নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-উনিশ)

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৮

শ্মশান বরাবরই নীলুর কাছে ভীতিকর এক জায়গা। শ্মশান মানেই সুনসান নীরবতা। শ্মশানের বাতাসকে তার মনে হয় ভূতের নিশ্বাস! শৈশবে রাত্রিবেলা সে যখন মা কিংবা ঠাকুমার কোলের মধ্যে কু-লী পাকিয়ে শুয়ে থাকতো, তখন যদি তার কানে আসতো দূরাগত কোনো শ্মশানবন্ধুদের ধ্বনি- ‘হরিধ্বনি বল, হরিবল’ বা ‘হরিহরি বল, হরিবল’, তার বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠতো। ভয়ে মা-ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরতো। কিছুতেই গলা ছাড়তো না। আতঙ্কে সে রাতে আর সহজে ঘুম আসতো না। নীলু প্রথম শ্মশানে গিয়েছিল তার ঠাকুমা মরলে। নিখিলের হাত ধরে। একবারের জন্যেও সে নিখিলের হাত ছাড়েনি। শৈশবে উঠোনে খেঁজুর পাতার পাটিতে ঠাকুমার কোলের ভেতর শুয়ে ডান হাতের মুঠোয় তাঁর সাদা থানের কোনা ধরে নিজের বুড়ো আঙুল চুষতো আর বাঁ হাতের আঙুলে ঠাকুমার ঝুলে পড়া শুকনো মাইয়ের বোঁটা চটকাতে চটকাতে তার মুখে শাস্তর শুনতো, কখনো কখনো ডান কিংবা বাঁ পা তুলে দিতো ঠাকুমার গায়ের ওপর। একটা শাস্তর শেষ হলেই আরেকটার জন্য বায়না ধরতো, সেটা শেষ হলে আরেকটা। শাস্তর শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়তো একসময়। ঠাকুমার মুখ থেকে তামাকের গন্ধ বের হতো। ঠাকুমার গুলের অভ্যাস ছিল না, ছিল তামাকের অভ্যাস। বাজার থেকে তামাক পাতা আনিয়ে রোদে মচমচে করে শুকাতো। তারপর সামান্য শুকনো খড় পুড়িয়ে, সেই ছাই আর তামাক পাতা সরার মধ্যে পুতো দিয়ে গুঁড়ো করতো। এরপর অনেক যত্নে রেখে দিতো হাকিমপুরী জর্দার খালি কৌটোয়। দিনে-রাতে অনেকবার সেই তামাক আঙুলের মাথায় নিয়ে মুখে পুরতো। সে ছিল ঠাকুমার সার্বক্ষণিক ন্যাওটা। একবার তো সে জর্দার কৌটা খুলে ঠাকুমার তামাকগুঁড়ো মুখে দিয়ে মরেই যায় আর কী! শ্মশানের চিতা থেকে কিছুটা দূরত্বে নিখিলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে, পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখেছিল প্রিয় ঠাকুমাকে। চোখ বুজে নিশ্বাস নিলে আজও যেন নীলু ঠাকুরমার মুখের সেই তামাকের গন্ধ পায়!

এরপর পাড়া-পড়শি কেউ মরলে বারকয়েক শ্মশানে গিয়েছে সে। তবে শ্মশানে গেলেও সে মানুষের ভিড়ের মধ্যে থাকতো। কখনও একা হতো না। ভয় করতো তার। তারপর অনেকদিন বাদে সে শ্মশানে যায় ভারতে নবদ্বীপ গোঁসাই মারা গেলে। সেদিন আর তার ভয় করেনি। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিল সে। সেই ঘোর নিয়ে ভারত থেকে দেশে আসার ক’দিন পরই মারা গেল তার মা। আবারও তাকে যেতে হলো শ্মশানে। চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল মা, পৃথিবীতে যে মা ছিল তার সবচেয়ে আপন।

এরপর বাড়ি ছেড়ে এখানে আসার বছর খানেক বাদে সে শ্মশানে গিয়েছিল। শ্মশান ভীতি তখনও কাটেনি তার। কাউকে দাহ করতে নয়, একদিন দুপুরবেলা শ্মশানের কাছ দিয়ে ডালিম আর সে হেঁটে আসছিল। হঠাৎ ডালিম বলে উঠলো, ‘চল মিতে শ্মশানে যাই।’

শ্মশানের পাশ দিয়ে যাচ্ছে সে কথা নীলুর মনে ছিল না। ডালিমের মুখে শ্মশানের নাম শুনেই তার গা ছমছম করে উঠলো। সে বললো, ‘শ্মশানে আবার কী! দরকার নাই যাওয়ার।’

ডালিম বুঝলো নীলু ভয় পেয়েছে। সে বললো, ‘কোনো ভয় নাই মিতে। একদম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শ্মশান। তাছাড়া এই দিনে-দুপুরে আবার ভয় কিসির! আমি তো রাত্তির বেলায়ও কতো আসি।’
‘তুমি তো এট্টা ভূত!’
‘ভূতির সাথে গেলি কোনো ভয় নাই! শ্মশানের গাছে অনেক অইত্তোকি ধরিছে। কয়ডা পাড়ে নিয়ে যাই।’

হরীতকীর কথা শুনে নীলুর জিভে জল এলো। কাঁচা হরীতকী চিবানোর পর জল মুখে নিলে যে কোমল স্বাদ অনুভূত হয়, সেই স্বাদ অনুভব করলো। বললো, ‘চলো। তয় তুমি কিন্তু আমারে ছাড়ে দূরি যাবা না।’
ডালিম বললো, ‘আচ্ছা, চলো।’

এরপর শ্মশানের গেট দিয়ে ঢুকলো দুজন। শ্মশানের চারপাশ খোলা। কোনো সীমানা প্রাচীর নেই। কিন্তু সুন্দর একটি গেট আছে। খোলা গেট। তারা দুজন ছাড়া এতো বড় শ্মশানে আর কেউ নেই। সুনসান নীরব। সেই নীরবতা ভেঙে ক্ষণে ক্ষণে কিছু পাখি ডাকছে। নীলুর গা ছমছম করতে লাগলো। দুজনে ঘুরে দেখতে লাগলো পুরো শ্মশান। চিতার খুঁটির উপর একটা দাঁড়কাক বসে কা কা করছে। চিতার দক্ষিণে ঢালু মতো সামান্য একটু জায়গা। তার পরই চন্দনা নদী। চন্দনার বুকে পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীর ক্ষয়িষ্ণু কামনার মতো স্রোতধারা। নদীর পাড়ে একটা ছেঁড়া বালিশ আর একটা মাদুর পড়ে আছে, বালিশ থেকে তুলো বেরিয়ে ছড়িয়ে আছে স্যাঁতসেঁতে মাটিতে, একটা ভাঙা কলসির কয়েকটা টুকরো পড়ে আছে কয়লার মধ্যে, ভেজা কয়লার সোঁদা গন্ধ ভেসে এলো নাকে। পশ্চিমের দিকটায় একটা পুরনো স্যাঁতাপড়া সমাধি মঠ। ফলকে মৃত ব্যক্তির নাম-পরিচয় পড়ার উপায় নেই। সমাধি মঠটির সামান্য দক্ষিণে ভাঙা একটি মাটির কলস পড়ে আছে। কলসের ভাঙা তলিতে এখনও জল জমে আছে। পাশেই মাটিতে পড়ে আছে একটি কড়ি, কয়েক টুকরো ভাঙা শাঁখা, সিঁদুরের কৌটো। হয়তো দু-একদিন আগেই কোনো সধবাকে সমাধি দেওয়া হয়েছে।

উত্তর-পূর্বদিকের কালী মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালো তারা। কালী মূর্তির মুখের দিকে তাকাতেই নীলুর বুকের হাপর যেন একটু ঘন কাজ করতে লাগলো। কুচকুচে কালো মূর্তি। মাটির নয়, পাথরের। চোখের দৃষ্টি যেন বুকের ভেতরটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়! কালী মূর্তির পরনে লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি, গলায়-হাতে সোনার গহনা। হাতে মোটা শাঁখা। হাতের এই শাঁখা নিয়ে এক গল্প চালু আছে। ডালিম সেই গল্প বললো নীলকে-‘একদিন এক শাঁখারি শ্মশানের পাশ দিয়ে যাতেছিল। লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরা এক যুবতী বউ শাঁখারিরে ডাহে শাঁখা দ্যাকপার চালো। শাঁখারি বউডারে শাঁখা দ্যাহালো। বউডা পছন্দমতো একজোড়া শাঁখা নিজির হাতে প’রে কোলো, “এই শাঁখাজোড়া আমার পছন্দ অইছে।” তারপর শাঁখারি টাহা চালি সে কোলো, “আমার বাবার কাছতে টাহা নিয়েন।”

শাঁখারি কোলো, “আপনার বাবা কিডা?”

বউডা তহন শ্মশানের পুরোহিত মশাইয়ের নাম কোলো। শাঁখারি বউডারে বিশ্বেস করে শাঁখা দিয়ে চলে গেল।
পরদিন পুরোহিত মশাইয়ের বাড়িতি যায়ে টাহা চালো শাঁখারি। কোলো, “আপনার মিয়া আমার কাছতে শাঁখা নিছে। আপনারে দাম দিবার কইছে।”

শুনে তো পুরোহিত মশাইয়ের চক্ষু চড়কগাছ! তাঁর মিয়া তো বিধবা, সে কী জন্যি শাঁখা কিনবি! শাঁখারি মনে অয় ভুল করে তার কাছে আইছে। উনি কোলো, “আমার মিয়া তো বিধবা, সে কী জন্যি শাঁখা কিনবি তুমার কাছতে?”

শাঁখারির মুখ শুহোয়ে গেল। কোলো, “কী কোতেছেন আপনি, আপনার মিয়া বিধবা! কিন্তু কাল আমি যহন শ্মশানের পাশ দিয়ে যাতেছিলাম, তহন লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরা অল্প বয়সী একটা সধবা বউ, গায়ের রঙ কালো, কপালে বড় সিঁদূরের ফোঁটা, আমার কাছতে একজোড়া শাঁখা নিলো। দাম চালি আপনার নাম কোয়ে কোলো, আমার বাবার কাছ থেকে দাম নিয়েন।”

এইবার পুরোহিত মশাইয়ের মনে কিছু এট্টা সন্দেহ জাগলো। আর কতা না বাড়ায়ে শাঁখার দাম মিটায়ে বিদায় দিলো শাঁখারিরে। তারপর পুরোহিত মশাই সাথে সাথে ছুটে আসলো শ্মশানে। আসে দেখলো মা-কালীর হাতে নতুন শাঁখা। তাই দেহে পুরোহিত মশাই উন্মাদের মতো মা-কালীর পাও জড়ায়ে ধরে মন্দিরের ভেতর গড়াগড়ি দিয়ে কান্দাকাটি শুরু করলো।’

ডালিমের মুখের গল্প শুনে হাসলো নীলু। তার মুখের অবিশ্বাসী হাসির অর্থ অনুধাবন করে ডালিম বললো, ‘বিশ্বেস অয় না?’

‘এই গাঁজাখুরি গল্প পাগলেও তো বিশ্বেস করে না! এই অয় নাকি!’
‘বিশ্বেস না অয় পুরোহিত কাকার কাছে শুনে দেহো।’

নীলু আবার হাসতে লাগলো। ডালিম বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ধুর বাল, নুমাকান্ত খালি হাসে! এই রাঙাবউয়ের পাল্লায় পড়ে তুমার ভক্তি-ছিদ্ধা সব গেছে!’

আবার হাসলো নীলু। ডালিম বললো, ‘আর যদি হাসো তো তুমারে মা-কালীর সামনে বান্ধে থুয়ে আমি চলে যাবানে কিন্তু। আমি বিশ্বেস করি। পুরোহিত কাকা মিত্যে কতা কয় না। শনি-মঙ্গলবারে কতো ভক্ত আসে, মা তাগের সগলের মনের আশা পূর্ণ না করলি কী তারা আসতো!’

নীলু হাসি থামিয়ে কালী মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার ধারণা চতুর পুরোহিত দর্শনার্থী বাড়ানোর জন্য এই ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। এখন দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এই কালীমূর্তি দেখতে ছুটে আসে, ভক্তবৃন্দ দক্ষিণার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। শৈশবের অভ্যাসবশত শ্মশানের নৈঃশব্দে তার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে ঠিকই কিন্তু পাথর প্রতিমার এই গল্পে আস্থা রাখতে পারেনি সে।

হরীতকী তলায় এলো দুজন। গাছ ভরা হরীতকী। নীলু গাছে উঠতে পারে না। ডালিম কোমরে কাপড় গুঁজে গাছে উঠলো। অনেকগুলো হরীতকী পাড়লো, নীলু তলা থেকে কুড়িয়ে গামছায় ভরলো।

তারপর আরও অনেকবার সে শ্মশানে গিয়েছে ডালিমের সাথে। শ্মশানের গাছ থেকে কখনও হরীতকী, কখনও চালতা, আবার কখনওবা বকফুল পেড়ে এনেছে বড়া ভেজে খাবার জন্য। রাতের বেলায়ও দু-বার গিয়েছে কালী পূজার সময়। আস্তে আস্তে তার শ্মশান ভীতি কেটে গেছে। স্মৃতির ভার বয়ে হাওয়ার ঘোড়ায় লাগাম জুড়ে আজ আবার শ্মশানের দিকে ছুটছে নীলু।

আজ মঙ্গলবার। শনি-মঙ্গলবার কালী মন্দিরে পূজা করেন পুরোহিত মশাই। তাই খুব সকালে এসে মন্দিরের ভেতর পরিষ্কার করেন তিনি। তেমনি বরাবরের মতো আজও এসেছেন। এসে নদী থেকে জল আনতে গিয়েছিলেন। তখনই দেখতে পান চিতা থেকে সামান্য দূরত্বে নদীতে নামার ঢালু জায়গায় উদোম শরীরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে ডালিম। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কালশিটে দাগ। কোথাও কোথাও জমাট বাঁধা ছোপ ছোপ শুকনো কালচে রক্ত। মুখের পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে শুকিয়ে আছে। লাল পিঁপড়ে লেগেছে মুখে। দু-চোখ নিমীলিত। কিছুটা দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ডালিমের কাপড়-ছায়া-ব্লাউজ। পুরোহিত মশাই দেখেই বুঝেছেন ডালিম মৃত। কেউ বা কারা তাকে মেরে ফেলে রেখেছে। তাঁর ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠলো। এতোদিন ধরে তিনি শ্মশানে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করছেন। এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। তাছাড়া ডালিমকে তিনি স্নেহ করতেন। শনি-মঙ্গলবার রাতে কালী পূজার সময় মাঝে মাঝেই ডালিম এসে মন্দিরের সামনের চাতালে বসে থাকতো। একটা সময় ভেউ ভেউ করে কাঁদতো। কাঁদতে কাঁদতে গড়িয়ে পড়তো চাতালে। কখনও কখনও ঘুমিয়েও পড়তো। পূজা শেষে তিনি এসে ডালিমকে ডেকে তুলতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, ‘তোর এই জনমের পূণ্যে তুই পরজনমে ঠিক মুক্তি পাবি।’

ডালিম তাঁর পা ধরে আরও জোরে ডুকরে কেঁদে উঠতো। তিনি বলতেন, ‘কাঁদিস নে মা, কাঁদিস নে। তোর জন্যে যে আমিও মায়ের পায়ে কান্নাকাটি করি। নে প্রসাদ নে। প্রসাদ নিয়ে ঘরে ফিরে যা।’

তাঁর স্নেহধন্য ডালিমের এমন অপমৃত্যুতে তিনি আজ বিচলিত।

পুলিশ এসে ডালিমের লাশ চাটাইয়ে মুড়িয়ে ফেললো। লাশ পোস্টমর্টেমে পাঠানো হবে জেলা সদরে। এসআই পুরোহিতের জবানবন্দি নোট করছেন। তিনি কীভাবে ডালিমকে দেখেছেন, কখন দেখেছেন এসব। ডালিমের কাপড়-ছায়া-ব্লাউজ নিয়ে গেলেন আলামত হিসেবে। এমন সময়ই হাওয়ার ঘোড়ায় লাগাম দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এলো নীলু। সে খবরটা পেয়েছে বেশ দেরিতে। শ্মশানে অনেক মানুষের ভিড়। কয়েকজন বৃহন্নলা-কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বাঁধানো বেদিতে বসে কাঁদছে। একজন বয়সী বৃহন্নলা প্রলাপ বকছেন। ডালিমের লাশ গাড়িতে তোলার আয়োজন চলছে। নীলু একজন পুলিশের কাছে কাকুতি মিনতি করলো লাশটা খুলে একবার দেখানোর জন্য। পুলিশ তাকে পাত্তা দিলো না। উল্টো দিলো ধমক। উপায় না দেখে এসআই’র কাছে গেল সে। কেঁদে কেঁটে কাকুতি মিনতি করলো। কিন্তু মন গললো না। শেষে পুরোহিত এসআইকে অনুরোধ করলেন নীলুকে লাশ দেখানোর জন্য। তাতে কাজ হলো। এসআই’র নির্দেশে একজন পুলিশ লাশের মুখের দিকের চাটাইয়ের বাঁধন খুলে দিলো। হতবিহ্বল নীলু তাকিয়ে রইলো তার মিতের নীলাভ নিস্তব্ধ মুখশ্রীর দিকে। দু-চোখ নিমীলিত। মিতে আর কখনও চোখ খুলবে না, কথা বলবে না, হাসবে না, হাসাবে না, চুটকি বলবে না, গান গাইবে না, নাচবে না, হাকিমপুরী জর্দা মিশিয়ে জোর করে তার মুখে পান পুরে দেবে না, দুষ্টুমি করবে না! চিরতরে ঘুমিয়ে গেল মিতে! অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো সে তার মিতের দিকে, পলক ফেলে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করতে চাইলো না। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো অধর বেয়ে মাটিতে। জনমের মতো দু-চোখ ভরে সে দেখছে তার প্রাণপ্রিয় মিতেকে।

কিছুক্ষণ পরই চাটাইটা পুনরায় মুড়িয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললো পুলিশ। তারপর চারজন পুলিশ ধরে গাড়িতে তুললো লাশ, তারাও উঠলো গাড়িতে। তাদের পায়ের কাছে চাটাইয়ে মোড়ানো ডালিমের লাশের দিকে তাকিয়ে রইলো নীলু। গাড়ি স্টার্টের শব্দে কেঁপে উঠলো তার সারা শরীর। বয়সী বৃহন্নলা আছড়ি-পিছাড়ি করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই অল্প বয়সের দুজন বৃহন্নলা তাকে ধরে থামালো, জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো সবাই। এসআই গিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতেই চলতে শুরু করলো গাড়ি।

শ্মশান পিছনে ফেলে গাড়ি পাকা রাস্তায় উঠে যতোই দূরে চলে যাচ্ছে নীলুর বুকটা যেন ততোই শূন্য হয়ে পড়ছে। খাঁ খাঁ করছে বুকের প্রান্তর, আউলা বাতাস বইছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চোখের আড়ালে চলে গেল গাড়ী। এখন তার শরীর কাঁপছে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে তবু সে স্থির দাঁড়িয়েই রইলো। অন্য বৃহন্নলারা অপেক্ষমাণ একটা ভ্যানে উঠে আহাজারি করতে করতে চলে গেল, পুরোহিত মন্দিরে প্রবেশ করলেন, অন্য মানুষ যারা ছিল তারাও চলে যাওয়ায় ফাঁকা হয়ে গেল শ্মশানচত্বর কিন্তু নীলু দাঁড়িয়েই রইলো। আজ কোনো ভয় নয়, গা ছমছম নয়, আজ তার ভেতরে কেবলই হাহাকার; হারানোর বেদনা, ক্ষরণ, কান্না।

একদিন মিতে তাকে এই শ্মশানে নিয়ে এসেছিল। চিনিয়েছিল ভোরের শ্মশানের স্নিগ্ধতা, মধ্যাহ্নের শ্মশানের মন উদাস করা সৌন্ধর্য, গভীর রাতের শ্মশানের ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ-মাধুর্য! আর আজ মিতে তার প্রিয় শ্মশানেই সারারাত ধরে পড়েছিল নিথর, নিস্তব্ধ, নগ্ন!
একরাতে সে ডালিমকে বলেছিল, ‘ছাতা নিয়ে গাওয়ালে যাতি আমার ভাল লাগে না। গাওয়াল আমার জন্যে না মিতে।’
ডালিম বলেছিল, ‘আমরা সবাই-ই দুই দিনের জন্যে এই দুনিয়ায় গাওয়ালে আইছি মিতে, কবে কার গাওয়াল শ্যাষ অবি তা কারো জানা নাই। দুনিয়ার এই গাওয়ালে যতো দুঃখ-কষ্টই থাক, গাওয়াল আমাগের করতি-ই অবি যতোদিন এই দেহের মইদ্যে প্রাণ আছে।’
খুব দরদ দিয়ে একটা গান গাইতো ডালিম। এখন তার কানে বাজছে মিতের গাওয়া সেই গানের সুর-
‘জানি না কে ধরে আছে
বিকিকিনির এই বাজারের হাল
আমি তো ভাই এসেছি
কিছুকাল করতে গাওয়াল।
সোনা-দানা নেই তো আমার
নেই তো কোনো মহাল
বুকে আছে ভালবাসার ভাণ্ডার
করি প্রেমের গাওয়াল।’

গাওয়াল! এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল ডালিমের গাওয়াল! এতো অল্প সময়ের জন্য ডালিম গাওয়ালে এসেছিল! কী গাওয়াল করলো সে, আর কী ধন নিয়েই বা ফিরে গেল? ডালিম তো প্রেম, ভালবাসা, স্নেহ, আনন্দ গাওয়াল করেছে ঢের; বিনিময়ে এই সমাজের বেশিরভাগ মানুষের কাছ থেকে পেয়েছে অপমান, অবহেলা, দুঃখ, যন্ত্রণা। ভালবাসাও পেয়েছে কিছু মানুষের কিন্তু তা দুঃখের সাগরের বিপরীতে এক আঁজলা স্বাদু জলের মতো!

এই কথাগুলোরই যেন একটু অন্যরকম প্রতিধ্বনি হতে লাগলো নীলুর বুকের ভেতর। রাত নেমেছে অনেক আগেই, কিন্তু রাতে খাওয়া হয়নি তার। রান্নাই করেনি রাতে, রান্না করতে ইচ্ছে করেনি। বিছানায় বসে ডালিম এলে যে বালিশটায় শুতো সেটা কোলে নিয়ে হাতের পরশ বুলাতে লাগলো, নাকের কাছে ধরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে ডালিমের চুলের গন্ধ খুঁজলো যেন। তারপর প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো বালিশটা জড়িয়ে ধরে। বাইরে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো ভুলু, নাকি কেঁদে উঠলো!

সন্ধ্যার পর থেকেই বিদ্যুৎ নেই, হারিকেনও জ্বালেনি সে; সবখানে অন্ধকার। দীর্ঘক্ষণ পর বিছানা থেকে নেমে খোলটা নিয়ে পুনরায় বিছানায় উঠে বসলো। কোলের ওপর খোল রেখে আঙুলের মৃদু টোকায় তাল ঠুকতে লাগলো। অনেকক্ষণ যাবৎ বিক্ষিপ্তভাবে আসা কিছু শব্দ একে একে সাজিয়েছে। নিস্তব্ধ কৃষ্ণ রাত্রির গলায় পরিয়ে দিলো সেই কথামালা সুরের সুতোয় গেঁথে-
‘বৃষ্টির ফুল ফুটবে না আর
আমার এ ছোট্ট আঙিনায়
সকাল-বিকাল হাসবে না আর
গাইবে না জ্যোৎস্নায়।
না পেলো সে ফুলদানীতে ঠাঁই
না হলো ঠাঁই খোঁপায়
নিঠুর ভুবন দিলো তারে ঠাঁই
গহীন মাটির তলায়।
বৃষ্টির ফুল ফুটবে না আর...’

নীলু গেয়েই চলেছে, সুরের সাথে মিশে আছে তার ভেতরের হাহাকার আর কান্না। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। খোলা দরজার ওপাশে স্থির হয়ে বসে আছে ভুলু; হঠাৎ প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে সামনের দু-পায়ে ভর দিয়ে উঠতে গিয়েই আবার বসে পড়লো, ঘাড় ফিরিয়ে অন্ধকারে প্রায় মিশে থাকা নীলুর দিকে তাকালো, পুনরায় প্ল্যাটফর্মের দিকে। কয়েক মুহূর্ত পরেই ভুলুকে অতিক্রম করে ঘরে ঢুকলো রাঙাবউ। নীলুর কণ্ঠরোধ হলো কান্নায়, গান থামিয়ে খোলের ওপর কপাল ঠেকিয়ে আর্তস্বরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। রাঙাবউ কিছু একটা নিয়ে এসেছে হাতে করে, কিন্তু কী তা বোঝা যাচ্ছে না অন্ধকারে। এ ঘরের সবকিছু রাঙাবউয়ের নখদর্পনে, অন্ধকারে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাতের জিনিসটি টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখতেই টুং করে একটু শব্দ হলো আর পরমুহূর্তেই বিদ্যুৎ আসায় ঘরের বাতি জ্বলে উঠলে দেখা গেল টেবিলের ওপর রাখা প্লেটে ঢাকা মেলামাইনের ছোট গামলা। তারপর বিছানায় এসে নীলুর পাশে বসে নীরবে ওর মাথায় হাত রাখলো রাঙাবউ; মুখে একটি কথাও বললো না বটে কিন্তু তার হাতের স্পর্শে সান্ত্বনা এবং সমবেদনার যে ভাব প্রকাশ পেল তা নীলুর চেতনার গভীরে প্রবেশ করলো। মাথা তুলে নীলু তাকালো রাঙাবউয়ের চোখের দিকে। তার চোখ রক্তিম, রাঙাবউয়ের চোখেও অশ্রু। দুজনের ব্যথাতুর চোখ দুজনের কাছেই যেন খুঁজলো সান্ত্বনা। হঠাৎ নীলুকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রাঙাবউ। বৈবাহিক সম্পর্কহীন দুজন নর-নারী নিজেদের সম্পর্কের নূন্যতম দূরত্ব ভুলে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ যাবৎ নীরবে অশ্রু বিসর্জন করলো একজন বৃহন্নলার জন্য, সমাজের কাছে যে মানুষ কিনা মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি; হিজড়া হয়েই থেকেছে সামজের চোখে, হয়ে উঠেছে হাসির পাত্র, মনোরঞ্জনের খোরাক; আর পেয়েছে অনাদর, অবহেলা, বঞ্চনা।

হঠাৎ ভুলু প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠলো। ভুলুকে ধমকালো সাজু, ‘এই ভুলু চুপ কর, চুপ কর। আমি, আমি...।’

সর্বনাশ! সাজু যে এদিকেই আসছে! মুহূর্তের মধ্যে রাঙাবউ নীলুকে ছেড়ে দিয়ে ঘরের উত্তর দিকের অপেক্ষাকৃত কম আলোকিত স্থানে গিয়ে দাঁড়ালো। নীলুও চটজলদি চোখের জল মুছতে মুছতে বিছানা থেকে নামলো, বারান্দার বাতিটা জ্বালিয়ে ঘরেরটা বন্ধ করে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সাজু বারান্দায় উঠে নিজেই মোড়াটা টেনে বসলো। নীলুও বসলো সামান্য তফাতে আরেকটি মোড়া টেনে। সাজু নিজে নিজেই ডালিমের চারিত্রিক গুণাবলির বিশদ আলোচনা শুরু করলো। অনেক বাক্য খরচ করলেও তার কথার সারমর্ম মোটামুটি এরকম-হিজড়া হলেও ডালিমের ব্যবহার ভাল ছিল, সকলের সাথে মন খুলে মিশতো, কারো সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করতো না, বু বলে ডেকে তার প্রাণটা জুড়িয়ে দিতো, রহমতকে ভাইজান ছাড়া কোনোদিনও মাজাভাঙা বলে সম্বোধন করেনি ইত্যাদি। বলার মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, চোখের জল মুছে, নাক টেনে আবার আলোচনা টেনে নিতে লাগলো একাই। তার আলোচনা শোনার মতো মানসিকতা বা আগ্রহ শ্রোতার থাক বা না থাক, শ্রোতাকে শুনতেই হবে। নীলুও শুনছে নীরবে। এরপর সাজু তার সৃষ্টিকর্তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালো, ‘আল্লাহ তোর বিচের নাই, বিচের থাকলি কী এমন কাণ্ড সহ্য করবার পারতি! মানুষডার ঘর-সুংসার নাই, সুয়ামি-আও-বাচ্চা নাই, বনে বনে ঘুরে বেড়াতো, কারো সাতে-পাঁচে ছিল না; আর সেই মানুষটারে তুই এমন অপঘাতে মারলি। তোর বিচের নাই আল্লাহ!’

মাঝখানে কিছুক্ষণ ডালিমের স্মৃতিচারণা করার পর কাঠগড়া থেকে নামিয়ে সে তার সৃষ্টিকর্তাকে আবার বিচারকের আসনে বসালো, ‘বিচের করিস আল্লাহ, যারা তার এই দুনিয়ার বরাত মারছে, তুই তাগের বিচের করিস।’

এবার কিছুক্ষণ নীলুকে সান্ত্বনা দিলো, তারপর একসময় আলোচনায় দাড়ি টানতে বললো, ‘যাইরে মিনসে। কাঁদিসনে। তার বাড়ি সে চলে গেছে। হাজার কাঁদলি-উ সে আর ফিরে আসপেন না। কাঁদিসনে বাইডি।’

সাজু চলে গেলে নীলু ঘরে ঢুকে বাতি জ্বাললো, রাঙাবউ চেয়ারে চুপটি করে বসে আছে। নীলু রাঙাবউয়ের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিয়ে বিছানায় বসতে যাবে এমন সময় রাঙাবউ বললো, ‘পেটে নিশ্চয় কিছু পড়েনি, ভাত নিয়ে আসিছি, খেয়ে নাও।’

‘পেটে ক্ষিদে নাই।’ বিছানায় বসে রাঙাবউয়ের দিকে দৃষ্টি ফেরালো নীলু।
‘খাইছো কিছু?’
নীলু দু-দিকে ঘাড় নাড়লে রাঙাবউ বললো, ‘তয় খাতি চাচ্ছো না কেন?’
‘ক্ষিদে মরে গেছে।’
‘ওঠো, অল্প একমুঠ খেয়ে নাও।’

বলে রাঙাবউ চেয়ার থেকে উঠে হাত ধুয়ে টেবিলে রাখা ভাতের গামলা থেকে প্লেটে ভাত তুলে দিলো, জগ থেকে জল ঢাললো গ্লাসে। নীলু আর আপত্তি করলো না, বিছানা থেকে উঠে জলের গ্লাস নিয়ে বারান্দায় গিয়ে হাত ধুয়ে এসে চেয়ার টেনে খেতে বসলো। পরপর দৃষ্টি বোলালো প্লেটের সাদা ভাত, বাঁধাকপি ঘণ্ট আর ছোট দুটো বাটির মুরগির মাংস এবং মটরডালে। বাঁধাকপি ঘণ্ট দিয়ে ভাত মেখে কয়েক গ্রাস পেটে চালান করার পরই তার মনে হলো, না, ক্ষিদেটা মরেনি, ঘাপটি মেরে ছিল; খাবারের গন্ধ-স্পর্শ পেতেই চাগাড় দিয়ে উঠেছে। সেই কাল রাতে ভাত খেয়েছে, আজ সারাদিনে খেয়েছে মাত্র দুটো সিঙ্গারা। রাজবাড়ী সদর থেকে পোস্টমর্টেম শেষে ডালিমের লাশ ওদের বাড়িতে নিয়ে আসতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যার কিছু আগে ডালিমকে কবর দেওয়া হয়েছে ওদের পুকুরপাড়ের বেলগাছতলায় ওর দাদীর কবরের পাশে। সারাগ্রামের মানুষ ভেঙে পড়েছিল ডালিমদের বাড়িতে, শেষবারের মতো ডালিমকে দেখতে। ডালিমের লাশবাহী খাটিয়া ওদের উঠোন থেকে পুকুরপাড়ের বেলগাছতলায় নিয়ে যাবার সময় অনেকের চোখেই ছিল জল, মানুষের চোখের এই জল ভাবিয়েছে নীলুকে। ডালিমের মৃত্যুতে মানুষ কি সত্যিই ব্যথিত? তাদের চোখের জল কি সত্যিকারের কান্নার, নাকি ডালিমের মা-বোন আর অন্য বৃহন্নলাদেরকে উন্মাদের মতো কাঁদতে দেখে সাময়িক আলগা আবেগের প্রকাশ? যদি তারা সত্যিই ডালিমের জন্য ব্যতিত হবে, ওই কান্না যদি তাদের বিক্ষত হৃদয়ের রস হবে, তবে ডালিম বাড়িতে নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারেনি কেন? কেন ডালিম আর তার পরিবারের জীবন অতিষ্ট করে তুলেছিল তার গ্রামের মানুষ? কেন ডালিমের মা কাঁদতে কাঁদতে একদিন ডালিমকে বলতে বাধ্য হয়েছিল, ‘তুই আর বাড়ি থাহিসনে?’ কেন মাকে দেখতে ইচ্ছে করলেও বাড়িতে যেতো না ডালিম? কতোদিন ডালিম তাকে বলেছে, ‘মারে খুব দ্যাকপার মন চাতেছে মিতে?’

প্রথমবার সে বলেছিল, ‘যাও, বাড়ি যায়ে খালাম্মারে দেহে আসো?’
‘না, বাড়ি যাবো না।’
‘ক্যান?’
‘বাড়ি গেলি মানষি নানান রহম কতা কয়; আমারে কয় না, কয় বাড়ির মানষির। মিয়েভাই’র ছাওয়াল-মিয়া দুডে এহন স্কুলি পড়ে। আমি বাড়ি গেলি অন্য ছাওয়ালপাল ওগের কয়, তোর ফুফু তো হিজলে। বড়মানুষি এসব নিয়ে আটকাচারি না করলি পুলাপান এসব শিখলো ক্যাম্বা! এই জন্যেই এহন আর যাইনে। আমার জন্যে উরা ক্যান অসুবিধেয় পড়বি!’
‘তালি আমি যায়ে খালাম্মারে নিয়ে আসি?’
‘যাবা?’
‘হ, নিয়ে আসি, খালাম্মা কয়দিন থাহে তারপর যাবেনে।’
‘যেমন তুমার ইচ্ছে।’

মাকে আনার কথা শুনে ডালিমের চোখের সেই খুশির ঝিলিক আর কোনোদিন কারো চোখে দ্যাখেনি নীলু। পরদিন সকালেই রওনা হয়েছিল ডালিমদের বাড়ির উদ্দেশে, ওর মা আর ছোটবোন নাজনিনকে নিয়ে ফিরে এসেছিল বিকেলেই। বারান্দায় বসে ছিল ডালিম, মা-বোনকে দেখে প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। মা-বোনকে পেয়ে ডালিমের সে কী কান্না জড়ানো আনন্দ, দশ বছরের বালিকা বনে গিয়েছিল সে! অনেকদিন পর মা আর সন্তানের মিলনের দৃশ্য নীলু অনেক দেখেছে তাদের গ্রামে, ভবিষ্যতে হয়তো আরও দেখবে, কিন্তু ডালিম আর তার মায়ের মিলনের দৃশ্যের প্রতিটি মুহূর্ত অবলোকন করা তার জীবনের এক দূর্লভ প্রাপ্তি, সারাজীবন ভাস্বর হয়ে থাকবে তার হৃদয়ে। এরপর আরও কয়েকবার ডালিমের মাকে নিয়ে এসেছিল নীলু। এসে কয়েকদিন থাকতেন, নিজহাতে রান্না করে খাওয়াতেন তাকে আর ডালিমকে। তারপর নীলু গিয়ে আবার রেখে আসতো ডালিমের মাকে।

তাই আজ মৃত ডালিমের জন্য ওদের গ্রামের মানুষের অশ্রু বিসর্জন উপহাসের মতো লেগেছে, ওই অশ্রুকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তার বান্ধবহারা ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়।

নীলুর খাওয়া শেষ হবার পর অনেকক্ষণ বসে রইলো রাঙাবউ। কখনও নীরবতায়, কখনও ডালিমের স্মৃতিচারণায় কাটতে লাগলো প্রহর। এক সময় রাঙাবউ বললো, ‘আমি আসি সখা।’

নীলুর একা হতে ইচ্ছে করছে না, রাঙাবউয়ের সঙ্গ চাইছে মন। রাঙাবউয়ের উপস্থিতিতে ব্যথানাশক বটিকা আছে। কিন্তু গভীররাতের কথা মাথায় রেখে তাকে বলতেই হলো, ‘চলো, তোমারে আগায়ে দিয়ে আসি।’

পুকুরপাড় পর্যন্ত রাঙাবউকে এগিয়ে দিয়ে এসে রেললাইনের ওপর মূক হয়ে বসে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো দীর্ঘক্ষণ!

(চলবে...)

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-এক)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৫:৫৩

ব্লগার_প্রান্ত বলেছেন: ঈদ মোবারক, মিরিন্ডা??

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৮:১৯

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৪

রাজীব নুর বলেছেন: শ্মশান কবরস্থান আমি খুব ভয় পাই।

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৮:২০

মিশু মিলন বলেছেন: শ্মশান-কবরস্থান আমার খুব ভাল লাগে। প্রায়ই একা একা গিয়ে বসে থাকি। অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করে ভেতরে।

৩| ২২ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩১

বর্ণা বলেছেন: দাদা রিদম আছে আপনার। লিখে যান।

২২ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৮:২১

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ। আমার ব্লগ আঙিনায় স্বাগতম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.