নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
প্রথম পক্ষ: ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম; ইসলাম শান্তির কথা বলে, ধ্বংসের কথা নয়; ইসলাম মানবতায় বিশ্বাসী, ইসলাম জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করেনা; জঙ্গিরা বিকৃত ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, ওরা সহি ইসলামের আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছে; জঙ্গিরা মুসলমান নয়, জঙ্গিদের কোনো ধর্ম নেই; ইসলাম ভিন্ন মতাবলম্বীদের সম্মান দিতে বলেছে, ইসলাম নারীদেরকে সম্মান দিতে বলেছে; ওয়াজ মাহফিলে মাওলানা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দেয়, মাওলানারা ভণ্ড মুসলমান!’
উপরের কথাগুলো কাদের? দেশে সুন্নি ইসলামী জঙ্গিদের হাতে মানুষ খুন হলেই উপরোক্ত কথা বলে জিগির তোলে কারা? প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, কবি-কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, নাট্যকার-নাট্যনির্দেশক, নাট্যকর্মী, চিত্রপরিচালক, চিত্রকর, ভাস্কর, পীর, সুফীবাদী, শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, খেলোয়াড়, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবি, বিজ্ঞানী, মাদ্রাসার কিছু হুজুর, মসজিদের কিছু ইমাম ইত্যাদি নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের একটা বড় অংশ। এরা কি কখনও কোরান-হাদিস পড়েছেন? কেউ কেউ পড়েছেন, কেউ কেউ পড়েননি। যিনি পড়েছেন তিনি উপরোক্ত কথাগুলো বলেন, আবার যিনি পড়েননি তিনিও উপরোক্ত কথাগুলো বলেন। বংশ পরম্পরায় এভাবেই চলে আসছে। এরা কেউ নিয়মিত নামাজ পড়েন, কেউ মাঝে মাঝে পড়েন, কেউ পড়েন না; কেউ মদ্যপান করেন, কেউ করেন না; কেউ প্রতারণা করেন, কেউ করেন না; কেউ ঘুষ খান, কেউ খান না। কিন্তু এরা প্রত্যেকেই নিজেকে প্রকৃত মুসলমান বলে দাবী করেন এবং প্রায়শই উপরোক্ত কথাগুলো বলে থাকেন। এই মতাদর্শীদেরকে আমরা প্রথম পক্ষ হিসেবে ধরে নিলাম।
দ্বিতীয় পক্ষ: এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা ইসলামী জঙ্গিবাদের পথ বেছে নিচ্ছে, ভিন্ন মতাদর্শী মানুষ খুন করছে, ওয়াজ মাহফিলে ভিন্ন ধর্মাবলস্বী মানুুষ এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তারা মুসলমান নয়? তারা নামাজ পড়ে না? রোজা রাখে না? নিশ্চয় তারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে। তারা দাবী করে, কোরান অনুসরণ করেই তারা জীবন-যাপন করছে, মুহাম্মদের দেখানো পথেই তারা হাঁটছে; তারাই সহি ইসলামের অনুসারী। এই মতাদর্শীদেরকে ধরে নিলাম দ্বিতীয় পক্ষ।
তৃতীয় পক্ষ: প্রথম পক্ষে যেসব শ্রেণি-পেশার মানুষের উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব শ্রেণি-পেশার মানুষের অপর একটা অংশ কিন্তু দ্বিতীয় পক্ষের সমর্থক; এরা হয়তো অস্ত্র হাতে তুলে নেয় না, কিন্তু মতাদর্শ একই। এরা তৃতীয় পক্ষ।
সহি ইসলামের গোলকধাঁধা
প্রথম পক্ষ অর্থাৎ উপরোক্ত নানা শ্রেণিপেশার সাধারণ মুসলমান দাবী করে তারা সহি ইসলামের অনুসারী এবং তারা প্রকৃত মুসলমান; দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ সশস্ত্র জঙ্গি এবং ওয়াজ মাহফিলে বিদ্বেষ ছড়ানো মাওলানারাও বলে তারা সহি ইসলামের অনুসারী এবং প্রকৃত মুসলমান। আবার তৃতীয় পক্ষ যারা মনে মনে জঙ্গিবাদের সমর্থক, তারাও দাবী করে যে তারা সহি ইসলামের অনুসারী এবং প্রকৃত মুসলমান। সকল পক্ষই সুন্নি মতাদর্শী, ফলে সকল পক্ষের এহেন দাবীতে আমরা ধন্দে পড়ে যাই! সুন্নি ছাড়াও শিয়া, আহমদিয়া প্রভৃতি মতাদর্শী ইসলাম রয়েছে; তারাও দাবী করছে যে তারা সহি ইসলামের অনুসারী এবং প্রকৃত মুসলমান। সুন্নীরা আবার মনে করে যে শিয়া-আহমদিয়ারা অমুসলিম বা সহি ইসলামের অনুসারী নয়। এতো এতো সহি ইসলামের দাবীদারের ভিড়ে রীতিমতো গোলাকধাঁধায় আটকে পড়েছি আমরা। আমাদের দেশে অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতো শিয়া, আহমদিয়ারাও প্রায়শই সুন্নি মুসলমানের হাতে নির্যাতিত, নিগৃহীত হয়।
এবার মূল আলোচ্য বিষয়ে দৃষ্টিপাত করি, আমাদের দেশে সুন্নি মুসলমানের অলিখিত এই তিনটি ধারা তৈরি হয়েছে; এই তিন পক্ষের সহি ইসলামের গোলকধাঁধায় পড়ে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছি, নাকানি-চুবানি খাচ্ছি। যার যার নিজস্ব অর্জিত জ্ঞানে যে যেমন খুশি তেমন বয়ান দিচ্ছে- ফেসবুকে, পত্রিকার কলামে, টকশো’তে। পাঠক, সঙ্গত কারণেই সহি ইসলামের গোলকধাঁধায় আটকে না থেকে আমরা বরং আমাদের মগজ খাটাই। আমরা ইন্দ্রিয় জাগ্রত মানুষ, ইন্দ্রিয় কাজে লাগিয়ে সবকিছু গ্রহণ-বর্জন করি; আমাদের অক্ষরজ্ঞান আছে, লিখতে-পড়তে পারি; আমাদের বুদ্ধি আছে, বুদ্ধি খাটিয়ে আমরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জগত সংসারে টিকে থাকি। আমরা এতো কিছু যখন পারি, তখন অন্যের কথায় কান না দিয়ে গোঁলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেরাই বরং কোরান-হাদিস পড়ে নিই। সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানই বলে থাকেন, কোরান আল্লার বাণী, কোরান অভ্রান্ত গ্রন্থ, পৃথিবীর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান রয়েছে কোরানে। যখন শয়ন-স্বপন, চলন-বলন, রণন-রমণ, জীবন-মরণ ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রের দিকনির্দেশনাই কোরানে আছে, তখন গোলাকধাঁধা থেকে বের হতে আমাদের কোরানের শরণাপন্ন হওয়াই শ্রেয়।
আল কোরান, সুরা মুহাম্মদ, (৪৭:৪) এ বর্ণিত আছে-
‘অতএব যখন তোমরা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে মোকাবিলা কর তখন তাদের ঘাড়ে-গর্দানে আঘাত করো। শেষ যখন তোমরা ওদেরকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করবে তখন ওদেরকে শক্ত করে বাঁধবে। তারপর তোমরা ইচ্ছে করলে ওদেরকে মুক্ত করে দিতে পারো বা মুক্তিপণ নিয়েও ছেড়ে দিতে পারো। যতোক্ষণ না ওরা অস্ত্র সংবরণ করে তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এ-ই বিধান। এজন্য যে আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে ওদেরকে শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি চান তোমাদের এককে অপরকে দিয়ে পরীক্ষা করতে। যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তিনি কখনই তাদের কাজ নষ্ট হতে দেননা।’
আল কোরান, সুরা আনফাল (৮: ১২) এ বর্ণিত আছে-
‘স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক ফেরেশতাদের ওপর প্রত্যাদেশ করেন, “আমি তোমাদের সাথে আছি, সুতরাং বিশ্বাসীদেরকে সাহস দাও।” যারা অবিশ্বাস করে আমি তাদের হৃদয়ে ভয় ঢুকিয়ে দেব। সুতরাং তোমরা তাদের ঘাড়ে ও সারাঅঙ্গে আঘাত করো।’
আল কোরান, সুরা আনফাল (৮:১৭) এ বর্ণিত আছে-
‘তোমরা তাদেরকে হত্যা করোনি, আল্লাহ তাদেরকে মেরেছিলেন, আর তুমি যখন (কাঁকর) ছুড়েছিলে তখন তুমি ছোড়োনি, আল্লাহ-ই তা ছুড়েছিলেন; তার তা ছিল অবিশ্বাসীদেরকে ভাল পুরস্কার দেওয়ার জন্য। নিশ্চয় আল্লাহ সব শোনেন, সব দেখেন।’
আল কোরান, সুরা আনকাবুত (২৯:৬৯) এ বর্ণিত আছে-
‘যারা আমার উদ্দেশে জিহাদ করে আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করবো। আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে থাকেন।’
উপরোক্ত কোরানের আয়াতের প্রেক্ষিতে এখন আমরা নিশ্চয় বলতে পারি যে জঙ্গিরাই সহি ইসলামের অনুসারী। তারাই আল্লার কথা মেনে চলে, তারাই যথাযথভাবে কোরান অনুসরণ করে। কোরান হাদিস অনুযায়ী প্রথম পক্ষ সহি ইসলামের অনুসারী নয়, তারা বঙ্গীয় এবং আকাশ সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ইসলামের অনুসারী; কেউ জেনে বা না জেনে, কেউ বুঝে বা না বুঝেই বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা যে পাশ্চাত্য, প্রাচ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের ত্রিমুখী সংস্কৃতির মিশ্রণে এক ফিউশন ইসলাম ধর্ম পালন করছেন এর অসংখ্য প্রমাণ দেওয়া যায়।
রমজান এলে মানুষের ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য প্রকট হয়ে ওঠে এবং তা রীতিমতো বিরক্তির পর্যায়ে চলে যায়। কোনো কোনো লেখক ঢাক পিটিয়ে জানান দেয় ফেসবুকে, ‘রোজার মাসে লেখালেখি করি না, যদি গুণাহ হয়’; নিজে চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং স্ত্রী ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পরপুরুষের সঙ্গে অভিনয় করে, পরপুরুষের বক্ষে নিজের স্ফীত স্তন ঠেকিয়ে মুখে যৌন আবেদন ফুটিয়ে তোলে, সেও ধর্ম সম্পর্কে উপদেশ দেয়। স্বল্পবসনা লাস্যময়ী কোনো নায়িকা পরপুরুষের (নায়ক) কণ্ঠলগ্ন হয়ে অথবা বক্ষ পেষিত হয়ে নৃত্য-গীত করার পর সন্ধ্যাবেলা ইফতারের বাহারি খাবার সামনে রেখে নিজের মেকআপ করা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে লেখে, ‘নামাজ পড়ুন, রোজা রাখুন’। এসব দেখে কোরান-হাদিস পড়া যুক্তিপ্রবণ মানুষের গাত্রদাহ হওয়া স্বাভাবিক, তা তিনি যে মতাদর্শেই বিশ্বাসী হোন না কেন। শুধু যে নায়িকাই রোজা রাখে বা ইফতারের ছবি প্রদর্শন করে ধর্মীয় উপদেশ দেয় কিংবা নিজের ধর্মপরায়ণতা প্রকাশ করে তাই নয়, এই দলে আছে অসৎ কবি-সাহিত্যিক, সংগীতশিল্পী, চিত্রকর, নারী নেত্রী, খেলোয়াড়, কর্মজীবি নারী-পুরুষ, রাজনীতিক, ঘুষখোর পুলিশ-র্যাব-মিলিটারি, মদ্যপ, মিথ্যাবাদী, প্রতারক, মজুতদার, ধর্ষক ইত্যাদি নানান পেশার এবং নানান চরিত্রের মানুষ।
এবার কিছু পেশা সম্পর্কে ইসলাম ধর্মে কি বলা হয়েছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করা যাক-
গান-বাজনা, অভিনয়:
আল কোরান, সুরা নজম (৫৩:৬১) এ বর্ণিত আছে-
‘তোমরা কি এ কথার (কোরান শরীফ-এর) উপর আশ্চর্য্যান্বিত হচ্ছো ও হাস্য করছো এবং ক্রন্দন করছো না, অথচ তোমরা সঙ্গীত বা গান-বাজনা করছো?’
এই আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে তাফসীরে ইবনে জারীর, ২৭ খণ্ড, ৪৩/৪৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ‘হযরত কাতাদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে রেওয়ায়েত করেন, মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম ‘সামিদুন’ (সামুদ ধাতু হতে উৎপন্ন হয়েছে) এর অর্থ সঙ্গীত বা গান-বাজনা, যখন কাফিরেরা কোরান শরীফ শ্রবণ করতো, সঙ্গীত বা গান-বাজনা করতো ও ক্রীড়া কৌতুকে লিপ্ত হতো, এটা ইয়ামেনবাসীদের ভাষা।’
আল কোরান, সুরা বনি-ইসরাইল: (১৭:৬৪) এ বর্ণিত আছে-
‘এবং (হে ইবলিস) তুই তাদের মধ্য হতে যাকে পারিস নিজের শব্দ দ্বারা পদস্খলিত কর।’
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে ইবনে জারীর-এর ১৫/৭৬ পৃষ্ঠায় আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন, ‘শয়তানের শব্দ অর্থ হচ্ছে ক্রীড়া ও সঙ্গীত বা গান-বাজনা।’
হাদিস এ বর্ণিত আছে-
নবী মুহাম্মাদ- ‘গান শোনা গুণাহের কাজ, গানের মজলিসে বসা ফাসেকী এবং গানের স্বাদ গ্রহণ এবং প্রশংসা করা কুফরী।’ এবং ‘আমি “বাদ্য-যন্ত্র” ও “মুর্তি” ধ্বংস করার জন্যে প্রেরিত হয়েছি।’
অন্য হাদিস এ নির্দেশ আছে- ‘পানি যেরূপ জমিনে ঘাস উৎপন্ন করে “গান-বাজনা” তদ্রুপ অন্তরে মুনাফেকী পয়দা করে।’ (বায়হাক্বী ফী শুয়াবিল ঈমান)
‘জামিউল ফতওয়া’ কিতাবে উল্লেখ আছে-‘গান-বাজনা শ্রবণ করা, গান-বাজনার মজলিশে বসা, বাদ্য-যন্ত্র বাজানো, নর্তন-কুর্দ্দন করা সবই হারাম, যে ব্যক্তি এগুলোকে হালাল মনে করবে সে ব্যক্তি কাফির।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে যারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে-প্রতিষ্ঠানে এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডায় হামলা করে মূর্তি ধ্বংস করছে তারা মোটেও বিপথগামী নয়; তারা সহি ইসলামের পথেই আছে। আর যারা অভিনয়, নাচ-গান, খেলাধুলা করছেন তারা বিপথগামী।
চিত্রকলা, ভাস্কর্য, এবং আলোকচিত্র:
বাংলাদেশে অসংখ্য চিত্রকর আছেন, যারা নিজেকে সহি মুসলমান মনে করেন, কালেভদ্রে নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, বাড়িতে কুকুর পোষেন, আবার ঘটা করে নিজের ধর্মপরায়ণতাও প্রকাশ করেন। দেখি এদের সম্পর্কে ইসলাম কি বলে-
‘যে ঘরে কুকুর থাকে আর প্রাণির ছবি থাকে সে ঘরে (রহমতের) ফিরিশতা প্রবেশ করেন না।’(সহীহ বুখারী, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস নং ২৯৯৮- ইফা)
‘(কিয়মতের দিন) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তাদের, যারা ছবি বানায়।” [সহীহ বুখারী, নবম খণ্ড, হাদিস নং ৫৫২৬-ইফা)
‘হাশরের দিন সর্বাধিক আজাবে আক্রান্ত হবে তারাই, যারা কোনো প্রাণির ছবি তোলে অথবা আঁকে।’ (বুখারি : ৫/২২২২)
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান আল্লামা মুফতি আবুল কাসেম নোমনী তার ফতোয়ায় উল্লেখ করেন, ‘পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরির মতো একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ইসলামে ছবি তোলা হারাম।’
অথচ ঈদের জামায়াতের সেলফি, কোরবানীর গুরুর সঙ্গে সেলফি, সংযমের কথা বলা হলেও রাজকীয় ইফতার পার্টিতে তোলা সেলফিতে সয়লাম থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ধর্মেও আছে, ধর্ম অবমাননাতেও আছে!
নারী নেতৃত্ব:
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, বিরোধীদলীয় নেতা নারী, স্পিকার নারী, নারী মন্ত্রী আছেন, বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে কর্তব্যরত আছেন নারী। এবার দেখি নারী নেতৃত্ব সম্পর্কে ইসলাম কি বলে-
আল কোরান, সুরা নিসা, (৪:৩৪) এ বর্ণিত আছে-
‘পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বিশিষ্টতা দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং যা লোকচুর অন্তরালে আল্লাহ্ হেফাজতে তারা তার হেফাজত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের উপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোনো পথ অনুসন্ধান করোনা। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ।’
বুখারী, তিরমিযী ও নাসাঈ এ বর্ণিত হয়েছে-
‘সে জাতি কখনও সাফল্য অর্জন করতে পারে না, যে জাতি তাদের স্বীয় কাজকর্মের কর্তৃত্ব ও দায়িত্বভার একজন নারীর হাতে সোপর্দ করে।’
বুখারীতে আরো বর্ণিত আছে- ‘সেই কওম (জাতি) কখনোই কল্যাণ লাভ করবে না যে কওমের প্রধান হবে মহিলা।’
নারী নেতৃত্ব সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করে রাসূল বলেছেন-
‘যখন তোমাদের শাসক হবে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুষ্ট ও শয়তান প্রকৃতির, তোমাদের ধনীরা যখন হবে তোমাদের মধ্যে বেশি কৃপণ আর তোমাদের (জাতীয়)কাজ-কর্মের দায়িত্ব যখন ন্যস্ত হবে তোমাদের স্ত্রী লোকদের হাতে তখন মৃত্যু হবে জীবন অপেক্ষা উত্তম। (তিরমিযী)
বন্ধুত্ব :
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের ধর্ম যেমনি ইসলাম, তেমনি আমাদের রাষ্ট্রেরও ধর্ম ইসলাম। এবার দেখা যাক বন্ধুত্ব সম্পর্কে ইসলাম কি বলে-
আল কোরান, সুরা মায়িদা (৫:৫১) এ বর্ণিত আছে-
‘হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করোনা। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।’
অর্থাৎ কেবল আমাদের রাষ্ট্রের মানুষই নয়, স্বয়ং রাষ্ট্রও ধর্ম অবমাননা করছে! বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন অমুসলিম রাষ্ট্রের দূতাবাসগুলো তো তাই প্রমাণ করে। এরকম আরো কিছু প্রামাণ উপস্থাপন করা যায়, কিন্তু তাতে লেখা আরো দীর্ঘায়িত হবে।
তাহলে কোরান-হাদিস অমান্য করে যেসব মুসলমান নারী রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন; যারা সিনেমা-টেলিভিশন-মঞ্চে অভিনয় করছেন, গান-কবিতা-গল্প লিখছেন; যারা ছবি আঁকছেন, ভাস্কর্য বানাচ্ছেন, অপ্রয়োজনে ছবি তুলছেন; ইহুদি-খ্রিষ্টানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছেন; তারা কি সহি ইসলামের অনুসারী? তারা কি সহি মুসলমান? এরা ছাড়া অন্যান্য পেশার মানুষ নাটক-সিনেমা দেখছে, গান শুনছে, অফিস থেকে ফেরার পথে বাসে বসে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে স্মার্টফোনের পর্দায় দীপিকা পাডুকোনের জিরো সাইজ ফিগারের ঝলকানি-ছটফটানি দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরে, ঘুমানোর আগে সানি লিয়নের কামকলার নিপুণ নৈপুণ্য দেখে ঘুমাতে গেলে ঘুমটা গভীর হয়, খেলাধুলাকে ‘শয়তানের শব্দ’ হিসেবে আখ্যা দিলেও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা এবং পাকিস্থান নিয়ে আমাদের চেয়ে বেশি মাতামাতি খুব কম দেশেই হয়। এতোসব করেও এরাই আবার সহি মুসলমান বনে যায়! বলে, ইসলাম আধুনিক ধর্ম, পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এই যে এদের চরিত্রের বৈপরীত্য-দ্বিচারিতা, একে কী বলা যায়? এদেরকে কি প্রতারক-ভণ্ড বলা যায়? এরা ঝোলের লাউ অম্বলে কদু; ঘোমটাও দেবে, খ্যামটাও নাচবে। এরা মুহাম্মদেও আছে, ডারউইনেও আছে!
অন্যদিকে জঙ্গিরা গান-বাজনা, খেলাধুলা, ছবি আঁকা প্রভৃতি থেকে বিমুখ। কোরানলব্দ যে বিশ্বাস তারা লাভ করেছে, সেই বিশ্বাস মেনেই তারা জীবনযাপন করার চেষ্টা করে। তাদের চরিত্রে বৈপরীত্য থাকলেও অন্যদের তুলনায় তা নিতান্তই কম।
আমাদের প্রথম পক্ষ কোরানের আংশিক বিশ্বাস করে অথবা মেনে চলে। এদের বেশিরভাগের চরিত্র জলের মতো! যখন যে পাত্রে রাখা হয়, তখন সেই পাত্রের রঙ ধারণ করে। এখনই দেশটা জঙ্গিদের হাতে চলে যাক, ইসলামী শাসন কায়েম হোক, সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের প্রথম পক্ষের অধিকাংশেরই সুর পাল্টে যাবে। তখন তারা জঙ্গিদের শাসনই মেনে নেবে এবং বলবে এটাই সহি ইসলাম। জঙ্গিদের চেয়েও এই চরিত্রের মানুষ বেশি ভয়ংকর এবং ক্ষতিকর। জঙ্গিদের একবারেই চেনা যায়, কিন্তু এরা বর্ণচোরা। এরা কেউ কেউ নিজের ধর্মানুভূতি কিংবা হৃদয়ের কোমলতা বোঝাতে টিভি ক্যামেরার সামনে বহু দূর দেশের ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন সংস্কৃতির গাজা’র মানুষের জন্য কাঁদে; ফেসবুকে জোর প্রতিবাদ জানায়, আবার অথৈই আবেগের কথাও লেখে। তা কাঁদুক-লিখুক, মানুষের দুর্দশার কথা শুনে মানুষই তো কাঁদবে; বিপদে মানুষই তো মানুষের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যখন নিজের দেশের একই ভাষার, একই সংস্কৃতির মানুষ শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মের কারণে তাদেরই ধর্মের মানুষের হাতে ক্রমাগত নির্যাতিত হয়, খুন হয়; তবু তাদের বেশিরভাগেরই প্রাণ কাঁদে না, ফেসবুকে জোর প্রতিবাদ জানায় না কিংবা অথৈই আবেগের কথাও লেখে না; তখন গাজার মানুষের জন্য তাদের অশ্রুপাত প্রশ্নবিদ্ধ হয়, অশ্রুধারায় তার অধরেই লেখা হয়ে যায় যে, এই অশ্রু মানবতার জন্য নয়, ইসলাম ধর্মের জন্য। যদি তাই না হবে তবে সৌদি বিমান হামলায় ইয়েমেনের মানুষের জন্য তাদের প্রাণ কাঁদবে না কেন, পায়ে পাথর বেঁধে কেউ সৌদি দূতাবাসের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ জানাবে না কেন! কাঁদতো, পায়ে পাথর বেঁধেও প্রতিবাদ জানাতো যদি সৌদি আরবের জায়গায় কোনো খ্রিষ্টান কিংবা ইহুদি রাষ্ট্র হতো! হয়তো তারা ভাবে মুহাম্মদ সৌদিতে জন্মগ্রহণ করায় ইয়েমেনের মানুষের চেয়ে সৌদিরা একটু বেশি সহি মুসলমান, তাই তারা যা করবে সেটাই ঠিক!
আসলে আমাদের এই প্রথম পক্ষের চেতনার উর্বর জমিনেই দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ জঙ্গিরা ধাই ধাই করে বেড়ে ওঠে। এখন দেখি কোরানের আংশিক বিশ্বাসকারী বা মান্যকারীদের সম্পর্কে কোরানে কি বলা হয়েছে-
সুরা বাকারাহ (২:৮৫) এ বর্ণিত আছে-
‘তোমরা কি ধর্মগ্রন্থের অংশবিশেষে বিশ্বাস কর ও অন্য অংশে অবিশ্বাস পোষণ কর? অতএব তোমাদের মধ্যে যারা এরকম করে তাদের ইহজীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া আর কী পুরস্কার আছে? আর কিয়ামতের দিনে তাদের পাঠানো হবে কঠোরতম শাস্তিতে। আর তোমরা যা করছো আল্লাহ্ সে-বিষয়ে অজ্ঞাত নন।’
©somewhere in net ltd.