নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প উপন্যাসের ভিটে মাটি মানুষের সন্ধানে

৩০ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:৩৮


গল্প-উপন্যাসের ভিটে-মাটি-মানুষের সন্ধানে আমার এবারের গন্তব্য মাগুরা, ফরিদপুর এবং রাজবাড়ী। আমার আগামী উপন্যাসের পটভূমি তিনশো বছরের অধিক সময় আগের ভূষণার রাজা সীতারামের সময়কাল, তৎকালীন সময়ের কিছু সত্য ঘটনা এবং হড়াই নদীর চরের একটি জনপদের গোরাপত্তন। রাজা সীতারামের রাজত্ব ছিল বর্তমান রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাগুরা এবং নড়াইলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে। আমি রাজবাড়ীর সন্তান, ফলে এই জনপদের অনেককিছুই আমার দেখা। তবু আরেকবার লেখকের চোখে গভীরভাবে দেখার জন্য, মানুষের সাথে কথা বলার জন্য, বিশেষত রাজবাড়ীর নলিয়া গ্রামের বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্যই এই যাত্রা। বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায় এই জনপদের অনেক কিছুই জানেন, তার সঙ্গে দেখা করাটা আমার মুখ্য উদ্দেশ্য।

আমার প্রথম গন্তব্য মাগুরা জেলার মুহম্মদপুরে অবস্থিত সীতারামের রাজবাড়ী, যেখান থেকে সীতারাম রাজ্য পরিচালনা করতেন। তবে আরো কয়েক জায়গায় তার দূর্গ ছিল, বিশেষত রাজবাড়ী জেলার বেলগাছি। রাজ্য পরিচালনার জন্য তিনি বেলগাছিতেও থেকেছেন।
ঢাকা থেকে মধ্যরাতে রওনা হয়ে সকাল সোয়া ছয়টায় মাগুরা শহরের ঢাকা রোডে নামলাম। আসবার সময় ঈগল পরিবহনের কর্মী মুহব্বত আলী আমাকে বলেছিল, ‘অতো সকালে বাস তো চলবেন না, অটোতে যাতি হবি। যদি অন্ধকার থাকতি ঢাকা রোডে নামেন তালি পরে সকাল হবার আগে মুহম্মদপুরের অটোতে উঠেন না। অটোতেই যানে, তয় সকাল অলি।’

মুহব্বত আলীর বাড়ি মুহম্মদপুরে। তাই এই রাস্তার নিরাপত্তা বিষয়ে তার ভাল ধারণা থাকাই স্বাভাবিক। তবে ঢাকা রোডে পৌঁছতে সকাল হয়ে যাওয়ায় আমাকে আর অপেক্ষা করতে হলো না, বাস থেকে নেমেই একটা অটোয় উঠে পড়লাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই অটোর আটটি সিট পূর্ণ হওয়ায় যাত্রা শুরু হলো মাগুরা-নড়াইল রোড ধরে। অটোর ভেতরের দু-দিকের সিটে আমরা চেপে-চুপে ছয়জন আর ড্রাইভারের দুইপাশে দুইজন। রাস্তাটি বেশ মসৃণ; রাস্তার দুইপাশে চোখ জুড়নো সবুজ-সবুজ ঘাস, বুনো ঝোপঝাড়; সবুজে ঘেরা ঘরবাড়ি। এখন বর্ষাকাল হওয়ায় ঘাস-লতাগুল্ম সব মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নিজেদের অস্তিত্ব প্রবলভাবে জানান দিচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে দু-একজন যাত্রী নেমে যাচ্ছে, আবার নতুন যাত্রী উঠছে। লোকালয় ছাড়িয়ে রাস্তার দু-পাশে পাটক্ষেত, আবার লোকালয়। কোথাও কোথাও পাট পচা দূর্গন্ধ, লোকের বাড়ির পাশের ছোট ছোট খালে পাট জাগ দেওয়া হয়েছে। পচা জলের রঙ দেখেই বোঝা যায় যে পাটের রঙ হবে কৃষ্ণবর্ণ। ছেলেবেলায় গ্রামে দেখেছি যার পাট সোনালি হতো, তার মুখে হাসি ফুটতো; কেননা সে বেশি দামে পাট বিক্রি করতো। আর যার পাটের রঙ মলিন হতো, সে খুব হতাশ হতো; কেননা তার পাট কম দামে বিকোতো। এখন আর সেই দিন নেই, এখন পাটে রঙ করা যায়। কালচে পাটও রঙের বদান্যতায় সোনালি হাসি হাসে। সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ে কৃষকের মুখে।

কোথাও কোথাও গৃহস্থ বধূ এবং ছোট ছেলে-মেয়েরা গাছতলায় বসে খিচিপাট এড়াচ্ছে। অনেকদিন পর এমন দৃশ্য দেখে দূরে ফেলে আসা ছেলেবেলাটা যেন কাছে ফিরে এলো। আমি কতো পাট এড়িয়েছি। পাড়ায় যাদের আবাদী জমি কম ছিল, তারা আমাদের পাট এড়িয়ে দিয়ে পাটকাঠি নিয়ে যেতো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য। স্কুল বন্ধ থাকলে তাদের সাথে বসে মাঝে মাঝে আমি এরকম পাট এড়াতাম।

একজন ছোটখাটো লোক উঠলো অটোতে, মুখে দাড়ি, গায়ে মলিন জামা, পারনে মলিন লুঙ্গি। হাতের মোবাইলে ওয়াজ চালানো। ওয়াজ শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কোথায় এই সকালবেলায় অচেনা জনপদে পাখপাখালির ডাক শুনবো, পথ চলতি লোকের দু-একটি কথা কানে আসবে কিংবা পাট নিড়ানি দিতে দিতে কেউ পল্লীসংগীত গেয়ে উঠলে তা কানে আসবে; তা না, শুনতে হচ্ছে কোনো অসভ্য বর্বর হুজুরের রেকর্ড করা ওয়াজ!

ছেলেবেলায় এই ধরনের মানুষদের দেখেছি পথ চলতে চলতে নিজের ছোট্ট রেডিওতে কিংবা সকালবেলায় রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানের জটলায় বসে শুনছে-‘পরের জাগা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো সেই ঘরের মালিক নই’ বা খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’; কিংবা আরো অসংখ্য পল্লীগীতি, লালনগীতি ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ইত্যাদি গান।

এই যে আজকে সংগীতের স্থান দখল করে নিয়েছে বা এখনো নিচ্ছে সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধতা এবং অবৈজ্ঞানিক বার্তা ছড়ানো ওয়াজ; এর দায় সরকারের এবং কিছুটা আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও। সরকার তৃণমূল পর্যায়ে সাংস্কৃতিক চেতনা ছড়িয়ে দিতে কোনো কাজ তো করেইনি বরং যাত্রা-পুতুলনাচ-সার্কাস প্রদর্শনীতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। রাতভর ওয়াজ মাহফিলে ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর অনুমতি মিললেও নিরাত্তার অজুহাতে যাত্রা-পুতুলনাচ-সার্কাসের অনুমতি সহজে মেলে না। আর আমাদের শহুরে সাংস্কৃতিক কর্মীদের দায় এজন্য যে তারাও তৃণমূলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রসারে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। তারা শহরের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে আর আত্মতৃপ্তিতে ভোগে এই ভেবে যে সংস্কৃতির সেবায় তারা যথেষ্ট করছে। সেই সুযোগে তৃণমূল পর্যায়ে ঢুকে গেছে অর্ধান্ধগোষ্ঠী, তারা সাধারণ মানুষের মগজধোলাই করতে পেরেছে ইচ্ছে মতো। আমাদের এই তথাকথিত সংস্কৃতিকর্মী বা বোদ্ধারা সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি, ছোট শহর বা গ্রাম পর্যায়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেবার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে। এখন পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়েই কোনো শিল্পকলা গড়ে ওঠেনি। কেননা এইসব সংস্কৃতিকর্মী বা বুদ্ধিজীবীরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রসারের চেয়ে সরকারের দালালিতেই বেশি ব্যস্ত থেকেছে সর্বদা।

মাগুরা-নড়াইল রোড ছেড়ে আমাদের অটো ঢুকে পড়লো মুহম্মদপুরের রোডে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি দু-পাশের সবুজ প্রকৃতি, ঘরবাড়ি, মানুষ। নবগঙ্গা নদীর ওপর ব্রিজ। নবগঙ্গা ছোট নদী, কুমার নদ-ই মাগুরায় এসে নবগঙ্গা নামে পরিচিতি পেয়েছে। নদী চওড়া বেশি নয়, আরো অনেক নদীর মতো এটাও ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে! নদীর বুকে হালকা স্রোত, কস্তুরী-কলমির ঝোঁপ। ম্রিয়মাণ স্রোতর সাধ্য নেই সেই কস্তুরী-কলমির ঝোঁপ ভাসিয়ে নিয়ে যায় ভাটির দিকে।

নবগঙ্গার ব্রিজ পার হতেই রাস্তার অবস্থা ভীষণ খারাপ! দেশের প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-সাংসদ থেকে শুরু করে পাতি নেতার মুখ থেকে উন্নয়নের বুলি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা, টকশোতে দালাল সাংবাদিকদের মুখে উন্নয়নের কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত, অথচ সারাদেশের অধিকাংশ রাস্তার অবস্থা এমন যে ঝাকিতে পেটের নাড়ি-ভুড়ি বেরিয়ে আসতে চায়! উন্নয়নের ঠেলায় কোমরের অর্ধেক খুলে পড়তে চায়! কোনো গর্ভবতী নারীকে এই রাস্তায় কীভাবে হাসপাতালে নেয়, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে!

অটো আমাদেরকে খালুইতে খাচতে খাচতে একসময় পৌঁছে দিলো মুহম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে। সকালবেলায় প্রাতঃকৃত্য সারা হয়নি, মাগুরায় ফিরে গিয়ে হোটেলে উঠার আগ পর্যন্ত ওই অধ্যায় ভুলে থাকতে চাই যদি না এরই মধ্যে নিন্মচাপ শুরু হয়! ক্ষুধা পেয়েছে খুব, একটা হোটেলে ঢুকলাম। বেশিরভাগ মফস্বলের হোটেল যেমন হয় আর কী, টিনের ঘর, ভেতরে কয়েকটি টেবিল আর টেবিলের দু-দিকে বেঞ্চ পাতা। তবে হোটেলের পরিবেশ মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। যিনি রুটি বানাচ্ছেন, তার রুটি বানানোর ধরন দেখে তবেই হোটেলে ঢুকলাম। খাওয়ার ব্যাপারে আমি বেশ খুঁতখুঁতে। রাস্তা ঘাটের যেখানে-সেখানের খাবার খাই না। আমার যখন অনেক বন্ধু ছিল, টিএসসি-সরওয়ার্দী উদ্যানে তুমুল আড্ডা হতো ওদের সঙ্গে, তখন আমি বাইরের ভাজা-পোড়া খোবার খেতাম না, আমার জন্য ওরাও কিছু খেতে পারতো না। মধুর ক্যান্টিনে এসে খেতাম। ওরা আমাকে বলতো-‘তুই শুচিবাইগ্রস্ত’। এখন আমার অফিসের কলিগরাও তাই বলে। অফিসের পিয়ন খাবার আনার সাথে সাথে হাত না ধুয়ে খেতে শুরু করে সবাই আর খাবার পর তৈলাক্ত হাতও ধোয় না। ফলে আমাকে খাবার আগে এবং পরে হাত ধুতে দেখে তারা হাসে। আসলে অধিকাংশ বাঙালী ভয়ানক রকমের নোংরা; তা আমাদের রাস্তা-ঘাট, হোটেলের পরিবেশ, খাবার তৈরির পদ্ধতি দেখলেই বোঝা যায়। ফলে অনেক অপরিচ্ছন্ন লোকের ভিড়ে কেউ একটু পরিচ্ছন্ন জীবন-যাপন করলেই আমরা তার গায়ে ‘শুচিবাইগ্রস্ত’ তকমা লাগিয়ে দিই।

রুটি আর সবজি খেলাম, বেশ তৃপ্তি পেলাম খেয়ে। হোটেল থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। মাগুরা যাওয়ার অপেক্ষায় একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে, বাসে ড্রাইভার আছে, হেলপার আছে, একজন লোক টিনের ছাউনির নিচে বসে টিকিট বিক্রি করছে; অনেকগুলো অটো যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে, কোনোটা যাত্রী নিয়ে স্ট্যান্ডে ঢুকছে, আবার সিট ভরে গেলে কোনোটা স্ট্যান্ড ছেড়ে যাচ্ছে; ভ্যানের অবস্থাও তাই, কিছু ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে, কিছু আসছে-যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছি; তিনশো বছর আগে রাজা সীতারামের শাসনামলে এইসব মানুষদের পূর্বপুরুষ দেখতে কেমন ছিল? কী ছিল তাদের পেশা? মুহূর্তে যেন আমার সামনে বর্তমানের এই সরগরম বাসস্ট্যান্ড উধাও হয়ে গেল! আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম মাটির রাস্তায় তখন তারা কেউ গুরুরগাড়ি চালাচ্ছে, কেউ ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছে। হিন্দু-মুসলমান সকলেরই পরনে ধুতি। গ্রাম্যবধূ গরুর গাড়িতে চড়ে নাইয়রে চলেছে, বাড়ির বাইরের জগতের প্রতি তার দারুণ কৌতুহল, গরুর গাড়ির ছইয়ের ভেতর থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমি যেন এক তরুণ পথিক, চলেছি কোথাও; আমার পরনে প্যান্ট নয়, ধুতি; গায়ে টি-শার্ট নয়, ফতুয়া; মাথায় টুপি নয়, গামছা বাঁধা; পায়ে স্যান্ডেল নয়, নগ্ন পা; পিঠে ব্যাগ নয়, কাপড়ের বোঁচকা! আমি দারুণ কৌতুহলে তাকিয়ে দেখছি গরুরগাড়ির ছউয়ের ভেতরে থাকা বধূটিকে। বধূটির সাথে চোখাচোখি হলো, লাজুক হেসে বধূটি ঘোমটা টেনে দিলো মুখে!

কল্পনার ঘোর থেকে বেরিয়ে ভ্যানস্ট্যান্ডে গিয়ে এক ভ্যানচালককে বললাম, ‘সীতারাম রাজার বাড়ি যাবেন?’
‘যাব।’
‘ভাড়া কতো?’
‘দশ টাকা।’
‘চলেন।’

বলেই ভ্যানে চড়ে বসলাম। ভ্যানে যেতে যেতে মানুষ, ঘর-বাড়ি আর গাছপালা দেখতে দেখতে ভাবছি যে তিনশো বছরে কতোটা পরিবর্তন হয়েছে। এই তিনশো বছরে ভিন্ন ধারার কালো আর ফর্সা মানুষের মিলনের ফলে মানুষের চেহারায় পরিবর্তন এসেছে, ব্রিটিশ শাসনের ফলে বেশভূষায় পরিবর্তন এসেছে, ঘরবাড়ির পরিবর্তন তো হয়েছেই; দেশি গাছের ভিড়ে ঢুকে গেছে অনেক বিদেশী গাছ, বাংলাদেশে কোনো কোনো বিদেশী গাছের আগমন এতো আগে হয়েছে যে আজ আর অনেকে জানেই না ওগুলো বিদেশী গাছ। আর ভাষা? ভাষাও সেই তিনশো বছর আগের জায়গায় স্থির নেই, ভাষার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। না জানি কতো-শত শব্দ হারিয়ে গেছে চিরতরে। আবার ভিন্ন ভাষার নতুন শব্দও যুক্ত হয়েছে বাংলা ভাষায়। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতির ছোঁয়ায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির। সেই আর্যদের বাংলায় আগমনের শুরু থেকেই বাঙালি উদারভাবে গ্রহণ করেছে অপর সংস্কৃতি। অপর ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি বাঙালির কৌতুহল এবং আগ্রহ চিরকালই প্রয়োজনের অধিক, আর নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি উদাসীনতা প্রবাদতুল্য! ভাষা এবং সংস্কৃতি চিরকাল একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, কালের দরজা দিয়ে ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি এসে ঢুকে স্থানীয় ভাষা-সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়। কিন্তু তার তো একটা সীমা আছে, কয়টা দেশ আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে মাতামাতি করে, যেমনটা আমরা ভিনদেশী সংস্কৃতি নিয়ে করে থাকি? এক্ষেত্রে বাঙালিকে কি উদার বলা যায়, নাকি আত্ম-অসচেতন নির্বোধ কিংবা পরগাছা স্বভাবের? আমার কাছে বাঙালিকে অনেকটা নির্বোধ আর পরগাছা স্বভাবেরই মনে হয়।

দু-পাশের ঘর-বাড়ি এবং গাছপালার মধ্য দিয়ে একে-বেঁকে পড়ে থাকা পিচঢালা সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। চেনা জনপদ ছেড়ে এরকম অজানা-অচেনা জনপদ দিয়ে যেতে আমার দারুণ লাগে! মনে হয় আর চেনা ডেরায় না ফিরে অনন্তকাল এভাবে অজানা জনপদ দিয়ে যেতে পারলে জীবনটা কী সমৃদ্ধই না হতো!

রাজা সীতারামের রাজবাড়ীর সামনে এসে ভ্যান থামলো। ভাড়া মিটিয়ে আমি রাজবাড়ির সামনের খোলা মাঠটিতে পা রাখলাম। সকাল আটটা বাজে, কিন্তু রোদ্দুর ঠাঠা করছে। বাড়ির সামনের মাঠে কালো রঙের একটি গরু বাঁধা। মাঠটার অধিকাংশ জায়গা ঘাসে ছাওয়া হলেও জল জমা এবং গরু বাঁধার কারণে মাঝখানের কিছুটা জায়গায় দাউদের মতো ন্যাড়া এবং কাঁচা ঘায়ের মতো কাদাময়। বাড়িটা দেখে আমি রীতিমতো হতাশ হলাম, হতাশ এই জন্য নয় যে বাড়িটির আকৃতি ছোট। আমার হতাশার কারণ রাজবাড়ীর ডানদিকের কিছুটা অংশ আড়াল করে একটি ঘর তোলা হয়েছে। কোনো সুন্দরী নারীর মুখে অ্যাসিড মারলে যেমন দেখায়, তেমনি দেখাচ্ছে। রাজবাড়ীর বামদিকের অবস্থাও সুবিধের নয়, রাজবাড়ী লাগোয়া মাঝারি উচ্চতার দেয়াল তোলা হয়েছে, দেয়ালের ওপাশে পাকা বাড়ি। দু-পাশে আরো কিছুটা খালি জায়গা থাকলে রাজবাড়ীকে দেখতে দারুণ লাগতো। আমি এগোলাম রাজবাড়ির দিকে, সদর দরজার বামদিকে কিছুটা দূরত্বে একটি লম্বা-সরু কাঁঠাল গাছ। সদর দরজায় তালা লাগানো। সদর দরজার দু-পাশে দুটি কক্ষ, কক্ষ দুটি অবশ্য খোলা। রাজবাড়ির দরজা এবং জানালায় লোহার শিক, বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যায়। আমি দরজা দিয়ে উঁকি মেরে ভেতরটা দেখতে লাগলাম যতোটা দেখা যায়। রাজবাড়ীর মাঝখানে বর্গাকৃতির উঠোন, চারপাশে বারান্দা এবং কক্ষ। রাজবাড়ী এবং রাজবাড়ীর কিছুটা অংশ আড়াল করে হাল আমলে তোলা ঘরটির মাঝখানে একটি গলি পথ, সেটি ধরে রাজবাড়ীর পিছন দিকে গেলাম। পিছনদিকে একটু খোলা জায়গা, সেখানে গোড়ায় গরু বাঁধা। তারপরেই উত্তর-দক্ষিণে লম্বা বড় একটি পুকুর। রাজবাড়ির পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় দিকেই লোকের বাড়ি। খোলা জায়গায় একটি বাঁশের আড়ে ঝুলছে শাড়ি, ছায়া, ব্লাউজ, বাচ্চাদের প্যান্ট। রাজবাড়ীর জানালার ওপরে কিসের একটা বস্তা রাখা। পিছনের দেয়ালে স্যাঁতা পড়া লম্বা-চওড়া কালো দাগ, ভাঙা ইটের আঁকি-বুকি। পুকুরের পশ্চিমদিকে এক মধ্যবয়সী নারী কাপড় ধুচ্ছে। পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে একটি বাড়ি, সেই বাড়ির উঠোন পেরিয়ে আমি পূর্বদিকের চালা ধরে সামনে এগোলাম। পায়ে চলা পথ। পুকুরের পাড় থেকে ঝোপ-ঝাড় এবং ছোট ছোট গাছপালা ঝুকে আছে জলের দিকে। একটা শ্বেত আকন্দ গাছে ফুটে আছে থোকা থোকা সাদা রঙের ফুল। অনেকদিন পর আকন্দগাছ দেখলাম। হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের উত্তর মাথায় চলে গেলাম। একটা সরু সিঁড়ি ওপর থেকে নেমে গেছে পুকুরে। সিঁড়িটা দেখলেই বোঝা যায় যে এটি হাল আমলে বানানো। পুকুরের পাশেই জমিতে জল জমেছে, নানা রকম জলজ উদ্ভিদেও মাঝে ফুটে আছে কিছু কিছু অপুষ্ট শাপলা।

পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে ভাবছি যে এককালের প্রভাবশালী রাজা সীতারাম, যার রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল দক্ষিণের নড়াইলের কিছু অংশ থেকে শুরু করে উত্তরে রাজবাড়ী জেলার পদ্মা নদী পর্যন্ত; যিনি মগ জলদস্যু আর ডাকাতদের ঠেঙিয়ে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ দমন করেছিলেন, যিনি ২২০০ সৈন্যের একটি বেলদার বাহিনী গঠন করেছিলেন, যে বাহিনী যুদ্ধের সময় ব্যতিত অন্য সময়ে প্রজাদের জলকষ্ট দূর করার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে শত শত পুকুর বা দীঘি খনন করতো; সেই রাজার রাজবাড়ীর আজ কী হাল! রাজবাড়ির খোলা জায়গার বাঁশের আড়ে লোকে ছায়া-ব্লাউজ-বাচ্চার মুতের কাঁথা শুকোচ্ছে, জানালার ওপর রেখেছে বস্তা, ভেতরে নিশ্চয় ইঁদুর-ছুঁচো-চামচিকা বাসা বেঁধেছে! জায়গা-জমি লোকেরা দখল করে নিয়েছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রাজবাড়ী ধ্বংস হতে চলেছে।

এই যে দেশের বিভিন্ন স্থানে অতীতের স্থাপত্য-ইতিহাস-সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের মুখে, এর প্রধান কারণ ১৯৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান এবং ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাস-সংস্কৃতিবিমুখ অসভ্য-বর্বর রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

রাজবাড়ীর সদরদ্বার এবং পশ্চাৎদ্বার, দু-দিকের দ্বারেই তালা দেওয়া। ভিতরে ঢুকতে না পারার আক্ষেপ নিয়েই পুনরায় রাস্তায় উঠে এলাম। রাস্তার ডানপাশে অনেকখানি নিচু জায়গা, যেখানে জল জমেছে। এই জলের পরেই একটি মন্দির। সামনে এগিয়ে তিন রাস্তার মোড়ে গেলাম, মোড়ের মুদি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ওটা দোল মন্দির। রাস্তা ঘুরে গেলাম দোল মন্দিরের সামনে। উঁচু বর্গাকৃতি বেদির ওপর আরেকটি বেদি, তার ওপর লম্বা মন্দির। নিচের বেদিটায় পাটি পেতে ধান শুকোতে দেওয়া, এক নারী হাত দিয়ে ধান নেড়ে দিচ্ছে! এখানে হয়তো এককালে সাড়ম্বরে দোল পুজা হতো, জলমগ্ন নিচু জমিতে হয়তো মেলা বসতো, বিপুল জনসমাগম হতো!

মন্দিরের ছবি তুলে আবার মোড়ের কাছের দোকানটায় এলাম। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাজবাড়ী দেখাশোনার কোনো লোক নেই? ভিতরে ঢোকা যায় না?’
‘একজন লোক আছে।’
‘কখন আসবে সে?’
‘ঠিক নাই। কোনোদিন দশটা-এগারোটার দিকে আসে, আবার কোনো দিন আসে না।’

সুতরাং এমন লোকের জন্য আর অপেক্ষা করা চলে না। রাজবাড়ীর ভেতরটা না দেখেই হেঁটে খানিকটা এগিয়ে এসে একটা ভ্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মধুমতি নদীর ব্রিজে যাব, যাবেন?’
‘না যাব না, রাস্তার কাজ করতিছে, ঘুরে যাতি হবে।’

আমি মুহম্মদপুর বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আরেকজন ভ্যানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই সে রাজি হলো। চড়ে বসলাম ভ্যানে। একটা সরকারী অফিসের সামনে দিয়ে ঢুকলো ভ্যান, নিচু মতো একটা জায়গায় নেমে পার হয়ে আবার ভ্যানে উঠলাম। ওদিকের রাস্তাটায় সত্যিই কাজ হচ্ছে, রাস্তার ওপর উঁচু মাটির ঢিবি। ব্রিজের রাস্তায়ও কাজ হচ্ছে, রাস্তার অর্ধেকে শ্রমিকেরা খোয়া ফেলছে আর অর্ধেক দিয়ে ভ্যান-গাড়ি চলাচল করছে। ব্রিজের মাঝখানে এসে ভ্যান ছেড়ে দিলাম। ব্রিজটা নতুন হয়েছে, এখনো উদ্বোধন হয়নি, রাস্তার কাজ শেষ হলেই হয়তো হবে। তবে লোকজন-গাড়ি চলাচল করছে ব্রিজের ওপর দিয়ে। ব্রিজের ওপারে ফরিদপুর জেলার শুরু, এপারে মাগুরার শেষ।

ভীষণ চড়া রোদ, প্রচুর ঘামছি; তবু মধুমতির দু-দিকের চেহারা মনে না গেঁথে ফিরছি না। প্রায় সোয়া তিনশো বছর আগে এই নদীকে কেন্দ্র করেই রাজা সীতারাম এখানে রাজধানী করেছিলেন। তখন হয়তো নদী আরো অনেক বড় ছিল। একটু গভীরে তলিয়ে ফরিদপুর জেলার অংশে তাকালেই বোঝা যায় যে নদীর চরে ফসলি জমি এবং মানুষের বাসভূমি গড়ে উঠেছে। মধুমতি মাগুরাকে খেয়েছে আর ফরিদপুরে প্রসব করেছে জমি।

লাল রঙের পাল তোলা একটা ছোট নৌকা দেখতে পেলাম সবুজ ডাঙার পাশ দিয়ে উত্তরদিকে চলেছে, নীল আকাশ আর সাদা মেঘের ছায়া পড়েছে জলে; যেন আবহমানকালের দৃশ্য, হাজার বছর আগেও ছিল, এখনো আছে। মাগুরার দিকে নদীর ধারে একটা বটগাছ চোখে পড়লো, বটগাছের ছায়া লোভ দেখালেও অনেকটা দূর হেঁটে যেতে হবে বলে লোভ সংবরণ করতে হলো। মাগুরার দিকে ঘন সবুজ-গাছপালা আর মধ্যে মধ্যে ঘরবাড়ি। ফরিদপুরের দিকে ঘন সবুজ ফসলি জমি-গাছপালা, অনেকটা দূরে লোকালয়।

ব্রিজ পার হয়ে বোয়ালমারী হয়ে ফরিদপুর যাওয়া যায়। কিন্তু আজকে মাগুরা থাকবো বলে ফেরার ভ্যানে চড়ে বসলাম, নামলাম মুহম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে। বাস বাউন্টারে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাস কয়টায় ছাড়বে।’
‘নয়টা পঁয়ত্রিশে।’

এখন নয়টা চব্বিশ। নয়টা পঁয়ত্রিশে বাস ছাড়ার কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন। তবু টিকেট কেটে উঠে বসলাম সিটে। আশ্চর্য, আমাকে অবাক করে দিয়ে নয়টা পঁয়ত্রিশেই বাস ছাড়লো। জীবনে প্রথমবারের মতো ঘটলো এমন ঘটনা!

পুনরায় ঢাকা রোডে এসে বাস থেকে নামলাম। এক রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা, আবাসিক হোটেল আছে কোথায়?’
‘চৌরঙ্গী মোড়ে আছে বেশ কয়ডা।’
‘চলেন।’

রিক্সায় উঠে বসলাম। হাইওয়ে পেরিয়ে উল্টোদিকের রাস্তায় দ্রুত ছুটতে লাগালো ইলেকট্রিক মোটর চালিত রিক্সা। এখানকার সব রিক্সাই এমন, ফলে রিক্সাওয়ালাদের কষ্ট কম হয়। এমনই হওয়া উচিত, এই একবিংশ শতাব্দীতে রিক্সাওয়ালারা রোদে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে নিজের শক্তি ক্ষয় করে রিক্সা চালিয়ে কেন আয়ু নিঃশ্বেষ করবে? ঢাকাতেও ইলেকট্রিক মোটর চালিত রিক্সা চালু হয়েছিল; সরকার বিদ্যুৎ খরচের দোহাই দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। গুলশান-বনানী-বারিধারার ধনী পাড়ায় প্রতিদিন প্রয়োজনে কেবলমাত্র সৌখিনতার জন্য কী বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের অপচয় হয়, সেদিকে সরকারের নজর নেই; অথচ শ্রমজীবি মানুষ নিজের প্রয়োজনে বিদ্যুৎ খরচ করলেই সেটা অপচয়!

রাস্তার দু-ধারে সারি সারি দোকানপাট। অধিকাংশ জেলাশহরগুলোর চেহারা প্রায় একইরকম, উঁচু উঁচু ভবন এখনো শহরগুলোকে গ্রাস করতে পারেনি। অল্পক্ষণের মধ্যেই চৌরঙ্গী মোড়ে এসে রিক্সা থেকে নামলাম। আশপাশে তাকিয়ে তিনটে আবাসিক হোটেল দৃষ্টিতে পড়লো। একদম মোড়ের সাথের একটা আবাসিক হোটেলে ঢুকলাম, কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম রুম খালি নেই। নেমে রাস্তা পেরিয়ে আল-মদিনা নামের একটা হোটেলে ঢুকলাম। নিচতলার কাউন্টারে বসে আছে তেইশ-চব্বিশ বছরের এক যুবক, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রুম খালি আছে?’
‘আছে।’
‘রুমটা দেখতে চাই।’

যুবক আমাকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে একটি রুম দেখালো। একেবারে বদ্ধ ঘর যাকে বলে, তাই। অ্যাটাচড বাথরুম থাকলেও ঘরে কোনো জানালা নেই। সঙ্গত কারণেই পছন্দ হলো না। বললাম, ‘জানালা আছে এমন ঘর খালি নেই?’
‘তিনতলায় একটা আছে।’
‘চলেন দেখি।’

‘তালাবদ্ধ ঘরটা খুলতেই কেমন একটা গুমট গন্ধ ভেসে এলো নাকে। জানালা আছে বটে একটা কিন্তু বন্ধ করে রাখায় গুমোট গন্ধ হয়েছে। বাতি জ্বাললে দেখতে পেলাম ঘরের পরিবেশ। খুব একটা ভাল না। দেয়ালে দাগ-ময়লা। বাথরুমটাও খুব একটা ভাল না। তারপরও কোনোরকমে থাকা যায় আর কী। এরকম ছোট শহরে এর চেয়ে ভাল আবাসিক হোটেল আশা করা যায় না। একটা রাত কোনোভাবে কাটিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া এরকম হোটেলে থাকার অভ্যাস যে একেবারেই নেই তা নয়। ছোট ছোট অনেক শহরে নাটকের প্রদর্শনী করতে গিয়ে এধরনের হোটেলে অনেকবার থাকতে হয়েছে। আমি যতো খুঁতখুঁতেই হই ঘুরতে গেলে এটুকু ছাড় দিতেই হবে।

যুবককে বললাম, ‘ভাড়া কতো?’
‘আড়াইশো।’
‘দু-শো হয় না?’
‘দাঁড়ান আমি একটু ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে আসি।’
নিচের সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটু পরে এসে যুবক জানালো, ‘আয়চেন যখন, থাকেন। দুইশো টাকাই নেবোনে।’
বললাম, ‘বালিশের কাভার আর বিছানার চাদর পাল্টে দিতে হবে।’

একটু পর যুবক আবার এসে বালিশের কাভার আর বিছানার চাদর বদলে দিয়ে খাতায় নাম-ঠিকানা-স্বাক্ষর নিয়ে চলে গেল।
আমি দরজা বন্ধ করে জানালাটা খুলে দিলাম। পোশাক ছেড়ে স্নান করে এসে দিলাম ঘুম। সকালে রুটি ছাড়া কিছু খাইনি। ক্ষিধেয় ঘুম ভেঙে গেল আড়াইটে নাগাদ। তবু তিনটে পর্যন্ত শুয়ে রইলাম। কারণ একবারে বেরিয়ে হোটেল থেকে খেয়ে সাতদোহা ন্যাংটো বাবার আশ্রমের রথের মেলায় যাব। ফিরবো সন্ধ্যায় কি রাতে। আমি যে গতকাল রাতে রওনা করে আজ সকালে মাগুরায় আসবো তা আগেই ঠিক করা ছিল। কিন্তু আজই যে রথের মেলা তা জানা ছিল না, জেনেছি দু-দিন আগে। জানার পর নেটে সার্চ দিয়ে দেখেছি মাগুরা শহরের সাতদোহা ন্যাংটো বাবার আশ্রম এবং নিজনান্দুয়ালী গৌর গোপাল সেবাশ্রমে রথযাত্রা হয়। তখনই ঠিক করি রথযাত্রা দেখবো এবং রাতে মাগুরাতেই থাকবো, নইলে থাকতাম ফরিদপুরে।

তিনটের দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে চৌরঙ্গী মোড়ের পাশেই জলযোগ নামে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। রেস্টুরেন্টটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রেস্টুরেন্ট তো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কিন্ত খাবার ভাল হবে তো? মনে এই প্রশ্ন জাগার কারণ, দিন পনের আগে টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ফেরার পথে রাতে ভাত খেয়েছিলাম সুনামগঞ্জ শহরের একটা রেস্টুরেন্টে। ভাতের মধ্যে অন্তত দশটি ধান পেয়েছিলাম। খুঁটে খুঁটে ধানগুলো বেছে ফেললাম, কিন্তু কুড়ো বাছবে কে? আর কী বিস্বাদ মুরগীর ঝোল! একটা পর্যটন শহরের রেস্টুরেন্টের অমন হাল দেখে হতাশ হয়েছিলাম। কোনোমতে কয়েকগ্রাস ভাত গিলেছিলাম মাত্র।

না, মাগুরায় তেমন বাজে অভিজ্ঞতা হলো না। সাদা ফুলের মতো পরিচ্ছন্ন ভাত এলো সামনে। আমি বাইরের লোক বুঝতে পেরেই হয়তো ওয়েটার ভদ্রলোক ভিতরে নির্দেশ দিলেন, ‘ভাল দেখে এক পিস খাসির মাংস দে।’

বেশ বড় এক পিস খাসির মাংস আর কচুর শাক এলো সামনে, সঙ্গে সালাদ। খাবার সুস্বাদু, বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। রেস্টুরেন্টটির ওয়েটাররা খুব আন্তরিক। এটা বোধ হয় মাগুরার লোকের লোকের একটি ভাল গুণ। অটোতে, রাস্তায় কিংবা কোনো দোকানে যখন যাকে যা জিজ্ঞেস করেছি, সে-ই খুব আন্তরিকতার সঙ্গে উত্তর দিয়েছে। কোনো তাড়া দেখায়নি বা দায়সারা গোছের উত্তরও দেয়নি। অনেক শহরের মানুষের মধ্যেই আমি এই আন্তরিকতার ব্যাপক অভাব দেখেছি।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে রিক্সায় চড়ে বসলাম সাতদোহা ন্যাংটো বাবার আশ্রমের রথের মেলার উদ্দেশ্যে। আবার সেই ঢাকা রোড পেরিয়ে বামের একটা রাস্তা ধরে চললো রিক্সা। অনেক নারী-পুরুষ হেঁটে চলেছে মেলার দিকে। রথের মেলার কারণেই ওবেলার চেয়ে এবেলায় রাস্তাঘাটে অনেক বেশি ভিড়। আশ্রমের সামনের রাস্তায় অটো এবং রিক্সার জট। অনেকটা জায়গাজুড়ে প্রাচীর ঘেরা আশ্রম, আশ্রমের মাঠেই মেলা বসেছে। মনে একটা শঙ্কা ছিল, মেলাটা প্লাস্টিকময় হবে না তো! আজকাল শহরের আশপাশের মেলা মানেই প্লাস্টিকের জিনিসে ভরপুর। আবহমান বাংলার মেলা সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না। রিক্সা থেকে নেমে গেট দিয়ে ঢুকে মেলার পরিবেশ দেখেই মনটা ছেলেবেলার মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠলো! আক্ষরিক অর্থে বাংলার মেলা বলতে যা বোঝায় এটা তাই। দোকানদাররা নানানরকম পসরা সাজিয়ে বসেছে-মাটির খেলনা, শো-পিস, হাঁড়ি-মালসার দোকান; দা-বটি-হাতা-খুন্তির দোকান; বাঁশের তৈরি কুলা-চালুনি-ঢাকনা, বেতের তৈরী ধামা-আধলা-সেরসহ গৃহস্থালী কাজের সামগ্রী; বাঁশ-কাঠের তৈরি বাচ্চাদের নানান রকম খেলনা, দোলনা এবং কাঠের ছোট ছোট মন্দির; জিলাপি-রসগোল্লা-কালোজামসহ নানা রকম মিষ্টির দোকান; চানাচুর-ঝুরিভাজা এবং আচারের দোকান; মেয়েদের সাজসজ্জার চুরি-ফিতে-আলতার দোকান ইত্যাদি। মেলার একপাশে বসেছে নাগরদোলা আর ঘূর্ণায়মান ঘোড়া, বাচ্চারা সব বিপুল আনন্দে তাতে চড়ছে। এসব দেখে বাল্য-কৈশোরে দেখা আড়কান্দী রথের মেলা আর নলিয়ার হরিঠাকুরের মেলার স্মৃতি চাগাড় দিয়ে উঠলো। সেই আনন্দ যেন ফিরে এলো মনে। আমি তো আর নাগরদোলায় চড়ে বসবো না, কিংবা হাঁড়ি-পাতিল, হাতা-খুন্তি-বেতের ধামা কিনে নিয়ে ঢাকায় ফিরবো না, কিন্তু এসব দেখে চোখের সুখ পাওয়া যায়, মনের শান্তি মেলে।

প্রচণ্ড গরম, তবু মেলায় ঘুরতে ভাল লাগছে! ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছি, পণ্য দেখছি, মানুষ এবং মানুষের কেনাকাটা দেখছি। কোনো বালক যখন এটা-ওটা কেনার জন্য মায়ের কাছে বায়না ধরছে, তখন ওই বালকের মাঝে যেন নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছি। ঘুরতে ঘুরতে কিছুটা ক্লান্ত হলে একটা বটগাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। মনে হলো একটু বসতে পারলে ভাল হতো, কিন্তু এখানে মানুষের ভিড়, বসার জায়গা নেই। নির্মিয়মাণ একটা সু-উচ্চ মন্দিরের পাশে একটা বৃহৎ অশ্বত্থগাছ চোখে পড়লো। ওদিকটায় যদি বসার জায়গা পাওয়া যায় সেই আশায় হাঁটতে শুরু করলাম। দু-পাশে মিষ্টির দোকানে সাজানো নানা ধরনের মিষ্টি। মিষ্টির দোকানের পিছনেই ময়রারা মিষ্টি বানাতে ব্যস্ত। ধোঁয় উঠা চুলার গরম কড়াইয়ে কেউ জিলাপির প্যাঁচ কষছে, কেউ রসে চুবিয়ে জিলাপি থালায় তুলছে, কেউবা রসগোল্লা ফুলিয়ে তুলছে কড়াইয়ে। মিষ্টির দোকান পার হলে দেখলাম একজন জটাধারী সন্ন্যাসী বসে আছে আর তাকে ঘিরে আছে কয়েকজন শিষ্য। নদীলগ্ন আশ্রমের পাকা ঘাট চোখে পড়লো। ঘাট পাড়ে গিয়ে বসবো ভাবছি, তার আগেই ডানদিকে চোখে পড়লো ছয়টি লোহার খুঁটির চিতা। এগোলাম চিতার দিকে। পাকা করা চিতা, একটা পাকা ড্রেন গিয়েছে নদীর দিকে, সেখানে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে মানুষ আর কাঠপোড়া ছাইয়ে গাদা।

চিতার এপাশে ঘাটের সিঁড়ির দিকে একটা ছাউনির নিচে বসার জায়গা। সেখানে বসে এবং দাঁড়িয়ে আছেন দশ-পনেরজন বৃদ্ধা। তাদের কেউ কেউ অশ্রুসিক্ত চোখে চিতায় প্রণাম করে শ্রদ্ধায় ফুল আর টাকা নামিয়ে রাখছেন। বৃদ্ধারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলছেন, কেউ কারো হাত ধরে আছেন অশ্রুসিক্ত চোখে, কেউ কেউ চোখের জল মুছছেন। অনেকদিন পর একটা উপলক্ষ্য পেয়ে সকলে এক জায়গায় মিলিত হয়ে হৃদয়ের কথা বিনিময় করতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে বৃদ্ধারা। হয়তো কোনো চেনা মানুষের কথা স্মরণ হওয়ায় তার জন্য চোখের জল ফেলছেন, যিনি হয়তো গত রথের মেলাতেই এই মিলন মেলায় ছিলেন, কিন্তু এবার নেই, ওই চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন। কেউ হয়তো নিজের বার্ধক্যপীড়িত দিনযাপনের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলছেন এই ভেবে যে আগামী রথের মেলায় তার এই মিলনমেলায় আসার সৌভাগ্য হবে কিনা, নাকি তার আগেই তাকে উঠতে হবে ওই চিতায়।

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এই বৃদ্ধাদের দেখলাম। তারপর নদীর ঘাটে গিয়ে সিঁড়িতে বসলাম। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ায় বৃহৎ অশ্বত্থগাছের ছায়া পড়েছে ঘাটে। ছায়ার লোভেই এখানে মানুষের ভিড়। অধিকাংশই যুবক-যুবতী। শান্তভাবে বইছে নবগঙ্গা নদী। নদীর স্রোতে কোনো কামুকতা নেই। বড় বড় কস্তুরীর ঝোঁপ। মাঝিরা মাছ ধরার চাঁই পেতেছিল, কয়েকজন মাঝি মাঝ নদীতে কোষায় আর ছোট নৌকায় চাঁই তুলছে জল থেকে।

ফরিদপুরের দিক থেকে মাগুরা শহরে ঢোকার মুখে নবগঙ্গা নদীর ওপরের ব্রিজটি এখান থেকে চোখে পড়ে। বাস চলালাচল করতে দেখে আমার কৈশোরের কথা মনে পড়লো। একবার আমার অসুখ হলে মায়ের সঙ্গে মাগুরায় এসেছিলাম ডাক্তার দেখাতে। তখন মাগুরায় এক নাম করা ডাক্তার ছিল, নাম ভুলে গেছি। মাগুরা শহরে ঢোকার মুখে ঝা চকচকে শহর রক্ষা বাঁধ আর নদীর মাঝখানের ওই একটুখানি স্থলভাগের দৃশ্য এখনো ভাসে আমার চোখে। এখন অবশ্য লতাপাতার জঙ্গলে বাঁধের বড় বড় পাথরগুলো ঢেকে গেছে।

একজন মাজাভাঙা বৃদ্ধা ঘাটের নিচের দিকে নেমে জলের কাছে গেলেন, জলে প্রণাম করলেন, জল নিয়ে নিজের মাথায় ছোয়ালেন, তারপর ডানহাতের আঁজলায় জল নিয়ে উপর দিকে এগিয়ে আসতেই একটি বালক বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে গেল। নিশ্চয় বৃদ্ধার নাতি। বৃদ্ধা নাতির ডানহাতে জলটুকু দিলেন, বালক ডান হাতের তালুতে জল নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে হাত মাথায় মুছলো। বৃদ্ধার হয়তো বিশ্বাস এই নবগঙ্গার জলে পূণ্য আছে। কিন্তু আমার বিজ্ঞান মনস্ক মন বলছে এই জলে আছে নানা ধরনের জীবানু। বুঝলাম বৃদ্ধার অন্ধ বিশ্বাস-ভক্তি বালকের মধ্যেও ভালভাবেই ঢুকেছে। ওর বয়সে আমার মধ্যেও এমন অন্ধ বিশ্বাস ছিল। কিন্তু ও কি পারবে নিজের সাথে, পরিবারের সাথে, সমাজের সাথে লড়াই করে এই অন্ধত্বের পথ ছেড়ে বিজ্ঞানের আলোর পথে যাত্রা করতে?

ঘাটের ডানদিকে কিছুটা দূরে চিতাভস্মের গাদা। লতাগুল্ম বেয়ে উঠছে ছাইয়ের গাদায়। কতো বছরের পুরোনো এই শ্মশান কে জানে! নিশ্চয় অনেক পুরোনো। হাজার হাজার মানুষ হয়তো এই শ্মশানে পুড়ে ছই হয়ে গেছে। কতো রকমের মানুষ-সৎ, অসৎ, সাহসী, ভীরু, সরল, চালাক, পাগল, মিথ্যাবাদী, অহংকারী, চরিত্রবান, লম্পট, ধনী, দরিদ্র ইত্যাদি। সব পুড়ে ছাই হয়েছে ওই ছয় খুঁটির ভেতরে। বুকের ভেতর দিয়ে কেমন লু হাওয়া বয়ে গেল, হাহাকার করে উঠলো। মনে হলো আমার এই তারুণ্য চিরকাল থাকবে না, শরীরে বার্ধক্যের ছাপ পড়বে, চামড়ায় ভাঁজ পড়বে, চোখের জ্যোতি কমে যাবে, তারপর একদিন চিরকালের মতো হারিয়ে যাব পৃথিবী থেকে।

অনেকটা সময় ঘাটে বসে থাকার পর আবার মেলার মধ্যে ফিরে এলাম। সূর্যের তেজ কিছুটা কমায় এখন লোকের ভিড় আরো বেড়েছে। কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘোরার পর একটা মৃৎশিল্পের দোকানে এসে দাঁড়ালাম। একটা মাটির টিয়াপাখি আর তেরোটা মাটির ছোট ছোট কচ্ছপ, কুমির, কুকুর, পাখি ইত্যাদি কিনলাম। আরেকটা দোকান থেকে কিনলাম একটা গরু।

এ ধরনের মেলায় এলেই আমি মৃৎশিল্প কিনি। কিনি মানুষ হিসেবে শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। কেননা আমরা না কিনলে মৃৎশিল্পীরা জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় চলে যাবেন, হারিয়ে যাবে মৃৎশিল্প। ফলে আমি নিজে যেমনি কিনি, তেমনি অন্যদেরও কিনতে উৎসাহ দিই। একথা সত্য আমাদের দেশের মৃৎশিল্প পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির মৃৎশিল্পের মতো অতোটা উচ্চমার্গে পৌঁছায়নি। যদিও ঘূর্ণির মৃৎশিল্পীদের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিলো আমাদের রাজশাহী জেলায়। পৃষ্ঠপোষকতা এবং শিল্পমনস্ক সাধরণ মানুষের কারণেই ঘূর্ণির মৃৎশিল্প এগিয়ে গেছে। পৃষ্ঠপোষকতা আর শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষের অভাব এবং মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণেই আমাদের মৃৎশিল্প আশানুরূপ এগোয়নি। ইসলাম ধর্মে প্রাণির ছবি আঁকা, যে কোনো প্রাণীর মূর্তি বানানো কিংবা ঘরে রাখা হারাম। ফলে বিপুল সংখ্যক মুসলমানের ঘরে মৃৎশিল্পের স্থান হয় না। তারপরও মৃৎশিল্প যতোটুকু এগিয়েছে এটুকুই টিকিয়ে রাখতে হবে। অনেকদিন ঘরে থাকার ফলে, বাসা বদলের ধকলে যে মৃৃৎশিল্পগুলোর রঙ চটে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়, সেগুলো পুকুর কিংবা নদীতে ফেলে দিই আমি। পুকুর কিংবা নদীতে ফেলে দিই এজন্য যে মৃৎশিল্পগুলো হাজার হাজার বছর টিকে থাকবে। এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে আবার নতুন কোনো সভ্যতার জন্ম হলে অনাগত কালের মানুষ খননকালে খুঁজে পাবে একালের মৃৎশিল্পীদের শিল্পকর্ম। একালের শিল্পীদের কাজ নিয়ে গবেষণা হবে, জাদুঘরে স্থান পাবে।

আশ্রম থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলাম। এবার যাব নিজনান্দুয়ালী গৌর গোপাল সেবাশ্রমের রথের মেলায়। এক ইজিবাইকের চালককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিজনান্দুয়ালী যাবেন, যেখানে রথের মেলা হচ্ছে?’
‘যাব, ওঠেন।’

উঠে পড়লাম। ইজিবাইকের চালক আরো লোক নিতে চাইলেও দাঁড়াতে পারলো না পুলিশের তাড়ায়। রাস্তায় ইজিবাইক আর রিক্সার জট লেগে গেছে। দাঁড়ালেই পিছন থেকে হর্ণ দিচ্ছে। অগত্যা শুধু আমাকে নিয়েই চালককে ছুটতে হলো। ঢাকা রোডে এসে দেখি ব্যাপক জ্যাম। জ্যামের কারণ মেইনরোড দিয়ে রথযাত্রার মিছিল যাচ্ছে। চালক আমাকে বললো, ‘ভাই, জ্যাম ছাড়তি সময় লাগবিনি, আপনে নামে রাস্তার ওই পাড়ে যায়ে ইজিবাইকে চলে যান।’

ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লাম। ভিড় ঠেলে রাস্তা পার হয়ে আবার ইজিবাইকে চড়ে বসলাম। চৌরঙ্গী মোড় হয়েই নিজনান্দুয়ালী যেতে হয়। চৌরঙ্গী মোড়ে চালককে দু-মিনিট দাঁড়াতে বলে আমি মৃৎশিল্পগুলো হোটেলের কাউন্টারে রেখে এলাম। নতুনবাজারে এসে যখন ইজিবাইক থেকে নামলাম তখন বেলা পড়ে এসেছে। আরো অনেক নারী-পুরুষ হেঁটে এগিয়ে চলেছে রথের মেলার উদ্দেশ্যে। তাদেরকে অনুসরণ করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নিজনান্দুয়ালী গৌর গোপাল সেবাশ্রমে। লোকসমাগম হয়েছে বটে কিন্তু মেলা বলতে যা বোঝায় এখানে তা নয়। আশ্রমের মাঠের এককোনে কীর্তন হচ্ছে, কীর্তনের আসরের চারিদিকে বসে আছে ভক্তবৃন্দ। বসে থাকা ভক্তদের পিছনেই প্রসাদ খাওয়ার জায়গা। সেখানে বৈঠকে বসে ভক্তরা প্রসাদ খাচ্ছে; এক উঠছে, এক বসছে। মানুষ মন্দিরে অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা দিতে কার্পণ্য করে না। কিন্তু সারা মাগুরা শহর ঘুরলে কয়টা পাঠাগার খুঁজে পাওয়া যাবে? স্বর্গ প্রত্যাশীদের সেদিকে কোনো নজরই নেই।

মন্দিরের সামনের খোলা জায়গায় একটা রথ, আশ্রমে আসা নানা বয়সের নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে সবাই রথের দু-পাশের রসি ধরে একবার এদিকে টানছে তো আরেকবার ওদিকে। রথের ওপরে থাকা দুই ভক্ত মানুষের হাতে প্রসাদ দিচ্ছে, প্রসাদ পেয়ে যারা সরে যাচ্ছে তাদের জায়গায় আবার নতুন কেউ এসে রথের দড়ি ধরে টানছে। রথের আর বিরাম নেই! একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে নানা বয়সের মানুষের এই রথ টানটানি দেখছি, হঠাৎ কালো রঙের একটা কুকুর সামনে এলো। অনেক সময় ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন সামনে এসে হাত মুখের কাছে নিয়ে মুখ নেড়ে খাবার প্রার্থনা জানায়, কুকুরটিও সেভাবে মুখ নেড়ে বোঝালো যে ও খুব ক্ষুধার্ত। কুকুরটিকে দেখে ভাল লাগলো আমার, মায়া মায়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ নাড়তে লাগলো আর শুকতে লাগলো আমার থাই। কিন্তু একটা আমড়ার দোকোন আরেকটা গজার দোকান ব্যতিত আর কিছু এখানে নেই। গজার দোকান থেকে লোকে গজা কিনে প্রসাদ হিসেবে রথে দিচ্ছে। কিন্তু কুকুর কি গজা খেতে পারবে?

‘আয়।’ বলেই হাত দিয়ে ইশারা করে কুকরটিকে গজার দোকানে নিয়ে গেলাম। দশ টাকার গজা কিনে আবার আগের জায়গায় এসে কাগজ খুলে ওর সামনে রাখলাম। প্রথমে একটু শুকলো, তারপর খেতে শুরু করলো। খাওয়া শেষ হলেও আমার আশপাশেই থাকলো। কিছুক্ষণ পর আমি হোটেলের পথে ফিরলাম।

পরদিন খুব সকালে উঠে স্নান সেরে হোটেল থেকে বেরিয়ে ঢাকা রোডের উদ্দেশ্যে রিক্সা নিলাম। রাতে বলতে গেলে ঘুম হয়ইনি। ছাড়পোকায় কামড়েছে। শেষে বিরক্ত হয়ে লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে ছিলাম। অধিকাংশ মফস্বল শহরের হোটেলের এই এক মারাত্মক সমস্যা, ছাড়পোকায় কামড়াবেই। হোটেলের কর্মী থেকে মালিক সবাই অপেশাদার আর অপরিচ্ছন্ন।

ঢাকা রোডে এসে শুনলাম ফরিদপুরের বাস ছাড়তে এখনো অনেক দেরি। একজন পরামর্শ দিলো অটোতে কামারখালি চলে যান, ওখান থেকে অটো বদলে মধুখালি চলে যায়েন। উঠে বসলাম কামারখালিগামী অটোতে। অটো ছাড়ার কিছুক্ষণ পর মনে হলো, জীবনের শেষ ভুল করলাম না তো! শেষ ভুল বললাম এই জন্য যে ডান পাশ দিয়ে যে গতিতে বাস-ট্রাক-পিকআপ যাচ্ছে, কোনো মতে একটা টোকা লাগলেই দুমড়ে-মুচড়ে আমরা খাদে চলে যাব, জীবনে আর ভুল করার সুযোগ পাব না!

মফস্বল শহরগুলোতে ঢাকা শহরের চেয়েও বেশি বাস মালিক-শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচারিতা চলে। বিভিন্ন স্টপেজে বাস থেমে থাকে দীর্ঘক্ষণ। আগে মানুষ নিরুপায় হয়ে বাসে চলতো। কিন্তু গত আট-দশ বছরে ব্যাপক হারে অটো-লেগুনা নেমেছে রাস্তায়, ফলে বাসওয়ালাদের আগের মাস্তানি আর নেই। মানুষ এখন বাসের অপেক্ষায় থেকে সময় নষ্ট না করে অটো-লেগুনাতেই বেশি যাতায়াত করে। অটো আর লেগুনা বন্ধের জন্য কোথাও কোথাও বাসওয়ালাদের ধর্মঘট পর্যন্ত হয়েছে, কিন্ত তাতে কোনো লাভ হয়নি। ফলে নিজেদের নাক কেটে আবার রাস্তায় নেমেছে তারা। এতো অটো আর লেগুনা বৃদ্ধি পাওয়ায় একটা অসুবিধা হয়েছে, দূর্ঘটনায় আগের চেয়ে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। দুটো বাসের সংঘর্ষে প্রাণহানির সংখ্যা বা সম্ভাবনা কম থাকে, কিন্তু একটা বাস আর একটা অটো কি লেগুনার সংঘর্ষ মানেই প্রাণহানি।

কামারখালিতে পৌঁছে আবার অটোয় চড়ে বসলাম। রাস্তার দু-পাশের ঘন সবুজ দেখতে দেখতে আর খোলা হাওয়া খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম মধুখালি। একটু হেঁটে মধুখালি বাজারের কাছে এসে আবার অটোয় চড়ে বসলাম, ড্রাইভারের বাম পাশে। মধুখালি-বালিয়াকান্দী সড়ক ধরে অটো চলতে লাগলো। রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ রকমের খারাপ। ড্রাইভারের মুখে শুনলাম চার বছর যাবৎ এ লাইনে বাস চলে না। আগে রাজবাড়ী টু মধুখালি বাস চলতো আধ ঘন্টা পর পর। এখন রাজবাড়ী থেকে বালিয়াকান্দী পর্যন্ত বাস চলে, কিন্তু বালিয়াকান্দী থেকে মধুখলি পর্যন্ত কোনো বাস চলে না। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে সারা পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, যাত্রাপথের সময় কমে গেছে। অথচ বাংলাদেশের মফস্বলের এই অঞ্চলে হয়েছে অবনতি। অধিকাংশ জেলার রাস্তাঘাটের-ই এই বেহাল দশা। অথচ শুধুমাত্র মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রামে কয়েকটা ফাইওভার বানিয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড চার লেন করেই সরকার পক্ষের রাজনীতিক, দালাল শিক্ষক আর সাংবাদিকদের মুখে উন্নয়নের বকবকানি শুনতে শুনেতে কান ঝালাপালা! তবু মানুষ কেন যে এদের ভোট দেয়!

মথুরাপুর দেউলের সামনে এসে অটো থেকে নেমে পড়লাম। দেউলের চারপাশে সবুজ ঘাসে ছাওয়া খোলা জায়গা, খোলা জায়গা ঘিরে দেয়াল তোলা, রাস্তার দিকে গেট। দেয়াললগ্ন কিছু ফুলের গাছ লাগানো, আর কয়েকটি পাকা বেঞ্চ বানানো হয়েছে দর্শনার্থীদের বসার জন্য। আগে অনেকবার এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করেছি, একবার নেমে দেউলের গায়ের কারুকাজ দেখেওছিলাম। তখন দেয়াল ছিল না, লোকজন খোলা জায়গায় গরু-ছাগল বাঁধতো, চুলকালে গরু-ছাগল গা ঘষতো দেউলের গায়ে। দেয়াল তুলে দেউল এবং জায়গাটুকু সংরক্ষণ করায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে ধন্যবাদ।

দেউল বলতে বোঝায় দেবালয় বা বৃহদাকার দেবমন্দির। দেবকুল শব্দ থেকে দেউল শব্দের উৎপত্তি। মথুরাপুর দেউলের উচ্চতা প্রায় সত্তর ফুট, রয়েছে ১২ টি কোণ অলঙ্কৃত দেয়াল, ফাঁকে ফাঁকে ইটের কার্নিশ বিশিষ্ট দেয়াল, নিচের দিকের বিভিন্ন থাকের ফাঁকে ফাঁকে পোড়া মাটির ফলক বসানো। এই ফলকগুলিতে খোদাই করা আছে-রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যান। মঠের ভিতরে একটি কক্ষ রয়েছে এবং দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে একটি মাত্র প্রবেশ পথ। প্রবেশপথটি তালাবদ্ধ।

মথুরাপুর দেউল নিয়ে ভিন্ন লোককথা বা জনশ্রুতি চালু থাকলেও আদতে ঐতিহাসিক সত্য হলো সপ্তদশ শতকে দেউলটি নির্মাণ করেছিলেন সংগ্রাম শাহ। অনেকে মনে করেন যে রাজা প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করে সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ এই বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৬০৩ সালে ধুমঘাটে মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধে প্রতাপাদিত্যের পরাজয় হলে প্রতাপাদিত্য মানসিংহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন এবং তিনি ১৬০৯ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তার পূর্বেই ১৬০৪ সালে মানসিংহ আগ্রায় ফিরে যান। আনন্দনাথ রায় রচিত ‘ফরিদপুরের ইতিহাস’ এবং আমার প্রয়াত শিক্ষক অধ্যাপক মতিয়ার রহমান রচিত ‘রাজবাড়ী জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী মথুরাপুরের দেউল নির্মাণ করেছিলেন সংগ্রাম শাহ। এই তথ্য আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।

সীমানা প্রাচীরের বাইরে লোকের বাড়ি-ঘর। রাস্তার সাথে একটি দোকানে একটি ছেলেকে দেখে ডাকলাম। ছেলেটির নাম-হৃদয়। ওকে দিয়ে কিছু ছবি তুলিয়ে নিলাম, কয়েকটি রাজহাঁস ঢুকে পড়লো ছবির ফ্রেমে। রোদ চড়ে গেছে বেশ, আমাকে আবার যেতে হবে মধ্যযুগে গোড়াপত্তন হওয়া প্রসিদ্ধ গ্রাম নলিয়ায়। হৃদয়কে ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। অল্পক্ষণ অপেক্ষার পর একটি অটো এলে তাতে চড়ে বসলাম।

স্থান বিশেষে রাস্তার খুব কাছ দিয়ে বয়ে চলেছে চন্দনা নদী। বয়ে আর চলেছে কোথায়? যেন স্থির কোনো পুকুর! চন্দনার চেহারা দেখে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমার শৈশব-কৈশোরেও বেশ চওড়া ছিল চন্দনা, এখন রূপান্তরিত হয়েছে একটি খালে। শৈশবে চন্দনা নদীলগ্ন গ্রাম যাদবপুরে আমার মামাবাড়ি বেড়াতে এসে কতোবার চন্দনায় স্নান করেছি, সাঁতার কেটেছি, হুটোপুটি করেছি; সেই চন্দনার আজ এই হাল!

অটো আশাপুরে ঢুকতেই দেখলাম রাস্তার অবস্থা যাই হোক লোকের ঘরবাড়ির অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। পাকাবাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। বড় একটি পাটকল হয়েছে। আরো নানান রকম কারখানা হয়তো। আমাদের বাড়ির পাশের এক দিদির শ্বশুরবাড়ি এই আশাপুরে। কতোবার এসেছি, অথচ এতোবছর বাদে আমি চেষ্টা করেও অনেকবাড়ির ভিড়ে দিদির বাড়িটাকে চিনতেই পারলাম না!

জামালপুর বাজারে এসে নামলাম। বাসস্ট্যান্ডের চেহারাও আর আগের মতো নেই। একটা হোটেলে ঢুকে নাস্তা করলাম। হাতধোয়ার সাবান পর্যন্ত নেই হোটেলে, এরা কোন শতাব্দীতে পড়ে আছে! কাপড় কাঁচার ডিটারডেন্ট চেয়ে নিয়ে হাত ধুলাম।

অতৃপ্তি নিয়ে খেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ভ্যান নিয়ে যাত্রা করলাম নলিয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে। কতো পরিবর্তন চোখে পড়লো। খাল বা পতিত জমি ভরাট করে পাকা দোকানপাট গড়ে উঠেছে। টিনের ঘরের জামালপুর কলেজটি চারতলা হয়েছে। যেতে যেতে বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায়কে ফোন দিলাম, যার সঙ্গে আমি দেখা করতে এসেছি, এসেছি উপন্যাসের রসদ নিতে। বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায় জানালেন, ‘আমি তো বাজারে, আপনি জোড়বাংলা মন্দিরের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করেন।’

আমি জোড়বাংলা মন্দিরের সামনে গিয়ে ভ্যান থেকে নামলাম। মন্দিরগুলো দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এভাবে অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে পুরাতন ঐতিহ্য! প্রকৃতির সাথে লড়াই করে চারটি মন্দির এখনো টিকে আছে। সবগুলোর দেয়াল আর চূড়া প্রচুর গাছপালা আর লতা-পাতায় আচ্ছাদিত। একটা মন্দির এতোটাই অরণ্য আচ্ছাদিত যে গভীরভাবে না তাকালে অন্ধকারে বোঝাই যায় না যে এখানে একটা মন্দির আছে! এটা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বাকি কিনটি ধ্বংস হতে চলেছে। মন্দিরগুলোর গায়ে টেরাকোটার ফলক ছিল। ফলকে খোদাই করা ছিল-বিভিন্ন চিত্র। কিছু কিছু চিত্র এখনো আছে, অধিকাংশ চিত্রই খুলে পড়েছে।

বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায় বাজার থেকে ফিরলেন সাইকেল চালিয়ে। ভদ্রলোকের সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো, তিনি বাড়িতে গেলেন সাইকেল রাখতে। চারটি মন্দিরের মাঝখানের পথ দিয়ে যেতে হয় তার বাড়িতে। তিনি ফিরে এলে বললাম, ‘স্কুলের পাশের দীঘির পাড়ে গিয়ে বসে আলাপ করি চলুন।’

তিনি সম্মত হলেন। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম নলিয়া শ্যামমোহন ইনস্টিটিউশনের দিকে। তিনি একটা পুকুর দেখিয়ে বললেন, ‘এটা সীতারামের সময়ের পুকুর। এই পুকুর পারে একটা দোল মন্দির ছিল, সেটা ধ্বংস হয়ে পুকুরে বিলীন হয়ে গেছে।’

আমার চোখে ভেসে উঠলো মুহম্মদপুরে দেখা দোলমন্দিরটি, এটাও হয়তো তেমনই ছিল। শ্যামামোহন ইনস্টিটিউশন পার হয়ে তিনি বসতে চাচ্ছিলেন স্কুলের পাশের নির্মীয়মাণ মন্দিরের সামনে। কিন্তু এখানে স্কুলের বাচ্চারা কোলাহল করছে, তাছাড়া পাশের রাস্তা দিয়ে ভ্যান-গাড়ি চলাচল করায় শব্দ হচ্ছে।

বললাম, ‘আপনার আপত্তি না থাকলে আমি আপনার কথা রেকর্ড করতে চাই।’
‘না, আমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘এখানে রেকর্ড করলে অন্য শব্দ ঢুকে যাবে, চলুন দীঘির ওই পাড়ের ঘাটে গিয়ে বসি।’
‘চলেন।’

স্কুলের সামনে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম দীঘির অপর পাড়ের ঘাটের উদ্দেশ্যে। এই স্কুলটি আমার কাছে বিশেষ কিছু, কেননা এই স্কুলেই আমার মা লেখাপড়া করেছেন। আমি স্কুলের দিকে বারবার তাকাতে লাগলাম। আমার কল্পনায় ভেসে উঠলো মায়ের শৈশব-কৈশোরের ছবি। যে পথে আমি হেঁটে চলেছি এই পথেই হয়তো মা তার বান্ধবীদের সঙ্গে ছুটোছুটি-হইচই করতেন, গোল্লাছুট খেলতেন। এখানকার এই দীঘির পাড়ের খেলার মাঠে আমারও স্মৃতি আছে। আমি তখন ক্লাস টেনে। বারুগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি। আমরা ক্রিকেট খেলতে এসেছিলাম শ্যামমোহন স্কুলের সঙ্গে। বিশ ওভারের খেলা। ওরা আগে ব্যাট করে ১৩৭ রান করেছিল। আমি অল-রাউন্ডার ছিলাম। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ তিনটি উইকেট পেয়েছিলাম। ব্যাট হাতে শূন্য রানে শর্ট লেগে ক্যাচ দিয়েছিলাম। ম্যাচটা আমরা হেরে গিয়েছিলাম ৩৭ রানে।

ঘাটের সিঁড়িতে বসতে যাব, একজন লোক বিদ্যুৎ বাবুকে বললেন, ‘দাদা, ওপাশে আমাগের টোঙ আছে, ও জায়গা যায়ে বসেন।’
আমরা চারিদিকে খোলা টোঙঘরে গিয়ে বসলাম। টোঙঘরের দক্ষিণে আরেকটি বড় পুকুর, যে লোকটি আমাদের বসতে বললো সে ওই পুকুরে মাছ চাষ করে। পুকুরের চারিদিক নীল রঙের কারেন্ট জাল দিয়ে ঘেরা। এমনকি জলের হাত কয়েক ওপরেও পাতলা জাল টাঙানো পুকুরের এপার থেকে ওপার পর্যন্ত, যাতে মাছরাঙা বা বক পুকুরের মাছ খেতে না পারে। এই টোঙঘরে বসেই দিনে-রাতে মাছ পাহাড়া দেয় লোকটা।

আমি মোবাইলের রেকর্ডার চালু করলাম। বিদ্যুৎবাবু গল্প শুরু করলেন-কিভাবে এই নলিয়া গ্রামের গোড়াপত্তন হয়েছিল, কিভাবে আশপাশের আরো কয়েকটি গ্রামের গোরাপত্তন হয়েছিল, কেন সীতারাম জোড়বাংলা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন ইত্যাদি। শুনকে শুনতে আমি কল্পনায় ভেসে গেলাম সোয়া তিনশো বছর আগে, মনের আয়নায় দেখলাম সে-কালের সেইসব মানুষকে, কতো ধরনের-কতো পেশার মানুষ!

অনেকটা বেলা গড়িয়ে গেল, বিদ্যুৎবাবু যা জানতেন সব আমাকে উগড়ে দিলেন। এবার ঢাকায় ফিরে এই আখ্যান সাজানো, উপন্যাসের ঘর-বাড়ি নির্মাণ, জমি নির্মাণ, চরিত্র নির্মাণ ইত্যাদি আমার কাজ। উপন্যাস কোথা থেকে শুরু করবো এই ভাবনার যাতনা অথবা বলা যায় উপন্যাস সৃষ্টির প্রসব বেদনা এই টোঙঘরের চাঙায় বসেই শুরু হয়ে গেল, লিখে শেষ না করা পর্যন্ত থাকবে এই প্রসববেদনা।

টোঙঘর থেকে দীঘি আর মাছ চাষের পুকুরের চালা দিয়ে আমরা চলে এলাম রাস্তায়। বিদ্যুৎবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি উঠে পড়লাম ইজিবাইকে। বাসস্ট্যান্ডে নেমে বালিয়াকান্দীগামী অটোতে উঠে পড়লাম। অটো ছুটতে লাগলো। এই জনপদ আমার অনেকদিনের চেনা, তবু অনেক বছর না আসায় কেমন অচেনা হয়ে গেছে। বাড়ি-ঘরের পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক। রাস্তার পাশের যে-সব জায়গায় আগে জমি কিংবা জঙ্গল মতো ছিল, সে-সব জায়গায় এখন ঘরবাড়ি উঠে গেছে। প্রায় দশ বছর এদিকে আসি না, এই দশ বছরে অনেক মানুষ বেড়েছে, অনেক পুরনো পরিবার ভেঙে নতুন পরিবার হয়েছে, তাদের জন্য প্রয়োজন হয়েছে নতুন আবাসস্থল। সঙ্গত কারণেই এই পরিবর্তন, এই পরিবর্তন তো কালের বিবর্তন।

কালীবাড়ি মোড়ে এসে অটো থামলো কয়েকজন যাত্রী নামানোর জন্য। কালীবাড়ি থেকে উত্তরদিকে সোজা রাস্তাটা চলে গেছে আড়কান্দী বাজারের পাশ দিয়ে আমাদের গ্রামে। মাত্র তিন কিলোমিটার, অথচ মনে হয় ওটা এখন অনেক দূরের, কোনো ভিনগ্রহের গ্রাম! প্রায় নয় বছর গ্রামটি দেখি না, গ্রামলগ্ন উত্তরের মাঠ দেখি না, জোয়ারের বিল দেখি না, বর্ষাকালে জোয়ারের বিলে নৌকায় ঘুরি না, হড়াই নদী দেখি না!

রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কোনো চেনা মানুষ নজরে পড়লো না। অটো আবার চলতে শুরু করলো। মিনিটখানেক এসেই শ্মশানের রাস্তাটায় নেমে পড়লাম। এসেছি যখন শ্মশানটা দেখেই যাই।

শ্মশানের রাস্তাটা সুনসান-ছায়াময়, দু-পাশে ঘন গাছপালা। শ্মশানের ভেতরে ঢুকতেই দেখি সেই আগের শ্মশান আর নেই, অনেক বদলে গেছে। পূর্বদিকটা প্রায় আগের মতোই থাকলেও পশ্চিমদিকটার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। পাকা ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে, ঘাটের সিঁড়ি নেমে গেছে মৃতপ্রায় চন্দনা নদীতে। ঘাটের দু-পাশে বসবার পাকা বেঞ্চ। ঘাটের পাশেই এক দম্পতিকে সমাধি দিয়ে ছোট্ট ঘরের মতো মঠ তোলা হয়েছে। মঠের সামনে দিয়ে সরু একফলি পাকা রাস্তা চলে গেছে পশ্চিমদিকের চিতার দিকে। পাকা রাস্তার দক্ষিণে ফুলের বাগান, তার পরেই চন্দনা নদী। রাস্তার ডানপাশে ঘাসে ছাওয়া সবুজ মাঠ। মাঠের উত্তরে একটি ঘর, ঘরটির পাশে আরেকটি নির্মীয়মাণ মন্দির। এই সবুজ মাঠের পশ্চিমদিকেই দৃষ্টিনন্দন চিতা। কাছে না গেলে বোঝার উপায় নেই যে ওটা চিতা, চিতার খুঁটি বাইরে থেকে দেখা যায় না। সরু ওই রাস্তটি ডানে ঘুরে শেষ হয়েছে চিতার গেটে। চিতার চারপাশে গেরুয়া রঙের দেয়ালঘেরা ঘরের মতো নির্মাণ করা হয়েছে, উপরে ছাদ, ছাদের মাঝখানে ধোঁয়া বেরোনোর জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে, সেই ফাঁকার উপরে আবার পাকা ছাউনি, যাতে বৃষ্টিতে চিতা ভিজে না যায়। চিতা থেকে সরু নালা চলে গেছে চন্দনা নদীর দিকে। বুকের ভেতর দিয়ে কেমন লু হাওয়া বয়ে গেল, এরই নাম বুঝি নীরব হাহাকার! মাস দেড়েক আগে সড়ক দূর্ঘটনায় অকাল প্রয়াত আমার একমাত্র পিসতুতো দাদার শরীর এই চিতায়ই নিঃশ্বেষ হয়েছে। আমার পিসিকেও এখানেই দাহ করা হয়েছিল। এই শ্মশানেই ২০০০ সালের শীতের এক গভীর অন্ধকার রাত্রে আমার ঠাকুমাকে সমাধি দিয়েছি। ১৯৫৬-৫৭ সালের দিকে আমার ঠাকুরদাকে এখানেই দাহ করা হয়েছে। তাছাড়া পাড়ার-গ্রামের অনেক চেনা মানুষের দেহ নিঃশ্বেষ হয়েছে এই শ্মশানে। একে একে সেইসব মানুষের মুখ ভেসে উঠলো আমার মনের আয়নায়। তাদের হাঁটা-চলা, কথা বলা, হাসি-কান্না; পুরুষদের মাঠে লাঙল দেওয়া, তাস খেলা, খোল-হারমনিয়াম বাজানো, গান করা, রেগে যাওয়া কিংবা মারামারি করা; নারীদের রান্না করা, কাঁথা সেলাই করা, ঝগড়া করা ইত্যাদি দৃশ্য আমার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলো!

চিতার কাছ থেকে এসে বসলাম নিম, তমাল আর হরিতকী গাছঘেরা গোলাকার বাঁধানো বেদির ওপর। মৃত মানুষগুলো জীবন্ত হয়ে আমার মনের আঙিনায় হেসে-খেলে বেড়াতে লাগলো। এদের অনেকেই আমার চেতনে-অবচেতনে উঠে এসেছে গল্প-উপন্যাসে। নিশ্চয় আরো অনেকের কথাই লিখবো। পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া এই মানুষগুলো বেঁচে থাকবে আমার গল্প-উপন্যাসে।

শ্মশানের পূর্বদিকটা আগের মতোই আছে। কালী মন্দিরে এক যুবক পূজার আয়োজন করছে। তাকে আগের পুরোহিত নরেন পালের কথা জিজ্ঞেস করতেই নরেন পালের সমাধিটা দেখিয়ে দিলো। যুবক পুরোহিতও নরেন পালের মতো অব্রা‏হ্মণ, সে রোজই পূজা করে, আর বছরে একবার পূজা করে ব্রা‏হ্মণ পুরোহিত। পূর্বদিকেও খোলা আকাশের নিচে চার খুঁটির একটি চিতা। পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলাম দুইটা চিতা কেন?

জানালো, ‘এখানে দুইটা শ্মশান। পূর্বপাশ বেতাঙ্গা গ্রামের আর পশ্চিম পাশ বাকি এগারো গ্রামের।’

মনে পড়লো, আমার কৈশোরেও এই চিতাটি ছিল, এর কিছুটা পশ্চিমদিকে আরেকটি চিতা ছিল যেটায় আমাদের গ্রামের শবদেহ পোড়ানো হতো। তবে এই ভাগাভাগির ব্যাপাটা আমি জানতাম না। ভাবতাম দুটো চিতা যাদের যেটায় খুশি শবদেহ পোড়ায়। আমি এতোকাল এখানে একটি শ্মশানের কথাই জেনে এসেছি, মাটি তো আর বুক চিড়ে তাকে ভাগ করার চি‎হ্ন দেখায় না! শ্মশানেও বিভেদ, বারোটি গ্রাম একসাথে থাকলে কী ক্ষতি হতো! জীবন শেষে শ্মশানে সকলেই তো ছাই হয়, কেউ তোর আর সোনা হয় না!

আমি শ্মশানময় পায়চারি করতে লাগলাম। একটা প্রজাপতি উড়ে এসে বসলো আমার হাতে। আমি যেখানে যাই প্রজাপতি উড়ে গিয়ে সেখানে গিয়েই আমার গায়ে বসে। হাতে বসে, কাঁধে বাসে, হ্যাটে বসে, এমনকি আমার ডান গালেও বসে থাকলো কিছুক্ষণ! হাতে প্রজাপতি নিয়ে ঘুরলাম কিছুক্ষণ। পূর্বপাশেও আরেকটি বাঁধানো ঘাট, ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে জলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, প্রজাপতি আমার সঙ্গে সঙ্গে গেল।

অনেকক্ষণ আপনমনে ঘুরে বেড়িয়ে প্রজাপতিকে বিদায় দিয়ে বেড়িয়ে এলাম শ্মশান থেকে। বারবার ফিরে তাকালাম, আর কি দেখা হবে কোনোদিন? আসা হবে এ পথে? এই প্রশ্ন নিয়েই উঠে এলাম পাকা রাস্তায়। উত্তরদিকের রাস্তাটির দিকে তাকালাম, এই রাস্তাটি একে-বেঁকে আড়কান্দী বাজারের সাথে মিশে চলে গেছে আমাদের গ্রামে। যে গ্রামের সঙ্গে নয় বৎসর আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ওই গ্রামের মাটিতেই ঘুমিয়ে আছে আমার মা। মৃত্যুর পরও মাকে কাছে রাখতে চেয়েছিলাম বলে শ্মশানে এনে মাকে দাহ করিনি, বাড়িতেই সমাধি দিয়েছি। অথচ নয় বছর মায়ের সমাধি দেখি না!

অটোর অপেক্ষায় রাস্তার পাশের একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে রইলাম স্মৃতিকাতর হয়ে। অটো এলে তাতে উঠে পড়লাম। ফিরে এলাম আমার অনেকদিনের চেনা জনপদ ছেড়ে বর্ষার প্রাণবন্ত ঘন সবুজ ঘাসের মতো স্মৃতির তেপান্তর জাগিয়ে নিয়ে।

ঢাকা।
জুলাই, ২০১৮

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:৪৬

শাহারিয়ার ইমন বলেছেন: সময় নিয়ে পড়তে হবে

৩১ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১২:১৮

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ৩১ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ১:৩৬

রাজীব নুর বলেছেন: অনেক বড় পোষ্ট। তবুও অনেক ভালো। খুব সুন্দর।

৩১ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৯:৪৯

মিশু মিলন বলেছেন: হ্যাঁ লিখতে লিখতে বেশ বড়ই হয়ে গেল। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.