নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গাওয়াল (উপন্যাস: শেষ পর্ব)

২৬ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ১:২৪

ঘর অন্ধকার। লেপ গায়ে দিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে নীলু। সারা শরীরে ব্যথা, পুলিশের মারের ব্যথা উপশম না হতেই নাজিরদের পিটুনি খেয়ে শরীরে নতুন ব্যথার আগমন। বাঁ-পাশের চোয়াল আর নাকের পাঁটা ফুলে গেছে, ফুলে গেছে ঠোঁটও। কালচে হয়ে আছে আঘাতের জায়গাগুলো। বাম কাঁধটা ব্যথায় নাড়াতে পারছে না, বামদিকে কাত হয়ে শুতে গেলেই পাঁজরে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। সেই ছেলেবেলায় ঠাকুমার শিখিয়ে দেওয়া ছড়া বলে অন্যপাড়ার ছেলেদের হাতে সে মার খেয়েছিল। তারপর বহুদিন সে কারো হাতে মার খায়নি। শারীরিক কারণেই হোক আর নরম স্বভাবের কারণেই হোক সে সবসময় ঝগড়া-গণ্ডগোল এড়িয়ে চলেছে। তাকে ক্ষ্যাপলেও সে চুপ করে নিজের পথে চলেছে। একটু বড় হয়ে কখনও কখনও কারো কোনো কথার প্রতিবাদ করেছে ঠিকই কিন্তু মারামারি কখনও নয়। অবিরাম ধৈর্যশীলতার চর্চা করে গেছে। সেই ছেলেবেলার পর সেদিন পুলিশের হাতে মার খেয়েছে সে, অন্যায়ভাবে পুলিশ তাকে মেরেছে। আর আজ নাজির যখন তার মিতেকে নিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করে কথা বললো তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি সে। মিতের সাথে তার সম্পর্কে কোনো অপবিত্রতা ছিল না, ছিল অকৃত্রিম বন্ধুত্ব-ভালবাসা। তার উপর খুনিরা অকালেই শেষ করে দিয়েছে পৃথিবীতে মিতের গাওয়াল, বুকে এখনও মিতেকে হারানোর দগদগে ক্ষত। সেই ক্ষতের ওপর ইতর ইঙ্গিতে এমন কদর্য বাক্যাঘাত! তাই ধৈর্য হারিয়ে নাজিরকে কষে চড় মেরেছিল সে। নাজিরকে আঘাত করার সময় প্রত্যাঘাতের কথা মাথায় আসেনি। আঘাতের বিপরীতে কয়েকগুণ বেশি প্রত্যাঘাত ফিরে এলেও এখন তার ভাল লাগছে এই ভেবে যে, মিতের সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ককে অসম্মান করার প্রতিবাদ করতে পেরেছে সে।

পায়ের শব্দে মুখ তুললো নীলু, রাঙাবউ ঘরে ঢুকে বললো, ‘ঘুমায়ে পড়িছো সখা?’
‘না।’ উঠে বসলো নীলু।

রাঙাবউ নিজেই লাইট জ্বাললো। তারপর বিছানায় বসে নীলুর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ইস! মুখখানের কী অবস্থা করিছে! কুকুরগুলো ক্ষেপলো ক্যান তোমার ওপর?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো নীলু, তারপর বললো, ‘মিতে আর আমারে নিয়ে খারাপ কথা কইছিল।’
‘তারপর?’
‘আমি আর ধৈর্য ধরে রাখপার পারি নাই। নাজিররে চড় মারছিলাম।’
‘কী দরকার ছিল চড় মারার? জানোই তো ওরা খারাপ।’
‘কী করবো কও! এমন খারাপ কথা কোলো যে মাথায় রক্ত উঠে গেল!’
‘তাই বলে ওগের সাথে কেউ লাগতি যায়! ওরা তো মানুষ না, জানোয়ার!’
চুপ করে রইলো নীলু। কয়েক মুহূর্ত পর বললো, ‘তুমি কেমন করে জানলে?’
‘পাড়ার লোকজন দেখিছে তোমারে মারতি। ওরাই কচ্ছিল। রাতে খেয়েছ?’
‘হে।’
‘ইস, এই কয়দিনে শরীরের কী হাল হয়ছে! থানায় খাতি-টাতি দিতো না ঠিকমতো?’
‘দিতো।’

তারপর রাঙাবউয়ের প্রশ্নের জবাবে গত পাঁচদিন থানায় এবং হাসপাতালে তার দিবারাত্রি কীভাবে কেটেছে সে-সবের বিস্তারিত রাঙাবউকে জানালো। শুনতে শুনতে রাঙাবউয়ের চোখ থেকে জল ঝরে পড়লো। নীলুর কপালে হাত রেখে পরীক্ষা করে দেখলো জ্বরের রেশ এখনো আছে কি-না। তারপর নেমে এলো নীরবতা, মাঝে একটা-দুটো কথা, আবার নীরবতা। জলভরা চোখে রাঙাবউ তাকিয়ে রইলো ঘরের উত্তর দিকের সেলফের থাকে সাজানো ভাস্কর্যের দিকে। ভাস্করের চোখে নীলু রাঙাবউয়ের দিকে তাকালো, শরীরে জড়ানো কালো চাদর। চাদরের ঘোমটা ছিল মাথায়, বৃন্তচ্যূত ফুলের মতো পিঠে এলিয়ে পড়েছে ঘোমটা। খোলা চুলের বেশিরভাগ অংশই চাদরের আড়ালে। মুখের বাম পাশটা দেখা যাচ্ছে। বামপাশ থেকে রাঙাবউকে বরাবরই দারুণ দেখায়! কিন্তু বৈদ্যুতিক আলোয় একটু পিছন থেকে এভাবে আগে কখনো দ্যাখেনি সে, অথবা দেখলেও তা অবচেতনে, আজকের মতো সচেতন শিল্পীর চোখে নয়। আজ খাড়া নাকের অদেখা এবং আলাদা সৌন্ধর্য ধরা পড়েছে তার চোখের চিরায়ত ক্যামেরায়। কেবল মুখের অর্ধেকটা দৃষ্টিগোচর হলেও তার ঠোঁটের অর্ধাংশে লেগে থাকা দুঃখ পাঠ করতে পারলো নীলুর অনুসন্ধিৎসু চোখ ও অনুভূতিপ্রবণ চিত্ত, উদ্ধার করতে পারলো তার হৃদয়সমাচার। এই মুহূর্তে দেখা রাঙাবউয়ের রূপ নীলু অন্তরে খোদাই করে নিলো দ্রুত, নব উন্মোচিত এই রূপ পরে প্রকাশ করবে কাঠ খোদাই করে।

মুখ ফেরালো রাঙাবউ, ‘কাল আমার কাকা আমারে নিতি আসবি, আমি পরশুদিন বাবার বাড়ি যাব।’
একথা শুনে নীলুর মনে মেঘ জমলেও মুখশ্রীতে তা প্রকাশ পেলো না। কেবল প্রশ্ন করলো, ‘বেড়াবার?’
‘আমার জেঠতুতো দাদার ছেলের অন্নপ্রাশন।’
‘কয়দিন থাকপা?’

‘বলিছে অন্নপ্রাশনের দুইদিন পরই চলে আসতি। আমি আসপোনানে। কদ্দিন পর যাচ্ছি। সব ভাই-বোনেরা অ্যাদ্দিন পর এক জায়গা হবো। দুটে দিন কাটাবো না ওগের সাথে! কাছে থাকলি লাথি মারে দূরে সরায়ে রাখে। আবার দূরি যায়ে কয়টা দিন শান্তিতি থাকপো, সে উপায়ও নেই। বাইরের লোকে দেখলি ভাববি, বউ অন্তপ্রাণ মানুষ। বউরে বাপের বাড়ি যাতি দিতি চায় না, নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে রাখতি চায়। হুম! বুক থাকলি তো আঁকড়ে ধরবি! ঘাড়ে ধরে সংসারের কাজ করানোর জন্য যাতি দিতি চায় না। এরা তো বিয়ে করে বউ আনে না। আনে দাসী। দাসী বাড়িতি সকাল থেকে রাত অব্দি খাটপি, বুড়ো বাপ-মায়ের হাগা-মুতা পরিষ্কার করবি। আর বাবুরা ফুর্তি করে বেড়াবি। আমি দিন দশেক থাকে আসপোনে।’

নীলু চুপ করে শুনতে লাগলো রাঙাবউয়ের কথা। রাঙাবউয়ের ভেতরের ক্ষোভ ঝরে পড়ছে কথা হয়ে। নিশ্চয় তপন তাকে অপমান করেছে। অবশ্য তপন সর্বদাই রাঙাবউকে অপমান করে। কিন্তু যেদিন খুব বেশি আঁতে ঘা লাগে রাঙাবউয়ের, সেদিন সে অনর্গল কথা বলে যায়। সেদিন নীলু কেবল শুনে যায় তার রাঙাবউয়ের ব্যথার শোহিনি।

রাঙাবউ আবার মুখ খুললো, ‘ঐ মাগিটারে এনে রাখতি চাইছিল। আমি কায়দা করে আমার ছোট ননদরে রাজি করাইছি। কাল সকালেই আসপি আমার ননদ। এই নিয়ে আমার সাথে সে কী চোটপাট! ক্যান আমি আমার ননদরে আসতি বললাম? ননদরে আসতি বলবো না তো কী করবো, ওই মাগিরে এনে আমার সংসারের পাটরানি করে রাখবো!’

রাঙাবউ দম নিয়ে বললো, ‘ননদরে আসতি বলিছি, বেশ করিছি। তারপরও যদি ওই মাগিটারে এনে ছিনালি করতি হয়, তো বোনের সামনে করুক। বোন দেখুক দাদার কু-কীর্তি!’

এই মোক্ষম কাজটি সফলভবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে তপনকে জব্দ করে যেমন স্বস্তি পেয়েছে, তেমনি তার সখার কাছে বলেও যেন দারুণ তৃপ্তি লাভ করলো রাঙাবউ।
নীলু বললো, ‘তোমার ছোট ননদটার ব্যবহার খুব ভাল।’

যেন নাক ঝাড়লো রাঙাবউ, ‘ভাল না ছাই! বাইরে থেকে দেকলি অমনই মনে হয়। তবু বড়টার চেয়ে ভাল। বড়টা যেন শয়তানের ডিম ফুটে বের হয়ছে! বড়টা ভাইয়ের কু-কীর্তির কথা জেনেও ভাইয়ের পক্ষে কথা কয়। ভাইয়ের কাছে আমার নামে নানান রকম কান ভাঙানি দেয়। আর আমারে বলে, পুরুষ মানুষ চুলে বেঁধে রাখতি জানতি হয়। কী আমার তন্ত্র সাধিকা রে! পেয়েছিলি তো একটা ভ্যাদামাছ বর, নাচিয়ে নিলি! এরকম রাক্ষুসে হাঙর একটা জুটতো কপালে, তখন বুঝতাম তোর তন্ত্রের ক্ষমতা!’

হঠাৎ যেন রাঙাবউয়ের স্মরণ হলো তার সখার শরীর ভাল না। মনে মনে সে লজ্জিত হলো খুব। প্রসঙ্গ বদলালো, ‘তুমি সময় মতো খাওয়া-দাওয়া কোরো সখা। তোমার যে ভুলো মন, ওষুধ খাতি আবার ভুলে যেয়ো না যেন! অসময়ে ডালিমদি এসে থাকতো, এখন তো সেও নেই। এজন্যই বলি, তোমার এখন বিয়ে করা দরকার।’

‘বিয়ে করলি আমার বউ যদি তোমারে আসতি বারণ করে?’
‘ইস, বারণ করলেই যেন আমি শুনবো!’
‘ধরো, আমার বউ খুবই ঈর্ষাকাতর হলো...’
বাক্য শেষ করতে পারলো না নীলু, রাঙাবউ বললো, ‘হুম..., ঈর্ষা! ঈর্ষা আমারও আছে!
‘তোমারও ঈর্ষা আছে রাঙাবউ! তুমি কাউকে ঈর্ষা করতে জানো?’
‘থাকপিনে ক্যান ঈর্ষা? আমি তো মানুষ, দেব-দেবীদেরও ঈর্ষা ছিল।’
‘কারে ঈর্ষা করো তুমি?’
‘শুনবা আমার ঈর্ষার গল্প? না, এখন তোমারে বলবো না, হয়তো কোনোদিনই বলবো না।’

কয়েক পলকের বিরতি দিয়ে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাঙাবউ আবার বললো, ‘অনেক রাত হলো, তোমার শরীর খারাপ। এখন তুমি ঘুমাও সখা। তোমার ঘুম দরকার। নবিয়াল আর ফারুক ধরা পড়ায় ওদের চ্যালাগুলো ক্ষ্যাপা কুকুর হয়ে আছে। তুমি কারো কোনো কথার উত্তর দিতি যেও না। আর বেশি ঝামেলা করলি দীপালিদের সঙ্গে নিয়ে থানায় যায়ে নালিশ কোরো। সাবধানে থেকো। খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো কোরো।’

নীলুর ছাড়া পাবার খবর কানে শোনামাত্র সস্ত্রীক ছুটে এসেছিল ননী গোপাল। ননী অবশ্য থানাতেও গিয়েছিল দেখা করার জন্য, কিন্তু পুলিশ তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। কেবল ননী নয়, চেনা-জানা আরো অনেকেই এসেছিল তাকে দেখতে। এর মধ্যে একদিন পঞ্চমী মাসিমার বাড়িতে গিয়েছিল ইব্রাহিমের সাইকেলে চেপে। লোকমুখে তার গ্রেফতারের খবর শুনে উতলা হয়ে ছিলেন মাসিমা। তার ছাড়া পাবার খবর শোনামাত্র ইব্রাহিমকে পাঠিয়েছিলেন তাকে নিতে। তাকে পেয়ে প্রথমে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চোখের জল ফেলেছিলেন, তারপর উদ্ধার করেছিলেন পুলিশের চৌদ্দগুষ্টি!

রাঙাবউ বাবার বাড়িতে যাওয়ার আজ আটদিন হলো, অথচ নীলুর মনে হচ্ছে সে যেন কতোকাল রাঙাবউকে দ্যাখে না! মনে হচ্ছে রাঙাবউ বহুদূরে চলে গেছে। শরীরটা একটু ভাল বোধ করায় আবার কাজ শুরু করেছে সে, বারান্দায় বসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে উত্তরের দিকে তাকায়। তার সকালটা মুখভার করে থাকে, তার দুপুরটা ম্রিয়মাণ হাসি ঝুলিয়ে রাখে ঠোঁটে, তার রাত্রির কান্না যেন শিশির হয়ে ঝরে পড়ে! রাঙাবউ এখানে নেই, মিতে কোথাও নেই; কণিকা কোথায় কোন যাত্রামঞ্চে নৃত্যের ঝড় তুলছে জানে না সে। কাল রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ায় অবচেতনেই হাত থেমে গেল তার, হাতুরি-বাটালি খসে পড়লো মেঝেতে, উত্তরের শীতল হাওয়ায় মনটাকে ভাসিয়ে দিলো ডালিমের উদ্দেশে!

এই নিয়ে চারবার স্বপ্নে দেখেছে ডালিমকে। একদম জীবন্ত ডালিম! সেই একই রকম শাড়ি পরা, মাথায় কাঠগোলাপ গোঁজা, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। গান গাইতে গাইতে, হাসতে হাসতে যেমনি আসতো তেমনি এসেছিল। ছাইরঙা শাড়ি প’রে নৌকার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে ডালিম তাকে ডেকেছিল, ‘মিতে আসো, নৌকায় চড়বা না?’

সে বলেছিল, ‘তোমার সাথে নৌকায় কেমন করে চড়বো মিতে? তুমি তো মরে গেছো।’
‘ধুর, কিডা কোলো আমি মরে গিছি! আমার মরণ নাই, আমি যমেরও অরুচি! আসো, আজ আমি নৌকা বায়ে তোমারে ঐ পাড়ে নিয়ে যাব।’

যাবে কি যাবে না এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার। তখন মাঝরাত, ভয় লাগছিল খুব। বাকি রাত বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিল ঘরে। মৃত মানুষ স্বপ্নে এসে ডাকলে গভীররাতে কিংবা ভোবেলায় ঘুম ভাঙার পর তার মা আর ঠাকুমা প্রায় চেঁচিয়ে বলতো, ‘আমারে ডাহো ক্যা মুখপুড়া শত্তুর! ছাওয়ালপান থুয়ে আমি কোন চুলোয় যাব! ফের যদি ডাহো তো গু মাহা শলা-বারুনদে ঝাড়ে দেব। শত্তুরির মুহি ছাই, দূর অ, দূর অ শত্তুর!’

মা-ঠাকুমার মুখেই শোনা, মৃতের আত্মা নাকি দোসর খোঁজে, তাই স্বপ্নের মধ্যে এসে এমন করে ডাকে; বকাঝকা করলে মৃতের আত্মা দূরে চলে যায়! কেবল স্বপ্নে নয়, বাস্তবেও নাকি মৃতের আত্মা আসে! মানুষ মারা যাবার পর মৃতের আত্মা নাকি কিছুদিন কাকের আত্মায় ভর করে, তখন মায়ার টানে আম-আমড়া কি জামগাছের ডালে বসে আত্মীয় কিংবা পরিচিতজনদের দিকে তাকিয়ে অনবরত কা কা স্বরে ডেকে যায়! এই কাকদেরও দূর দূর করে তাড়াতো নীলুর মা-ঠাকুমা। ঠাকুমা মারা যাবার পর তার বাবা যখন কলার খোলায় হবিষ্যান্ন নিয়ে কাকের পিছু পিছু ঘরতো তখন সেও তার বাবার পিছু নিতো। কাক দেখলেই মতে হতো ওই বুঝি তার ঠাকুমা! তারপর বাবার নামিয়ে রাখা কলার খোলার হবিষ্যান্ন যখন কাক গপগপ করে খেতো তখন ঠাকুমা ভেবে জলভরা চোখে সে তাকিয়ে থাকতো কাকের দিকে! নীলুর এখন মনে হয় সেসব নিছকই বানানো কথা। তবু শিমুল কিংবা কাঁঠালগাছের ডালে বসে কখনো কাক ডাকলে সে কাকের দিকে তাকায়, ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। বন্ধুবিরহে তার আর্দ্র হৃদয় ক্ষণিকের জন্য সংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে কিনা কে জানে! তবে সে কাককে তাড়ায় না। এমনকি স্বপ্নের ভেতর ডালিম তাকে দেখলেও ঘুম ভাঙার পর কখনো বলে না, ‘দূর অ শত্তুর!’ প্রাণের বন্ধুকে সে কী করে শত্তুর বলবে!

এই বিষন্ন দিনযাপনের মধ্যেই আরেক প্রতিকূল বার্তা তার হৃদয়কে যেন বিষিয়ে তুললো। একদিন বিকেলে স্টেশন মাস্টার এসে জানালো তাকে স্টেশন ছেড়ে দিতে হবে। এই কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া লাইনে আবার ট্রেন চালু হবে, কাজ শুরু হবে শীঘ্রই; সে যেন এ মাসের মধ্যেই স্টেশন ছেড়ে দেয়।

এই লাইনে আবার ট্রেন চালু হবে এটা অনেকদিন ধরেই এলাকার মানুষের আলোচনার বিষয়, কিন্তু কাজ শীঘ্র শুরু হবে এমন আলোচনা কোথাও শোনা যায়নি। আর এই স্টেশনটি পুনরায় চালু হবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়, শোনা যাচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ এই স্টেশনটি আর চালু করবে না। আর যদিবা চালু করেও তা এখনো অনেক দেরি, কেননা এখনো লাইনের কাজই শুরু হয়নি, এ পর্যন্ত আসতেও তো কয়েক মাস লেগে যাবার কথা। অথচ তার মাস্টার কাকা তাকে এ মাসেই স্টেশন ছেড়ে দিতে বলেছে। অনুরোধ করলেও সময় দিতে নারাজ তিনি। মাস্টার কাকার ব্যবহারও হঠাৎ পাল্টে গেছে। রাস্তায় দেখা হলে সে আগের মতোই আন্তরিকভাবে কথা বলে, কিন্তু মাস্টারকাকার চোখে-মুখে কেমন বিব্রতভাব প্রকাশ পায় আর তিনি দু-চার শব্দের বেশি ব্যয় করেন না। সেই দু-চার শব্দ প্রক্ষেপণেও তার অনীহা স্পষ্ট বোঝা যায় এবং তার এই ব্যবহার যে আরোপিত তাও অস্পষ্ট থাকে না। ফলে এর মধ্যে অন্য কোনো কালো হাতের ছায়া দেখতে পায় নীলু! তার মনে হয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাস্টার কাকা তাকে স্টেশন থেকে বিতাড়িত করছে অন্য কারো চাপে। একবার তার মনে হয়েছিল শোভনকে ফোন করে জানাবে, তারপর নিজেই মত বদলেছে; তার জন্য মাস্টার কাকা কোনো ঝামেলায় পড়ুক তা সে চায় না।

একে তো মাঘের শীতের রাত, তার ওপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ধুন আর উত্তরে বাতাসের ধুয়োয় শীতও কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে ঘুঙুর বেঁধে পায়ে মানুষের শরীর কাঁপাচ্ছে তার কলা নৈপূণ্যে! নীলু দরজা বন্ধ করে সবে লেপের নিচে ঢুকেছে, গা এখনো গরম হয়নি; এমন সময় দরজায় শব্দ হলো।

‘সখা ঘুমায়ে পড়িছ? সখা...’

রাঙাবউ বাবার বাড়িতে দশদিন থেকে গতকাল বিকেলে এসেছে তা সে জানে, শুনেছে সাজুর মুখে। কিন্তু এমন জড়াজড়ি করা শীত আর বৃষ্টির রাতে রাঙাবউ আসবে তা আশা করেনি সে। উঠে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দরজা খুলে দিতেই গা-মাথা চাদরে মুড়ে ঘরে ঢুকলো রাঙাবউ, ‘বাইরের লাইটা বন্ধ করে রাখতি পারো না!’

‘আমি কী জানি যে এই শীতের মইদ্যে বৃষ্টি মাথায় করে আমার রাঙাবউ আসপি!’ দরজা বন্ধ করে দিলো নীলু।
রাঙাবউ চাদরের নিচ থেকে ছোট প্লেটে ঢাকা দেওয়া একটা বাটি নীলুর হাতে দিয়ে বললো, ‘দাদার ছেলের অন্নপ্রাশনের মিষ্টি। খেয়ে আশির্বাদ কোরো ছেলেটাকে।’

নীলু বাটিটা টেবিলের ওপর রেখে বিছানায় এসে বসলো। রাঙাবউয়ের চাদরটা বেশ ভিজে গেছে। খুলে রেখে দিয়ে নীলুর গামছা দিয়ে মুখের জল মুছতে লাগলো। নীলু বললো, ‘ছাতা নিয়ে আসপার পারো নাই?’

‘হুম! বেশ বুদ্ধি তোমার। তারপর ঘরে ফিরে ভেজা ছাতা আমি কই রাখপো!’

গামছাটা রেখে দিয়ে ঘুরে তাকাতেই রাঙাবউয়ের কপালের কালশিটে দাগটা দেখতে পেল নীলু। দাগের দিকে তাকিয়ে সে বললো, ‘কপালে কী অইছে তোমার রাঙাবউ?’

‘তুমি আমায় এমন করে দ্যাখো কেন কও তো? কিচ্ছুটি লুকোনোর কায়দা নেই তোমার কাছে!’

আগে হলে নীলু লজ্জা পেতো। এখন আর রাঙাবউয়ের কাছে সেই লজ্জার আবরণটি নেই। আছে একে-অন্যের প্রতি সরস রসিকতার স্ফুরণ, ‘সখার কাছে লুকোনোর দরকারই বা কী!’

‘হুম! সখার কাছে লুকোনোর দরকারই বা কী!’ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে মৃদু হাসলো রাঙাবউ। তারপর আবার বললো, ‘বেশ আমার সখা হয়েছ। রাঙাবউয়ের মনের খবর রাখো কিছু? বোঝ রাঙাবউয়ের মনের গোপন কথা? কিচ্ছুটি বোঝ না তুমি!’
‘খুব বুঝি আমি রাঙাবউয়ের মনের কথা।’

নীলু বললো বটে, কিন্তু অপরাধীর মতো ভাবতে লাগলো। সে কি সত্যিই রাঙাবউয়ের মনের খবর রাখে না? বোঝে না রাঙাবউয়ের গোপন কথা? রাঙাবউয়ের সব কথাই তো সে জানে। দুঃখ, কষ্ট, যাতনার সব খবরই তো সে রাখে। রাঙাবউয়ের ব্যথায় সে ব্যথিত হয়। তার মতো করে আর কে বোঝে রাঙাবউকে! তবে যে রাঙাবউ বললো, ‘কিচ্ছুটি বোঝ না তুমি!’ ভাবনার তল খুঁজে পেলো না সে।

সে বললো, ‘কইলে না, কপালে কিসের দাগ?’
‘আলপনা, কপালে সংসারের আলপনা!’ বিছানায় বসে রাঙাবউ এমন স্বাভাবিক গলায় কথাগুলো বললো যেন সত্যিই পৌষ সংক্রান্তির উঠোনের আলপনা কপালে তুলে নিয়েছে সে!

‘আলপনা মানে?’
‘আলপনা মানে আলপনা। অনেক সুখে সংসার করতিছি তো আমি, বর শুধু ভালবেসেই ক্ষান্ত হয় না, কপালে ভালবেসে আলপনাও এঁকে দেয়!’

তপন আবার রাঙাবউয়ের গায়ে হাত তুলেছে! রাঙাবউয়ের মার খাওয়ার কথা শুনলেই তার শান্ত মন ক্রোধ আর ঘৃণায় বিচলিত হয়, ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে পড়ে; ক্রোধ, ঘৃণা আর উত্তেজনার ছায়া পড়ে তার মুখেও। বরাবরই সেটা ধরা পড়ে রাঙাবউয়ের চোখে। সখার মুখের এই আচম্বিত পরিবর্তন দেখে ভাল লাগে রাঙাবউয়ের। সে তার নিজের বরের সম্বন্ধে পুনঃপুনঃ বিষোধাগার করে সখাকে আরো তাতায়। তারপর কথার বারুদবিন্যাস শেষে সখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বিস্ফোরণ দেখার অপেক্ষায়, কিন্তু কখনোই যেন বিস্ফোরণ তার আশানুরূপ হয় না। সখা তার বরকে অমানুষ, নরপশু, জানোয়ার ইত্যাদি গালি দেয়; তবু রাঙাবউ আশাহত হয়ে একবুক অভিমান নিয়ে ফিরে যায়। এরপর বেশ কিছুদিন আর স্টেশনমুখো হয় না। নীলু বোঝে যে রাঙাবউ কোনো কারণে তার ওপর অভিমান করেছে, কিন্তু ঠিক কী কারণে অভিমান করেছে তা বুঝতে পারে না অথবা বুঝলেও সে বিষয়ে মৌন থাকে।

ক্রোধজড়ানো স্বরে নীলু প্রশ্ন করলো, ‘আবার গায়ে হাত তুললো ক্যান নরপশুটা?’

‘অন্নপ্রাশনের দুইদিন পর চলে আসতি বলছিল। আমি আরো তিনদিন বেশি থাকে আসছি, তার পুরস্কার পাব না! আলপনা এঁকে সেই পুরস্কার দিয়েছে আমায়!’ রাঙাবউ এমন শান্তভাবে কথাটা বললো যেন এমনটাই হবার কথা ছিল এবং ব্যাপারটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।

নীলু দু-চোখের ক্ষোভ লুকোতে বন্ধ জানালার পাল্লার দিকে তাকালো। টিনের বেড়ায় একটা টিকটিকি আরেকটা টিকটিকিকে তাড়া করছে। ওরা কি দম্পতি, নাকি দু-জনেই পুরুষ, একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী? পিছনের টিকটিকিটা দূরত্ব ঘুচিয়ে সামনেরটার অনেক কাছে চলে গেল। সামনেরটা নিচের দিকে নেমে চকির আড়ালে চলে গেলে পিছনেরটাও সেটাকে অনুসরণ করলো আর কিছুক্ষণ পর একটার ডাক শোনা গেল। পিছনের টিকটিকিটা কী সত্যিই সামনেরটাকে তাড়া করলো, নাকি সামনেরটার প্রেমময় ইঙ্গিতে সাড়া দিয়ে তার পিছু নিলো! আর ওই ডাক কী শীৎকার নাকি আর্তনাদ! টিকটিকি দুটোর ভাবনা ঝেড়ে ফেলে এখন ভেতরে কথা সাজাতে লাগলো সে; এই স্টেশন ছেড়ে, এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার কথা।

দু-জনেই কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর নৈঃশব্দ ভাঙলো রাঙাবউ, ‘তোমার শরীর এখন কেমন?’
নীলু দৃষ্টি ফেরালো রাঙাবউয়ের কাটা দাগের ওপর, ‘ভাল।’
‘এমন চালকুমরোর মতো মুখ ভার করে আছো কেন, মাইর মনে হয় আমি নতুন খাইছি!’
‘রাঙাবউ!’ আলতো স্বরে বললো নীলু।

রাঙাবউ তার দিকে তাকিয়েই ছিল, নীলু অন্যদিকে তাকিয়ে স্টেশন মাস্টারের কথাগুলো শোনালো রাঙাবউকে। তারপর অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বললো না। রাঙাবউ মূক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার সখার দিকে। আর সখা পুনরায় বেড়ায় দৃষ্টি রাখলো হয়তো টিকটিকি দুটোকে দেখার আশায়!

‘তুমি কী ঠিক করলে?’ নীরবতা ভাঙলো রাঙাবউ।
‘চলে যাওয়া ছাড়া তো আর কোনো উপায় নাই।’
‘কই যাবা?’

‘জানিনে। দুই চোখ যেদিক যায় চলে যাব। আমার জীবনডা মনে অয় এমনই। শিকড় গাড়ে কোনো জায়গা থাহা আমার কপালে নাই। শিকড়বিহীন মানুষ আমি এক, যাযাবর।’

নীলুর চোখ ছলছল করে উঠলো। রাঙাবউয়ের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না।
‘আর তোমার রাঙাবউয়ের কী হবি?’

নীলু চুপ করে রইলো। তার হৃৎপিণ্ড যেন আছাড় পড়ছে শিশুর হাতের রাবারের বলের মতো। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাঙাবউ বললো, ‘বললাম না সখা, তুমি কিচ্ছুটি বোঝ না! তুমি তোমার রাঙাবউয়ের মনের খবর রাখো না। আমি আসি সখা।’

রাঙাবউ উঠে চলে যাবার উদ্যোগ করতেই নীলু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার হাত টেনে ধরে বললো, ‘শোন রাঙাবউ, তুমি অন্তত ভুল বুঝো না।’

‘ভুল বুঝবো কেন? ভুল বুঝতি হলি কোনো একটা সম্পর্ক থাকতি হয়, তুমি আমার কে?’
‘এমন কথা কবার পারলে তুমি?’
‘সব কওয়ার অধিকার কী কেবল পুরুষের সখা, মেয়েদের নেই! তুমি এতো সহজেই চলে যাবার কথা বলতি পারলি আমি বলতি পারবো না ক্যান?’

নীলু রাঙাবউয়ের হাত ধরে তাকে বিছানায় বসালো। এতোক্ষণের আটকে রাখা কান্না এবার ছিটকে বের হলো রাঙাবউয়ের বুকের ভেতর থেকে। বিমূঢ় নীলু রাঙাবউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো অপরাধীর মতো। আপনমনে কাঁদতে কাঁদতে রাঙাবউ তার বুকের ব্যথা উগড়ে দিলো, ‘স্বয়ং রামচন্দ্র থেকে নীলকান্ত, তোমরা সব পুরুষরাই এক; শুধু নিজেরটা ভাল বোঝ কিন্তু অন্যের মন বোঝনা! আর যদিবা বোঝ পৌরুষের অন্ধ অহংকারে তার মূল্য দাও না।’

রাঙাবউ ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে, নীলুও একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে; কী বলবে তা সে ভেবে পাচ্ছে না, কেবল বুঝতে পারছে যে চলে যাবার কথা বলে সে রাঙাবউকে ভীষণ দুঃখ দিয়েছে, নইলে রাঙাবউ এমন করে কাঁদতো না। রাঙাবউয়ের আকস্মিক কান্নায় সে বিচলিত, একেকটি অশ্রুফোটা হাজারো শিলাখণ্ড হয়ে ঝরে পড়ছে তার হৃদশস্যভূমিতে! রাঙাবউয়ের কান্নার অবসরে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো সে, রাঙাবউ তার কে? রাঙাবউ তার বিবাহিত স্ত্রী যেমন নয়, তেমনি নয় গোপন প্রণয়িনী। তবে রাঙাবউ তার কে? কেন রাঙাবউকে দেখার জন্য তার মন উচাটন হয়, কেন রাঙাবউ এলে সে জগতের সকল দুঃখ ভুলে যায়, কেন রাঙাবউ এলে চারিদিকের অসংখ্য নির্দয় মানুষের ভিড়েও অনন্তকাল বেঁচে থাকার বাসনা জাগে তার মনে, তপন রাঙাবউকে মারলে কেন তার হৃদয়ে দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে, অভিমান করে কিছুদিন রাঙাবউ তার কাছে না এলে কেন তার মনে হয় জীবন অর্থহীন আর মরে যেতে ইচ্ছে করে? রাঙাবউয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের পরিচয় কী? না, রাঙাবউয়ের সাথে তার যে সম্পর্ক তা জগতের প্রথাগত কোনো সম্পর্কের ছাঁচেই পড়ে না, এই সম্পর্কের জন্য গড়তে হবে নতুন সম্পর্কের ছাঁচ। পরিচয়হীন এক সম্পর্ক অথচ শিকড় প্রোথিত দু-জনের হৃদয়ের গভীরে। তারা দু-জনেই দুঃখী, একে অন্যের দুঃখসারথি। বন্ধু নয়, বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু। রাঙাবউ তার শিল্প সৃষ্টির পিছনের শক্তি, তার অনুপ্রেরণা; তার অগোছালো হৃদয়ের বিন্যাসকারী। আবার সেও অনেক যত্নে আগলায় রাঙাবউয়ের হৃদয়ের ক্ষত; কথা, সানাইয়ের সুর আর গানের অকৃত্রিম বটিকার শুশ্রূষায় উপশম করে ক্ষত’র ব্যথা। ঝোঁকের বশে চলে যাবার কথা বলে ফেলার পর এখন মনোভূমির গভীরে মনোনিবেশ করে নিজেই বুঝতে পারছে রাঙাবউ ছাড়া সে নিঃস্ব, ঝড়ের মুখের কলাগাছের মতো অসহায়; তার চারিদিক ধূসর, শূন্য, হাহাকারময়!

রাঙাবউয়ের কান্নার দমক কিছুটা কমলেও অধর বেয়ে গড়াতে লাগলো জল, ‘কণ্ঠস্বরে এখনো কান্নার রেশ, ‘তুমি সেদিন আমার ঈর্ষার কথা শুনতে চেয়েছিলে না, শুনবা আমার সেই ঈর্ষার গল্প?’

নীলু রাঙাবউয়ের জলভরা দুটি চোখের দিকে তাকালে সে আবার বলতে শুরু করলো, ‘ডালিমরে আমি ঈর্ষা করতাম, ভাবতাম ডালিমের সাথে তোমার প্রেমের সম্পর্ক! ডালিমও ভাবতো আমার নারীদেহের কাছে তার পরাজয় ঘটেছে, আমি তার মিতের দখল নিয়েছি। একদিন দুপুরবেলা আমার ঘরে বসে ডালিমের সাথে অনেক কথা হয় তোমারে নিয়ে। সেদিনই আমি জানলাম ডালিমের সাথে তোমার কোনো গোপন প্রেমের সম্পর্ক নেই, ডালিমও জানলো আমার কাছে তার পরাজয় হয়নি; আমাদের দু-জনের কাছেই তুমি সমান। ডালিম আমায় বলতো, “জানো রাঙাবউ, মিতে আমার সাধুপুরুষ। পাশাপাশি শুয়ে থাকি, মিতে ভুল করেও কোনোদিন আমার শরীরে হাত দেয় না।” সেই থেকে তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গিয়েছে, বেড়ে গিয়েছে মায়াও।’

রাঙাবউ আঁচলে নাক মুছে আবার বলতে লাগলো, ‘আমি ক্যান ডালিমরে ঈর্ষা করতাম সখা, বলতি পারো? কখনো আমার মনের অতলে ডুব দিয়ে দেখিছ, আমি কী চাই? তুমি তো সাধুপুরুষ! তাই বুঝতি পারো না স্বামী-সোহাগ বঞ্চিত, দিনের পর দিন রাতের পর রাত স্বামীর হাতে শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতিত এক কুলবধু সুযোগ পেলেই পরপুরুষের কাছে ক্যান ছুটে আসে; স্বামীর খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে, স্বামীকে ঘুম পাড়িয়ে কলঙ্কের ভয় উপেক্ষা করেও যুবতী কুলবধু ক্যান পরপুরুষের ঘরে বসে রাত ভোর করে! সাধুপুরুষ তুমি, যাও যেদিকে দু-চোখ যায় চলে যাও, যেখানে মন চায় চলে যাও; কেউ তোমারে বাঁধা দিবিনানে। আমার আর কী, যে ক’দিন স্বামীর গালমন্দ-মারধর খেয়ে টিকে থাকতি পারি থাকি, আর যেদিন সহ্যের সীমা ছাড়ায়ে যাবি সেদিন একমুঠো ঘুমের ওষুধ খেয়ে জনমের ঘুম ঘুমায়ে থাকপো। যাও তুমি, যেখানে খুশি যাও।’

নীলুর চোখ থেকে অশ্রু ঝরে চিবুকে জমেছে, জলভরা চোখে তাকিয়ে আছে রাঙাবউয়ের দিকে। দু-পা এগিয়ে তার ছোট ছোট আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় রাঙাবউয়ের কপোলের জল মুছে দিলো। রাঙাবউ যেমনি পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে ছিল, তেমনি রইলো। নীলু বললো, ‘রাঙাবউ!’

মৌন রাঙাবউ আর্দ্রচোখে তাকালো তার সখার দিকে। নীলু রাঙাবউয়ের হাত দুটো ধরলো। রাঙাবউয়ের চোখের মণিতে সে যেন দেখতে পেল মুক্তির আকাক্সক্ষায় হাজারো বন্দী পাখির ডানা ঝাপটা-ঝাপটি, রক্ত ক্ষরণ! শক্তি খুঁজে পেল সে রাঙাবউয়ের চোখের দৃষ্টি থেকে। রাঙাবউয়ের দু-হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে বললো, ‘রাঙাবউ, যাবা তুমি আমার সাথে?’

‘কোথায়?’ সখার চোখ থেকে দৃষ্টি সরালো না রাঙাবউ।

লোকনিন্দার ভয়ে ভীত অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র বোধবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে নিজের বিবাহিত সন্তানসম্ভবা স্ত্রী সীতাদেবীকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন সীতাদেবী নির্দোষ জেনেও; আর একদা তারই ভক্ত নীলকান্ত লোকনিন্দার ভয় উপেক্ষা করে এক কুলবধূকে তার দুঃচরিত্র-অত্যাচারী বরের সংসারশৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করার জন্য বললো, ‘যেদিকে দু-চোখ যায়, অনেক দূরে চলে যাব আমরা! যে জায়গায় কেউ আমাগের চিনবিনে, জানবিনে; সেই জায়গা যায়ে ঘর বাঁধবো আমরা। আমার হয়তো খুব ধন-সম্পদ নাই। আমি সংসারের জটিলতা বুঝিনে, বুঝবারও চাইনে। কিন্তু যেমন মনের তুমি মানুষ চাও, তেমন মানুষ আমি হবার পারবো! আমি শক্ত ধাতু না, একতাল কাদামাটি। তোমার যেমন খুশি তেমনভাবেই আমারে গড়ে নিও। যাবা তুমি, রাঙাবউ?’

রাত্রির নিস্তব্ধতা খান খান করে হাসিতে ফেটে পড়লো রাঙাবউ, কান্না জড়ানো হাসি ঠোঁটে; আকাশে ডানামেলা হাজারো মুক্ত পাখির অপার আনন্দ দু-চোখে! ভুলে গেল সে এখন পরপুরুষের ঘরে, ভুলে গেল এই হাসির শব্দ কারো কানে গেলে তার কলঙ্ক হতে পারে, তার সখার বিপদ হতে পারে! স্বামী সোহাগ বঞ্চিত রাঙাবউ ভুলে গেল বিগত দিনের সকল লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, যাতনায় ভরা যাপিত জীবন; সব ভুলে হাসলো, হাসতে হাসতে কাঁদলো; কাঁদতে কাঁদতে আচমকা তার সখার বুকে মাথা রেখে দু-হাতে জড়িয়ে ধরলো সখাকে! কান্নার দমকে সখার বুকে মাথা ঘষতে ঘষতে দাঁতে কামড়ে ধরলো সখার জামার বোতাম, মাথার খোঁপা ভেঙে এলিয়ে পড়লো তার পিঠে। সখাও একহাত রাঙাবউয়ের মাথায় এবং আরেক হাত পিঠে রেখে শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো তাকে। সখার ছোট্ট বুকে রাঙাবউ সেই আকাশ খুঁজে পেলো, যে আকাশে সে কোনোদিন ডানা মেলে উড়তে পারেনি; সখার ছোট্ট বুকে সেই সমুদ্র খুঁজে পেলো, যে সমুদ্রে সে কোনোদিন অবগাহন করতে পারেনি; সখার ছোট্ট বুকে সেই অরণ্য খুঁজে পেলো, যে অরণ্যের ছায়ার স্পর্শ সে কোনোদিন পায়নি! হাজারো সুখের কৈতর সখার বুকের শীতল সরোবরে তৃষ্ণা মিটিয়ে উড়ে এসে বসলো তার হৃদবৃক্ষে! আলিঙ্গনাবদ্ধ থেকেই সে মুখ তুলে চাইলো সখার পানে, তার চোখে সখার চোখ, তার কপালের চূর্ণ চুলে সখার তপ্ত নিশ্বাসের উস্কানি; নিঃশব্দ তরঙ্গে সখার ঠোঁটজোড়া আছড়ে পড়লো রাঙাবউয়ের চঞ্চুর উপকুলে! রাঙাবউয়ের হৃদপাখিটা সখার হৃদয়াকাশে ডানা মেলে উঠলো ডেকে- আহা সুখ, আহা সুখ, এতোদিন কোথায় ছিলে!

সমাপ্ত
রচনাকাল-২০১১-১২

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-এক)

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ২:০৯

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:
সুন্দর।

২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১:০৪

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ২৬ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:০৫

শায়মা বলেছেন: অনেক সুন্দর ভাইয়া।

২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১:০৫

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ২৬ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:১২

স্বপ্নীল ফিরোজ বলেছেন:
ভালো লাগলো। পুরোটাই পড়ার ইচ্ছা রাখি।
শুভেচ্ছা।

২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১:০৬

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। আপনাকেও শুভেচ্ছা.....

৪| ২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ২:১৫

রাজীব নুর বলেছেন: আশা করি গাওয়াল আগামী বছর বইমেলাতে বের হবে। তখন আরাম করে একটানা পড়া যাবে।

২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:০৫

মিশু মিলন বলেছেন: শান্তিনিকেতনের একটি প্রকাশনী থেকে এ বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে বের হবে গাওয়াল। এখন কাজ চলছে। এখানে প্রকাশক পেতে ব্যর্থ হয়েছি।

৫| ২৯ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:৫০

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: খুব বড় লাগলো। যে কারনে কয়েকটি জায়গা একটু ছেড়েছি । রাঙাবৌ চরিত্রটি বেশ ভালো লেগেছে। রাঙাবৌ এর সঙ্গে ডালিমের সম্পর্ক নিয়ে নীলুর ঈর্ষার কারনটি অমূলক নয়। বেশ ভালো লিখেছেন। গ্রাম্য কিছু অশ্লীল কথা হয়তো উঠে এসেছে, তবুও বেশ ভালো লাগলো। সুনীল গাঙ্গুলীকে এরকম কিছু শব্দ লিখতে দেখেছি। মোটের উপর ভালো লাগলো।

শুভকামনা রইল।

৩০ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১:৫৭

মিশু মিলন বলেছেন: মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.