিরাম তীর ছুড়ে হত্যা করে সহস্র রাবণসেনা! কী আশ্চর্য, জীবের প্রতি প্রেম-মায়া থাকায় একটা পিঁপড়াকেও মারার কথা যে কখনো ভাবে না, সে-ই কিনা কল্পিত যুদ্ধক্ষেত্রে সহস্র রাবণ সেনাকে কী অবলীলায় হত্যা করছে! রক্ত দেখলে যে নীলুর মাথা ঘোরে, সেই নীলুই কিনা রাবণসেনাদের রক্তে ভাসিয়ে দিচ্ছে লঙ্কাভূমি!

কিন্তু হায়, যার জন্য এই মহাযুদ্ধ, অগণিত প্রাণ বিসর্জন, স্নানপূর্বক দিব্য অঙ্গরাগ ও দিব্য অলংকারে বিভূষিত করে সুক্ষ্ম রেশমীবস্ত্রে ঘেরা চতুর্দোলায় চড়িয়ে সেই সীতাকে রামের কাছে নিয়ে আসার সময় রামের একি আচরণ! চতুর্দোলা রেশমীবস্ত্রে ঘেরার জন্য তিনি বিভীষণকে ভর্ৎসনা করছেন! চতুর্দোলা থেকে সীতাকে নামিয়ে অসংখ্য বানর আর রাক্ষসদের সামনে দিয়ে পায়ে হাঁটিয়ে তার সম্মুখে নিয়ে আসার নির্দেশ দিচ্ছেন! নীলু যেন এই ঘটনার অসহায় সাক্ষী, সত্যি সত্যি চতুর্দোলা থেকে নামিয়ে বানর আর রাক্ষসদের মাঝখান দিয়ে হাঁটিয়ে সীতাকে আনা হলো রামের সম্মুখে! উত্তেজনায়, অথচ গভীর মনোযোগে রামের অহংকার আর নিষ্ঠুরতায় চোখ বুলালো নীলু-
আমার না ছিল কেহ সীতা তব পাশ।
ব্যবহার তোমার না জানি দশমাস।।
সূর্য্যবংশে জন্ম, দশরথের নন্দন।
তোমা হেন নারীতে নাহিক প্রয়োজন।।
তোমারে লইতে পুনঃ শঙ্কা হয় মনে।
যথা তথা যাও তুমি থাক অন্য স্থানে।।
এই দেখ সুগ্রীব বানর-অধিপতি।
ইহার নিকটে থাক যদি লয় মতি।।
লঙ্কার ভূপতি এই বীর বিভীষণ।
ইহার নিকটে থাক যদি লয় মন।।
ভরত শত্রুঘ্ন মম দেশে দুই ভাই।
ইচ্ছা হয় থাক গিয়া তাহাদের ঠাঁই।।
যথা তথা যাও তুমি আপনার সুখে।
কেন দাঁড়াইয়া কান্দ আমার সম্মুখে।।
থাকিতে রাক্ষস-ঘরে না হ’ত উদ্ধার।
ত্রিভুবনে অপযশ গাহিত আমার।।
ঘুচিল সে অপযশ তোমার উদ্ধারে।
মেলানি দিলাম এবে সভার ভিতরে।।

দীর্ঘ দশমাস পর স্ত্রীকে পেয়ে বিরহকাতর রাম কোথায় ক্রন্দনরত সীতাকে বুকে টেনে নিয়ে আলিঙ্গণ করবেন, আনন্দাশ্রু বিসর্জন করে এতোদিনের বিরহের অবসান ঘটাবেন, তা-না করে তিনি নিজের পৌরুষের অহংকার প্রকাশ করছেন, সকলের সামনে সীতাকে অপমান করছেন! রাম তবে সীতার প্রতি ভালবাসায় আর সীতাকে ফিরে পাবার ব্যাকুল বাসনায় রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেননি? তিনি যুদ্ধ করেছেন সূর্য্যবংশের মর্যাদা রক্ষার জন্য, যাতে তার লোকনিন্দা না হয় সে-জন্য! হায় শ্রী রামচন্দ্র, হায় প্রভু!

নীলু আর পড়তে পারছে না। সীতার প্রতি অপরিসীম দরদ আর রামের প্রতি ভীষণ অভিমানে তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সীতাকে পেয়ে প্রভু নিজেই সীতার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করছেন, যে সীতা তাকে মন দিয়েছেন, দেহ দিয়েছেন, রাজপ্রাসাদের জৌলুসময় জীবন পরিত্যাগ করে গাছের বাকলের পোশাক পরে স্বেচ্ছায় তার সাথে বনবাসী হয়েছেন! নীলু স্নান-খাওয়ার কথা ভুলে গেছে, কণিকা এসে তার হাত ধরে টেনে রামায়ণের কালের কল্পিত অবস্থা থেকে নিয়ে এসেছে বর্তমানের বাস্তবতায়।

তারপর নিরিবিলি সন্ধ্যায় নীলু আবার ডুব দিয়েছে রামায়ণে। পড়া এগোয়, যুদ্ধকাণ্ড থেকে উত্তরকাণ্ড। পড়তে পড়তে কখন যেন সে অযোধ্যার প্রজা বনে গেছে আর রামের চরিত্রের দোষ-ত্রুটি, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে রামের অন্ধ ভক্ত থেকে অবচেতনে বিচারক হয়ে রামকে কাঠগড়ায় তুলেছে! রামকে মনোজগতের কাঠগড়ায় তোলার বিষয়ে সে সচেতন হলো তখন, যখন রাজ্যাভিষেকের পর কিছু প্রজার কথায় কান দিয়ে দ্বিতীয়বার সীতার চরিত্রে কলঙ্কলেপন করে রাম লক্ষ্মণকে নির্দেশ দিলেন সীতাকে বনবাসে রেখে আসার জন্য, আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও লক্ষ্মণ সীতাকে গঙ্গা নদীর তীরে বাল্মীকির আশ্রমের কাছে একলা ফেলে এসে অক্ষরে অক্ষরে দাদার নির্দেশ পালন করলেন। সামনে গঙ্গায় উত্তাল ঢেউ বইছে আর পিছনে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার সমাকুল বিস্তীর্ণ ঘন জঙ্গল, অসহায় আর অশ্রুসিক্ত চোখে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মণের ফিরে যাওয়া দেখছেন সীতা! নীলুর ইচ্ছে করে হনুমানের মতো শক্তিশালী হয়ে সীতাকে সুরক্ষা দিতে! তারপর তার মনে হয় অযোধ্যা এক পাথুরে নগর, রাম এক পাথুরে রাজা! অযোধ্যায় কোনো হৃদয় নেই, আর যেখানে হৃদয় নেই সেখানে সীতার থাকাও সম্মানজনক নয়। হৃদয়হীন মানুষের চেয়ে পত্রধারী বৃক্ষও ভাল, প্রাণহীন নগরের চেয়ে প্রাণোচ্ছল অরণ্যই উত্তম!

সীতার বনবাস নিয়ে প্রশ্ন করলে নবদ্বীপ গোঁসাই একদিন নীলুকে বলেছিলেন, ‘রামচন্দ্র স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু, লীলা করার জন্যই তিনি নশ্বর মানবদেহ ধারণ করে পৃথিবীতে এসেছিলেন। এসব তার লীলা।’

নীলুর এখন মনে হচ্ছে, রাম কি সত্যিই ভগবান? রাম যদি ভগবানই হবে তবে ভগবানের এ কেমন নিষ্ঠুর লীলা! ভগবানের কাছে যা লীলা, সীতার কাছে তা জীবন-মরণের সমস্যা। অস্তিত্বের সংকট।

বিনয় এসে নীলুর কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘কাকা, আমার অংক করে দাও।’

নীলু রামায়ণের কালের গঙ্গার তীর থেকে ফিরে এলো, রামায়ণ থেকে মুখ তুলে দৃষ্টি রাখলো বিনয়ের মুখের দিকে। বিনয় হাতের বই-খাতা-কলম বিছানায় রেখে দুই হাতে ভর রেখে লাফ দিয়ে উঠলো বিছানায়। নীলু রামায়ণ বন্ধ করে পাশে রেখে দিয়ে ভাতিজার অংক করানোয় মন দিলো। আর কিছুদিন পরই বিনয়ের ফাইনাল পরীক্ষা, এরপরই ক্লাস টু’তে উঠবে সে। বিনয় পড়ার চেয়ে কথা বলে বেশি, কাকাকে ভয় পাওয়া দূরে থাক উল্টে কাকার ঘাড়ে চড়ে বসে! কিছুক্ষণ বিনয়কে যোগ-বিয়োগ অংক শেখানোর পর রান্নাঘর থেকে গলা চড়িয়ে খেতে ডাকলো মেনকা।

বরাবরের মতোই চারজন এক লাইনে খেতে বসেছে, বরাবরই তাদের সামনে নিখিলের ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে খুঁটিতে হেলান দিয়ে পিঁড়িতে বসে থাকতো ভানুমতি। জায়গাটা এখন ফাঁকা, নিখিলের ছেলে এই সময় একা একাই খেলা করে বাবা-মায়ের বিছানায়; কেঁদে উঠলে মেনকা উঠে গিয়ে ছেলেকে নিয়ে আসে, কোলের ভেতর রেখে খেতে দেয় সবাইকে। নীলুর বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আড়চোখে বাবার দিকে তাকায়। মায়ের মৃত্যুর পর হঠাৎ-ই যেন বাবার বয়স বেড়ে গেছে। এখন বাইরে খুব একটা যায় না। বারান্দায় বসে থাকে তিন হাঁটু এক করে, ধুতির পাশ দিয়ে কালো চুপসানো হোলের বিচি বেরিয়ে থাকলেও বুঝতে পারে না। বিনয় দাদুর হোলের বিচি দেখে যখন হাতহালি দিয়ে হেসে ওঠে, তখনই কেবল সে সজাগ হয়ে ধুতি ঠিক করে।

আজকাল সংসারের সব কাজ মেনকাকে এক হাতেই সামলাতে হয়, ভানুমতি মারা যাবার পর কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও এখন আবার গজগজ করতে শুরু করেছে। নীলু পারতপক্ষে মেনকাকে এড়িয়ে চলে। খেতে বসেও চুপি চুপি খেয়ে চলে যায়। নীলুর খাওয়া যখন শেষের পথে তখন নিখিল তার উদ্দেশে বললো, ‘কিছু এট্টা কর, এমনে বসে থাকলি কী চলে!’

এর আগে মেনকা যে নিখিলকে চোখের ইশারা করেছে, তা দেখেছে নীলু। নীলু এই কথার মানে বোঝে, আজকাল সংসারটা বলতে গেলে নিখিল একাই টানছে একথাই তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। নীলু অবশ্য তার জমানো টাকা থেকে মাঝে মাঝে কিছু সাহায্য করে নিখিলকে।

দাদার কথার বিপরীতে নীলু কেবল একটি শব্দ ব্যয় করলো, ‘দেহি।’

তারপর চলে গেল নিজের ঘরে। একটু পর বিনয় এসে সটান শুয়ে পড়লো বিছানায়। ছোটভাই পৃথিবীর আলোয় আসার পর থেকে বিনয় নীলুর কাছেই শোয় রাতে। না ঘুমানো পর্যন্ত বিনয় অনর্গল কথা বলেই চলে। নীলু ওকে চোখ বুজে থাকার সত্ত্ব দিয়ে গল্প শোনায় আর আস্তে আস্তে ওর কপালে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এক সময় ওর নিমীলিত চোখের পাতা আর কাঁপে না, অস্থির ঠোঁট দুটো স্থির হয়।

বিনয় ঘুমিয়ে পড়লে আবার রামায়ণ খুলে বসলো নীলু। মা এবং নবদ্বীপ গোঁসাইকে হারানোর শোক ভুলে মানসিক শান্তি পেতে, মনোজগতের গভীর সংকট থেকে মুক্তি পেতে সে ডুব দিয়েছিলো রামায়ণে; কিন্তু সংকট থেকে মুক্তি পাবার বদলে সে আরো গভীর সংকটে জড়িয়ে পড়েছে, ভগবানের ন্যায়-অন্যায় বিচারের সংকট, রামচন্দ্র তার কাছে ভগবান! নীলু অন্তর্দন্দ্বে ভোগে আর পড়তে পড়তে শেষের দিকে এগিয়ে যায়। এবার রাম নিজেও পড়েছে গভীর সংকটে। এক ব্রা‏হ্মণ মৃত বালক কোলে নিয়ে রাজদ্বারে বিলাপ করছে। তার পুত্রের মৃত্যুর জন্য রাজা রামকে দায়ী করছে। কিন্তু রামের রাজ্যে তো কারো অকাল মৃত্যু হয় না! তবে কোন পাপের ফলে এই ব্রা‏হ্মণ বালকের মৃত্যু হলো?

রাম তার উপদেষ্টা বশিষ্ঠ, মার্কণ্ডেয়, মৌদগল্য, কাশ্যপ, কাত্যায়ন, জাবালি, গৌতম ও নারদ মুনিকে ডেকে ব্রা‏হ্মণ বালকের অকাল মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে নারদ জানালেন যে, শূদ্রজাতির তপস্যায় অধিকার নেই, শূদ্রজাতির তপস্যা করা অতিশয় অধর্ম, কিন্তু কোনো একজন শূদ্র তপস্যা করে চলেছে, সেই অধর্মের ফলেই ব্রা‏‏হ্মণ বালক কালগ্রাসে পতিত হয়েছে। রামের উচিত শীঘ্র সেই দুরাচারকে খুঁজে বের করে তাকে দমন করা, তাতে রামের ধর্মবৃদ্ধি এবং মানুষের আয়ুবৃদ্ধি হবে, আর ব্রা‏হ্মণ বালকও পুনরায় তার জীবন লাভ করবে।
রাম ভরত এবং লক্ষ্মণকে নগর রক্ষার ভার দিয়ে পুষ্পক রথে চড়ে ছুটলেন সেই দুরাচারের খোঁজে। নীলুর পুষ্পক রথ নেই, সে মনোরথে ছুটলো রামের পিছু পিছু-
এত বলি কৈলা রাম রথে আরোহণ।
পশ্চিম দিকেতে রাম করিলা গমন।।
পশ্চিমের যত দেশ করিয়া বিচার।
উত্তর দিকেতে রাম কৈলা আগুসার।।
উত্তরের যত দেশ করি অন্বেষণ।
পূর্ব্বদিকে রঘুনাথ করেন গমন।।
পূর্ব্বদিক বিচারিয়া গেলেন দক্ষিণে।
এক শূদ্র তপ করে মহাঘোর বনে।।
করয়ে কঠোর তপ বড়ই দুষ্কর।
অধোমুখে ঊর্ধ্বপদে আছে নিরন্তর।।
বিপরীত অগ্নিকুণ্ড জ্বলিছে সম্মুখে।
ব্যাপিল ব‎হ্নির ধূম সুবর্ণ নাশিকে।।
দেখিয়া কঠোর তপ শ্রীরামের ত্রাস।
ধন্য ধন্য বলি রাম যান তার পাশ।।
জিজ্ঞাসা করেন তারে কমল-লোচন।
কোন জাতি তপ কর কোন প্রয়োজন।।
তপস্বী বলেন আমি হই শূদ্রজাতি।
শম্বুক নাম ধরি আমি শুন মহামতি।।
করিব কঠোর তপ দুর্লভ সংসারে।
তপস্যার ফলে যাব বৈকুণ্ঠ-নগরে।।
তপস্বীর বাক্যে কোপে কাঁপে রাম-তুণ্ড।
খড়গ হাতে কাটিলেন তপস্বীর মুণ্ড।।
সাধু সাধু শব্দ করে যত দেবগণ।
রামের উপরে করে পুষ্প বরিষণ।।

যেন অকস্ম্যাৎ নীলুর মাথাটা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তার সামনে রাখা রামায়ণ গ্রন্থের ওপর পড়লো! চতুর্দিকে ছিটকে পড়লো রক্ত, বিছানায়, ঘরের বেড়ায়, মেঝেতে, এমনকি বেড়ায় টাঙানো রাম-সীতার ছবিতেও; তার মস্তকবিহীন ধড় থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগলো ঘরের মেঝেতে আর রামায়ণের ওপর পড়ে থাকা তার কাটা মুণ্ডর মুখশ্রীতে একটা দুটো রক্তের ফোঁটা, ঠোঁটে এখনো অমলিন হাসি, অপলক চোখে বৈকুণ্ঠলাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা!

নীলু স্তব্ধ! বাকরুদ্ধ! কান্নার জোয়ার আসা ঝাপসা চোখ আর শূন্য দৃষ্টিতে ভাসছে নিজের বিচ্ছিন্ন রক্তাক্ত মাথার চিত্র। বাঁ-দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে দৃষ্টি রাখতেই তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো কপোল বেয়ে। নিজেকে তার কেবলই শম্বুক মনে হচ্ছে, শম্বুকের জন্য কান্না উথলে উঠছে তার বুকের ভেতর থেকে।

সেই কোন ছেলেবেলায় নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের রামায়ণ-পালা দেখে রামের ভক্তবনে গেছে নীলু। সেই থেকে রাম তার কাছে ভগবান, তার আদর্শ, প্রভু। কিন্তু এ কোন প্রভু রাম? এই রামকে তো চেনে না! নবদ্বীপ গোঁসাই রামায়ণ পড়ে পড়ে নিজে পালা লিখতেন; সে পালায় থাকতো রামের বীরত্বগাঁথা আর মহানুভবতার কথা। দানশীল, প্রজা-দরদী, ধর্মনিষ্ঠ, পিতৃ-মাতৃভক্ত রামের স্তুতিগাঁথা এমন নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করতেন যে ভক্তগণ রামের মতো সর্বগুণ সম্পন্ন সন্তান কামনা করতেন, উঠতি যুবতীরা রামের মতো বর প্রার্থণা করতো। এমনকি সীতার অগ্নিপরীক্ষা কিংবা বনবাসের দৃশ্যগুলোও নবদ্বীপ গোঁসাই কথা আর গানে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যে ভক্তগণ সেখানে রামের চরিত্রে কোনো ত্রুটি খুঁজে পেতো না, বিধিলিপি অথবা ভগবান রামের লীলা হিসেবে দেখতো আর রাম এবং সীতা দু’জনের জন্যই চোখের জল ফেলতো!

নীলু এর আগে কখনো রামায়ণ পড়েনি। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের লেখা পালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তার রামায়ণের জ্ঞান। বেশ কিছুদিন যাবৎ সে রামায়ণ পড়ছে, রামের সুখে হাসছে, রামের দুঃখে কাঁদছে, আবার সীতার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করায় রামের প্রতি অভিমানও হয়েছে তার। কিন্তু আজ এক নতুন রাম আবিষ্কৃত হলো তার কাছে। বামন হয়ে জন্মানোয় এতোদিন সংসারের অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করেছে সে, নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দলে ঢোকার পরে একদিকে যেমনি মানুষের ভালবাসা পেয়েছে, তেমনি আরেকদিকে ভদ্রতার আবরণে অনেক অপমানও হজম করতে হয়েছে। তবু তার মনে হতো, ‘কেউ না থাকুক আমার তো রাম আছে, প্রভু রাম নিশ্চয় তার আশির্বাদের হাত আমার মাথায় রেখেছেন। তিনি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না।’ এতোদিন নিজেকে রামের চরণে সঁপে দিয়ে বেঁচে ছিল নীলু। কিন্তু আজ নিজেকে ভীষণ দেউলিয়া মনে হচ্ছে তার, মনে হচ্ছে তার কেউ নেই, কিছু নেই। তার কোনো ভগবান নেই, কোনো দেব-দেবী নেই, রামায়ণে তার অধিকার নেই, রামের আশির্বাদের হাত তার মাথার ওপরে নেই, পরকালে স্বর্গলাভের আশা এবং অধিকার কোনোটিই নেই, নীচুকুলজাত একজন শম্বুক সে, হতভাগ্য শম্বুক!

শূদ্রদের স্বর্গে যাবার অধিকার নেই? তাহলে মৃত্যুর পর শূদ্ররা কোথায় যাবে? এই যে অগণিত শূদ্র বারোমাস এতো দেব-দেবীর পূজা-পার্বণ করে, ভগবানকে ডাকে, এসব কি বৃথা? শূদ্রদের স্বর্গে যাবার অধিকার যদি নাই-ই থাকে, তাহলে এসব পূজা-পার্বণের তো কোনো প্রয়োজন নেই।

রামায়ণখানা এতোদিন তার কাছে ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, খোলা এবং বন্ধ করার সময় প্রণাম করতো। কিন্তু আজ তার মনে হচ্ছে এটি আর পাঁচটা বইয়ের মতোই সাধারণ একখানা বই! প্রণাম ছাড়াই রামায়ণ বন্ধ করে টেবিলের ওপর রেখে ঘরের দরজা খুলে বাইরে গেল সে। আকাশে চাঁদ নেই, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। উঠোন পেরিয়ে গাছপালার দিকে গিয়ে অন্ধকারে লুঙ্গি তুলে বসে প্রসাব করলো। প্রসাব করা শেষ হলে লুঙ্গির গিঁটটা পুনরায় টাইট করে বেঁধে আমগাছের নিচে দাঁড়ালো, নিজেকে ভীষণ অসহায় আর নিঃস্ব মনে হচ্ছে, বুকের ভেতরটা শূন্য মনে হচ্ছে, চোখ থেকে জল গড়িয়ে নামছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে অন্ধকার ছিঁড়ে-ফুঁড়ে এখনই পুষ্পক রথ থেকে নেমে আসবেন রাম, বলবেন, ‘ওরে দুরাচার মুচি, কোন সাহসে তুই রামায়ণ পড়ছিস?’

বলেই দিব্যদর্শন খড়গ দিয়ে তার ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলবেন!

বিছানায় শুয়েও স্বস্তি পেল না নীলু। প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতায় এপাশ-ওপাশ করতে লাগলো। এর মধ্যে একবার বিনয়কে ঘুম থেকে তুলে বাইরে নিয়ে গিয়ে প্রসাব করিয়েও আনলো। রাতে একবার প্রসাব না করালে বিনয় ভোরের দিকে বিছানাতেই প্রসাব করে দেয়।
নীলুর দেহটাই কেবল বিছানায় শায়িত থাকলো কিন্তু মন পড়ে রইলো দক্ষিণের সেই মহাঘোর বনে। সেখানে বৃক্ষতলায় বসে সে শম্বুকের রক্তাক্ত ছিন্ন মাথাটা কোলে নিয়ে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলো, যেন কোনো ঘাতকের হাতে নিহত এক পরমাত্মীয়ের ছিন্ন মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে শোকগ্রস্ত অপর আত্মীয়, নিহতের রক্তাক্ত চুলে-কপালে তার হাতের স্নেহস্পর্শ বুলিয়ে দিতে দিতে বিলাপ করছে!

শম্বুকের জন্য চোখের জল ফেলতে ফেলতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো নীলু। ঘুমের মধ্যে তার কাছে এলো রাম, প্রকাণ্ড দেহধারী রাম! চওড়া বুক, লম্বা লম্বা হাত-পা, মাথায় রাজমুকুট আর হাতে দিব্যদর্শন খড়গ। ভয়ানক রোষে অগ্নিচক্ষু রাম এগিয়ে আসছে তার দিকে। রামের হাত থেকে বাঁচার জন্য সে দৌড়চ্ছে, ভীষণ জোরে দৌড়নোর চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী সামনে এগোতে পারছে না, দূরত্ব বাড়ার পরিবর্তে ক্রমশ রাম তার নিকটবর্তী হচ্ছে। রাম যতো কাছে আসছে সে ততো জোরে ছোটার চেষ্টা করছে। কিন্তু তবু শেষ রক্ষা হলো না, লম্বা লম্বা পা ফেলে কিভাবে যেন রাম তার সামনে এসে দাঁড়ালো। এবার উল্টোদিকে ছুটতে শুরু করলো সে। হঠাৎ-ই তার নজরে পড়লো ভানুমতি দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের দিকে ছুটতে শুরু করতেই দেখলো রামের হাতের দিব্যদর্শন খড়গ তার গলার দিকে নেমে আসছে। ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠলো সে, ‘মা....!’

নীলুর চিৎকার শুনে সুবোধ দরজায় ধাক্কাতে লাগলো, ‘নীলু, এ নীলু, কী অইছে, স্বপ্ন দেকছিস?’

ঘুম ভেঙে গেল নীলুর। কোথায় ভানুমতি! কোথায় রাম! জানালার বাইরে সকালের আদুরে রোদ। আমগাছে পাখি ডাকছে। সুবোধের পুনর্বার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নীলু বুঝলো, সত্যিই সে কাঁদছে, চোখের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা!

কণিকার দেওয়া পরামর্শ নিয়ে নীলুর ভাবনাটা আর এগোলো না। নতুন দল গড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে সে। চেষ্টা করলে আজ না হোক, দু’দিন পরে হলেও কয়েকজনকে জুটিয়ে একটা দল দাঁড় করাতে হয়তো সে পারবে। কিন্তু দল গড়ে সে করবেটা কী? নবদ্বীপ গোঁসায়ের মতো কেবল রামের স্তুতিবাক্যে পরিপূর্ণ পালা লিখতে পারবে না সে। সে পালা লিখলে রামকে ছাপিয়ে নায়ক হয়ে যাবে শম্বুক! শম্বুকের তপস্যা, শম্বুকের একাগ্রতা, সততা, সত্যবাদিতা এসব উঠে আসবে পালায়; আর এক বিয়োগান্তক ঘটনা অর্থাৎ রামের হাতে নিরপরাধ শম্বুকের নির্মমভাবে নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হবে পালা। নীলুর খুব ইচ্ছে করছে শম্বুককে নিয়ে পালা লিখে আসরে গাইতে। কিন্তু একজন ঋষিপুত্রের মুখে আর একজন শূদ্রপুত্রের জীবনগাঁথা কে শুনতে আসবে! আর যদিবা আসে প্রকৃত সত্য তুলে ধরে রামকে খলনায়ক বানানোর অপরাধে আসরে অসংখ্য মানুষের কাছে বাহবা আর প্যালার বদলে জুটবে উত্তমমধ্যম! তাই নতুন দল গড়ার ভাবনাটা সে পুরোপুরি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো, এ বিষয়ে কণিকার সাথে আর কোনো আলোচনাই সে করলো না।

বাড়ির পরিবেশ আবার ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে, অথচ রুটিরুজির কোনো ব্যবস্থাই সে করতে পারছে না। কোথায় যাবে, কী করবে, এই চিন্তায় নীলুর এখন দিশেহারা অবস্থা। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই এই বাড়িতে সে বড় একলা আর অসহায় হয়ে পড়েছে। সারাদিন বাড়িতে থাকে না বললেই চলে, মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। তারই মতো একলা আর সহায় হয়ে পড়েছে সুবোধও। স্ত্রী বিয়োগে সুবোধ মানসিকভাবে যেমনি ভেঙে পড়েছে, তেমনি ভেঙে গেছে তার শরীরও। মন চাইলে একদিন গাওয়ালে বের হয় তো সাতদিন বাড়িতেই থাকে। পাড়ায়ও বিশেষ যায় না, হয় নিজের ঘরে নয়তো আমতলায় বসে থাকে। মাঝে মাঝে ডালা-কুলা বোনে। মেজাজটাও খিটখিটে থাকে সবসময়। আর তার যতো রাগ, যতো ক্ষোভ সব সে নীলুর ওপর ঝাড়ে। স্ত্রী বিয়োগে তার দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত জীবনে ছন্দ-পতন ঘটেছে। এই ছন্দ-পতনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না সে। নিজের স্ত্রী তার প্রতি যে খেয়াল রাখতো, তাকে যেভাবে যত্ন করতো, স্বাভাবিকভাবেই ছেলের বউ তা করতে পারে না। পরনের ধুতিটা ময়লায় আঠালো হয়ে গায়ের চমড়ার সাথে লেগে গেলেও মেনকা খেয়াল করে ধুয়ে দেয় না, বিছানার চাদরটা পিঠের সাথে লেগে গেলেও না বলা পর্যন্ত ধুয়ে দেয় না। ভীষণ অসহায়বোধ করে সুবোধ।

তার ওপর নীলু বাড়িতে না থাকলে মেনকা সুবোধের কাছে নানান অভিযোগ করে নীলুর সম্পর্কে, এমনকি কণিকার সাথে তার মেলামেশা নিয়ে নিজের সন্দেহের কথাটাও শ্বশুরকে জানাতে ভোলে না। নিজের ছেলের সম্পর্কে এতো অভিযোগ শুনতে ভাল লাগে না সুবোধের। কিন্তু মেনকাকে কিছু বলতে পারে না সে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কেননা ঝাল হোক আর নোনতা হোক মেনকার হাতেই তাকে খেতে হয়, ভবিষ্যতেও খেতে হবে। ক্ষোভ ঝাড়ে নীলুর ওপর, ‘তুই মরবার পারিসনে!’

কানাইজ্যাঠা উন্নতি জেঠিমার ওপর বরাবরই খিটমিট করে, মাঝে মাঝে হাতের কাছে যা পায় তা-ই ছুড়ে মারে উন্নতি জেঠিমার দিকে। উন্নতি জেঠিমাকে তার ছেলের বউরাও বিশেষ কদর করে না। তাই উন্নতি জেঠিমা পাড়া-পড়শির কাছে প্রায়ই দুঃখ করে বলে, ‘যারে দ্যাকপার পারে না ভাতারে, তারে লাথি মারে রাহালে!’

নীলুর অবস্থাও এখন তাই। বাড়ির লোকের কাছে তার কোনো কদর নেই, পাড়ার লোকের কাছে সে যেন আবার সেই আগের নীলে! ব্যতিক্রম শুধু একজন, সে কণিকা। কণিকা তাকে বোঝায় তার দিন আবার ফিরবে। আরো যেন কতো কী কণিকা তাকে বোঝাতে চায় ইঙ্গিতে। উন্নাসিকতায় ডুবে থেকে সে-সব তার মাথায় ঢোকে না। কণিকার ইশারা সে বুঝতে পারে না। সে শুধু বোঝে এই সংসারে অর্থ রোজগার করতে না পারলে একজন পুরুষের দাম পশুর চেয়েও কমে যায়। অন্য যতো গুণই থাক তা মূল্যহীন হয়ে যায়। এই সমাজে যে অর্থ রোজগার করতে পারে, সেই মানুষ। তাতে সে যেভাবেই অর্থ রোজগার করুক না কেন। আর যে অর্থ রোজগার করতে পারে না, তার দিকে লোকে তর্জনী তুলে বলে, ‘ছেলেটা মানুষ হলো না।’ নীলুর দিকে এখন শতেক তর্জনী।

অবশেষে একদিন নীলু তার বাবার গাঁটরি আর ছাতার বাঁটগুলো কাঁধে নিয়ে পৈত্রিক পেশা অবলম্বন করে তথাকথিত মানুষ হবার উদ্দেশে শতেক তর্জনীর বাইরে বেরিয়ে পড়লো গাওয়ালে।

(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.